বিনিয়োগের চালচিত্র ও সম্ভাব্য করণীয় -অর্থনীতি by মামুন রশীদ
উন্নত অনেক দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও বাংলাদেশে কিন্তু গেল এক-দেড় বছরে আমরা ইতিবাচক ধারাই লক্ষ করেছি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আমাদের মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) ৫ দশমিক ৯ শতাংশসহ রপ্তানি খাতে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স আয়ে ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তথাপি আমাদের অর্থনীতিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের রপ্তানি আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট মাসে জুলাইয়ের তুলনায় পাঁচ শতাংশ আর জুলাইয়ে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ রপ্তানি কমেছে। সেপ্টেম্বরে কমেছে আরও বেশি। তবে বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে রপ্তানি বাড়বে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার প্রায় ছয় শতাংশ, আমদানি এলসি নিষ্পত্তির হার ২০ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্র নিষ্পত্তির হার ২২ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহও কমেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ ২১ শতাংশ বাড়ে, যা কিনা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৬ শতাংশ কমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই হার ১৪ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আর চলতি অর্থবছরে তা এখনো পর্যন্ত কমতির দিকেই রয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ বেড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।
সার্বিকভাবে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণের পরিমাণও কমছে। দেশের আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ৩০ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে শিল্প খাতে আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
২০০০-০১ অর্থবছরে দেশে মোট বিনিয়োগ হয়েছে এক হাজার ৮০ কোটি ডলার, যা তত্কালীন জিডিপির ২৩ শতাংশ। আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে মোট বিনিয়োগ হয়েছে দুই হাজার ১৬০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ২৪ শতাংশের সমান। ডলারের হিসাবে দেশে মোট বিনিয়োগ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জিডিপির হিসাবে বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র এক শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি খাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে এরই মধ্যে জিডিপির ১৯ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় সরকারি খাতের বিনিয়োগ তেমন বাড়ছে না। প্রত্যেক অর্থবছরেই এডিপি সংশোধন তথা কাটছাঁট করে ছোট করতে দেখা যায়।
২০০৮ সালে অবশ্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রে আশাবাদের সঞ্চার হয়। এই বছরে দেশে এফডিআই ১০০ কোটি ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায়, যা ২০০৭ সালে ছিল ৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তবে এফডিআই-প্রবাহ আবার কমতে শুরু করেছে। দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য নিম্নোক্ত কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:
অবকাঠামো উন্নয়ন: দেশে বন্দর ব্যবস্থাপনায় সমস্যাসহ পরিবহনব্যবস্থা অপর্যাপ্ত রয়ে গেছে। এর ওপর তীব্র জ্বালানিসংকট তো আছেই। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবকাঠামো খাতের ব্যাপক উন্নয়ন আর জ্বালানি (গ্যাস ও বিদ্যুত্) সংকটের সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যুত্ খাতে বিশেষ করে বেসরকারি ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) মাধ্যমে স্বতন্ত্র বিদ্যুেকন্দ্র (আইপিপি), ক্ষুদ্র বিদ্যুেকন্দ্র (এসপিপি) ও পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে জোর দিতে হবে। জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের বিষয়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বিত আঞ্চলিক বিদ্যুত্ গ্রিড স্থাপনের সম্ভাব্যতাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বিকল্প জ্বালানি সমাধান এবং নীতিনির্দেশনার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কয়লানীতি প্রণয়ন করতে হবে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর ও এক্সপ্রেস হাইওয়ে স্থাপন এবং মেট্রো রেল চালু করলে অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটবে।
বেসরকারি খাতের উন্নয়ন: বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতকে বলা হয় উন্নয়নের চাবিকাঠি। দেশে এখনো বেসরকারি খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যেমন অভাব আছে, তেমনি করপোরেট সুশাসনেও বেশ ঘাটতি রয়েছে। সেই সঙ্গে মানবসম্পদের ব্যবস্থাপনা ও মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করা এবং ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। সরকার চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি খাতে অংশীদারিত্বে (পিপিপি) কাজ করার লক্ষে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তহবিলের তীব্র সংকট থাকে, সেখানে পিপিপির ভিত্তিতে কাজ করার ধারণা খুবই যুগোপযোগী।
নতুন বিনিয়োগ ক্ষেত্র: দেশে এখনো টেলিযোগাযোগ, বস্ত্র ও ব্যাংক খাতেই বেশি করে বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু কৃষিপ্রধান দেশ, সেহেতু এই খাতেও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। কারণ কৃষির বিভিন্ন উপখাত, যেমন—সার ও বীজ, কোল্ড স্টোরেজ, পিসি কালচার, পশুসম্পদ, হাঁস-মুরগি (পোলট্রি), মাংস রপ্তানি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সেচ যন্ত্রপাতি প্রভৃতিতে বিনিয়োগের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এতে কৃষির বাণিজ্যিকায়ন ত্বরান্বিত হবে।
হালকা প্রকৌশল, গ্লাস সিট, মেলামাইন ও সিরামিক-পণ্যের ব্যাপক রপ্তানি সম্ভাবনা থাকায় এসব শিল্পে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। জোর দিতে হবে বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ানো এবং আমদানি বিকল্প পণ্য উত্পাদনে। এ ছাড়া বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মানসম্পন্ন বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে জোর দিতে হবে। যেন দেশে অধিক সংখ্যায় মানবসম্পদ সৃষ্টি হয় এবং উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করা যায়।
উন্নত চিকিত্সার জন্য আমাদের দেশের নাগরিকেরা প্রতিবছর বিদেশে ২০ কোটি ডলারের মতো খরচ করে। সে জন্য দেশে উন্নত চিকিত্সাব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও দক্ষ চিকিত্সক তৈরি করতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। এতে যেমন বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, তেমনি দেশের জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাংলাদেশ ওষুধশিল্পেও বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
পুঁজিবাজারের উন্নয়ন: বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা ৪৪৩ এবং বাজার মূলধনের যে আকার তা জিডিপির ২৫ শতাংশের সমান, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কমই। গত দুই বছরে গ্রামীণফোন, ম্যারিকো বাংলাদেশ, তিতাস গ্যাসসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যেও মার্চেন্ট ব্যাংকিং শাখা খোলার পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ড ছাড়ার আগ্রহ বাড়ছে। বুক বিল্ডিংয়ের সূচনাটাও দেশের পুঁজিবাজারের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। ব্যাংক খাতের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাসেল-২ চালু করায় ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে ডেট ইনস্ট্রুমেন্ট বা ঋণ-উপকরণের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহে আগ্রহী হবে বলে আশা করা যায়। এর ওপর সিকিউরিটাইজেশন, করপোরেট বন্ড, বিভিন্ন ধরনের ডেরিভেটিভস ও কমার্শিয়াল পেপার ইত্যাদি প্রচলনেরও ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের পুঁজিবাজারে কিছু সংস্কারসহ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অনেক জোরদার হয়েছে এবং তদারকিও বেড়েছে। এ ধরনের ইতিবাচক অবস্থায় পুঁজিবাজারে যাতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে, সেদিকে গভীর মনোযোগ দেওয়া দরকার। দেশের পুঁজিবাজারের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে পুঁজিবাজারে নতুন নতুন শেয়ারের চাহিদা মেটানো, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত পরিবেশন, পোর্টফলিও ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব, মূল্যবৈষম্য ও আনুষ্ঠানিক ঋণবাজারের ঘাটতি দূরীকরণ, স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সেবার মান বাড়ানো এবং গবেষণা ইত্যাদি বিষয়ে জোর দিতে হবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্সের ব্যবধানও বাড়ানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মতো পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা চালাতে হবে। সরকারও পরিবহন তথা যোগাযোগব্যবস্থাসহ অবকাঠামো খাতের বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করার পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ছাড়া কার্যকর আইন ও বিধিবিধানের ওপরও জোর দিতে হবে, যাতে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এ দেশের পুঁজিবাজারের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
আন্তর্জাতিক (বিনিয়োগ) সম্পর্ক: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করতে হলে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারকেও মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলো এবং প্রতিবেশী ভারত, চীন ও সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের বিনিয়োগ দেশে আনার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ সম্প্রসারণশীল অভ্যন্তরীণ বাজারের কথাও ফলাও করে প্রচার করতে হবে।
আমাদের সামনে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভাবনা রয়েছে। অবকাঠামো খাতে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ ও প্রচলিত আইনকানুন সংশোধন ও যুগোপযোগী করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ এবং সম্পদের সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে সম্পদ সৃষ্টি ও সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে। এই পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। তবে এসব কথা বলা যত সহজ বাস্তবায়ন করাটা ততই কঠিন। কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের আর কোন গত্যন্তর নেই।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক।
তথাপি আমাদের অর্থনীতিতে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের রপ্তানি আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট মাসে জুলাইয়ের তুলনায় পাঁচ শতাংশ আর জুলাইয়ে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ রপ্তানি কমেছে। সেপ্টেম্বরে কমেছে আরও বেশি। তবে বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে রপ্তানি বাড়বে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার প্রায় ছয় শতাংশ, আমদানি এলসি নিষ্পত্তির হার ২০ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্র নিষ্পত্তির হার ২২ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহও কমেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ ২১ শতাংশ বাড়ে, যা কিনা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৬ শতাংশ কমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই হার ১৪ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আর চলতি অর্থবছরে তা এখনো পর্যন্ত কমতির দিকেই রয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ বেড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।
সার্বিকভাবে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণের পরিমাণও কমছে। দেশের আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ৩০ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে শিল্প খাতে আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
২০০০-০১ অর্থবছরে দেশে মোট বিনিয়োগ হয়েছে এক হাজার ৮০ কোটি ডলার, যা তত্কালীন জিডিপির ২৩ শতাংশ। আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে মোট বিনিয়োগ হয়েছে দুই হাজার ১৬০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ২৪ শতাংশের সমান। ডলারের হিসাবে দেশে মোট বিনিয়োগ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জিডিপির হিসাবে বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র এক শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি খাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে এরই মধ্যে জিডিপির ১৯ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় সরকারি খাতের বিনিয়োগ তেমন বাড়ছে না। প্রত্যেক অর্থবছরেই এডিপি সংশোধন তথা কাটছাঁট করে ছোট করতে দেখা যায়।
২০০৮ সালে অবশ্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রে আশাবাদের সঞ্চার হয়। এই বছরে দেশে এফডিআই ১০০ কোটি ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায়, যা ২০০৭ সালে ছিল ৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তবে এফডিআই-প্রবাহ আবার কমতে শুরু করেছে। দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য নিম্নোক্ত কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:
অবকাঠামো উন্নয়ন: দেশে বন্দর ব্যবস্থাপনায় সমস্যাসহ পরিবহনব্যবস্থা অপর্যাপ্ত রয়ে গেছে। এর ওপর তীব্র জ্বালানিসংকট তো আছেই। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে অবকাঠামো খাতের ব্যাপক উন্নয়ন আর জ্বালানি (গ্যাস ও বিদ্যুত্) সংকটের সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যুত্ খাতে বিশেষ করে বেসরকারি ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) মাধ্যমে স্বতন্ত্র বিদ্যুেকন্দ্র (আইপিপি), ক্ষুদ্র বিদ্যুেকন্দ্র (এসপিপি) ও পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে জোর দিতে হবে। জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের বিষয়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বিত আঞ্চলিক বিদ্যুত্ গ্রিড স্থাপনের সম্ভাব্যতাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বিকল্প জ্বালানি সমাধান এবং নীতিনির্দেশনার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কয়লানীতি প্রণয়ন করতে হবে। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর ও এক্সপ্রেস হাইওয়ে স্থাপন এবং মেট্রো রেল চালু করলে অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটবে।
বেসরকারি খাতের উন্নয়ন: বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতকে বলা হয় উন্নয়নের চাবিকাঠি। দেশে এখনো বেসরকারি খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যেমন অভাব আছে, তেমনি করপোরেট সুশাসনেও বেশ ঘাটতি রয়েছে। সেই সঙ্গে মানবসম্পদের ব্যবস্থাপনা ও মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করা এবং ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। সরকার চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি খাতে অংশীদারিত্বে (পিপিপি) কাজ করার লক্ষে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তহবিলের তীব্র সংকট থাকে, সেখানে পিপিপির ভিত্তিতে কাজ করার ধারণা খুবই যুগোপযোগী।
নতুন বিনিয়োগ ক্ষেত্র: দেশে এখনো টেলিযোগাযোগ, বস্ত্র ও ব্যাংক খাতেই বেশি করে বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু কৃষিপ্রধান দেশ, সেহেতু এই খাতেও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। কারণ কৃষির বিভিন্ন উপখাত, যেমন—সার ও বীজ, কোল্ড স্টোরেজ, পিসি কালচার, পশুসম্পদ, হাঁস-মুরগি (পোলট্রি), মাংস রপ্তানি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সেচ যন্ত্রপাতি প্রভৃতিতে বিনিয়োগের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এতে কৃষির বাণিজ্যিকায়ন ত্বরান্বিত হবে।
হালকা প্রকৌশল, গ্লাস সিট, মেলামাইন ও সিরামিক-পণ্যের ব্যাপক রপ্তানি সম্ভাবনা থাকায় এসব শিল্পে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে। জোর দিতে হবে বিশ্ববাজারে আমাদের চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ানো এবং আমদানি বিকল্প পণ্য উত্পাদনে। এ ছাড়া বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মানসম্পন্ন বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে জোর দিতে হবে। যেন দেশে অধিক সংখ্যায় মানবসম্পদ সৃষ্টি হয় এবং উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করা যায়।
উন্নত চিকিত্সার জন্য আমাদের দেশের নাগরিকেরা প্রতিবছর বিদেশে ২০ কোটি ডলারের মতো খরচ করে। সে জন্য দেশে উন্নত চিকিত্সাব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও দক্ষ চিকিত্সক তৈরি করতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। এতে যেমন বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, তেমনি দেশের জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাংলাদেশ ওষুধশিল্পেও বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
পুঁজিবাজারের উন্নয়ন: বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা ৪৪৩ এবং বাজার মূলধনের যে আকার তা জিডিপির ২৫ শতাংশের সমান, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কমই। গত দুই বছরে গ্রামীণফোন, ম্যারিকো বাংলাদেশ, তিতাস গ্যাসসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যেও মার্চেন্ট ব্যাংকিং শাখা খোলার পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ড ছাড়ার আগ্রহ বাড়ছে। বুক বিল্ডিংয়ের সূচনাটাও দেশের পুঁজিবাজারের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। ব্যাংক খাতের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাসেল-২ চালু করায় ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে ডেট ইনস্ট্রুমেন্ট বা ঋণ-উপকরণের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহে আগ্রহী হবে বলে আশা করা যায়। এর ওপর সিকিউরিটাইজেশন, করপোরেট বন্ড, বিভিন্ন ধরনের ডেরিভেটিভস ও কমার্শিয়াল পেপার ইত্যাদি প্রচলনেরও ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের পুঁজিবাজারে কিছু সংস্কারসহ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অনেক জোরদার হয়েছে এবং তদারকিও বেড়েছে। এ ধরনের ইতিবাচক অবস্থায় পুঁজিবাজারে যাতে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে, সেদিকে গভীর মনোযোগ দেওয়া দরকার। দেশের পুঁজিবাজারের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে পুঁজিবাজারে নতুন নতুন শেয়ারের চাহিদা মেটানো, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত পরিবেশন, পোর্টফলিও ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব, মূল্যবৈষম্য ও আনুষ্ঠানিক ঋণবাজারের ঘাটতি দূরীকরণ, স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সেবার মান বাড়ানো এবং গবেষণা ইত্যাদি বিষয়ে জোর দিতে হবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্সের ব্যবধানও বাড়ানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মতো পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা চালাতে হবে। সরকারও পরিবহন তথা যোগাযোগব্যবস্থাসহ অবকাঠামো খাতের বড় ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করার পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ছাড়া কার্যকর আইন ও বিধিবিধানের ওপরও জোর দিতে হবে, যাতে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এ দেশের পুঁজিবাজারের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
আন্তর্জাতিক (বিনিয়োগ) সম্পর্ক: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করতে হলে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারকেও মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলো এবং প্রতিবেশী ভারত, চীন ও সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের বিনিয়োগ দেশে আনার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ সম্প্রসারণশীল অভ্যন্তরীণ বাজারের কথাও ফলাও করে প্রচার করতে হবে।
আমাদের সামনে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভাবনা রয়েছে। অবকাঠামো খাতে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ ও প্রচলিত আইনকানুন সংশোধন ও যুগোপযোগী করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ এবং সম্পদের সর্বাত্মক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে সম্পদ সৃষ্টি ও সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে। এই পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। তবে এসব কথা বলা যত সহজ বাস্তবায়ন করাটা ততই কঠিন। কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের আর কোন গত্যন্তর নেই।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক।
No comments