সংসদ নজরদারির বাইরে নয় by কামাল আহমেদ
যত
দূর মনে পড়ে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)
পার্লামেন্ট ওয়াচ কার্যক্রম যখন শুরু হয়েছিল, সেটি ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন
জোটের শাসনামল। অষ্টম সংসদের সময় থেকে সংসদের কার্যক্রম নিয়ে এই সমীক্ষা
তারা নিয়মিতই প্রকাশ করে আসছে। ফলে আমরাও জানতে পেরেছি কোন সাংসদ কয় দিন
অধিবেশনে উপস্থিত থেকেছেন, আর কয় দিন হাজির না হলেও বেতন-ভাতা পেয়েছেন। নবম
সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়ার সংসদে অনুপস্থিতির
বিষয়ে টিআইবির হিসাবই সম্ভবত এরপর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সাবেক
মহাজোটের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বারবার উদ্ধৃত হয়েছে। তাঁরা কেউ সংসদ
সচিবালয়ের হাজিরা খাতা যাচাই করেছেন—এমনটি কখনো শুনিনি। সেই একই সংস্থা,
টিআইবি তার সাম্প্রতিক রিপোর্টে ‘বর্তমান জাতীয় সংসদকে নিয়মরক্ষার সংসদ এবং
ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র ভুবনে পরিণত হওয়ার’ কথা বলে একটি পর্যবেক্ষণ
দিয়েছে।
কিন্তু এবারের রিপোর্টে ক্ষুব্ধ হয়ে বর্তমান সাংসদেরা টিআইবির মূল্যায়নকে সংবিধান পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছেন। সোমবার এক অনির্ধারিত আলোচনায় সংসদের সমালোচনা করার এখতিয়ার কোনো এনজিওর আছে কি না, এই প্রশ্ন তুলে তাঁরা টিআইবিকে সংসদে তলব করে শাস্তি দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। অনেক প্রবীণ সাংসদ তাঁদের বক্তব্যে টিআইবিকে সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপির পকেট সংগঠন বলেও অভিহিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, শাস্তি এড়াতে হলে টিআইবিকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হবে।
অবশ্য পুরো পর্যবেক্ষণই প্রত্যাহার করতে হবে কি না অথবা ক্ষমা চাওয়ার জন্য কোনো সময়সীমা আছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কেননা, সংসদের আলোচনায় সাংসদদের অনেকেই নানা ধরনের হুমকির সুর তুললেও কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা জানা যায় না। এরপর মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয়–বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবারও টিআইবিকে একহাত নিয়েছেন। এনজিওগুলোতে বিদেশি অর্থায়নের বিষয়ে সরকারের প্রস্তাবিত নতুন আইনের খসড়ায় সংসদ, সংবিধান ও রাষ্ট্র নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দিলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান যুক্ত করার কথা বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে টিআইবি সংসদের বর্তমান অবস্থা বর্ণনায় ‘পুতুলনাচের নাট্যশালা’র যে রূপক ব্যবহার করেছে, সেটিকেই সাংসদরা বড় করে দেখাচ্ছেন। কিন্তু কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশবাসী যে তাঁদের ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ধারণ প্রশ্নে সংসদে গণতান্ত্রিক বিতর্ক ও জবাবদিহি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, সাংসদেরা সেই সমালোচনার কোনো জবাব দিতে আগ্রহী নন।
সাংসদদের এই প্রতিক্রিয়ার জবাবে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘টিআইবি কিছু অসত্য বলে থাকলে ওনারা বলুক, আমরা দুঃখ প্রকাশ করব, সংশোধনী দেব, প্রত্যাহার করব। কিন্তু জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কথা বলার অধিকার নেই, এটা মানছি না। সংসদ নিয়ে কথা বলতে না পারাটা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ।’
সুলতানা কামাল যথার্থই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে বিএনপি আমলে তাঁদের সংস্থাকে আওয়ামী লীগের পকেট সংগঠন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল এবং তখনো টিআইবির বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক, ইফতেখারুজ্জামান অবশ্য একটু বিনয়ী জবাব দিয়ে বলেছেন যে সংসদের আলোচনাকে তাঁরা তাঁদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন।
সংসদের অবমাননা হয়েছে এমনটি মনে হলে সংসদে বিতর্ক অস্বাভাবিক কিছু নয়। ব্যক্তিগতভাবে সাংসদদের কারও অধিকার ক্ষুণ্ন হলে সে বিষয়েও সংসদে আলোচনা হতে পারে এবং তিনি সংসদের অভিভাবক স্পিকারের কাছে তার প্রতিকার চাইতে পারেন। কিন্তু সংসদের মর্যাদা সবার ওপরে—এমন ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিেকরা একক বা গোষ্ঠীগতভাবে সংসদের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও তার সমালোচনা করার অধিকার রাখেন না, এটি মনে করার কোনো সুযোগ আধুনিক রাষ্ট্রে থাকতে পারে না।
নাগরিকদের কাছে সংসদেরও যে জবাবদিহির প্রশ্ন আছে, সেটি পার্লামেন্টের নবাগত কেউ নাও জানতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ, প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান ও পেশাদার রাজনীতিকেরা তা অস্বীকার করলে সেটাকে আর নিরীহ অজ্ঞতা বলা চলে না, বরং তাতে ভোটারদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং অবজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অন্তত পার্লামেন্টারিয়ানদের বৈশ্বিক সংগঠন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ঘোষিত নানা নীতিমালায় সে রকম কথাই বলা আছে।
নাগরিকেরা যাতে সংসদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, সে জন্য অনেক দেশেই সংসদ ভবন এমনভাবে নির্মাণ করা হয় যে ভবনটির বাইরে থেকেও অধিবেশনকক্ষের ভেতরে নজরদারি করা যায়। বার্লিনে জার্মান সংসদ ভবন তার একটি দৃষ্টান্ত। আবার আমাদের জাতীয় সংসদের মতো যেসব ভবনে বাইরে থেকে অধিবেশনকক্ষে চোখ রাখার সুযোগ নেই, সেসব জায়গায় প্রেস গ্যালারি ও দর্শক গ্যালারি থেকে সাংসদদের ওপর নজরদারির ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। সম্প্রতি ভারত ও ব্রিটেনে অধিবেশনকক্ষে বসে ট্যাবলেট বা আইপ্যাডে নীল ছবি (পর্নোগ্রাফি) দেখার চিত্র অন্যের ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর সভা থেকে তাঁদের সাময়িক বহিষ্কারের খবর এটিই প্রমাণ করে যে কার্যকর গণতন্ত্রে সাংসদদের ওপর নাগরিক নজরদারির আলাদা গুরুত্ব আছে।
এ তো গেল সংসদ বা পার্লামেন্টের স্থাপনা বা অবকাঠামোতে নাগরিকদের নজরদারির সুবিধা রাখার প্রশ্ন। কিন্তু পার্লামেন্টে নজরদারির আইনগত ব্যবস্থাও একাধিক দেশে আছে। আমাদের পরে গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে—এমন দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় আইন করে নাগরিকদের সংসদের অধিবেশনে যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে (সূত্র: পার্লামেন্ট অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি: আ গাইড টু গুড প্র্যাকটিস, প্রকাশক: ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন, আইপিইউ, ২০০৬)।
গণতন্ত্রের তীর্থকেন্দ্র বা মাদার অব অল পার্লামেন্ট খ্যাত ব্রিটিশ সংসদ, ওয়েস্টমিনস্টারে সাংসদদের নৈতিকতার বিষয়টিতে নজরদারি করার জন্য আছে স্বাধীন সংস্থা, ইনডিপেনডেন্ট পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি, আইপিএসএ। টেলিগ্রাফ পত্রিকা দেশটির এমপিদের নানা অজুহাতে খরচ হিসেবে অন্যায়ভাবে নানা ধরনের ভাতা নেওয়ার যে হিসাব তুলে ধরেছিল, তার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকবে। এমপিদের ওই কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ ঠেকানোর জন্য সেখানেও কিছু এমপি-মন্ত্রী হুংকার দিয়েছিলেন যে সংসদের অবমাননা গ্রহণযোগ্য নয়। সে সময়ে এমপিদের নীতিনৈতিকতার বিষয়টি ছিল পার্লামেন্টের নিজস্ব এখতিয়ার। সেই স্বশাসন (সেলফ রেগুলেশন) কাজে না আসায় শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে আইন করে প্রতিষ্ঠিত হয় আইপিএসএ (সূত্র: আইপিএসএ ওয়েবসাইট)। বাইরের লোক, বিশেষ করে হিসাব বিশেষজ্ঞদের নজরদারিতে ওয়েস্টমিনস্টারের অবশ্য কোনো মানহানি হয়নি।
আমরা গর্ব করি যে সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী বিশ্বের ১৬৬টি দেশের সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন আইপিইউর সভাপতি এবং স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) চেয়ারপারসন। সোমবার জাতীয় সংসদের বিতর্কে এই দুটি মহান সংগঠনের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সাংসদদের কেউ আইপিইউর প্রকাশনাটি পড়ে দেখেছেন কি না সন্দেহ।
পার্লামেন্ট অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি: আ গাইড টু গুড প্র্যাকটিস-এর মুখবন্ধে সাবের হোসেন চৌধুরীর একজন পূর্বসূরি পিয়ের ফার্দিনান্দো ক্যাসিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সময়ের গোলকধাঁধা (প্যারাডক্স) হচ্ছে আমরা যখন গণতন্ত্রের বিজয়কে স্বাগত জানাই, তখন অনেক দেশেই গণতন্ত্রের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান পার্লামেন্ট বৈধতার সংকটে ভুগছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্বাহী বিভাগের প্রাধান্য এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তাতে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের অভাব ঘটছে এবং মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে যে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও পার্লামেন্ট তাদের বৈচিত্র্যময় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম কি না।’ কোনো সংসদ গণতান্ত্রিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য তিনি পাঁচটি শর্ত পূরণের কথা বলেছেন। এগুলো হলো প্রতিনিধিত্ব, স্বচ্ছতা, সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, জবাবদিহি ও কার্যকারিতা।
নাগরিকদের কাছে জবাবদিহির জন্য সাংসদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তাঁকে অপসারণের ব্যবস্থাও চালু আছে উগান্ডার মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে। এতটা গণতান্ত্রিক সংস্কার আমাদের দেশে সহসা যে সম্ভব নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু পার্লামেন্ট ওয়াচের মতো সীমিত নজরদারির অধিকারটুকুও যদি নাগরিকদের না থাকে, তাহলে কি এ কথা বলা যাবে যে আমরা একুশ শতকের গণতন্ত্রে আছি?
গণতন্ত্র শুধু সংসদ আর রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নয়, গণতন্ত্রে এখন নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই নাগরিক সংগঠন বা এনজিওগুলোকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ভয়ভীতি দেখানো কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। গণতন্ত্রায়ণে গত দুই দশকে এনজিও বা সুশীল সমাজের কাছ থেকে যেসব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য-সমর্থন নিতে হয়েছে, সেগুলোর কথা ক্ষমতাসীনেরা এত দ্রুত বিস্মৃত হন কীভাবে তা সত্যিই একটা বিস্ময়। ব্রিটেনে প্রকৃত বিরোধী দলকে আলংকারিক ভাষায় বলা হয় ‘হার রয়াল অপজিশন’ কেননা, দেশটি রাজতান্ত্রিক ও রাজ্যের সিংহাসনে আসীন আছেন রানি এলিজাবেথ। কিন্তু আমাদের দেশে? এখানে যদি অপজিশন হয় ‘হার (প্রধানমন্ত্রীর) লয়াল (অনুগত) অপজিশন’, তাহলে কোনো নাগরিক গোষ্ঠী সংসদের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে কীভাবে ‘অসত্য’ অভিহিত করা যায়?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক।
কিন্তু এবারের রিপোর্টে ক্ষুব্ধ হয়ে বর্তমান সাংসদেরা টিআইবির মূল্যায়নকে সংবিধান পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছেন। সোমবার এক অনির্ধারিত আলোচনায় সংসদের সমালোচনা করার এখতিয়ার কোনো এনজিওর আছে কি না, এই প্রশ্ন তুলে তাঁরা টিআইবিকে সংসদে তলব করে শাস্তি দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। অনেক প্রবীণ সাংসদ তাঁদের বক্তব্যে টিআইবিকে সংসদের বাইরের বিরোধী দল বিএনপির পকেট সংগঠন বলেও অভিহিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, শাস্তি এড়াতে হলে টিআইবিকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হবে।
অবশ্য পুরো পর্যবেক্ষণই প্রত্যাহার করতে হবে কি না অথবা ক্ষমা চাওয়ার জন্য কোনো সময়সীমা আছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কেননা, সংসদের আলোচনায় সাংসদদের অনেকেই নানা ধরনের হুমকির সুর তুললেও কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা জানা যায় না। এরপর মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয়–বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবারও টিআইবিকে একহাত নিয়েছেন। এনজিওগুলোতে বিদেশি অর্থায়নের বিষয়ে সরকারের প্রস্তাবিত নতুন আইনের খসড়ায় সংসদ, সংবিধান ও রাষ্ট্র নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দিলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান যুক্ত করার কথা বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে টিআইবি সংসদের বর্তমান অবস্থা বর্ণনায় ‘পুতুলনাচের নাট্যশালা’র যে রূপক ব্যবহার করেছে, সেটিকেই সাংসদরা বড় করে দেখাচ্ছেন। কিন্তু কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে দেশবাসী যে তাঁদের ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ধারণ প্রশ্নে সংসদে গণতান্ত্রিক বিতর্ক ও জবাবদিহি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, সাংসদেরা সেই সমালোচনার কোনো জবাব দিতে আগ্রহী নন।
সাংসদদের এই প্রতিক্রিয়ার জবাবে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘টিআইবি কিছু অসত্য বলে থাকলে ওনারা বলুক, আমরা দুঃখ প্রকাশ করব, সংশোধনী দেব, প্রত্যাহার করব। কিন্তু জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কথা বলার অধিকার নেই, এটা মানছি না। সংসদ নিয়ে কথা বলতে না পারাটা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ।’
সুলতানা কামাল যথার্থই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে বিএনপি আমলে তাঁদের সংস্থাকে আওয়ামী লীগের পকেট সংগঠন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল এবং তখনো টিআইবির বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক, ইফতেখারুজ্জামান অবশ্য একটু বিনয়ী জবাব দিয়ে বলেছেন যে সংসদের আলোচনাকে তাঁরা তাঁদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন।
সংসদের অবমাননা হয়েছে এমনটি মনে হলে সংসদে বিতর্ক অস্বাভাবিক কিছু নয়। ব্যক্তিগতভাবে সাংসদদের কারও অধিকার ক্ষুণ্ন হলে সে বিষয়েও সংসদে আলোচনা হতে পারে এবং তিনি সংসদের অভিভাবক স্পিকারের কাছে তার প্রতিকার চাইতে পারেন। কিন্তু সংসদের মর্যাদা সবার ওপরে—এমন ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিেকরা একক বা গোষ্ঠীগতভাবে সংসদের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও তার সমালোচনা করার অধিকার রাখেন না, এটি মনে করার কোনো সুযোগ আধুনিক রাষ্ট্রে থাকতে পারে না।
নাগরিকদের কাছে সংসদেরও যে জবাবদিহির প্রশ্ন আছে, সেটি পার্লামেন্টের নবাগত কেউ নাও জানতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ, প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান ও পেশাদার রাজনীতিকেরা তা অস্বীকার করলে সেটাকে আর নিরীহ অজ্ঞতা বলা চলে না, বরং তাতে ভোটারদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং অবজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অন্তত পার্লামেন্টারিয়ানদের বৈশ্বিক সংগঠন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ঘোষিত নানা নীতিমালায় সে রকম কথাই বলা আছে।
নাগরিকেরা যাতে সংসদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, সে জন্য অনেক দেশেই সংসদ ভবন এমনভাবে নির্মাণ করা হয় যে ভবনটির বাইরে থেকেও অধিবেশনকক্ষের ভেতরে নজরদারি করা যায়। বার্লিনে জার্মান সংসদ ভবন তার একটি দৃষ্টান্ত। আবার আমাদের জাতীয় সংসদের মতো যেসব ভবনে বাইরে থেকে অধিবেশনকক্ষে চোখ রাখার সুযোগ নেই, সেসব জায়গায় প্রেস গ্যালারি ও দর্শক গ্যালারি থেকে সাংসদদের ওপর নজরদারির ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। সম্প্রতি ভারত ও ব্রিটেনে অধিবেশনকক্ষে বসে ট্যাবলেট বা আইপ্যাডে নীল ছবি (পর্নোগ্রাফি) দেখার চিত্র অন্যের ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর সভা থেকে তাঁদের সাময়িক বহিষ্কারের খবর এটিই প্রমাণ করে যে কার্যকর গণতন্ত্রে সাংসদদের ওপর নাগরিক নজরদারির আলাদা গুরুত্ব আছে।
এ তো গেল সংসদ বা পার্লামেন্টের স্থাপনা বা অবকাঠামোতে নাগরিকদের নজরদারির সুবিধা রাখার প্রশ্ন। কিন্তু পার্লামেন্টে নজরদারির আইনগত ব্যবস্থাও একাধিক দেশে আছে। আমাদের পরে গণতন্ত্রায়ণ ঘটেছে—এমন দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় আইন করে নাগরিকদের সংসদের অধিবেশনে যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে (সূত্র: পার্লামেন্ট অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি: আ গাইড টু গুড প্র্যাকটিস, প্রকাশক: ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন, আইপিইউ, ২০০৬)।
গণতন্ত্রের তীর্থকেন্দ্র বা মাদার অব অল পার্লামেন্ট খ্যাত ব্রিটিশ সংসদ, ওয়েস্টমিনস্টারে সাংসদদের নৈতিকতার বিষয়টিতে নজরদারি করার জন্য আছে স্বাধীন সংস্থা, ইনডিপেনডেন্ট পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি, আইপিএসএ। টেলিগ্রাফ পত্রিকা দেশটির এমপিদের নানা অজুহাতে খরচ হিসেবে অন্যায়ভাবে নানা ধরনের ভাতা নেওয়ার যে হিসাব তুলে ধরেছিল, তার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকবে। এমপিদের ওই কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ ঠেকানোর জন্য সেখানেও কিছু এমপি-মন্ত্রী হুংকার দিয়েছিলেন যে সংসদের অবমাননা গ্রহণযোগ্য নয়। সে সময়ে এমপিদের নীতিনৈতিকতার বিষয়টি ছিল পার্লামেন্টের নিজস্ব এখতিয়ার। সেই স্বশাসন (সেলফ রেগুলেশন) কাজে না আসায় শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে আইন করে প্রতিষ্ঠিত হয় আইপিএসএ (সূত্র: আইপিএসএ ওয়েবসাইট)। বাইরের লোক, বিশেষ করে হিসাব বিশেষজ্ঞদের নজরদারিতে ওয়েস্টমিনস্টারের অবশ্য কোনো মানহানি হয়নি।
আমরা গর্ব করি যে সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী বিশ্বের ১৬৬টি দেশের সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন আইপিইউর সভাপতি এবং স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) চেয়ারপারসন। সোমবার জাতীয় সংসদের বিতর্কে এই দুটি মহান সংগঠনের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সাংসদদের কেউ আইপিইউর প্রকাশনাটি পড়ে দেখেছেন কি না সন্দেহ।
পার্লামেন্ট অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি: আ গাইড টু গুড প্র্যাকটিস-এর মুখবন্ধে সাবের হোসেন চৌধুরীর একজন পূর্বসূরি পিয়ের ফার্দিনান্দো ক্যাসিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সময়ের গোলকধাঁধা (প্যারাডক্স) হচ্ছে আমরা যখন গণতন্ত্রের বিজয়কে স্বাগত জানাই, তখন অনেক দেশেই গণতন্ত্রের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান পার্লামেন্ট বৈধতার সংকটে ভুগছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্বাহী বিভাগের প্রাধান্য এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তাতে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের অভাব ঘটছে এবং মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে যে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও পার্লামেন্ট তাদের বৈচিত্র্যময় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম কি না।’ কোনো সংসদ গণতান্ত্রিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য তিনি পাঁচটি শর্ত পূরণের কথা বলেছেন। এগুলো হলো প্রতিনিধিত্ব, স্বচ্ছতা, সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, জবাবদিহি ও কার্যকারিতা।
নাগরিকদের কাছে জবাবদিহির জন্য সাংসদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে তাঁকে অপসারণের ব্যবস্থাও চালু আছে উগান্ডার মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে। এতটা গণতান্ত্রিক সংস্কার আমাদের দেশে সহসা যে সম্ভব নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু পার্লামেন্ট ওয়াচের মতো সীমিত নজরদারির অধিকারটুকুও যদি নাগরিকদের না থাকে, তাহলে কি এ কথা বলা যাবে যে আমরা একুশ শতকের গণতন্ত্রে আছি?
গণতন্ত্র শুধু সংসদ আর রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নয়, গণতন্ত্রে এখন নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই নাগরিক সংগঠন বা এনজিওগুলোকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ভয়ভীতি দেখানো কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। গণতন্ত্রায়ণে গত দুই দশকে এনজিও বা সুশীল সমাজের কাছ থেকে যেসব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য-সমর্থন নিতে হয়েছে, সেগুলোর কথা ক্ষমতাসীনেরা এত দ্রুত বিস্মৃত হন কীভাবে তা সত্যিই একটা বিস্ময়। ব্রিটেনে প্রকৃত বিরোধী দলকে আলংকারিক ভাষায় বলা হয় ‘হার রয়াল অপজিশন’ কেননা, দেশটি রাজতান্ত্রিক ও রাজ্যের সিংহাসনে আসীন আছেন রানি এলিজাবেথ। কিন্তু আমাদের দেশে? এখানে যদি অপজিশন হয় ‘হার (প্রধানমন্ত্রীর) লয়াল (অনুগত) অপজিশন’, তাহলে কোনো নাগরিক গোষ্ঠী সংসদের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে কীভাবে ‘অসত্য’ অভিহিত করা যায়?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক।
No comments