বিহারি গণতন্ত্রের আসল ছবি by মিজানুর রহমান খান

কোনো সন্দেহ নেই, বিহারের নির্বাচন শাসক বিজেপির অহংকার ও ঔদ্ধত্য উভয়কে চূর্ণ করেছে। নরেন্দ্র মোদি-অমিতের লাখো কোটি টাকার উন্নয়ন উৎকোচকে বিহারের মানুষ না বলেছে। প্রমাণিত হয়েছে গরু দুধ দেয় ভোট দেয় না। দাদরি কাণ্ড, শাহরুখ খান, মুসলিম জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, গোমাংস ভক্ষণ করলে হয় পাকিস্তানে নির্বাসন অথবা মুণ্ডুচ্ছেদ থেকে শুরু করে ‘বিজেপি হারলে পাকিস্তানে বাজি ফাটবে’ মর্মে দলের নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদেরাও যে ক্রমাগত বিভাজন ও ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়েছিলেন, তার একটা উচিত শিক্ষা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হতেই পারে।
তবে ভারতীয়সহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যতটা উৎসাহ-উদ্দীপনায় বিহারের নির্বাচনে বিজেপির ‘ভরাডুবির’ চিত্র তুলে ধরেছে এবং এর ফলাফলকে অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতা, বিশেষ করে গরুর রাজনীতির বিরুদ্ধে আমজনতার গণরায় হিসেবে দেখানোর প্রবণতাকে ফুটিয়ে তুলেছে, তা-ই পুরোটা নয়, বরং খণ্ডিত। মিডিয়া প্রধানত যেকোনো সমাজের প্রগতিশীল অংশের ধ্যানধারণাকে সামনে আনার স্বাভাবিক প্রবণতা দেখিয়ে থাকে। হিন্দু মৌলবাদী দর্শন থেকে বিচ্যুত না থাকা বিজেপির ‘ভরাডুবির’ খবর প্রকাশের ধরন সেটাই মনে করিয়ে দিল।
প্রকৃতপক্ষে এই নির্বাচনে বিজেপি বিহারের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়ে একক দল হিসেবে বিজেপিই সর্বাধিক ভোট পেয়েছে। যদিও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় তাদের ভোট কমেছে। কিন্তু লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন ভিন্ন খেলার বিষয়। ভারতের ইতিহাসে গত লোকসভা নির্বাচনটি মোদি-জাদুর কল্যাণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রূপ নিয়েছিল। বোদ্ধারা যখন একমত যে মোদি-জাদুর ইন্দ্রজাল ছিন্ন হতে চলেছে, তখন দেখার বিষয় হলো বিহারে বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায়ও মাত্র ৫ শতাংশ ভোট খুইয়েছে। সুতরাং আমাদের দেশের সাধারণ নির্বাচনের পরে পরাজিত দলকে ‘জনগণ প্রত্যাখ্যান’ করেছে মর্মে যে আজগুবি ও গণতন্ত্রবিরোধী শিরোনাম করা হয়, সেটা বিজেপির ক্ষেত্রে খাটবে না। তবে ব্যক্তি মোদির শাসনগত অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার বিরূপ প্রভাব যে বিহারে পড়েছে এবং অন্যান্য নির্বাচনে আরও পড়বে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ কী।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে পাটিগণিতের হিসাবে আওয়ামী লীগ হেরে গিয়েছিল। বিএনপির চেয়ে বেশি ভোট পেলেও তারা সংসদে আসনসংখ্যা বিএনপির চেয়ে কম পেয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগ সরকার গড়তে পারেনি, সরকার গড়েছে বিএনপি। পাটিগণিতের জোর তাই বলে কম নয়, নিশ্চয় এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেদিন সরকার গড়তে পারেনি বলে সমাজে তার শক্তিকে খাটো করে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। ঠিক তেমনিভাবে বিহারে বিজেপি সরকার গড়তে পারেনি বলে সেখানে তার শক্তিকে খাটো করে দেখা যাবে না। সুতরাং বিহারের নির্বাচনে আসন ও ভোটসংখ্যা উভয় দিক বিবেচনায় না নিলে বিহারি গণতন্ত্রের আসল ছবি চোখের আড়ালে থেকে যাবে।
বিজেপির সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের নীতি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হম্বিতম্বির প্রতিবাদ জানাতে ভারতজুড়ে প্রথিতযশা লেখক-সাহিত্যিকেরা পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল বেরোনোর কারণেও বিজেপির প্রতি নাগরিক সমাজের পুরোনো জনপ্রিয় নেতিবাচক মনোভাবটা আবার মিডিয়ায় জায়গা পেতে শুরু করেছে। মোদি-জাদুতে সম্মোহিত মিডিয়া প্রায় ভুলিয়ে দিতে বসেছিল যে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দলের অনেক বাঘা নেতার বিরুদ্ধে অতীতে কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী কথাটি স্বাভাবিক বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষ ও পরমতসহিষ্ণু শক্তিতে পরিণত হয়েছিল বলে ভারতবাসী মোদিকে দুই হাত ভরে ভোট দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সরকারের কীর্তিকলাপ দেখে জনগণের ঘুম ভেঙেছে, আর তাই বিহারে তাঁরা প্রতিশোধ নিয়েছেন— বিষয়টি হয়তো এমন নয়। তবে এ রকম দৃষ্টিভঙ্গির ভিত একেবারেই যে নেই, তা নয়। আমাদের দেখতে হবে যে ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত বিহার কখনো বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী দেখেনি। ১৯৯০ সালের মার্চে সবশেষ কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রীর জমানা শেষ হওয়ার পরে এই রাজ্য আর কখনো কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীর অধিষ্ঠান দেখেনি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সরকার গড়বে কি গড়বে না, সেটা কখনো আলোচনারই যোগ্য বিষয় ছিল না। তাদের প্রার্থীরা হরদম জামানত খোয়াতেন। সেই দিন ধীরে হলেও বিজেপির অনুকূলে বদলাচ্ছে। আজ বিহারে বিজেপির তথাকথিত ভরাডুবির খবর যেভাবে ফলাও করে বিশ্ব মিডিয়ায় জায়গা করে নিয়েছে, আসলে তাতে দলটির কেবলই দুর্বলতা নয়, বরং শক্তির উত্থানও দেখা যায়। সংক্ষেপে মানেটা দাঁড়াচ্ছে, বিজেপি এখন বিহারে সরকার গঠন করবে, সেটাই স্বাভাবিক ছিল, আর এখন হেরে গেছে বলেই বড় শিরোনাম হয়েছে। অথচ সত্য এটাই, বিহারে বিজেপি কখনো এককভাবে সরকার করতে পারেনি। বিহার এখনো বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পায়নি। কিন্তু জাতপাতের প্রাধান্যধর্মী বিহারি রাজনীতিতে বিজেপির জনপ্রিয়তা অব্যাহতভাবে ক্রমবর্ধমান।
বিজেপি নেতা অমিত শাহ বলেছিলেন, ক্ষমতাসীন জনতা দলের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারকে একটি ভোট দেওয়ার অর্থ হবে পাকিস্তানকে খুশি করা। নিতীশের বিজয় পাকিস্তানিরা উদ্যাপন করবে। এটা কেবলই বিদ্বেষপ্রসূত নয়, ভোটারদেরও আহত ও অপমান করা। বিজেপিকে সরকার গড়তে না দিয়ে জনগণ তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন। কিন্তু আমরা মনে রাখব, জনতা দলের নিতীশ কুমারের সঙ্গে বিজেপির আপস ও সমঝোতার রাজনীতি কিন্তু নিকট অতীতের বিষয়। ২০১০ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে ছবিটি আরও স্পষ্ট হবে। ওই বছরে নিতীশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দলের সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপি প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিজেপির ভোট বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। নিতীশ এবার তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী। ২০০৫ সালে প্রথম বাজপেয়ি ও আদভানির আশীর্বাদ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০০০ সালেও সাত দিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেই হিসাবে বলা যায়, নিতীশ আমলে বিজেপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের এমন অবনতি ঘটবে না, যাতে তাঁর পক্ষে সরকার পরিচালনা করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০০৫ ও ২০১০ সালে নিতীশ তাঁর রাজ্য মন্ত্রিসভায় যথাক্রমে বিজেপির ৮ ও ১০ জনকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। জনতা-বিজেপি জোটের নির্বাচনে ২০০৫ সালে জনতা দল ৫৫ ও বিজেপি ৩৭টি আসন পেয়েছিল। ২০১০ সালেও তারা জোট করে নির্বাচন করে। তবে উভয়ের আসন বাড়ে। জনতা ১১৫ ও বিজেপি ৯১টি আসন পায়। এবারেও বিজেপি পেয়েছে ৫৮টি।
পরিহাস হলো, বিহারে নিতীশের দলের সঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক ও সরকার পরিচালনাগত ঐক্য একটানা ১৭ বছর টিকে থাকার পরে ২০১৩ সালে ভেঙে গেল নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির প্রধান হিসেবে প্রস্তাব অনুমোদনের ঘটনায়।
বিহারের নির্বাচনী ফলের জাতীয় প্রভাব কী, তার চেয়ে বিহারের রাজনীতিতে তার প্রভাব কী, সেটাই বেশি কৌতূহলের সঙ্গে দেখার বিষয়। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির প্রতিভূ হিসেবে বিবেচিত এবং ভারতের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর সেনানীর ছেলে নিতীশ কুমার ১৭ বছর ধরে রাজ্যের উন্নয়ন ও স্থিতিশীল বিধানসভা ও সরকার পরিচালনার স্বার্থে বিজেপির সঙ্গে কর্মসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। যদিও নিতীশ মোদির বিরুদ্ধে তাঁর প্রকাশ্য উষ্মার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সব সময় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। মোদির উপস্থিতি কাম্য নয় বলে তিনি টানা তিন বছর জ্যেষ্ঠ বিজেপি নেতাদের সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নেননি। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে রাজ্য বিজেপিকে নিতীশ আলটিমেটাম দিয়েছিলেন যে তাঁদের সঙ্গে থাকতে হলে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য সেক্যুলার মনোভাবের কাউকে প্রার্থী করতে হবে। সুতরাং দেখার বিষয় হলো মতাদর্শগতভাবে বিপরীত মেরুর দলের সঙ্গে সরকার করা চলে। হয়তো নিতীশ গোড়াতেই বুঝতে পেরেছেন যে রাজনৈতিক বা সরকারব্যবস্থাটায় কোনো ব্যক্তি বা দলের একচেটিয়া অধিকার নেই। আমাদেরও উচিত বিহারের পাঠ নেওয়া।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতেই হয় যে খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক সমঝোতা করার সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন। ইনডেমনিটি বিল বাতিল, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রশ্রয় না দিয়ে আগস্ট ও জেলহত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটানোর মতো বিষয়ে খালেদা জিয়া কোনো ধরনের কার্যকর সমঝোতায় যেতে চাননি। আওয়ামী লীগ পঞ্চম সংসদকে অকার্যকর করে দিয়েছিল। তারা যে সংখ্যায় বিএনপির চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল, সেটাই তারা জোর গলায় প্রচার চালিয়েছে।
বিহারে দেখার বিষয়, বিজেপি কীভাবে তাদের পাটিগণিত পরাজয় থেকে শিক্ষা নেয়। কারণ, সময়টা একনায়কসুলভ আচরণ প্রদর্শনের। গোমাংস বিতর্কের আড়ালে অনেকটা নিজেদের ‘বর্ণগত’ শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার প্রবণতা আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছিলাম। বহুত্ববাদের পরিবর্তে আমিত্ব প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল। জায়গা করে নিচ্ছে অন্ধত্ব। গোমাংস বিতর্কে ইন্দ্রদেব গোমাংস খেতেন বলে অনেকে বিজেপিকে সংবরণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু যুক্তিতে কান দেওয়ার মতো কান নেই হয়তো। এর কারণটা বলেছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর গবেষণা করেছেন। গতকাল তাঁর লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘কারণ, তাঁরা ইন্দ্রদেবের থেকে নরেন্দ্রদেবের ওপরে বেশি আস্থা রাখেন।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.