অকুতোভয় পিতা, নিবেদিতপ্রাণ পুত্র -সময়ের প্রতিবিম্ব by এবিএম মূসা
আশির দশকে ঢাকার রাস্তার দেয়ালে চিকা দেখা যেত ‘জাতি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চায়।’ সেটি দেখে আমি আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কার কাছে চায়? বলতে হবে জাতি বিচার করবে।’ নানা বাধা-বিপত্তি, ওজর-অজুহাত, ষড়যন্ত্র আর অশুভ চক্রান্তের অবসান ঘটিয়ে জাতি বিচার করেছে। জনগণের পরম প্রত্যাশা বা দাবি পূরণে এত দীর্ঘসূত্রতার কারণ তারা প্রকৃত অর্থে ৩৪ বছরের অধিকাংশ সময়ে ক্ষমতায় ছিল না বলে। জনগণ প্রথম দফায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল বিচারের সূচনা করতে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এনেছে অনেক ক্ষুদ্র-বৃহত্ প্রত্যাশা পূরণের এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বিচারকাজ সম্পন্ন করার জন্য। তার পরও এই বিচার শুরু ও শেষ করায় ছিল নানা সমস্যা। আইনি দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য অকুতোভয় ও একনিষ্ঠ আইনজীবী কোথায় পাওয়া যাবে, সেই প্রশ্নটিও গুরুত্ব পায়। সব সমস্যারও সমাধান করেছেন, প্রত্যাশা পূরণ করেছেন বংশানুক্রমে দুজন আইনজীবী, আজ তাঁদের কথাই বলব।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার খবরটি শুনেই সিরাজ ভাবিকে টেলিফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার মনের অনুভূতি কী? বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সর্বশেষ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন শ্রদ্ধেয় আইনজীবী সিরাজুল হক সাহেব, আপনার স্বামী। শেষ করলেন আপনার পুত্র স্নেহভাজন আনিসুল হক। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বলেছেন, জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে, দায়মুক্ত হয়েছে। স্বামীর অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পাদিত হওয়ায় একজন পরিতৃপ্ত স্ত্রী ও গর্বিত মাতা, আপনার অনুভূতি কী?’ সবাই যা বলেছেন তার বাইরে গিয়ে তিনি অনেক কথা বলেছেন, তার সব এখন বলছি না। সবাই যা বলেছেন সে সম্পর্কে প্রথমেই বলব, দুটি ব্যতিক্রম রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেছেন, ‘এ রায় ঐতিহাসিক। জাতি এর জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ছিল।’ তিনি নিজেকেও কি অপেক্ষাকারীদের একজন মনে করেন? জেনারেল জিয়া খুনিদের বিদেশে চাকরি দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি সেই সব চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছেন। কয়েকজনকে পদোন্নতিও দিয়েছিলেন। তা হলে তাঁর অপেক্ষাটির কোনো ব্যাখ্যা তো খুঁজে পাচ্ছি না, বিএনপির দলীয় প্রতিক্রিয়া নেই, কারণ তাদের মনে সংগত কারণে একটি অপরাধবোধ রয়েছে, যা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বিচার নিয়ে এত কথা, এত লেখালেখি হয়েছে কিন্তু আরও একটি বিস্মৃত ঘটনা কেউ বলেননি। এরশাদের আমলে বিলেতের প্রবাসী বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত ও বিচারের সম্ভাবনা যাচাই করার জন্য একজন ব্রিটিশ আইনজ্ঞ পাঠাতে চেয়েছিলেন, সেই আইনজীবীকে ভিসা দেওয়া হয়নি কেন?
ভাবি তথা বেগম জাহানারা হকের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। বিচার পরিচালনায় তিনি পিতা-পুত্র উভয়েরই ছিলেন প্রেরণাদায়িনী। রায় জানার পর টেলিফোনে তাঁর স্মৃতিচারণা করলাম, মনে করলাম অতীতের অনেক কাহিনী। মনে হলো তাঁকে নস্টালজিয়ায় পেয়েছে, পুরোনো দিনের স্মৃতি তাঁকে আবেগাপ্লুত করেছে। প্রথমেই সিরাজুল হকের জীবনকাহিনী, এই মামলার পেছনে তিনি কীভাবে আত্মমগ্ন হয়েছিলেন, কেন এবং কীসের দায়ে? ভাবি আলোচনায় সুদূর অতীতে চলে গেলেন। সেই অতীত সব না হলেও অনেকখানি আমার জানা ছিল। ঢাকায় মোহাম্মদপুরে আমরা দুই পরিবার এক পাড়ায়, বর্তমান ইকবাল রোডের পাশাপাশি দুই রাস্তায় দীর্ঘ ২০ বছর একসঙ্গে ছিলাম। বস্তুত একটি বিরান ভূমিতে ৪৫ বছর আগে আমরা দুজনই সরকার প্রদত্ত জমিটিতে বাড়ি করেছি। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও অন্তরঙ্গতার সূচনা তখন থেকে। তদুপরি অন্য একটি যোগসূত্রও ছিল। আমার পরম স্নেহভাজন সাংবাদিক আতাউস সামাদ ভাবির ছোট ভাই, সেই সূত্রে তাঁকে আপাও বলতাম। সামাদ সিরাজ ভাইয়ের ছোট ভগ্নিপতিও বটে।
আশপাশে বসতি ছিল না। তাই অবসরে সিরাজ ভাইয়ের বাড়িতে আড্ডা জমাতাম, সেখানে ভাবিও থাকতেন। জেনেছি, সিরাজ ভাইয়ের ছোটবেলা কেটেছে তাঁর পুলিশ কর্মকর্তা পিতার কর্মস্থল খুলনায়। ফরিদপুর জেলা হলেও গোপালগঞ্জ তখন খুলনার আওতাভুক্ত। মধ্যখানে একটি নদী কী যেন নাম, কুমারখালী কি? এপারে শেখ মুজিব ওপারে সিরাজুল হক। বোধহয় একই স্কুলে পড়তেন দুজনই। নদী সাঁতরে বা নৌকায় দুজনই এপার-ওপার করে পরস্পরের গভীর সান্নিধ্যে এলেন। ইনট্রোভার্ট, অন্তর্মুখী সিরাজুল হক আর আড্ডাবাজ মুজিবের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। অতঃপর বন্ধুত্বে দীর্ঘ ছেদ, কলকাতায় আবার দেখা হলো দুজনার। একজন ইসলামিয়ায়, অন্যজন প্রেসিডেন্সিতে; থাকতেন একসঙ্গে বেকার হোস্টেলে। সিরাজুল হক পড়াশোনায় মগ্ন হয়ে রইলেন, শেখ মুজিব অবিভক্ত বাংলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। দেশ ভাগ হলো। এক বন্ধু যখন রাজনীতির চূড়ায় অন্য বন্ধু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চপদস্থ কাস্টমস অফিসার। তবে স্বাধীনচেতা সিরাজুল সরকারি চাকরিতে মানিয়ে নিতে পারলেন না। এলেন আইন পাস করে ওকালতি পেশায়। ঢাকায় আবার দেখা হলো দুজনার। বন্ধুত্ব গাঢ়তর হলো, একই সঙ্গে গড়ে উঠল একটি রাজনৈতিক বন্ধন। সেই বন্ধুত্বের মায়ায় আগরতলা মামলায় আসামি পক্ষে বাঘা আইনজীবী আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান, তরুণ ব্যারিস্টার কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিনুল হকের (জেলখানায় শহীদ সার্জেন্ট জহিরুল হকের ভাই, এখন প্রয়াত) সঙ্গে যোগ দিলেন অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। মামলার শুনানির সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িয়ে থাকার কারণেই বোধহয় পরবর্তী সময়ে আইনজীবী বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়লেন। সত্তরে আর তিয়াত্তরে আওয়ামী লীগের সাংসদ হলেন।
অতীত বর্ণনায় দুই পরিবারের আত্মার সম্পর্কের আরেকটি হূদয়গ্রাহী কাহিনী বলতে হয়। প্রথম আলোতে ‘প্রেরণাদায়িনী ফজিলাতুন্নেসা’ প্রতিবেদনটিতে এই প্রসঙ্গটি পুরোপুরি উল্লেখ করিনি। তবে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘শেখ মুজিব যখন জেলে অথবা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়াচ্ছেন তখন কীভাবে সংসারের হাল ধরে ছিলেন অসহায় এক মহীয়সী নারী?’ আগরতলা মামলার সামান্যতম খরচ জোগাতেন কী করে, তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যার দুই বেলার আহার জুটাত কীভাবে। একই দুশ্চিন্তা ছিল বেগম সিরাজুল হকেরও। নিজের গয়না বেচে মুজিব-সংসারে অতিপরিচিত কয়েকজনের মাধ্যমে অতিসঙ্গোপনে সংসার খরচের টাকা পাঠিয়েছেন। সেই অজানা গোপন কাহিনী আজ বঙ্গবন্ধুর বন্ধুভাগ্য নিয়ে আলোচনায় ভাবির বিনানুমতিতেই ফাঁস করে দিলাম।
আগরতলা মামলা ভেস্তে গেল, জনতা ‘জেলের তালা ভাঙল, শেখ মুজিবকে আনল’। পরের ইতিহাস আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠক, ছয় দফা ঘোষণা, আইয়ুব খানের পতন, ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ। লাহোরে ছয় দফা ঘোষণা করে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকা ফেরত এসে শেখ মুজিব প্রথমেই মোহাম্মদপুরে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সেই দেখা করার সঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত মধুর স্মৃতি জড়িত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সিরাজ ভাইয়ের বাড়িতে কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর বললেন, ‘পাশেই কোথায় যেন মূসা থাকে। তার বাড়িতে যেতে হবে। তার ছেলেকে দেখব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।’ প্রতিশ্রুতির পশ্চাত্পটটি বলতে হয়। আগরতলা মামলা চলাকালে আমার ছেলের জন্ম হয়। পাকিস্তান অবজারভার-এর জন্য মামলার রিপোর্ট সংগ্রহে আদালতে অন্যদের মধ্যে রিপোর্টার আবদুর রহিমকেও পাঠাতাম। রহিমকে বললাম, ‘নেতাকে বলো, আমার একটি ছেলে হয়েছে, তিনি যেন দোয়া করেন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মূসার ছেলেকে দেখতে যাব।’ বার্তাটি পেয়ে অবাক হয়ে বললাম, ‘কদিন পরে যিনি নিশ্চিত ফাঁসির দড়িতে ঝুলবেন তিনি বলছেন শিগগিরই আমার বাড়িতে আসবেন!’ সেই উপাখ্যান ভুলেই গিয়েছিলাম।
সিরাজ ভাবি টেলিফোনে আমার স্ত্রীকে জানালেন ‘মুজিব ভাই আপনার বাড়িতে যাচ্ছেন।’ তিনি আমার কর্মস্থল পাকিস্তান অবজারভার-এ ফোন করলেন, ‘জলদি আসো, শেখ সাহেব আসছেন।’ অতিদ্রুত বাড়ি এসে পৌঁছালাম। ইতিমধ্যে কিশোর শ্যানন ওরফে আনিসুল হক মুজিব ভাইকে নিয়ে আমার বাড়িতে এলেন। আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে একটি সোনার চেইন পরিয়ে বললেন, ‘তোমার ভাবি দিয়েছে।’ একটি বাবাস্যুট আর এক বাক্স মিষ্টি দিলেন আমার স্ত্রীর হাতে। আমাকে দেখেই কৌতুক করে বললেন, ‘কিরে, এলাম তো! যখন আসব বলেছিলাম তখন তো নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিলি।’ অবশ্যই অবাক হয়েছিলাম। তাঁর অসামান্য স্মরণশক্তি ছিল কিংবদন্তি, তুচ্ছ বিষয়টি মনে রেখে দিয়েছেন। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, চৌষট্টিতে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে ঢাকার তত্কালীন জেলা প্রশাসকসহ (এম কে আনোয়ার, বর্তমানে বিএনপির নেতা) রায়েরবাজার-মোহাম্মদপুরে এসেছিলেন তখনো একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন। সূচনা করেছিলাম সিরাজ ভাবিকে দিয়ে। মধ্যিখানে একটি নিজস্ব কাহিনী বর্ণনা হয়তো অবান্তর মনে হতে পারে। তবুও বললাম, গত শুক্রবার প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘অন্তরঙ্গ আলোকে বঙ্গবন্ধু’ উপাখ্যানে বলা হয়নি।
সিরাজ-মুজিব প্রাণের বন্ধন শেখ হাসিনার অজানা ছিল না। তাই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় তিনিই একমাত্র অকুতোভয় হতে পারবেন। হত্যাকারীদের সঙ্গে একই সূত্রে বাঁধা ব্যক্তিরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইনডেমনিটির বাধা সরিয়ে নতুন সরকার মামলা শুরু করলেন। মামলা পরিচালনায় বাঘা বাঘা আইনজীবীর কাউকে নয়, দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁকে কেন বেছে নিলেন শেখ হাসিনা? শেখ হাসিনা জানতেন, মামলার পরিচালনায় পার হতে হবে অনেক বাধা-বিপত্তি আর আইনি চড়াই-উতরাই। আসবে ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি। এসব ভয়ঙ্কর ও অশুভ শক্তির মোকাবিলা একটিমাত্র নির্ভীক দৃঢ়চেতা ব্যক্তিই করতে পারবেন। তিনি সিরাজুল হক, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক দিন পর বঙ্গভবনে ফারুক-রশিদ-বেষ্টিত মোশতাককে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন মুজিবকে খুন করেছ?’ তাঁর মুখে শুনেছি, পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাচ্যুত মোশতাকের আগামসিহ লেনের বাড়িতে গিয়েও বলেছিলেন, ‘তুমি খুনি!’
আবারও মামলা প্রসঙ্গে আসি। ইনডেমনিটি তথা দায়মুক্তি আইন বাতিল হলো। মামলা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিরাজ ভাই তখন বনানীর নতুন বাসস্থানে। আইনজীবী সিরাজুল হকের কাছে আমি অত্যন্ত গুরুতর একটি প্রশ্ন করেছিলাম। জানতে চেয়েছি, ফৌজদারি কার্যক্রম অনুসরণে সাধারণ হত্যা মামলার বিচার হবে অথবা বিশেষ আদালত ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে? তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘হাসিনাকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের পরামর্শ দিয়েছি, কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর মন্ত্রিসভার সঙ্গে পরামর্শ করে আমাকে বিদ্যমান ফৌজদারি আইনে বিচারপ্রক্রিয়া অনুসরণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।’ শেখ হাসিনার যুক্তি ছিল, ‘জাতি প্রতিশোধ চায় না, বিচার চায়। সেই বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও প্রশ্নাতীত হতে হবে।’
সিরাজ ভাই শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার হলে স্বচ্ছতা ও দ্রুত আইনি প্রক্রিয়ায় সুবিচার নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে। বলা হতো, বিচার যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় হয়নি, ধরে-বেঁধে শাস্তি দেওয়া হলো। বিচার শেষ হতে ৩০০ কর্মদিন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু বিচার যে স্বচ্ছ ও সঠিক হয়েছে, তা আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও স্বীকার করেছেন। তাই তো চূড়ান্ত বিচারকালে তাঁরা কখনো মক্কেলদের নির্দোষ বলেননি। শুধু দণ্ড লাঘব করার আবেদন জানিয়েছেন।
মামলা চলাকালীন বনানীর বাড়িতে এসব আলোচনার সময়ে সদ্য সনদপ্রাপ্ত আনিসুল হকও উপস্থিত থাকতেন। প্রথম থেকেই পুরো বিচারপ্রক্রিয়ায় পিতার সঙ্গে পুত্র জড়িত ছিলেন। আইনের পুস্তক ঘেঁটে সঠিক সূত্রগুলো খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন। পরে ভেবেছি, তখন কি জানতেন, একদিন পিতার বোঝা, অসমাপ্ত দায়িত্ব পালনের কর্তব্যটি তাঁর কাঁধেই চাপবে। তাই তো বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ায় ছেদ ঘটিয়ে পিতার মহতী উদ্যোগে সম্পৃক্ত হতে দেশে ফিরে আইনি ডিগ্রি নিয়ে পিতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বুঝে নিয়েছিলেন পিতার মামলা পরিচালনার কর্মপদ্ধতি। পিতার মনেও কি জানা হয়ে গিয়েছিল, একটি দীর্ঘ বৈচারিক পদ্ধতির শুরু করেছেন, হয়তো শেষটি দেখে যেতে পারবেন না! আমার মনে হয়, তিনি আমাদের বৈচারিক পদ্ধতির দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই সন্তানকে উপযুক্ত উত্তরাধিকারী তৈরি করেছিলেন। পিতার অসমাপ্ত মহান উদ্যোগটি সফল করার দায়িত্ব নিষ্ঠাবান সন্তানের হাতে অর্পণ করে গিয়েছিলেন। সেই দায়িত্ব পালনে সাফল্যই অনন্য একটি ঐতিহাসিক মামলায় যুদ্ধ বিজয়ের গৌরববোধের চেয়েও অধিকতর তৃপ্তি দিয়েছে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার খবরটি শুনেই সিরাজ ভাবিকে টেলিফোন করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার মনের অনুভূতি কী? বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সর্বশেষ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন শ্রদ্ধেয় আইনজীবী সিরাজুল হক সাহেব, আপনার স্বামী। শেষ করলেন আপনার পুত্র স্নেহভাজন আনিসুল হক। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বলেছেন, জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে, দায়মুক্ত হয়েছে। স্বামীর অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পাদিত হওয়ায় একজন পরিতৃপ্ত স্ত্রী ও গর্বিত মাতা, আপনার অনুভূতি কী?’ সবাই যা বলেছেন তার বাইরে গিয়ে তিনি অনেক কথা বলেছেন, তার সব এখন বলছি না। সবাই যা বলেছেন সে সম্পর্কে প্রথমেই বলব, দুটি ব্যতিক্রম রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেছেন, ‘এ রায় ঐতিহাসিক। জাতি এর জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ছিল।’ তিনি নিজেকেও কি অপেক্ষাকারীদের একজন মনে করেন? জেনারেল জিয়া খুনিদের বিদেশে চাকরি দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি সেই সব চাকরির মেয়াদ বাড়িয়েছেন। কয়েকজনকে পদোন্নতিও দিয়েছিলেন। তা হলে তাঁর অপেক্ষাটির কোনো ব্যাখ্যা তো খুঁজে পাচ্ছি না, বিএনপির দলীয় প্রতিক্রিয়া নেই, কারণ তাদের মনে সংগত কারণে একটি অপরাধবোধ রয়েছে, যা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বিচার নিয়ে এত কথা, এত লেখালেখি হয়েছে কিন্তু আরও একটি বিস্মৃত ঘটনা কেউ বলেননি। এরশাদের আমলে বিলেতের প্রবাসী বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত ও বিচারের সম্ভাবনা যাচাই করার জন্য একজন ব্রিটিশ আইনজ্ঞ পাঠাতে চেয়েছিলেন, সেই আইনজীবীকে ভিসা দেওয়া হয়নি কেন?
ভাবি তথা বেগম জাহানারা হকের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। বিচার পরিচালনায় তিনি পিতা-পুত্র উভয়েরই ছিলেন প্রেরণাদায়িনী। রায় জানার পর টেলিফোনে তাঁর স্মৃতিচারণা করলাম, মনে করলাম অতীতের অনেক কাহিনী। মনে হলো তাঁকে নস্টালজিয়ায় পেয়েছে, পুরোনো দিনের স্মৃতি তাঁকে আবেগাপ্লুত করেছে। প্রথমেই সিরাজুল হকের জীবনকাহিনী, এই মামলার পেছনে তিনি কীভাবে আত্মমগ্ন হয়েছিলেন, কেন এবং কীসের দায়ে? ভাবি আলোচনায় সুদূর অতীতে চলে গেলেন। সেই অতীত সব না হলেও অনেকখানি আমার জানা ছিল। ঢাকায় মোহাম্মদপুরে আমরা দুই পরিবার এক পাড়ায়, বর্তমান ইকবাল রোডের পাশাপাশি দুই রাস্তায় দীর্ঘ ২০ বছর একসঙ্গে ছিলাম। বস্তুত একটি বিরান ভূমিতে ৪৫ বছর আগে আমরা দুজনই সরকার প্রদত্ত জমিটিতে বাড়ি করেছি। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও অন্তরঙ্গতার সূচনা তখন থেকে। তদুপরি অন্য একটি যোগসূত্রও ছিল। আমার পরম স্নেহভাজন সাংবাদিক আতাউস সামাদ ভাবির ছোট ভাই, সেই সূত্রে তাঁকে আপাও বলতাম। সামাদ সিরাজ ভাইয়ের ছোট ভগ্নিপতিও বটে।
আশপাশে বসতি ছিল না। তাই অবসরে সিরাজ ভাইয়ের বাড়িতে আড্ডা জমাতাম, সেখানে ভাবিও থাকতেন। জেনেছি, সিরাজ ভাইয়ের ছোটবেলা কেটেছে তাঁর পুলিশ কর্মকর্তা পিতার কর্মস্থল খুলনায়। ফরিদপুর জেলা হলেও গোপালগঞ্জ তখন খুলনার আওতাভুক্ত। মধ্যখানে একটি নদী কী যেন নাম, কুমারখালী কি? এপারে শেখ মুজিব ওপারে সিরাজুল হক। বোধহয় একই স্কুলে পড়তেন দুজনই। নদী সাঁতরে বা নৌকায় দুজনই এপার-ওপার করে পরস্পরের গভীর সান্নিধ্যে এলেন। ইনট্রোভার্ট, অন্তর্মুখী সিরাজুল হক আর আড্ডাবাজ মুজিবের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। অতঃপর বন্ধুত্বে দীর্ঘ ছেদ, কলকাতায় আবার দেখা হলো দুজনার। একজন ইসলামিয়ায়, অন্যজন প্রেসিডেন্সিতে; থাকতেন একসঙ্গে বেকার হোস্টেলে। সিরাজুল হক পড়াশোনায় মগ্ন হয়ে রইলেন, শেখ মুজিব অবিভক্ত বাংলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। দেশ ভাগ হলো। এক বন্ধু যখন রাজনীতির চূড়ায় অন্য বন্ধু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চপদস্থ কাস্টমস অফিসার। তবে স্বাধীনচেতা সিরাজুল সরকারি চাকরিতে মানিয়ে নিতে পারলেন না। এলেন আইন পাস করে ওকালতি পেশায়। ঢাকায় আবার দেখা হলো দুজনার। বন্ধুত্ব গাঢ়তর হলো, একই সঙ্গে গড়ে উঠল একটি রাজনৈতিক বন্ধন। সেই বন্ধুত্বের মায়ায় আগরতলা মামলায় আসামি পক্ষে বাঘা আইনজীবী আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান, তরুণ ব্যারিস্টার কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিনুল হকের (জেলখানায় শহীদ সার্জেন্ট জহিরুল হকের ভাই, এখন প্রয়াত) সঙ্গে যোগ দিলেন অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। মামলার শুনানির সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িয়ে থাকার কারণেই বোধহয় পরবর্তী সময়ে আইনজীবী বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়লেন। সত্তরে আর তিয়াত্তরে আওয়ামী লীগের সাংসদ হলেন।
অতীত বর্ণনায় দুই পরিবারের আত্মার সম্পর্কের আরেকটি হূদয়গ্রাহী কাহিনী বলতে হয়। প্রথম আলোতে ‘প্রেরণাদায়িনী ফজিলাতুন্নেসা’ প্রতিবেদনটিতে এই প্রসঙ্গটি পুরোপুরি উল্লেখ করিনি। তবে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘শেখ মুজিব যখন জেলে অথবা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়াচ্ছেন তখন কীভাবে সংসারের হাল ধরে ছিলেন অসহায় এক মহীয়সী নারী?’ আগরতলা মামলার সামান্যতম খরচ জোগাতেন কী করে, তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যার দুই বেলার আহার জুটাত কীভাবে। একই দুশ্চিন্তা ছিল বেগম সিরাজুল হকেরও। নিজের গয়না বেচে মুজিব-সংসারে অতিপরিচিত কয়েকজনের মাধ্যমে অতিসঙ্গোপনে সংসার খরচের টাকা পাঠিয়েছেন। সেই অজানা গোপন কাহিনী আজ বঙ্গবন্ধুর বন্ধুভাগ্য নিয়ে আলোচনায় ভাবির বিনানুমতিতেই ফাঁস করে দিলাম।
আগরতলা মামলা ভেস্তে গেল, জনতা ‘জেলের তালা ভাঙল, শেখ মুজিবকে আনল’। পরের ইতিহাস আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠক, ছয় দফা ঘোষণা, আইয়ুব খানের পতন, ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ। লাহোরে ছয় দফা ঘোষণা করে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকা ফেরত এসে শেখ মুজিব প্রথমেই মোহাম্মদপুরে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সেই দেখা করার সঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত মধুর স্মৃতি জড়িত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সিরাজ ভাইয়ের বাড়িতে কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর বললেন, ‘পাশেই কোথায় যেন মূসা থাকে। তার বাড়িতে যেতে হবে। তার ছেলেকে দেখব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।’ প্রতিশ্রুতির পশ্চাত্পটটি বলতে হয়। আগরতলা মামলা চলাকালে আমার ছেলের জন্ম হয়। পাকিস্তান অবজারভার-এর জন্য মামলার রিপোর্ট সংগ্রহে আদালতে অন্যদের মধ্যে রিপোর্টার আবদুর রহিমকেও পাঠাতাম। রহিমকে বললাম, ‘নেতাকে বলো, আমার একটি ছেলে হয়েছে, তিনি যেন দোয়া করেন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘মূসার ছেলেকে দেখতে যাব।’ বার্তাটি পেয়ে অবাক হয়ে বললাম, ‘কদিন পরে যিনি নিশ্চিত ফাঁসির দড়িতে ঝুলবেন তিনি বলছেন শিগগিরই আমার বাড়িতে আসবেন!’ সেই উপাখ্যান ভুলেই গিয়েছিলাম।
সিরাজ ভাবি টেলিফোনে আমার স্ত্রীকে জানালেন ‘মুজিব ভাই আপনার বাড়িতে যাচ্ছেন।’ তিনি আমার কর্মস্থল পাকিস্তান অবজারভার-এ ফোন করলেন, ‘জলদি আসো, শেখ সাহেব আসছেন।’ অতিদ্রুত বাড়ি এসে পৌঁছালাম। ইতিমধ্যে কিশোর শ্যানন ওরফে আনিসুল হক মুজিব ভাইকে নিয়ে আমার বাড়িতে এলেন। আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে একটি সোনার চেইন পরিয়ে বললেন, ‘তোমার ভাবি দিয়েছে।’ একটি বাবাস্যুট আর এক বাক্স মিষ্টি দিলেন আমার স্ত্রীর হাতে। আমাকে দেখেই কৌতুক করে বললেন, ‘কিরে, এলাম তো! যখন আসব বলেছিলাম তখন তো নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিলি।’ অবশ্যই অবাক হয়েছিলাম। তাঁর অসামান্য স্মরণশক্তি ছিল কিংবদন্তি, তুচ্ছ বিষয়টি মনে রেখে দিয়েছেন। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, চৌষট্টিতে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামাতে ঢাকার তত্কালীন জেলা প্রশাসকসহ (এম কে আনোয়ার, বর্তমানে বিএনপির নেতা) রায়েরবাজার-মোহাম্মদপুরে এসেছিলেন তখনো একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন। সূচনা করেছিলাম সিরাজ ভাবিকে দিয়ে। মধ্যিখানে একটি নিজস্ব কাহিনী বর্ণনা হয়তো অবান্তর মনে হতে পারে। তবুও বললাম, গত শুক্রবার প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘অন্তরঙ্গ আলোকে বঙ্গবন্ধু’ উপাখ্যানে বলা হয়নি।
সিরাজ-মুজিব প্রাণের বন্ধন শেখ হাসিনার অজানা ছিল না। তাই বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় তিনিই একমাত্র অকুতোভয় হতে পারবেন। হত্যাকারীদের সঙ্গে একই সূত্রে বাঁধা ব্যক্তিরা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইনডেমনিটির বাধা সরিয়ে নতুন সরকার মামলা শুরু করলেন। মামলা পরিচালনায় বাঘা বাঘা আইনজীবীর কাউকে নয়, দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁকে কেন বেছে নিলেন শেখ হাসিনা? শেখ হাসিনা জানতেন, মামলার পরিচালনায় পার হতে হবে অনেক বাধা-বিপত্তি আর আইনি চড়াই-উতরাই। আসবে ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি। এসব ভয়ঙ্কর ও অশুভ শক্তির মোকাবিলা একটিমাত্র নির্ভীক দৃঢ়চেতা ব্যক্তিই করতে পারবেন। তিনি সিরাজুল হক, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক দিন পর বঙ্গভবনে ফারুক-রশিদ-বেষ্টিত মোশতাককে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কেন মুজিবকে খুন করেছ?’ তাঁর মুখে শুনেছি, পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাচ্যুত মোশতাকের আগামসিহ লেনের বাড়িতে গিয়েও বলেছিলেন, ‘তুমি খুনি!’
আবারও মামলা প্রসঙ্গে আসি। ইনডেমনিটি তথা দায়মুক্তি আইন বাতিল হলো। মামলা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিরাজ ভাই তখন বনানীর নতুন বাসস্থানে। আইনজীবী সিরাজুল হকের কাছে আমি অত্যন্ত গুরুতর একটি প্রশ্ন করেছিলাম। জানতে চেয়েছি, ফৌজদারি কার্যক্রম অনুসরণে সাধারণ হত্যা মামলার বিচার হবে অথবা বিশেষ আদালত ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে? তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘হাসিনাকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের পরামর্শ দিয়েছি, কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর মন্ত্রিসভার সঙ্গে পরামর্শ করে আমাকে বিদ্যমান ফৌজদারি আইনে বিচারপ্রক্রিয়া অনুসরণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।’ শেখ হাসিনার যুক্তি ছিল, ‘জাতি প্রতিশোধ চায় না, বিচার চায়। সেই বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও প্রশ্নাতীত হতে হবে।’
সিরাজ ভাই শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার হলে স্বচ্ছতা ও দ্রুত আইনি প্রক্রিয়ায় সুবিচার নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে। বলা হতো, বিচার যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় হয়নি, ধরে-বেঁধে শাস্তি দেওয়া হলো। বিচার শেষ হতে ৩০০ কর্মদিন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু বিচার যে স্বচ্ছ ও সঠিক হয়েছে, তা আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও স্বীকার করেছেন। তাই তো চূড়ান্ত বিচারকালে তাঁরা কখনো মক্কেলদের নির্দোষ বলেননি। শুধু দণ্ড লাঘব করার আবেদন জানিয়েছেন।
মামলা চলাকালীন বনানীর বাড়িতে এসব আলোচনার সময়ে সদ্য সনদপ্রাপ্ত আনিসুল হকও উপস্থিত থাকতেন। প্রথম থেকেই পুরো বিচারপ্রক্রিয়ায় পিতার সঙ্গে পুত্র জড়িত ছিলেন। আইনের পুস্তক ঘেঁটে সঠিক সূত্রগুলো খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন। পরে ভেবেছি, তখন কি জানতেন, একদিন পিতার বোঝা, অসমাপ্ত দায়িত্ব পালনের কর্তব্যটি তাঁর কাঁধেই চাপবে। তাই তো বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ায় ছেদ ঘটিয়ে পিতার মহতী উদ্যোগে সম্পৃক্ত হতে দেশে ফিরে আইনি ডিগ্রি নিয়ে পিতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বুঝে নিয়েছিলেন পিতার মামলা পরিচালনার কর্মপদ্ধতি। পিতার মনেও কি জানা হয়ে গিয়েছিল, একটি দীর্ঘ বৈচারিক পদ্ধতির শুরু করেছেন, হয়তো শেষটি দেখে যেতে পারবেন না! আমার মনে হয়, তিনি আমাদের বৈচারিক পদ্ধতির দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই সন্তানকে উপযুক্ত উত্তরাধিকারী তৈরি করেছিলেন। পিতার অসমাপ্ত মহান উদ্যোগটি সফল করার দায়িত্ব নিষ্ঠাবান সন্তানের হাতে অর্পণ করে গিয়েছিলেন। সেই দায়িত্ব পালনে সাফল্যই অনন্য একটি ঐতিহাসিক মামলায় যুদ্ধ বিজয়ের গৌরববোধের চেয়েও অধিকতর তৃপ্তি দিয়েছে।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
No comments