যাঁরা দল করেন না, তাঁদের চাকরি কে দেবে? by আলী ইমাম মজুমদার
বিষয়টি
এখন বাংলাদেশের প্রশাসনে একটি মৌলিক প্রশ্ন হিসেবে আসছে। এ সংস্কৃতির
সূচনা প্রায় দেড় দশক আগে থেকে। এর আগে কমবেশি কিছু থাকলেও এখন অনেকটা
ব্যাপক ও খোলামেলা হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে পেয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। দেশে
রাজনৈতিক দল আছে, থাকবেও। এগুলোর নেতা, কর্মী, সমর্থকও আছেন অনেকে। তবে সব
নাগরিকই কিন্তু সরাসরি দলগুলোর কর্মী বা সমর্থক নন। হওয়ার বাধ্যবাধকতা
কিংবা প্রয়োজনীয়তাও নেই। তাঁরা দলনিরপেক্ষ। নির্বাচন এলে দলগুলোর
পূর্বাপর ভূমিকা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে প্রার্থীর গুণাগুণ বিবেচনায় ভোট
দেন। প্রভাব থাকে আঞ্চলিকতা, সম্প্রদায় ও গোত্রের। বলা অসংগত নয় যে কোনো
কোনো স্থানের নির্বাচনে ফলাফলে দলের ভূমিকা গৌণই হয়ে যায়। এভাবে
প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছু স্থানে দল বা ব্যক্তির নির্বাচনের ফলাফলে নির্ণায়ক
ভূমিকা পালন করেন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিরাই।
তবে তাঁরা কোনো দলের সদস্য বা স্থায়ীভাবে সমর্থকও নন। তাঁরা কিন্তু এখন মহা মসিবতে আছেন। সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধায় তাঁরা পেছনের কাতারে। চাকরির বাজারে তাঁদের প্রবেশাধিকার সীমিত। বেসামরিক চাকরিতে পিএসসির মাধ্যমে পরীক্ষায় মেধার কিছুটা ভূমিকা থাকে। তবে তা–ও সময়ান্তরে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আর অন্যান্য চাকরিতে দলের নাম করে নেতা-কর্মীদের সনদ ছাড়া প্রবেশ প্রায় অসম্ভব। সেই সনদ অবশ্য ভিন্ন দলের লোকেরাও ক্ষেত্রবিশেষে জোগাড় করেন নানা কৌশলে। কোথাও কোথাও টাকাপয়সার লেনদেন বড় রকম ভূমিকা রাখে বলে পত্রপত্রিকায় অভিযোগ আসে। আর এর সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাও আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিরা হয়ে পড়ছেন অচ্ছুত। তাঁদেরও আজ দুঃসময় চলছে।
সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিকে খবর এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগ প্রসঙ্গে। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি দাবি করেছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি আওয়ামী লীগ করেন বলেই এ পদ লাভ করেছেন। তাঁর এ বক্তব্য যথার্থ বলেই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। শুধু রাজশাহীতে নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এ নিয়মটাই এখন অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দফাতেই ৫৪৪ জন দলীয় সদস্যকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর এ বক্তব্যও তথ্যভিত্তিক। পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করেছেন, বর্তমানে পাঁচ শতাধিক শূন্য পদের মধ্যে ‘স্বাধীনতার পক্ষের দেড়-দুই-আড়াই শ ছেলেকে কি চাকরি দেওয়া যায় না?’
এখন যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁরাও হয়তো রাজনৈতিক পালাবদলের আশায় অপেক্ষা করছেন। ‘সুদিন’ এলে সুদাসলে পুষিয়ে দেবেন!
যিনি এ বক্তব্যটি দিয়েছেন, তিনি শুধু ক্ষমতাসীন দলের মহানগর কমিটির সভাপতি নন, পাঁচ বছর এ মহানগরীর নির্বাচিত মেয়রও ছিলেন। তিনি জেলহত্যার শিকার স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্রনায়ক চার নেতার একজনের সন্তান। এসব বিবেচনায় অতি সম্মানিত ও দায়িত্বশীল নাগরিক তিনি। সুতরাং তাঁর বক্তব্যও গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
প্রথমেই দেখা দরকার, তিনি স্বাধীনতার পক্ষের লোক বলতে কাদের বোঝাতে চাইছেন। এ বিষয়ে খুব গভীরে না গেলেও বলা চলে, সম্ভবত তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের কথাই বলতে চেয়েছেন। অনস্বীকার্য, তাঁর দল স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে রাখতেও তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। এর বাইরে যেসব দলীয় বা নির্দলীয় লোক আছেন, তাঁদের পাইকারিভাবে নিশ্চয়ই স্বাধীনতাবিরোধী বলা যাবে না। দেশপ্রেমিক যে-কেউ হতে পারেন। এমনকি নেতারা যাঁদের চেনেন না বা জানেন না, তাঁরাও। দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের বিপরীতে কারও অবস্থান থাকলে তাঁর স্থান তো আইনানুগভাবে প্রমাণ সাপেক্ষে হওয়ার কথা কারাগার। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ এ ধরনের বিভাজনের কর্তৃত্ব নিতে পারেন না। আজ স্বাধীনতার পক্ষের নাম দিয়ে যাঁদের চাকরি দেওয়ার কথা উঠেছে, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতাসীন দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী বা তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি। অবশ্য তিনি পুরো শূন্য পদের বিপরীতে তাঁর তালিকা দেননি। তবে নিয়োগপর্ব শুরু হলে তাঁর দলের এমনকি অঙ্গসংগঠনের অন্য নেতারাও বসে থাকবেন না। সক্রিয় হবেন জোটের অন্য দলের কোনো কোনো নেতাও।
এমনটাই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীর সংখ্যা শূন্য পদকেও ছাড়িয়ে যায় প্রায় কিছু ক্ষেত্রে। তখন কর্তৃপক্ষ কী করবে? আর এভাবে শুধু তালিকা ধরেই যদি চাকরি দিয়ে দিতে হয়, তাহলে নিয়োগের এত ধরনের বিধিবিধান কেন? হতে পারে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকতে তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দলীয় বিবেচনায় এ ধরনের নিয়োগ দিয়েছে। আর এরই কারণে তো তারা ২০০৮–এর নির্বাচনে চরম খেসারতও দিয়েছে। এখনো দিয়ে চলছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের থাকা উচিত। নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে এ ধরনের নিয়োগ দেওয়া সমীচীন মনে করবে না দেশের সচেতন মহল। আর আগের সরকারের সময়েও তা করেনি। এ ধরনের নিয়োগ গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে বারংবার। সেই ধারাবাহিকতা ভাঙা আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকারই ২০০৮ সালে মহাজোটের মহাবিজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।
অবশ্য দুর্ভাগ্য, অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষেত্রেই। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের শূন্য পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হলে রাজনৈতিক নেতারা তালিকা ধরিয়ে দেন। এর বিপরীতে অবস্থান নিলে পরীক্ষাকেন্দ্র ভাঙচুর, দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নাজেহাল আর জেলা প্রশাসককে হয়রানিমূলক বদলির শিকার হতে হয়। ঠিক তেমনই অবস্থা পুলিশ কনস্টেবল ও এসআই নিয়োগের ক্ষেত্রে। নিয়োগের পর্ব শুরু হলে কোনো কোনো এসপি ছুটি নিয়ে রেহাই পেতে চান বিড়ম্বনা থেকে। একই ‘তালিকা আখ্যান’। আর এ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য বড় অঙ্কের লেনদেনের কাহিনিও গণমাধ্যমে বারংবার আসে। এই ধারাবাহিকতা চলছে বেসামরিক প্রশাসনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রসারের উদ্দেশ্যে বিধি সংশোধন করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তো বটেই, বেসরকারি স্কুল-কলেজেও নিয়োগের ক্ষেত্রে চলছে একই সংস্কৃতি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করে নিবন্ধের সূচনা। তবে অন্য বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়েও এমনটা ঘটে চলেছে। এ ধরনের চাপ দিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় শাসক দলের ছাত্রসংগঠন।
তাহলে যাঁরা এ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট হতে পারছেন না, তাঁরা যাবেন কোথায়? এর জবাব অন্য কেউ দেবে না। খুঁজতে হবে আমাদের নিজেদেরই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকবে। মনে হয়, তারা সবাই ধরে নিচ্ছে ক্ষমতায় গেলে শুধু তাদের কর্মী-সমর্থকদের চাকরি হবে। এখন যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁরাও হয়তো রাজনৈতিক পালাবদলের আশায় অপেক্ষা করছেন। ‘সুদিন’ এলে সুদাসলে পুষিয়ে দেবেন! আর আরও বুদ্ধিমানেরা এর জন্য অপেক্ষা করেন না। তাঁরা রং বদলান দ্রুত। এমনকি দীর্ঘদিনের ত্যাগী কর্মী-সমর্থকদেরও পেছনে ফেলে বা বাদ দিয়ে তাঁদের স্থান হয় নেতাদের তালিকায়। এমন অভিযোগ কিন্তু একেবারে কম নয়।
স্বাধীনতার চেতনা ধারণের কথা বলা হয় অনেক ক্ষেত্রে। এমন বলাটা অসংগত নয়। সেই চেতনারই তো ফল আমাদের সংবিধান। সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই এর প্রণেতারা ঘোষণা করেছেন রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করার। প্রস্তাবনার ধারাবাহিকতায় এর মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত অধ্যায়ে প্রজাতন্ত্রের পদে নিয়োগলাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের প্রণেতারা দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এ প্রজাতন্ত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থেকেই এসব বিধান সংযোজন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে চলেছে এর বিপরীত চিত্র। আর যাঁরা এমনটা করছেন, তাঁরা আঘাত করছেন সংবিধানের প্রত্যয়ে। বস্তুতপক্ষে, এ ধরনের আঘাত স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে। আর যে দল ক্ষমতায় আসে, তারা সবাই এরূপ করলেই এটা গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় না। ভবিষ্যতেও হবে না। চাকরির অধিকার তো থাকা উচিত দল–মতনির্বিশেষে সব যোগ্য ব্যক্তির।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
তবে তাঁরা কোনো দলের সদস্য বা স্থায়ীভাবে সমর্থকও নন। তাঁরা কিন্তু এখন মহা মসিবতে আছেন। সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধায় তাঁরা পেছনের কাতারে। চাকরির বাজারে তাঁদের প্রবেশাধিকার সীমিত। বেসামরিক চাকরিতে পিএসসির মাধ্যমে পরীক্ষায় মেধার কিছুটা ভূমিকা থাকে। তবে তা–ও সময়ান্তরে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আর অন্যান্য চাকরিতে দলের নাম করে নেতা-কর্মীদের সনদ ছাড়া প্রবেশ প্রায় অসম্ভব। সেই সনদ অবশ্য ভিন্ন দলের লোকেরাও ক্ষেত্রবিশেষে জোগাড় করেন নানা কৌশলে। কোথাও কোথাও টাকাপয়সার লেনদেন বড় রকম ভূমিকা রাখে বলে পত্রপত্রিকায় অভিযোগ আসে। আর এর সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাও আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিরা হয়ে পড়ছেন অচ্ছুত। তাঁদেরও আজ দুঃসময় চলছে।
সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিকে খবর এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগ প্রসঙ্গে। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি দাবি করেছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি আওয়ামী লীগ করেন বলেই এ পদ লাভ করেছেন। তাঁর এ বক্তব্য যথার্থ বলেই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। শুধু রাজশাহীতে নয়, অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়েছে এবং হচ্ছে। আর এ নিয়মটাই এখন অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দফাতেই ৫৪৪ জন দলীয় সদস্যকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর এ বক্তব্যও তথ্যভিত্তিক। পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করেছেন, বর্তমানে পাঁচ শতাধিক শূন্য পদের মধ্যে ‘স্বাধীনতার পক্ষের দেড়-দুই-আড়াই শ ছেলেকে কি চাকরি দেওয়া যায় না?’
এখন যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁরাও হয়তো রাজনৈতিক পালাবদলের আশায় অপেক্ষা করছেন। ‘সুদিন’ এলে সুদাসলে পুষিয়ে দেবেন!
যিনি এ বক্তব্যটি দিয়েছেন, তিনি শুধু ক্ষমতাসীন দলের মহানগর কমিটির সভাপতি নন, পাঁচ বছর এ মহানগরীর নির্বাচিত মেয়রও ছিলেন। তিনি জেলহত্যার শিকার স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্রনায়ক চার নেতার একজনের সন্তান। এসব বিবেচনায় অতি সম্মানিত ও দায়িত্বশীল নাগরিক তিনি। সুতরাং তাঁর বক্তব্যও গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
প্রথমেই দেখা দরকার, তিনি স্বাধীনতার পক্ষের লোক বলতে কাদের বোঝাতে চাইছেন। এ বিষয়ে খুব গভীরে না গেলেও বলা চলে, সম্ভবত তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের কথাই বলতে চেয়েছেন। অনস্বীকার্য, তাঁর দল স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে রাখতেও তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। এর বাইরে যেসব দলীয় বা নির্দলীয় লোক আছেন, তাঁদের পাইকারিভাবে নিশ্চয়ই স্বাধীনতাবিরোধী বলা যাবে না। দেশপ্রেমিক যে-কেউ হতে পারেন। এমনকি নেতারা যাঁদের চেনেন না বা জানেন না, তাঁরাও। দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের বিপরীতে কারও অবস্থান থাকলে তাঁর স্থান তো আইনানুগভাবে প্রমাণ সাপেক্ষে হওয়ার কথা কারাগার। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ এ ধরনের বিভাজনের কর্তৃত্ব নিতে পারেন না। আজ স্বাধীনতার পক্ষের নাম দিয়ে যাঁদের চাকরি দেওয়ার কথা উঠেছে, তাঁরা নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতাসীন দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী বা তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তি। অবশ্য তিনি পুরো শূন্য পদের বিপরীতে তাঁর তালিকা দেননি। তবে নিয়োগপর্ব শুরু হলে তাঁর দলের এমনকি অঙ্গসংগঠনের অন্য নেতারাও বসে থাকবেন না। সক্রিয় হবেন জোটের অন্য দলের কোনো কোনো নেতাও।
এমনটাই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীর সংখ্যা শূন্য পদকেও ছাড়িয়ে যায় প্রায় কিছু ক্ষেত্রে। তখন কর্তৃপক্ষ কী করবে? আর এভাবে শুধু তালিকা ধরেই যদি চাকরি দিয়ে দিতে হয়, তাহলে নিয়োগের এত ধরনের বিধিবিধান কেন? হতে পারে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকতে তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দলীয় বিবেচনায় এ ধরনের নিয়োগ দিয়েছে। আর এরই কারণে তো তারা ২০০৮–এর নির্বাচনে চরম খেসারতও দিয়েছে। এখনো দিয়ে চলছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের থাকা উচিত। নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে এ ধরনের নিয়োগ দেওয়া সমীচীন মনে করবে না দেশের সচেতন মহল। আর আগের সরকারের সময়েও তা করেনি। এ ধরনের নিয়োগ গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে বারংবার। সেই ধারাবাহিকতা ভাঙা আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকারই ২০০৮ সালে মহাজোটের মহাবিজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।
অবশ্য দুর্ভাগ্য, অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষেত্রেই। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের শূন্য পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হলে রাজনৈতিক নেতারা তালিকা ধরিয়ে দেন। এর বিপরীতে অবস্থান নিলে পরীক্ষাকেন্দ্র ভাঙচুর, দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নাজেহাল আর জেলা প্রশাসককে হয়রানিমূলক বদলির শিকার হতে হয়। ঠিক তেমনই অবস্থা পুলিশ কনস্টেবল ও এসআই নিয়োগের ক্ষেত্রে। নিয়োগের পর্ব শুরু হলে কোনো কোনো এসপি ছুটি নিয়ে রেহাই পেতে চান বিড়ম্বনা থেকে। একই ‘তালিকা আখ্যান’। আর এ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য বড় অঙ্কের লেনদেনের কাহিনিও গণমাধ্যমে বারংবার আসে। এই ধারাবাহিকতা চলছে বেসামরিক প্রশাসনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রসারের উদ্দেশ্যে বিধি সংশোধন করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তো বটেই, বেসরকারি স্কুল-কলেজেও নিয়োগের ক্ষেত্রে চলছে একই সংস্কৃতি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করে নিবন্ধের সূচনা। তবে অন্য বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়েও এমনটা ঘটে চলেছে। এ ধরনের চাপ দিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় শাসক দলের ছাত্রসংগঠন।
তাহলে যাঁরা এ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট হতে পারছেন না, তাঁরা যাবেন কোথায়? এর জবাব অন্য কেউ দেবে না। খুঁজতে হবে আমাদের নিজেদেরই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকবে। মনে হয়, তারা সবাই ধরে নিচ্ছে ক্ষমতায় গেলে শুধু তাদের কর্মী-সমর্থকদের চাকরি হবে। এখন যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁরাও হয়তো রাজনৈতিক পালাবদলের আশায় অপেক্ষা করছেন। ‘সুদিন’ এলে সুদাসলে পুষিয়ে দেবেন! আর আরও বুদ্ধিমানেরা এর জন্য অপেক্ষা করেন না। তাঁরা রং বদলান দ্রুত। এমনকি দীর্ঘদিনের ত্যাগী কর্মী-সমর্থকদেরও পেছনে ফেলে বা বাদ দিয়ে তাঁদের স্থান হয় নেতাদের তালিকায়। এমন অভিযোগ কিন্তু একেবারে কম নয়।
স্বাধীনতার চেতনা ধারণের কথা বলা হয় অনেক ক্ষেত্রে। এমন বলাটা অসংগত নয়। সেই চেতনারই তো ফল আমাদের সংবিধান। সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই এর প্রণেতারা ঘোষণা করেছেন রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করার। প্রস্তাবনার ধারাবাহিকতায় এর মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত অধ্যায়ে প্রজাতন্ত্রের পদে নিয়োগলাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের প্রণেতারা দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এ প্রজাতন্ত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় থেকেই এসব বিধান সংযোজন করেছেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটে চলেছে এর বিপরীত চিত্র। আর যাঁরা এমনটা করছেন, তাঁরা আঘাত করছেন সংবিধানের প্রত্যয়ে। বস্তুতপক্ষে, এ ধরনের আঘাত স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে। আর যে দল ক্ষমতায় আসে, তারা সবাই এরূপ করলেই এটা গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় না। ভবিষ্যতেও হবে না। চাকরির অধিকার তো থাকা উচিত দল–মতনির্বিশেষে সব যোগ্য ব্যক্তির।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments