‘মৃত্যুর আগে ছেলের মুখটা একবার দেখতে চাই’
‘আমার
ঘুম হয় না। ছেলের জন্য শুধু কাঁদি আর কাঁদি। আমি আমার ছেলেটাকে ফেরত চাই।
আমার ছেলেকে আপনারা এনে দেন। মৃত্যুর আগে ছেলের মুখটা একবার দেখে যেতে
চাই।’ এ কথাগুলো এক সন্তানহারা মায়ের। তার এ আর্তনাদ ও আকুতি শুনে কেঁদেছেন
সবাই। ওই মায়ের নাম হাজেরা খাতুন। চার বছর আগে তার ছেলে সাজেদুল ইসলাম
সুমন গুম হন। হাজেরা খাতুন যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন সুমনের চার বছরের
মেয়ে আরোয়াও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এ সময় মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে নাছিমা
আক্তার বলেন, মা তুমি কেঁদো না, তোমার বাবা আসবেন। কিন্তু মায়ের এমন
সান্ত্বনায় ছোট্ট আরোয়ার কান্না থামছিল না। রোববার দুপুরে জাতীয় প্রেস
ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘মায়ের ডাক, সন্তানদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দাও’
শীর্ষক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য দেন হাজেরা খাতুন। এ অনুষ্ঠানে শুধু
হাজেরা নয়, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কেউ কথা বলতে গিয়ে
কেঁদেছেন, আবার কেউ কথা বলতে পারেননি, ছিলেন নির্বাক। এ অনুষ্ঠানে গুমের
শিকার হওয়া ২৭ জনের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ
করেন সুমনের বোন মারুফা ইসলাম। অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের
প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক
মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড
মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক সিআর আবরার,
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পরিচালক
নাসিরউদ্দিন এলান বক্তব্য দেন। গুমের জন্য সরকারকে দায়ী করে ডা. জাফর
উল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে গুম, খুন বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড থামছে না।
সরকারের অঙ্গুলিতে এসব ঘটনা ঘটছে।
তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল ফরহাদ মজহারের
সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তার সঙ্গে আলোচনায় বুঝতে পেরেছি পুলিশ ও র্যাব
সক্রিয় ছিল বলে তিনি ফিরে আসতে পেরেছেন। এতে বোঝা যায়, তার নিখোঁজ হওয়ার
পেছনে অন্য কোনো শক্তি কাজ করেছিল। তাই পুলিশ ও র্যাববকে সক্রিয় করার জন্য
জোর অনুরোধ জানাচ্ছি।’ এ অনুষ্ঠান এবং স্বজনদের কান্না ও বক্তব্য রেকর্ড
করে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন,
তাহলে মানুষ কথা বলবে, মানবতা জাগবে। তিনি বলেন, ‘একসময় আওয়ামী লীগ করতাম।
গুমের পরিস্থিতির শিকার এই কঠিন সময়টি সম্পর্কে জানি।’ তিনি বলেন, প্রতিবছর
পরিবারগুলোর সদস্যরা তাদের সন্তান বা ভাইয়ের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের
কাছে আবেদন জানায়। কিন্তু এ আহ্বান কারও কানে পৌঁছায় না। রাজনৈতিক ও
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে গুম করা হচ্ছে অভিযোগ করে মান্না
আরও বলেন, গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা এ ঘটনায় সরাসরি সরকারের দিকে
আঙুল তুলছেন। তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাদা পোশাকের সদস্যরা
স্বজনদের ধরে নিয়ে গেছে। এসব ঘটনায় তাদের মামলা নেয়া হয়নি। তিনি বলেন,
সরকারের লোকজন সব মগের মুলুক মনে করে, তারা মনে করে দেশে যা ইচ্ছা তাই করা
যাবে। সিআর আবরার বলেন, দেশে গুম-হত্যা চলছে। যারা গুমের পেছনে রয়েছে তাদের
বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক। গুম নিয়ে যে অভিযোগ সে ব্যাপারে জবাব
দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে তারা এখন নীরব।
এমন অবস্থা চলতে পারে না। নূর খান লিটন বলেন, বিভিন্ন দেশের গুমের সংখ্যা
দিয়ে গুমকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বিচারের নায্যতায়
নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে গুমের ঘটনায় আগামী
মার্চের মধ্যে গণশুনানির দাবি জানাচ্ছি। সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম বলেন,
পরিবারের সদস্যদের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে আমাদের ভাইদের,
সন্তানদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ প্রশাসনের লোকজন বলছেন তারা কিছুই
জানেন না। তিনি বলেন, বিচার চাইতে গিয়ে মারা গেছেন গুম হওয়া মুন্নার বাবা ও
পারভেজের বাবা। পিন্টুর মা ও আমার মা অসুস্থ। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে
সরকারের আন্তরিক হস্তক্ষেপ কামনা করি।
No comments