নৈরাজ্য, নিষ্ঠুর, বর্বর by বিল্লাল হোসেন রবিন ও শুভ্র দেব
নির্মম।
নিষ্ঠুর। বর্বর। অমানবিক। হৃদয়বিদারক। কোনো বিশেষণ দিয়েই এই নির্মমতার
চিত্র ফুটিয়ে তোলা যাবে না। ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনীতে নিহত হচ্ছে একের
পর এক। রাজধানীর বাড্ডা ও নারায়ণগঞ্জের দু’টি মর্মান্তিক ঘটনায় শিহরিত
মানুষ।
এর একজন তাসলিমা বেগম। যিনি সন্তানের ভবিষ্যতের খোঁজে গিয়ে নিজেই নির্মম গণপিটুনিতে না ফেরার দেশে যেতে হলো। সেই শিশু সন্তানটির ভবিষ্যত এখন আরও অনিশ্চিয়তায় পড়েছে।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে মেয়েকে দেখতে গিয়ে গণপিটুনীতে মারা গেছে বাকপ্রতিবন্ধী পিতা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ছোট্ট তাসনিম তুবাকে নিয়ে বড় বোনের বাসায় থাকতেন তাসলিমা বেগম রেনু। তার দুই সন্তানের মধ্যে চার বছর বয়সী তুবা ছিল ছোট। আর ছেলেকে নিয়ে স্বামী অন্যত্র থাকতেন। ৪০ বছর বয়সী রেনুর সব স্বপ্ন ছিল আদরের মেয়ে তুবাকে নিয়ে। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকে তিনি কিছুটা মানসিক বিষন্নতায়ও ভুগছিলেন। স্বামী ছাড়া বাকি জীবন কিভাবে পার করবেন এই চিন্তায় সময় পার করতেন। তাই তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লাগত। মেয়েকে স্কুলে ভর্তির জন্য কিছুদিন ধরে স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। শনিবার ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন তিনি। এরপর মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার খোঁজ খবর নিতে চলে যান উত্তর বাড্ডায়। সেখানকার একটি প্রাইমারি স্কুলের সামনে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন তিনি।
এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও রেনু বাসায় ফিরছিলেন না। তাই মেয়ে তুবা ও বড় বোন জয়নব বেগম তার ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। ততক্ষণে ছেলে ধরা সন্দেহে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। খবর চলে যায় রেনুর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে। পরে তার ভাগ্নে নাসির উদ্দিন টিটু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেন। গণপিটুনির এই ঘটনায় বাড্ডা থানায় নিহতের ভাগ্নে অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরা থেকে ভিডিও ফুটেজ নিয়ে গণপিটুনিতে অংশগ্রহনকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে তার স্বজনরা ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেণ। তার ভাগ্নে থানায় একটি মামলা করেছেন। আমরা আসামি শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, তাসলিমা বেগম রেনু শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে উত্তর বাড্ডার ওই স্কুলের গেট দিয়ে প্রবেশ করতে চান। এসময় স্কুলের গেটে বসে থাকা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা তাকে আটকে স্কুলে কেন প্রবেশ করছেন তার কারণ জিজ্ঞাসা করে। এসময় রেনু জানান তিনি তার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার খোঁজ নিতে চান। ভেতরে গেলে রেনুকে জানানো হয় স্কুলে এখন ভর্তি নেয়া হবে না। এই কথা বলে তাকে প্রধান শিক্ষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তার কথাবার্তা কিছুটা অস্বাভাবিক হওয়াতে চারদিকে খবর ছড়ায় স্কুলে ছেলে ধরা এসেছে। এমন খবরে স্কুলের বাইরে শত শত লোক এসে অবস্থান করে। পরে ওই নারীকে স্কুলের বাইরে নিয়ে আসলে উৎসুক মানুষ তাকে পিটুনি দেয়।
পুলিশ ও নিহতের স্বজনসূত্রে জানা গেছে, আড়াই বছর আগে পারিবারিক কলহে রেনুর সঙ্গে তার স্বামীর বিচ্ছেদ হয়। তবে এর আগে তিনি উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আলী মোড় এলাকায় স্বামী তসলিম হোসেনের সঙ্গে দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। বিচ্ছেদের পর রেনু মেয়ে তুবাকে নিয়ে ৩৩/৩ জিপি/জ মহাখালীর তার বড় বোন জয়নব বেগমের সঙ্গে থাকতেন। রেনুর ভাগ্নে নাসির উদ্দিন টিটু বলেন, ফজরের নামাজ পড়ে তিনি প্রতিদিন হাটতে বের হতেন। ঘটনার দিনও নামাজ পড়ে ভোরবেলা তিনি হাটতে বের হয়েছিলেন। তুবাকে স্কুলে ভর্তির জন্য তিনি বিভিন্ন স্কুলে ঘুরছিলেন। স্বামীকে নিয়ে যে বাসায় ছিলেন তার পাশে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেই তিনি ভর্তির খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তার কথা বার্তায় কিছু অস্বাবিক আচরণ ছিল। হয়ত তাই তাকে নির্মমভাবে স্কুল মাঠেই পিটিয়ে হত্যা করা হল। কিন্তু সেখানে কি একটা লোক ছিল না তাকে বাঁচানোর মত। আমি এই ঘটনায় জড়িতদের কঠিন শাস্তির দাবি করছি। বড় বোন রেহেনা আক্তার বলেন, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে সে বিষন্নতায় ভুগতো ও মেয়ের ভষিষ্যত নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকত। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, কেন আমার নিরাপরাধ বোনটাকে তারা মেরে ফেলল? গল্পে শুনেছিলাম ছেলে ধরা আছে। আজ সেই গল্পের মতই আমার বোনকে মারা হয়। ওদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার বোনের আত্মার শান্তি হবে না।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা প্রয়োজন গত দুই সপ্তাহ ধরে এমন গুজব ছড়াচ্ছে এক শ্রেনীর মানুষ। এতে করে একের পর এক ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। দুই সপ্তাহে সারা দেশে ছেলে ধরা সন্দেহে ২১টি গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ছয়জন আর মারাত্বভাবে আহত হয়েছেন ২২ জন। এছাড়া আরও নানা কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৩৬ জন মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। শনিবার একই দিনে ঢাকার বাড্ডা, কেরানীগঞ্জে, নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে গণপিটুনিতে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনা তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তে ঘটনার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে ছেলে ধরার কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন, কেউ মাদকাসক্ত বা অনেককে সন্দেহজনকভাবে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার পর পদ্মাসেতু কর্তৃপক্ষ সেতু নির্মাণে শিশুদের মাথা লাগবে এমন ঘটনা গুজব বলে বিজ্ঞপ্তি দেয়। এছাড়া পুলিশ সদরদপ্তরের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে মানুষকে সতর্ক করেছে। শনিবার মিডিয়া শাখা থেকে পাঠানো আরেক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা একটি ফৌজদারি অপরাধ। জনসাধারণকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারি উপমহাপরিদর্শক সোহেল রানা বলেন, গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা রাষ্ট্র বিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা ফৌজদারি অপরাধ। তাই কাউকে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। তিনি বলেন, গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার প্রত্যেকটি ঘটনা পুলিশ আমলে নিয়েছে। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছে।
বাকপ্রতিবন্ধী সিরাজের উপর নির্মমতা: মো. সিরাজ। জন্মগতভাবে কথা বলতে পারেন না। বাকপ্রতিবন্ধী। রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতো। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় সিরাজকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করানো হয়। তাদের ঘরে আসে এক মেয়ে সন্তান। নাম মিনজু। বর্তমানে বয়স ৬ থেকে ৭ বছর। ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু সিরাজের অগোচরে স্ত্রী সামছুন্নাহার জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায়। সেই সূত্রে এক সময় মেয়েকে নিয়ে পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যায় সামছুন্নাহার। একা হয়ে পড়ে সিরাজ। পাগলের মতো স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজে বেড়ায়। এক সময় স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ পেলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সিরাজের। সামছুন্নাহার সিরাজকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। পিছু হটে সিরাজ। কিন্তু সন্তানের মায়া ছাড়তে পারেনি। মাঝে মাঝে ছুটে যায় মেয়েকে দেখতে। তারই ধারাবাহিকতায় মেয়েকে দেখার জন্য শনিবার সকাল ৮টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পূর্বপাড়া পাগলাবাড়ি এলাকায় যায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার মেয়ের মতো সাদিয়া নামে একটি মেয়েকে দেখতে পেয়ে আদর করে চিপস কিনে দেয়। কে জানতো এই চিপস কিনে দেয়াই সিরাজের জন্য কাল হবে। আর হয়েছেও তাই। ছেলেধরা ভেবে তাকে আটক করে স্থানীয় লোকজন। এ সময় সিরাজ ঈশারায় বোঝানোর চেষ্টা করে এটা তার মেয়ের মতো। সে ছেলেধরা না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অজ্ঞ, অথর্ব, আর হিংস্র কিছু হায়েনার দল পিটিয়ে নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, সিরাজের নিস্তেজ দেহটি টেনে হিঁচড়ে প্রায় ১০০ গজ অদূরে নিয়ে ক্যানেলপাড়ে ফেলে রাখা হয়। পরে পুলিশ গিয়ে সিরাজের লাশ উদ্ধার করে। নিহত সিরাজ সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো চারতলা এলাকায় একটি ম্যাচে ভাড়া থাকতো।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, পাগলাবাড়ি এলাকায় আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন নামে একটি স্কুল রয়েছে। শনিবার সকালে ওই স্কুলের শিশু শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া (৬)কে চিপস কিনে দেয় সিরাজ। এবং মেয়েটিকে কোলে নিতে চায়। এ সময় একজন রিকশাচালক তাকে আটক করে। পরে আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক রেদোয়ান আহমেদ ছুটে আসেন। তিনি শিশুটিকে সিরাজের কাছে দেখে ছেলেধরা আখ্যা দিয়ে মারধর করতে থাকেন। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। স্থানীয় লোকজন ও কিছু যুবক ছুটে এসে দফায় দফায় পিটাতে থাকে সিরাজকে। এ সময় ছেলেটা বার বার কি যেন বলার চেষ্টা করছিল। এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরে টেনে হিঁচড়ে দূরে ক্যানেলপাড়ে নিয়ে তার দেহটি ফেলে রাখা হয়। উত্তেজিত লোকজনের মধ্যে যুবক শ্রেণির একটি গ্রুপ ছিল। যারা বেশি মারধর করে।
নিহতের পরিবারের বক্তব্য: নিহত সিরাজের ছোট দুইভাই মো. আলম ও কালাম জানান, সিরাজ পরিবারের সবার বড়। রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতো। বিয়ের পর ভাবিকে নিয়ে সাইলো এলাকায় মোহন চাঁদের বাড়িতে ভাড়া থাকতো। বর্তমানে সিরাজের ৬ বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। নাম মিনজু। এদিকে বিয়ের পর সিরাজের পাশের বাসার মান্নান ওরফে সোহেলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে স্ত্রী সাছুন্নাহার। মান্নানের বাড়ি আমাদের পরের গ্রামে। মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ মাস আগে সিরাজকে ডিভোর্স দেয় সামছুন্নাহার। এরপর থেকে অনেক কান্নাকাটি করে সিরাজ। মেয়েকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যায়। এক সময় সে আমাদের জানায়, মিজমিজি পাগলাবাড়ি এলাকায় তার মেয়ে থাকে। সেখানে সে তাকে দেখেছে। আমরা তাকে বুঝাতাম বাদ দেন। কান্নাকাটি করে লাভ নাই। সে ঈশারায় বুঝাতো মেয়ের জন্য তার অনেক কষ্ট হয়। তাই যেদিন কাজ থাকতো না সেদিন ছুটে যেত ওই এলাকায়। শনিবার সকাল ৮টার দিকে একইভাবে সে ওই এলাকায় যায় মেয়েকে দেখার জন্য। কিন্তু আমাদের বোবা ভাইটাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলেছে। সিরাজের সঙ্গে বাবা আব্দুর রশিদ থাকতো। নিজেই রান্না করে খেতো সিরাজ। ঈদের আগে দাদীর অসুস্থতার কথা শুনে পরিবারের সঙ্গে সিরাজ ভোলার লালমোহন যায়। ঈদের পর দাদী মারা যাওয়ার পর সিরাজ কাজের জন্য চলে আসে।
আলম আরো জানায়, ঘটনার দিন শনিবার সকাল ৮টার দিকে সিরাজ ভাইকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখি। ওই সময় ভেবেছি তিনি কাজে যাচ্ছেন। সকাল ১০টার দিকে এলাকার এক লোক তার মোবাইলে ফেসবুকে আমাকে দেখাচ্ছেন যে, একজন লোককে ছেলেধরা সন্দেহে মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। নিহতের ছবি দেখে আমি সিরাজ ভাইকে চিনতে পারি। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করি। আমরা আমাদের ভাই হত্যার বিচার চাই।
নিহত সিরাজের জ্যাঠাতো বোন তরিফা জানান, শুক্রবার দুপুরে তার বাসা থেকে ভাত খেয়ে যায় সিরাজ। মাঝে মধ্যে তার বাসায় যেতো। বোবা ভাইটাকে এভাবে মেরে ফেলবে চিন্তাও করতে পারি না। এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সাইলো এলাকার সোহেব আহমেদ নামে এক যুবক জানায়, তাদের বাড়িতে অনেকদিন আগে কনস্ট্রাকশনের কাজের হেলপার হিসেবে কাজ করেছে সিরাজ। কখনো কাজে ফাঁকি দিতো না। অনেক শান্ত একটা মানুষ ছিল।
প্রতিবেশী লোকজন জানিয়েছেন, কোরবানির ঈদের সময় সিরাজ মানুষের বাড়িতে কোরবানির গরু কাটাকাটির কাজ করতো। বিনিময়ে টাকা ও কিছু মাংস পেতো। সামনের কোরবানির ঈদেও এই কাজ করতো। কিন্তু তার আগেই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছে সে।
৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা: গ্রেপ্তার ১৪
এদিকে এ ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই সাখাওয়াত মৃধা বাদী হয়ে ৬৭ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো তিনশ’ থেকে চারশ’ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। এর মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যাদের মধ্যে ঘটনাস্থলের পাশে থাকা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক মো. রেদওয়ান রয়েছে। রেদওয়ান ওই মামলার প্রধান আসামি। তিনিই প্রথম সিরাজকে মারধর করেন।
গ্রেপ্তার রেদওয়ান পুলিশকে জানিয়েছে, ঘটনার দিন সকালে স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া (৬)কে আদর করে কোলে তুলে নেয় সিরাজ। এ দৃশ্য দেখে সে সিরাজকে কারণ জিজ্ঞেস করলে সিরাজ আকার ইঙ্গিতে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, মেয়েটি তার নিজের মেয়ের বয়সী। কিন্তু ওই সময় সে বিষয়টি বুঝতে না পেরে সিরাজকে মারধর শুরু করে। এরপর তার সঙ্গে স্থানীয় লোকজন সিরাজকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিলে সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
বিচার দাবি করে মিছিল: এদিকে গতকাল রোববার সকালে সিরাজের লাশ সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো গেইট এলাকায় নিয়ে আসলে কান্নায় ভেঙে পড়ে এলাকাবাসী। তাদের অনেককেই আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেছে-এমন করে মানুষকে পিটিয়ে মারতে পারলো লোকজন। লাশকে ঘিরে থাকা এলাকাবাসী ও তার মেজো ভাই আলম সিরাজের হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেন। এ সময় তারা সিরাজ হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে মিছিলও করে।
সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো এলাকার ঠিকাদার মোহর চানের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন মৃত সিরাজ। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহন থানার মুগিয়া বাজার এলাকায়। তার পিতার নাম আ. রশিদ মণ্ডল। মায়ের নাম কমলা খাতুন।
বিভ্রান্ত না হতে পুলিশ সুপারের ব্রিফিং: এদিকে গতকাল রোববার দুপুরে নগরের চাষাঢ়া শহীদ মিনারে সাংবাদিকদের সাম্প্রতিক ছেলেধরা ইস্যুতে ব্রিফিং করেন পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ। তিনি আইন হাতে তুলে না নিতে জেলাবাসীকে অনুরোধ করে বলেন, কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে তাকে আটকে রেখে পুলিশে সোপর্দ করবেন। তা না হলে আপনারা এ ধরনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি হয়ে যাবেন। ছেলেধরা গুজবে কেউ কান দেবেন না। এ ধরনের ঘটনা রোধে পুলিশ সচেতনতার জন্য মাইকিং করছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। তবে তিনি এও বলেন, অনেক জনপ্রতিনিধি এসব গণপিটুনির ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
এর একজন তাসলিমা বেগম। যিনি সন্তানের ভবিষ্যতের খোঁজে গিয়ে নিজেই নির্মম গণপিটুনিতে না ফেরার দেশে যেতে হলো। সেই শিশু সন্তানটির ভবিষ্যত এখন আরও অনিশ্চিয়তায় পড়েছে।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে মেয়েকে দেখতে গিয়ে গণপিটুনীতে মারা গেছে বাকপ্রতিবন্ধী পিতা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ছোট্ট তাসনিম তুবাকে নিয়ে বড় বোনের বাসায় থাকতেন তাসলিমা বেগম রেনু। তার দুই সন্তানের মধ্যে চার বছর বয়সী তুবা ছিল ছোট। আর ছেলেকে নিয়ে স্বামী অন্যত্র থাকতেন। ৪০ বছর বয়সী রেনুর সব স্বপ্ন ছিল আদরের মেয়ে তুবাকে নিয়ে। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকে তিনি কিছুটা মানসিক বিষন্নতায়ও ভুগছিলেন। স্বামী ছাড়া বাকি জীবন কিভাবে পার করবেন এই চিন্তায় সময় পার করতেন। তাই তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লাগত। মেয়েকে স্কুলে ভর্তির জন্য কিছুদিন ধরে স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। শনিবার ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হয়েছিলেন তিনি। এরপর মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার খোঁজ খবর নিতে চলে যান উত্তর বাড্ডায়। সেখানকার একটি প্রাইমারি স্কুলের সামনে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন তিনি।
এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও রেনু বাসায় ফিরছিলেন না। তাই মেয়ে তুবা ও বড় বোন জয়নব বেগম তার ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। ততক্ষণে ছেলে ধরা সন্দেহে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। খবর চলে যায় রেনুর আত্মীয়-স্বজনদের কাছে। পরে তার ভাগ্নে নাসির উদ্দিন টিটু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেন। গণপিটুনির এই ঘটনায় বাড্ডা থানায় নিহতের ভাগ্নে অজ্ঞাত ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরা থেকে ভিডিও ফুটেজ নিয়ে গণপিটুনিতে অংশগ্রহনকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে তার স্বজনরা ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেণ। তার ভাগ্নে থানায় একটি মামলা করেছেন। আমরা আসামি শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, তাসলিমা বেগম রেনু শনিবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে উত্তর বাড্ডার ওই স্কুলের গেট দিয়ে প্রবেশ করতে চান। এসময় স্কুলের গেটে বসে থাকা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা তাকে আটকে স্কুলে কেন প্রবেশ করছেন তার কারণ জিজ্ঞাসা করে। এসময় রেনু জানান তিনি তার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার খোঁজ নিতে চান। ভেতরে গেলে রেনুকে জানানো হয় স্কুলে এখন ভর্তি নেয়া হবে না। এই কথা বলে তাকে প্রধান শিক্ষকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তার কথাবার্তা কিছুটা অস্বাভাবিক হওয়াতে চারদিকে খবর ছড়ায় স্কুলে ছেলে ধরা এসেছে। এমন খবরে স্কুলের বাইরে শত শত লোক এসে অবস্থান করে। পরে ওই নারীকে স্কুলের বাইরে নিয়ে আসলে উৎসুক মানুষ তাকে পিটুনি দেয়।
পুলিশ ও নিহতের স্বজনসূত্রে জানা গেছে, আড়াই বছর আগে পারিবারিক কলহে রেনুর সঙ্গে তার স্বামীর বিচ্ছেদ হয়। তবে এর আগে তিনি উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আলী মোড় এলাকায় স্বামী তসলিম হোসেনের সঙ্গে দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। বিচ্ছেদের পর রেনু মেয়ে তুবাকে নিয়ে ৩৩/৩ জিপি/জ মহাখালীর তার বড় বোন জয়নব বেগমের সঙ্গে থাকতেন। রেনুর ভাগ্নে নাসির উদ্দিন টিটু বলেন, ফজরের নামাজ পড়ে তিনি প্রতিদিন হাটতে বের হতেন। ঘটনার দিনও নামাজ পড়ে ভোরবেলা তিনি হাটতে বের হয়েছিলেন। তুবাকে স্কুলে ভর্তির জন্য তিনি বিভিন্ন স্কুলে ঘুরছিলেন। স্বামীকে নিয়ে যে বাসায় ছিলেন তার পাশে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেই তিনি ভর্তির খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, তার কথা বার্তায় কিছু অস্বাবিক আচরণ ছিল। হয়ত তাই তাকে নির্মমভাবে স্কুল মাঠেই পিটিয়ে হত্যা করা হল। কিন্তু সেখানে কি একটা লোক ছিল না তাকে বাঁচানোর মত। আমি এই ঘটনায় জড়িতদের কঠিন শাস্তির দাবি করছি। বড় বোন রেহেনা আক্তার বলেন, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে সে বিষন্নতায় ভুগতো ও মেয়ের ভষিষ্যত নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকত। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, কেন আমার নিরাপরাধ বোনটাকে তারা মেরে ফেলল? গল্পে শুনেছিলাম ছেলে ধরা আছে। আজ সেই গল্পের মতই আমার বোনকে মারা হয়। ওদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার বোনের আত্মার শান্তি হবে না।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা প্রয়োজন গত দুই সপ্তাহ ধরে এমন গুজব ছড়াচ্ছে এক শ্রেনীর মানুষ। এতে করে একের পর এক ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। দুই সপ্তাহে সারা দেশে ছেলে ধরা সন্দেহে ২১টি গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ছয়জন আর মারাত্বভাবে আহত হয়েছেন ২২ জন। এছাড়া আরও নানা কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৩৬ জন মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। শনিবার একই দিনে ঢাকার বাড্ডা, কেরানীগঞ্জে, নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে গণপিটুনিতে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনা তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তে ঘটনার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে ছেলে ধরার কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন, কেউ মাদকাসক্ত বা অনেককে সন্দেহজনকভাবে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার পর পদ্মাসেতু কর্তৃপক্ষ সেতু নির্মাণে শিশুদের মাথা লাগবে এমন ঘটনা গুজব বলে বিজ্ঞপ্তি দেয়। এছাড়া পুলিশ সদরদপ্তরের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে মানুষকে সতর্ক করেছে। শনিবার মিডিয়া শাখা থেকে পাঠানো আরেক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা একটি ফৌজদারি অপরাধ। জনসাধারণকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারি উপমহাপরিদর্শক সোহেল রানা বলেন, গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা রাষ্ট্র বিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা ফৌজদারি অপরাধ। তাই কাউকে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। তিনি বলেন, গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার প্রত্যেকটি ঘটনা পুলিশ আমলে নিয়েছে। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছে।
বাকপ্রতিবন্ধী সিরাজের উপর নির্মমতা: মো. সিরাজ। জন্মগতভাবে কথা বলতে পারেন না। বাকপ্রতিবন্ধী। রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতো। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় সিরাজকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করানো হয়। তাদের ঘরে আসে এক মেয়ে সন্তান। নাম মিনজু। বর্তমানে বয়স ৬ থেকে ৭ বছর। ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু সিরাজের অগোচরে স্ত্রী সামছুন্নাহার জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায়। সেই সূত্রে এক সময় মেয়েকে নিয়ে পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যায় সামছুন্নাহার। একা হয়ে পড়ে সিরাজ। পাগলের মতো স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজে বেড়ায়। এক সময় স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ পেলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সিরাজের। সামছুন্নাহার সিরাজকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। পিছু হটে সিরাজ। কিন্তু সন্তানের মায়া ছাড়তে পারেনি। মাঝে মাঝে ছুটে যায় মেয়েকে দেখতে। তারই ধারাবাহিকতায় মেয়েকে দেখার জন্য শনিবার সকাল ৮টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পূর্বপাড়া পাগলাবাড়ি এলাকায় যায়। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার মেয়ের মতো সাদিয়া নামে একটি মেয়েকে দেখতে পেয়ে আদর করে চিপস কিনে দেয়। কে জানতো এই চিপস কিনে দেয়াই সিরাজের জন্য কাল হবে। আর হয়েছেও তাই। ছেলেধরা ভেবে তাকে আটক করে স্থানীয় লোকজন। এ সময় সিরাজ ঈশারায় বোঝানোর চেষ্টা করে এটা তার মেয়ের মতো। সে ছেলেধরা না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অজ্ঞ, অথর্ব, আর হিংস্র কিছু হায়েনার দল পিটিয়ে নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, সিরাজের নিস্তেজ দেহটি টেনে হিঁচড়ে প্রায় ১০০ গজ অদূরে নিয়ে ক্যানেলপাড়ে ফেলে রাখা হয়। পরে পুলিশ গিয়ে সিরাজের লাশ উদ্ধার করে। নিহত সিরাজ সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো চারতলা এলাকায় একটি ম্যাচে ভাড়া থাকতো।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, পাগলাবাড়ি এলাকায় আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন নামে একটি স্কুল রয়েছে। শনিবার সকালে ওই স্কুলের শিশু শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া (৬)কে চিপস কিনে দেয় সিরাজ। এবং মেয়েটিকে কোলে নিতে চায়। এ সময় একজন রিকশাচালক তাকে আটক করে। পরে আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক রেদোয়ান আহমেদ ছুটে আসেন। তিনি শিশুটিকে সিরাজের কাছে দেখে ছেলেধরা আখ্যা দিয়ে মারধর করতে থাকেন। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। স্থানীয় লোকজন ও কিছু যুবক ছুটে এসে দফায় দফায় পিটাতে থাকে সিরাজকে। এ সময় ছেলেটা বার বার কি যেন বলার চেষ্টা করছিল। এক সময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরে টেনে হিঁচড়ে দূরে ক্যানেলপাড়ে নিয়ে তার দেহটি ফেলে রাখা হয়। উত্তেজিত লোকজনের মধ্যে যুবক শ্রেণির একটি গ্রুপ ছিল। যারা বেশি মারধর করে।
নিহতের পরিবারের বক্তব্য: নিহত সিরাজের ছোট দুইভাই মো. আলম ও কালাম জানান, সিরাজ পরিবারের সবার বড়। রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতো। বিয়ের পর ভাবিকে নিয়ে সাইলো এলাকায় মোহন চাঁদের বাড়িতে ভাড়া থাকতো। বর্তমানে সিরাজের ৬ বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। নাম মিনজু। এদিকে বিয়ের পর সিরাজের পাশের বাসার মান্নান ওরফে সোহেলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে স্ত্রী সাছুন্নাহার। মান্নানের বাড়ি আমাদের পরের গ্রামে। মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ মাস আগে সিরাজকে ডিভোর্স দেয় সামছুন্নাহার। এরপর থেকে অনেক কান্নাকাটি করে সিরাজ। মেয়েকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যায়। এক সময় সে আমাদের জানায়, মিজমিজি পাগলাবাড়ি এলাকায় তার মেয়ে থাকে। সেখানে সে তাকে দেখেছে। আমরা তাকে বুঝাতাম বাদ দেন। কান্নাকাটি করে লাভ নাই। সে ঈশারায় বুঝাতো মেয়ের জন্য তার অনেক কষ্ট হয়। তাই যেদিন কাজ থাকতো না সেদিন ছুটে যেত ওই এলাকায়। শনিবার সকাল ৮টার দিকে একইভাবে সে ওই এলাকায় যায় মেয়েকে দেখার জন্য। কিন্তু আমাদের বোবা ভাইটাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলেছে। সিরাজের সঙ্গে বাবা আব্দুর রশিদ থাকতো। নিজেই রান্না করে খেতো সিরাজ। ঈদের আগে দাদীর অসুস্থতার কথা শুনে পরিবারের সঙ্গে সিরাজ ভোলার লালমোহন যায়। ঈদের পর দাদী মারা যাওয়ার পর সিরাজ কাজের জন্য চলে আসে।
আলম আরো জানায়, ঘটনার দিন শনিবার সকাল ৮টার দিকে সিরাজ ভাইকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখি। ওই সময় ভেবেছি তিনি কাজে যাচ্ছেন। সকাল ১০টার দিকে এলাকার এক লোক তার মোবাইলে ফেসবুকে আমাকে দেখাচ্ছেন যে, একজন লোককে ছেলেধরা সন্দেহে মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। নিহতের ছবি দেখে আমি সিরাজ ভাইকে চিনতে পারি। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করি। আমরা আমাদের ভাই হত্যার বিচার চাই।
নিহত সিরাজের জ্যাঠাতো বোন তরিফা জানান, শুক্রবার দুপুরে তার বাসা থেকে ভাত খেয়ে যায় সিরাজ। মাঝে মধ্যে তার বাসায় যেতো। বোবা ভাইটাকে এভাবে মেরে ফেলবে চিন্তাও করতে পারি না। এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সাইলো এলাকার সোহেব আহমেদ নামে এক যুবক জানায়, তাদের বাড়িতে অনেকদিন আগে কনস্ট্রাকশনের কাজের হেলপার হিসেবে কাজ করেছে সিরাজ। কখনো কাজে ফাঁকি দিতো না। অনেক শান্ত একটা মানুষ ছিল।
প্রতিবেশী লোকজন জানিয়েছেন, কোরবানির ঈদের সময় সিরাজ মানুষের বাড়িতে কোরবানির গরু কাটাকাটির কাজ করতো। বিনিময়ে টাকা ও কিছু মাংস পেতো। সামনের কোরবানির ঈদেও এই কাজ করতো। কিন্তু তার আগেই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছে সে।
৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা: গ্রেপ্তার ১৪
এদিকে এ ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই সাখাওয়াত মৃধা বাদী হয়ে ৬৭ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো তিনশ’ থেকে চারশ’ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। এর মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যাদের মধ্যে ঘটনাস্থলের পাশে থাকা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক মো. রেদওয়ান রয়েছে। রেদওয়ান ওই মামলার প্রধান আসামি। তিনিই প্রথম সিরাজকে মারধর করেন।
গ্রেপ্তার রেদওয়ান পুলিশকে জানিয়েছে, ঘটনার দিন সকালে স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া (৬)কে আদর করে কোলে তুলে নেয় সিরাজ। এ দৃশ্য দেখে সে সিরাজকে কারণ জিজ্ঞেস করলে সিরাজ আকার ইঙ্গিতে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, মেয়েটি তার নিজের মেয়ের বয়সী। কিন্তু ওই সময় সে বিষয়টি বুঝতে না পেরে সিরাজকে মারধর শুরু করে। এরপর তার সঙ্গে স্থানীয় লোকজন সিরাজকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিলে সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
বিচার দাবি করে মিছিল: এদিকে গতকাল রোববার সকালে সিরাজের লাশ সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো গেইট এলাকায় নিয়ে আসলে কান্নায় ভেঙে পড়ে এলাকাবাসী। তাদের অনেককেই আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেছে-এমন করে মানুষকে পিটিয়ে মারতে পারলো লোকজন। লাশকে ঘিরে থাকা এলাকাবাসী ও তার মেজো ভাই আলম সিরাজের হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেন। এ সময় তারা সিরাজ হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে মিছিলও করে।
সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো এলাকার ঠিকাদার মোহর চানের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন মৃত সিরাজ। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহন থানার মুগিয়া বাজার এলাকায়। তার পিতার নাম আ. রশিদ মণ্ডল। মায়ের নাম কমলা খাতুন।
বিভ্রান্ত না হতে পুলিশ সুপারের ব্রিফিং: এদিকে গতকাল রোববার দুপুরে নগরের চাষাঢ়া শহীদ মিনারে সাংবাদিকদের সাম্প্রতিক ছেলেধরা ইস্যুতে ব্রিফিং করেন পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ। তিনি আইন হাতে তুলে না নিতে জেলাবাসীকে অনুরোধ করে বলেন, কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে তাকে আটকে রেখে পুলিশে সোপর্দ করবেন। তা না হলে আপনারা এ ধরনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি হয়ে যাবেন। ছেলেধরা গুজবে কেউ কান দেবেন না। এ ধরনের ঘটনা রোধে পুলিশ সচেতনতার জন্য মাইকিং করছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। তবে তিনি এও বলেন, অনেক জনপ্রতিনিধি এসব গণপিটুনির ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
No comments