সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিত্ব ও মন্ত্রিসভা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে পরদিন
অস্থায়ী সংবিধান অর্ডিন্যান্স জারি করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য তিনি ২৩
বছর সংগ্রাম করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে তিনি সংসদীয় গণতান্ত্রিক
পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করেন। এবং ওই দিনই তিনি গঠন করেন তাঁর মন্ত্রিসভা।
তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীরা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন
আহমদ, মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, আবদুস সামাদ আজাদ,
কামারুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, ইউসুফ আলী, জহুর আহমদ চৌধুরী, ফণি মজুমদার
ও কামাল হোসেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটি ছিল সবচেয়ে সফল মন্ত্রিসভা।
কোমলমতি বালক-বালিকারা টিভির পর্দায় দেশ-বিদেশের মন্ত্রীদের দেখে প্রতিদিন। তাদের কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে মন্ত্রিত্ব জিনিসটা আসলে কী? রূপকথার দেশের রাজা-উজিরের কথা আমরা ছোটবেলায় শুনেছি। রূপকথার দেশই আধুনিক রাষ্ট্র। এবং সেই উজিরই আধুনিক রাষ্ট্রে মন্ত্রী। এককালে যাদের বলা হতো প্রজা, এখন তাদের বলা হয় রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্র থাকলে মন্ত্রী থাকবেনই। রাষ্ট্রে যে পদ্ধতির সরকারই থাকুক না কেন, তাতে গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক—মন্ত্রী থাকতেই হবে।
বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন ১১ জন। সেটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে নাজুক সময়। তখন তাঁর দলে মন্ত্রী করার মতো নেতা ছিলেন অন্তত জনা পঞ্চাশ। ওই মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। আমার মতো সামান্য মানুষের সৌভাগ্য হয়েছিল তাতে উপস্থিত থেকে তা প্রত্যক্ষ করার।
সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের মার্চে। সেই নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাস দুই সারা দেশে বহু জনসভায় তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল। ভারতীয় ও পশ্চিমি মিডিয়ার সাংবাদিকেরাও কখনো থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর মতো রাশভারী মানুষের মধ্যে একজন সহজ হাস্যরসিক মানুষ বাস করতেন। নতুন রাষ্ট্রে সীমাহীন সমস্যা। তাঁর বিরুদ্ধশক্তি সংখ্যায় অল্প হলেও খুবই সক্রিয় ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। তার মধ্যেও তিনি হেলিকপ্টারে আমাদের সঙ্গে অতীতের তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বহু ব্যাপারে স্মৃতিচারণামূলক গল্প করতেন। রসিকতা করতেন। নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক পর তিনি তাঁর দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল জমজমাট। বিদেশি কূটনীতিক, সাংবাদিকসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তবে উপস্থিত ছিলেন না জাসদ, ন্যাপ প্রভৃতি পরাজিত দলগুলোর নেতারা। সম্ভবত আমাদের জিনে সংসদীয় গণতন্ত্রের উপাদান অনুপস্থিত। যা হোক, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ আকার ছিল ১৯৯১-পরবর্তী প্রায় সব মন্ত্রিসভার তিন ভাগের এক ভাগ।
অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির মন্ত্রিসভা গঠিত হয় পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর। ভারতবর্ষ তখন ছিল আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত, ওদিকে আসমুদ্রহিমাচল। ব্রিটিশ সরকার তখনো বিদায় নেয়নি, তবে নেওয়ার পথে। ভারতের জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তারা যেতে চান। আগস্ট মাসে তাঁরা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের ডেকে বলেন, আপনারা মিলেমিশে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করুন। স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বড় দল কংগ্রেসের নেতা নেহরুকেই সরকারপ্রধান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। জিন্নাহ নাখোশ। বহু দেনদরবার ও ঝগড়াঝাঁটির পর গঠিত হয় মন্ত্রিসভা। প্রকাণ্ড ভারতবর্ষ। এখনকার অনুপাতে হলে মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার কথা ১ হাজার ২০০-এর কিছু বেশি। আমার কথা এখন সম্ভবত বিশ্বাস করবেন না অনেকেই। উপমহাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল ১৩ সদস্যবিশিষ্ট। পণ্ডিত নেহরুর সেই মন্ত্রিসভায় ছিলেন কংগ্রেসের সর্দার প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জগজীবন রাম, খ্রিষ্টান জন মাথাই, শিখ বলদেব সিং ও সি এইচ ভাবা এবং মুসলিম লীগের মন্ত্রীরা হলেন লিয়াকত আলী খান, আই আই চুন্দ্রীগর, আবদুর রব নিশতার, গজনফর আলী খান ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।
এক বছর পরে ভারত ও পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট, তখন দুই রাষ্ট্রেই সংসদীয় পদ্ধতির মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রিসভা এবং ভারতে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা ছিল ১৪-র কম। অন্যদিকে, যে ভূখণ্ড নিয়ে আজকের বাংলাদেশ, সেটি তখন পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ। এই প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে। তাঁর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন জনা আটেক। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মন্ত্রিসভায় সদস্য ছিলেন সাত-আটজন। পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের মন্ত্রিসভার আকারও ১০ ছাড়ায়নি।
বাংলার মাটিতে মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে গোলমাল চিরকালই হয়েছে। চুয়ান্নর ঐতিহাসিক নির্বাচনের পরে শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় জনা কয়েককে নিয়ে, তার আয়ু ছিল কয়েক সপ্তাহ। টেন্ডার বিশেষজ্ঞ ছাত্র ও যুবনেতা, যাঁদের ছবিসংবলিত বিলবোর্ড ও ডিজিটাল ব্যানারে আজ ভরে গেছে প্রজাতন্ত্রের রাস্তাঘাট, গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খাম্বা, তাঁদের অনেকেই জানেন না আওয়ামী লীগের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে। শেখ মুজিবসহ যে কয়জন সেই কেবিনেটে মন্ত্রী ছিলেন, এখন বাংলাদেশে মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীর সংখ্যা তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি।
মাননীয় মন্ত্রীর একেবারে কাছে গিয়ে সালাম দিতে অথবা হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে আজকাল হুমড়ি খেয়ে পড়ে অনেকেই হাত-পা পর্যন্ত ভাঙেন। কোনো মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ বিধাতার কৃপাদৃষ্টি পাওয়ার শামিল। গত ৪৫ বছরে বহু মন্ত্রীর সাহচর্য পেয়ে ধন্য হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিন মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের অনেকেই ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ, বন্ধুস্থানীয় ও অনুজপ্রতিম। খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভারও অনেকে ছিলেন। কিন্তু আমার জীবনে প্রথম কোনো মন্ত্রীর হাতের পরশ পাই ১৯৫৪ সালে। ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার কৃষক প্রজা পার্টির নেতা আবদুল লতিফ বিশ্বাস যেদিন মন্ত্রী হয়ে পায়জামা-শেরওয়ানি পরে পুলিিশ পাহারায় আমাদের বৈঠকখানায় গেলেন এবং আমার মাথায় হাত রাখলেন, সেদিন রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, সেই শিহরণ আমি এখনো অনুভব করি। তাতে বুঝতে পারি কেন মন্ত্রীর সামনে যাওয়ার জন্য আজ ধাক্কাধাক্কিতে অনেকে পাঞ্জাবি ছেঁড়েন, কেউ মোবাইল ফোন হারান, কেউ হাঁটু ভাঙেন, কেউ চশমা খোয়ান। যে লতিফ বিশ্বাসকে আমি এক হপ্তা আগে দেখেছি সাধারণ মানুষ, সাত দিন পরে শেরওয়ানি পরা অবস্থায় তাঁকে মনে হলো তিনি মানুষের বেশি কিছু—মন্ত্রী।
যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা কখনো এমপি হবেন অথবা মন্ত্রী হবেন, সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যাঁরা সত্যিকারের জননেতা, তাঁদের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় ব্যাপার নয়। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না।’ সেটি তাঁর কথার কথা ছিল না। আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দমনমন্ত্রী ছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র দলীয় রাজনীতির গণতন্ত্র। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মাওলানা ভাসানী সভাপতি। মাওলানা মুজিবকে বললেন, তুমি এখন মন্ত্রী। দপ্তরে অনেক কাজ করতে হয়। দলের কাজে সময় দেবে কখন? তোমাকে দলে দরকার। মন্ত্রী হওয়ার বহু লোক আছে। মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দাও।
ওই সময়ের বিপুল কাগজপত্র ঘেঁটে আমি দেখেছি, কোনো রকম গড়িমসি বা মান-অভিমান না করে শেখ মুজিব মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেন ১৯৫৭ সালের জুলাইতে। তিনি জানতেন, তাঁকে যেতে হবে বহুদূর। সচিবালয়ের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অপরিসর কামরা তাঁর জন্য নয়। তাঁকে যেতে হবে জনগণের কাছে। তাদের কল্যাণে, তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাদের পাশে থাকতে হবে। দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকতে তিনি মন্ত্রিত্ব ছুড়ে ফেলে দেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিত্ব পাওয়া ও হারানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আজকাল অনেকে মনে করেন, মন্ত্রিত্ব গেলে সবই গেল, জীবনটাও গেল, শুধু দেহটা খাঁচার মতো পড়ে রইল। সম্প্রতি সপ্তাহ খানেক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে নিয়ে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হলো, তা অনেকে উপভোগ করলেও আমি বিরক্ত হয়েছি। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ কয়েকটির দুটিই তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটি প্রধানমন্ত্রীর পরেই সবচেয়ে ক্ষমতাধর। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা তাঁকে সেখান থেকে সরাননি। তিনি খুবই সজ্জন এবং তাঁকে আমরা সৎ হিসেবে জানি। সে জন্য তাঁর আলস্যকে সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে মাঝে মাঝে মন্ত্রিসভায় রদবদল করা প্রয়োজন। কাউকে বাদ দিতে হয়, কাউকে যোগ করতে হয়। মন্ত্রিত্ব কোনো মৌরসি পাট্টা নয়। অলস, অদক্ষ ও অসৎ মন্ত্রীদের বাদ দিলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ে। তবে বড় আকারের মন্ত্রিসভাই দক্ষ ও ভালো মন্ত্রিসভা নয়। অনেক সময় তা বিরাট বোঝার মতো।
সৈয়দ আশরাফকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার পর তাঁর অনুরাগীদের যে প্রতিক্রিয়া ও সহানুভূতির প্রকাশ, তা যথোচিত ছিল না। সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ নয়। কেউ কেউ ঘটনাটিকে যেভাবে বিশ্লেষণ করলেন, তাতে কোনো দায়িত্বশীলতা ছিল না। কেউ লিখল, তিনি ‘দেশান্তরি’ হচ্ছেন অভিমানে, একই দিনে কেউ লিখল, ‘চমক আসছে’ এবং তাঁকে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিবর্তে সংসদ উপনেতা ও উপপ্রধানমন্ত্রী করা হচ্ছে। সংবিধানে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ কোথায়? খবরের সূত্র কে? ধারণা করি, এ-জাতীয় সংবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিব্রত হয়ে থাকবেন। বিব্রত হয়ে থাকবেন সৈয়দ আশরাফ নিজেও। শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফ উভয়েই নিজ নিজ কীর্তিমান পিতাকে নির্মমভাবে হারিয়েছেন। তাঁদের ওই জায়গাটি নিয়ে রাজনীতি না করা ভালো। তাঁদের মধ্যে বিবাদ বাধানো বা মনোমালিন্যের সৃষ্টি করা খুবই অন্যায়। তাঁরা মিলেমিশে উভয়েই সুস্থধারার রাজনীতি করুন, দেশের কল্যাণ করুন, সেটাই কাম্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
কোমলমতি বালক-বালিকারা টিভির পর্দায় দেশ-বিদেশের মন্ত্রীদের দেখে প্রতিদিন। তাদের কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে মন্ত্রিত্ব জিনিসটা আসলে কী? রূপকথার দেশের রাজা-উজিরের কথা আমরা ছোটবেলায় শুনেছি। রূপকথার দেশই আধুনিক রাষ্ট্র। এবং সেই উজিরই আধুনিক রাষ্ট্রে মন্ত্রী। এককালে যাদের বলা হতো প্রজা, এখন তাদের বলা হয় রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্র থাকলে মন্ত্রী থাকবেনই। রাষ্ট্রে যে পদ্ধতির সরকারই থাকুক না কেন, তাতে গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক—মন্ত্রী থাকতেই হবে।
বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন ১১ জন। সেটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে নাজুক সময়। তখন তাঁর দলে মন্ত্রী করার মতো নেতা ছিলেন অন্তত জনা পঞ্চাশ। ওই মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। আমার মতো সামান্য মানুষের সৌভাগ্য হয়েছিল তাতে উপস্থিত থেকে তা প্রত্যক্ষ করার।
সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের মার্চে। সেই নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাস দুই সারা দেশে বহু জনসভায় তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল। ভারতীয় ও পশ্চিমি মিডিয়ার সাংবাদিকেরাও কখনো থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর মতো রাশভারী মানুষের মধ্যে একজন সহজ হাস্যরসিক মানুষ বাস করতেন। নতুন রাষ্ট্রে সীমাহীন সমস্যা। তাঁর বিরুদ্ধশক্তি সংখ্যায় অল্প হলেও খুবই সক্রিয় ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। তার মধ্যেও তিনি হেলিকপ্টারে আমাদের সঙ্গে অতীতের তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বহু ব্যাপারে স্মৃতিচারণামূলক গল্প করতেন। রসিকতা করতেন। নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক পর তিনি তাঁর দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল জমজমাট। বিদেশি কূটনীতিক, সাংবাদিকসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তবে উপস্থিত ছিলেন না জাসদ, ন্যাপ প্রভৃতি পরাজিত দলগুলোর নেতারা। সম্ভবত আমাদের জিনে সংসদীয় গণতন্ত্রের উপাদান অনুপস্থিত। যা হোক, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ আকার ছিল ১৯৯১-পরবর্তী প্রায় সব মন্ত্রিসভার তিন ভাগের এক ভাগ।
অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির মন্ত্রিসভা গঠিত হয় পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর। ভারতবর্ষ তখন ছিল আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত, ওদিকে আসমুদ্রহিমাচল। ব্রিটিশ সরকার তখনো বিদায় নেয়নি, তবে নেওয়ার পথে। ভারতের জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তারা যেতে চান। আগস্ট মাসে তাঁরা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের ডেকে বলেন, আপনারা মিলেমিশে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করুন। স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বড় দল কংগ্রেসের নেতা নেহরুকেই সরকারপ্রধান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। জিন্নাহ নাখোশ। বহু দেনদরবার ও ঝগড়াঝাঁটির পর গঠিত হয় মন্ত্রিসভা। প্রকাণ্ড ভারতবর্ষ। এখনকার অনুপাতে হলে মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার কথা ১ হাজার ২০০-এর কিছু বেশি। আমার কথা এখন সম্ভবত বিশ্বাস করবেন না অনেকেই। উপমহাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল ১৩ সদস্যবিশিষ্ট। পণ্ডিত নেহরুর সেই মন্ত্রিসভায় ছিলেন কংগ্রেসের সর্দার প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, জগজীবন রাম, খ্রিষ্টান জন মাথাই, শিখ বলদেব সিং ও সি এইচ ভাবা এবং মুসলিম লীগের মন্ত্রীরা হলেন লিয়াকত আলী খান, আই আই চুন্দ্রীগর, আবদুর রব নিশতার, গজনফর আলী খান ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।
এক বছর পরে ভারত ও পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট, তখন দুই রাষ্ট্রেই সংসদীয় পদ্ধতির মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রিসভা এবং ভারতে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা ছিল ১৪-র কম। অন্যদিকে, যে ভূখণ্ড নিয়ে আজকের বাংলাদেশ, সেটি তখন পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ। এই প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে। তাঁর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন জনা আটেক। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মন্ত্রিসভায় সদস্য ছিলেন সাত-আটজন। পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের মন্ত্রিসভার আকারও ১০ ছাড়ায়নি।
বাংলার মাটিতে মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে গোলমাল চিরকালই হয়েছে। চুয়ান্নর ঐতিহাসিক নির্বাচনের পরে শেরেবাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় জনা কয়েককে নিয়ে, তার আয়ু ছিল কয়েক সপ্তাহ। টেন্ডার বিশেষজ্ঞ ছাত্র ও যুবনেতা, যাঁদের ছবিসংবলিত বিলবোর্ড ও ডিজিটাল ব্যানারে আজ ভরে গেছে প্রজাতন্ত্রের রাস্তাঘাট, গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খাম্বা, তাঁদের অনেকেই জানেন না আওয়ামী লীগের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে। শেখ মুজিবসহ যে কয়জন সেই কেবিনেটে মন্ত্রী ছিলেন, এখন বাংলাদেশে মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীর সংখ্যা তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি।
মাননীয় মন্ত্রীর একেবারে কাছে গিয়ে সালাম দিতে অথবা হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে আজকাল হুমড়ি খেয়ে পড়ে অনেকেই হাত-পা পর্যন্ত ভাঙেন। কোনো মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ বিধাতার কৃপাদৃষ্টি পাওয়ার শামিল। গত ৪৫ বছরে বহু মন্ত্রীর সাহচর্য পেয়ে ধন্য হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিন মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের অনেকেই ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ, বন্ধুস্থানীয় ও অনুজপ্রতিম। খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভারও অনেকে ছিলেন। কিন্তু আমার জীবনে প্রথম কোনো মন্ত্রীর হাতের পরশ পাই ১৯৫৪ সালে। ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার কৃষক প্রজা পার্টির নেতা আবদুল লতিফ বিশ্বাস যেদিন মন্ত্রী হয়ে পায়জামা-শেরওয়ানি পরে পুলিিশ পাহারায় আমাদের বৈঠকখানায় গেলেন এবং আমার মাথায় হাত রাখলেন, সেদিন রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, সেই শিহরণ আমি এখনো অনুভব করি। তাতে বুঝতে পারি কেন মন্ত্রীর সামনে যাওয়ার জন্য আজ ধাক্কাধাক্কিতে অনেকে পাঞ্জাবি ছেঁড়েন, কেউ মোবাইল ফোন হারান, কেউ হাঁটু ভাঙেন, কেউ চশমা খোয়ান। যে লতিফ বিশ্বাসকে আমি এক হপ্তা আগে দেখেছি সাধারণ মানুষ, সাত দিন পরে শেরওয়ানি পরা অবস্থায় তাঁকে মনে হলো তিনি মানুষের বেশি কিছু—মন্ত্রী।
যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা কখনো এমপি হবেন অথবা মন্ত্রী হবেন, সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যাঁরা সত্যিকারের জননেতা, তাঁদের কাছে মন্ত্রিত্ব বড় ব্যাপার নয়। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না।’ সেটি তাঁর কথার কথা ছিল না। আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দমনমন্ত্রী ছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র দলীয় রাজনীতির গণতন্ত্র। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মাওলানা ভাসানী সভাপতি। মাওলানা মুজিবকে বললেন, তুমি এখন মন্ত্রী। দপ্তরে অনেক কাজ করতে হয়। দলের কাজে সময় দেবে কখন? তোমাকে দলে দরকার। মন্ত্রী হওয়ার বহু লোক আছে। মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দাও।
ওই সময়ের বিপুল কাগজপত্র ঘেঁটে আমি দেখেছি, কোনো রকম গড়িমসি বা মান-অভিমান না করে শেখ মুজিব মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেন ১৯৫৭ সালের জুলাইতে। তিনি জানতেন, তাঁকে যেতে হবে বহুদূর। সচিবালয়ের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অপরিসর কামরা তাঁর জন্য নয়। তাঁকে যেতে হবে জনগণের কাছে। তাদের কল্যাণে, তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাদের পাশে থাকতে হবে। দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকতে তিনি মন্ত্রিত্ব ছুড়ে ফেলে দেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিত্ব পাওয়া ও হারানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আজকাল অনেকে মনে করেন, মন্ত্রিত্ব গেলে সবই গেল, জীবনটাও গেল, শুধু দেহটা খাঁচার মতো পড়ে রইল। সম্প্রতি সপ্তাহ খানেক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে নিয়ে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হলো, তা অনেকে উপভোগ করলেও আমি বিরক্ত হয়েছি। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ কয়েকটির দুটিই তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটি প্রধানমন্ত্রীর পরেই সবচেয়ে ক্ষমতাধর। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা তাঁকে সেখান থেকে সরাননি। তিনি খুবই সজ্জন এবং তাঁকে আমরা সৎ হিসেবে জানি। সে জন্য তাঁর আলস্যকে সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে মাঝে মাঝে মন্ত্রিসভায় রদবদল করা প্রয়োজন। কাউকে বাদ দিতে হয়, কাউকে যোগ করতে হয়। মন্ত্রিত্ব কোনো মৌরসি পাট্টা নয়। অলস, অদক্ষ ও অসৎ মন্ত্রীদের বাদ দিলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ে। তবে বড় আকারের মন্ত্রিসভাই দক্ষ ও ভালো মন্ত্রিসভা নয়। অনেক সময় তা বিরাট বোঝার মতো।
সৈয়দ আশরাফকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার পর তাঁর অনুরাগীদের যে প্রতিক্রিয়া ও সহানুভূতির প্রকাশ, তা যথোচিত ছিল না। সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ নয়। কেউ কেউ ঘটনাটিকে যেভাবে বিশ্লেষণ করলেন, তাতে কোনো দায়িত্বশীলতা ছিল না। কেউ লিখল, তিনি ‘দেশান্তরি’ হচ্ছেন অভিমানে, একই দিনে কেউ লিখল, ‘চমক আসছে’ এবং তাঁকে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিবর্তে সংসদ উপনেতা ও উপপ্রধানমন্ত্রী করা হচ্ছে। সংবিধানে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ কোথায়? খবরের সূত্র কে? ধারণা করি, এ-জাতীয় সংবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিব্রত হয়ে থাকবেন। বিব্রত হয়ে থাকবেন সৈয়দ আশরাফ নিজেও। শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফ উভয়েই নিজ নিজ কীর্তিমান পিতাকে নির্মমভাবে হারিয়েছেন। তাঁদের ওই জায়গাটি নিয়ে রাজনীতি না করা ভালো। তাঁদের মধ্যে বিবাদ বাধানো বা মনোমালিন্যের সৃষ্টি করা খুবই অন্যায়। তাঁরা মিলেমিশে উভয়েই সুস্থধারার রাজনীতি করুন, দেশের কল্যাণ করুন, সেটাই কাম্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments