সমৃদ্ধি বাড়াতে চাই সুশাসন ও সক্ষমতা by মামুন রশীদ
কিছুদিন আগে আমেরিকা সফরকালে আমার ছোটবেলার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অন্য অনেক প্রবাসীর মতো আমার এই বন্ধুও আধুনিক ইন্টারনেট বা অনলাইন-সুবিধার বদৌলতে দেশের সব খোঁজখবরই রাখেন। সে জন্যই হয়তো দেশের প্রসঙ্গ উঠতেই তাঁকে বেশ উত্তেজিত দেখাল। ইভ টিজিংয়ের জের ধরে হত্যা-খুন, ঈদ উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক মানুষের শহর থেকে গ্রামের বাড়ি কিংবা এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার সময় পরিবহন-সংকটজনিত তীব্র ভোগান্তির শিকার হওয়া, অহর্নিশ সড়ক দুর্ঘটনা, পরিবেশদূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি প্রভৃতিসহ সাম্প্রতিক কালের আরও অনেক নেতিবাচক খবরের কারণেই মূলত আমার বন্ধু উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। এ ধরনের নেতিবাচক খবর জেনে তাঁর হয়তো মনে হয়ে থাকতে পারে, দেশে প্রিয়জনেরা যেন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যেই বসবাস করছেন। তা সত্ত্বেও আমি জানালাম, আমি বাংলাদেশকে নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। বন্ধু তখন অভিযোগের সুরে তাঁর শেষ প্রশ্নটি ছুড়ে দিল, ‘এত সব নেতিবাচক খবরের মধ্যেও বাংলাদেশ সম্পর্কে তুমি কীভাবে আশাবাদী থাকো?’ জবাবে আমি নরম গলায় তাঁকে জানালাম, পর্যটনবিষয়ক খ্যাতনামা জার্নাল লোনলি প্ল্যানেট ২০১১ সালের সেরা ১০ ভ্রমণ গন্তব্যের তালিকায় বাংলাদেশকে রীতিমতো পুরোভাগেই রেখেছে। জার্নালটি বাংলাদেশের মানুষের আতিথ্যপরায়ণতার প্রশংসার পাশাপাশি একেবারে নতুন নতুন কিছু পর্যটনকেন্দ্রের নামও তুলে ধরেছে।আবারও বলছি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী। যদিও এখানে অনেক সমস্যাও রয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের প্রায়ই বলা একটি কথা মনে পড়ছে, ‘এক লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দেশে ১৬ কোটি মানুষকে ম্যানেজ করা বা পরিচালনা করাটাই একটা চ্যালেঞ্জ।’ আমাদের প্রিয় দেশটি হাজারো চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সামনে এগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কৃষক, পোশাকশ্রমিক ও প্রবাসে কর্মরত নাগরিকেরা, যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাঁদের অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে।শিল্পোদ্যোগের চেতনা: বাংলাদেশের মতো একটি বিকাশমান অর্থনীতিতে শিল্প স্থাপনে যুব সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা খুবই জরুরি। কারণ, বাংলাদেশে তরুণ-যুবাদের সংখ্যা বিশাল, যাঁদের গড় বয়স ২৩ বছর। বৃহত্তর এই যুবসমাজকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পুঁজির জোগান দিয়ে এবং দক্ষতা ও সক্ষমতা অনুযায়ী যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে, যাতে দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।এটি বেশ আনন্দের যে দেশে এখন এমন তরুণ-যুবাও আছেন, যাঁরা উচ্চ বেতনে বহুজাতিক কোম্পানিতে যোগ না দিয়ে বাপ-দাদার স্বপ্নের প্রকল্প বা কোম্পানির সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন। নারীরাও অধিক হারে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছেন। এতে সংসারে নারী-পুরুষের যৌথ আয়-উপার্জনের প্রবণতা বাড়ছে। বর্তমান সময়ে জীবনসঙ্গিনীর আয়-উপার্জনের সুবাদে কিছুটা আর্থিক সমর্থন পেলে পুরুষদের পক্ষেও এগিয়ে যাওয়া সহজতর হয়। দেশে শ্রমশক্তি তথা যুবসমাজের একটি অংশ কিন্তু এখন দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা, কঠোর অধ্যবসায়, প্রবল নিয়মানুবর্তিতা, নিরন্তর প্রচেষ্টা ও দক্ষতা অর্জনের সুবাদে তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ভাগ্যবদলে এ ধরনের ইতিবাচক প্রবণতার প্রশংসা করি।নিজের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকেই একটি নেতিবাচক ধারণা নিয়েই বাংলাদেশে আসেন। মূলত কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়ার পরিবেশিত নেতিবাচক খবর পড়েই তাঁদের এমন ধারণা হয়। কিন্তু ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁরা শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক ও উচ্ছ্বসিত ধারণা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ফিরে যান। তরুণ উদ্যোক্তা ও পেশাজীবী, অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলে ও মেলামেশা করেই তাঁদের ধারণা পাল্টে যায়।
সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকসমূহ: বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষি খাতের ওপর প্রভাব ফেললেও গত তিন বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে একটি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রবণতা আমরা লক্ষ করেছি। ২০১০ অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে ৬৮৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা চার বছর আগেও ছিল মাত্র ৪৪৭ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদেশ থেকে শ্রমিকদের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের মোট পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ১০ শতাংশ এবং ১০ বছর আগে দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী-আয় আসত, তা ছিল এখনকার পাঁচ ভাগের এক ভাগ। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার পরিস্থিতিতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে যে ১২টি দেশ রপ্তানি-আয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, তাতে বাংলাদেশও রয়েছে। এই বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি-আয়ের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬২০ কোটি ডলার। চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮২৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, যা আলোচ্য পাঁচ মাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি ভালোভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা খাতের বিকাশের ফলে বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ কমে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আশির দশকে ছিল জিডিপির ৬ শতাংশ। তবে দেশে এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। আশার কথা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রকেরা নীতিমালার প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সফলতার সঙ্গেই মূল্যস্ফীতিকে সিঙ্গেল ডিজিট বা ১০ শতাংশের নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি জোরদারকরণ, বিকল্প জ্বালানিসহ উৎপাদনশীল খাতগুলোতে পুঁজি প্রবাহিতকরণ এবং গ্রামের জনগণকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশে চাল ও গমের উৎপাদন বেড়ে তিন কোটি ৩০ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে, যা আশির দশকের ১১ লাখ মেট্রিক টনের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। আমরা বর্তমানে প্রায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার পর্যায়ে রয়েছি।
অতীতে বিশ্বব্যাপী গতিশীল পরিবর্তনের পরিস্থিতিতে দেশে রক্ষণশীল নীতিমালা গ্রহণের কারণে আমরা অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা নীতিনির্ধারকদের সমালোচনা করেছি। কিন্তু কোনো কোনো রক্ষণশীল নীতিও পরবর্তীকালে দেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। অতিরিক্ত উদারীকরণের কারণে সাম্প্রতিক কালে ভিয়েতনাম এবং গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বিপাকে পড়েছে। সেই তুলনায় রক্ষণশীল নীতিমালার ফলে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও বহিস্থ অভিঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি অগ্রগতি অর্জন করেছি। যেমন—দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৫ বছরে ৫৬ থেকে কমে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ১৪৬ থেকে কমে ৬৭তে নেমেছে। নবজাতকের মৃত্যুহারও প্রতি হাজারে ৯২ থেকে কমে ৪৫তে নেমে গেছে। সন্তান প্রসবকালে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৫৭৪ থেকে কমে ৩৮৪তে নেমে এসেছে। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে বর্তমানে ৯১ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, যা আগে ছিল ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ।
মিডিয়া: দেশে মিডিয়া বা গণমাধ্যম এখন কমবেশি স্বাধীনতা উপভোগ করছে। সমাজের কোনো কোনো রাঘববোয়াল ও আইন অমান্যকারী ব্যবসায়ী মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নাখোশ রয়েছেন। আমরা আশা করি, মিডিয়া আরও জোরালো ভূমিকা রাখবে, যা প্রকারান্তরে দেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ত্বরান্বিত করবে।সংস্কার: দেশে সংস্কারের এজেন্ডা এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের গতি এখনো ধীর। বিগত সময়ে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল প্রলম্বিত হওয়ায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও সাময়িকভাবে বিচ্যুত হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের জন্য এটিই হলো প্রকৃষ্ট পন্থা।সবশেষে বলব, বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হতে হবে। ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার জন্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন। সমাজে যেমন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বা পদে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যেও নীতি-নৈতিকতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া সর্বস্তরে সহিষ্ণুতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সুশাসন প্রভৃতি নিশ্চিত হতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা বহির্বিশ্বের কাছ থেকে সম্মান-সমীহ পাওয়া জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাব।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকসমূহ: বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষি খাতের ওপর প্রভাব ফেললেও গত তিন বছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে একটি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রবণতা আমরা লক্ষ করেছি। ২০১০ অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে ৬৮৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা চার বছর আগেও ছিল মাত্র ৪৪৭ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদেশ থেকে শ্রমিকদের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়ের মোট পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ১০ শতাংশ এবং ১০ বছর আগে দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী-আয় আসত, তা ছিল এখনকার পাঁচ ভাগের এক ভাগ। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার পরিস্থিতিতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে যে ১২টি দেশ রপ্তানি-আয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, তাতে বাংলাদেশও রয়েছে। এই বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি-আয়ের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬২০ কোটি ডলার। চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮২৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, যা আলোচ্য পাঁচ মাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি ভালোভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা খাতের বিকাশের ফলে বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ কমে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আশির দশকে ছিল জিডিপির ৬ শতাংশ। তবে দেশে এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। আশার কথা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রকেরা নীতিমালার প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সফলতার সঙ্গেই মূল্যস্ফীতিকে সিঙ্গেল ডিজিট বা ১০ শতাংশের নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি জোরদারকরণ, বিকল্প জ্বালানিসহ উৎপাদনশীল খাতগুলোতে পুঁজি প্রবাহিতকরণ এবং গ্রামের জনগণকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশে চাল ও গমের উৎপাদন বেড়ে তিন কোটি ৩০ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে, যা আশির দশকের ১১ লাখ মেট্রিক টনের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। আমরা বর্তমানে প্রায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার পর্যায়ে রয়েছি।
অতীতে বিশ্বব্যাপী গতিশীল পরিবর্তনের পরিস্থিতিতে দেশে রক্ষণশীল নীতিমালা গ্রহণের কারণে আমরা অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা নীতিনির্ধারকদের সমালোচনা করেছি। কিন্তু কোনো কোনো রক্ষণশীল নীতিও পরবর্তীকালে দেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। অতিরিক্ত উদারীকরণের কারণে সাম্প্রতিক কালে ভিয়েতনাম এবং গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বিপাকে পড়েছে। সেই তুলনায় রক্ষণশীল নীতিমালার ফলে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও বহিস্থ অভিঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি অগ্রগতি অর্জন করেছি। যেমন—দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৫ বছরে ৫৬ থেকে কমে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুমৃত্যু প্রতি হাজারে ১৪৬ থেকে কমে ৬৭তে নেমেছে। নবজাতকের মৃত্যুহারও প্রতি হাজারে ৯২ থেকে কমে ৪৫তে নেমে গেছে। সন্তান প্রসবকালে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৫৭৪ থেকে কমে ৩৮৪তে নেমে এসেছে। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে বর্তমানে ৯১ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, যা আগে ছিল ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ।
মিডিয়া: দেশে মিডিয়া বা গণমাধ্যম এখন কমবেশি স্বাধীনতা উপভোগ করছে। সমাজের কোনো কোনো রাঘববোয়াল ও আইন অমান্যকারী ব্যবসায়ী মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নাখোশ রয়েছেন। আমরা আশা করি, মিডিয়া আরও জোরালো ভূমিকা রাখবে, যা প্রকারান্তরে দেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ত্বরান্বিত করবে।সংস্কার: দেশে সংস্কারের এজেন্ডা এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের গতি এখনো ধীর। বিগত সময়ে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল প্রলম্বিত হওয়ায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও সাময়িকভাবে বিচ্যুত হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের জন্য এটিই হলো প্রকৃষ্ট পন্থা।সবশেষে বলব, বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হতে হবে। ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার জন্যই প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন। সমাজে যেমন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বা পদে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যেও নীতি-নৈতিকতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া সর্বস্তরে সহিষ্ণুতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সুশাসন প্রভৃতি নিশ্চিত হতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা বহির্বিশ্বের কাছ থেকে সম্মান-সমীহ পাওয়া জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাব।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
No comments