রাজনীতি -আব্দুল জলিল এবং ব্যক্তির আত্মমর্যাদা by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কিছুদিন আগে আব্দুল জলিলের মানসিক ভারসাম্যের বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর ওই বক্তব্যে আমরা কিঞ্চিত্ অবাক হয়েছি, অনেকটা হতবাক হয়েছি। আর সেটা এ জন্য যে সাধারণত আধুনিক রাজনীতিতে একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা আরেকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে এ ধরনের অন্তত প্রকাশ্য মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। আব্দুল জলিল যে সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্যই সমস্যার সূচনা করেছেন, শুধু তা-ই নয়। তিনি গোটা জাতিকে লজ্জিত করেছেন এই বলে যে আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। বাস্তবতা যেখানে বলে, বাংলাদেশের জনগণ বিপুলভাবে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলোকে সরকার গঠন করার সুযোগ করে দিয়েছে, সেখানে জলিল সাহেবের মন্তব্য ওই সব ব্যক্তি ও দলকে সাহায্য করে, যারা বরাবরই বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করেছে। এই ধরনের মন্তব্য এর আগে আমরা ১৯৭১ সালে শুনেছিলাম এবং সেটাও ২৫ মার্চের অব্যবহিত পরে যখন পাকিস্তানের সামরিক সরকার এবং তার বাঙালি দোসরেরা এই বলে অপপ্রচার শুরু করল যে হিন্দুসম্প্রদায়ের সমর্থনের কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভ করে।
এখন জলিল সাহেব কেন এ কাজটি করতে গেলেন? নাকি এই কাজটি তাঁকে দিয়ে করানো হয়েছে, সেটা দেখার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, যদি বিগত নির্বাচন সম্পর্কে জলিল সাহেবের কোনো সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে তিনি জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তাঁর মনের কথাগুলো বলতে পারতেন। সেটা অবশ্য তিনি করেননি। এরই মধ্যে তিনি তাঁর বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তাঁর আনুগত্য ও বিশ্বাস পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। এতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যেই তিনি জাতীয় সংসদের একটি স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ হারিয়েছেন। তিনি দেশে ফিরেছেন। দলের ভেতরে এবং দেশের রাজনীতিতে তাঁর ভবিষ্যত্ কী হবে, সে বিষয়ে বোধকরি আমরা কেউই হলফ করে কিছু বলতে পারব না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অবশ্য জাতিকে জানিয়েছেন যে তিনি মনে করেন, দলের উচিত হবে জলিলকে ক্ষমা করে দেওয়া। অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের বলেছেন এবং যথার্থই বলেছেন যে আব্দুল জলিল ক্ষমা চাইতে পারেন, তবে তাঁর ইদানীংকালের কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে শাস্তি পেতে হবে।
আব্দুল জলিল যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক নির্যাতিত হয়েছেন, সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এই ক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার একটা স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু জলিল সাহেব কেন? যে অসম্মানজনকভাবে দেশের অন্যান্য নেতাকে সেই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার করা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়, সেই বিষয়ে একটি পুনঃ তদন্ত হওয়া খুবই দরকার এবং এই কারণে যে ভবিষ্যতে যেন দেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদদের অপমান করার স্পর্ধা আর কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান না করে। আমাদের এখনো স্মরণে রয়েছে, কী নাটকীয়ভাবে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এমনভাবে ভোরবেলায় তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়, যেন সবাইকে বোঝানো হচ্ছে যে এইভাবে কাজটি সম্পন্ন না হলে তিনি পলাতক বা ফেরারি হয়ে যাবেন অথবা যেতেন। এ ধরনের অপমানজনক গ্রেপ্তারের ঘটনা আরও অনেক রয়েছে। মহীউদ্দীন খান আলমগীর তাঁর নিজ অভিজ্ঞতার কথা সদ্য রচিত একটি বইয়ে তুলে ধরেছেন। মওদুদ আহমদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি আমরা, কী অকথ্য ভাষায় তাঁকে গ্রেপ্তারের পর সরকারি নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা গালাগাল করেছেন। যেসব ব্যক্তিকে কোনো দিন কোনো মন্দ কথা স্বয়ং তাঁদের পিতা-মাতার মুখ থেকে শুনতে হয়নি, সেই মন্দ কথাগুলো শুনতে হয়েছে ওই সব লোকের মুখ থেকে।
তাঁদের রাতের আঁধারে গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁরাই বলবেন, কী জঘন্যভাবে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা আব্দুল জলিলের হয়েছে। তাঁর মতো একজন সম্মানিত রাজনীতিক, যাঁর বয়স আবার অন্যদের তুলনায় একটু বেশি, তাঁকেও রিমান্ডে নেওয়া হয়। এবং আমাদের এই দেশে রিমান্ডে নিয়ে ব্যক্তিকে কী কঠিন অবস্থার মধ্যে ফেলা হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সবারই মোটামুটি একটা ধারণা রয়েছে। জলিল সাহেবের বিষয় একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তাঁকে যে প্রশ্ন করা হয় এবং তিনি যে উত্তরগুলো দেন, সেগুলো টেপ আকারে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ এক অদ্ভুত কাণ্ড! সভ্য সমাজে ও দেশে এ ধরনের কার্যকলাপ লক্ষ করা গেছে, সে কথা আমরা বলতে পারি না! আমাদের এই বাংলাদেশেই তো অনেক অন্যায়-অবিচার হয়েছে। অনেকে কারাগারে গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। কই? তাঁদেরকে কেন্দ্র করে কোনো টেপ তো সারা দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। আব্দুল জলিলের ক্ষেত্রে তাহলে এমনটি হলো কেন? এবং এর জন্য কারা দায়ী? জলিল সাহেব অবশ্য এ ব্যাপারে আমাদের কিছুটা বলেছেন। তিনি নাকি মুক্ত হওয়ার পর এবং সম্ভবত নির্বাচনের পর জানতে চেয়েছিলেন, কী করে সেই টেপ অর্থাত্ টেপে ধারণ করা তাঁর কথা বাজারে পৌঁছে? তাঁকে নাকি কে বা কারা বলেছেন যে টেপটি একজন সাংবাদিক চুরি করে বাজারে ছেড়ে দেন। এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, সেই সাংবাদিক সরকারি নিরাপত্তার এই ধরনের কড়া ও কঠিন বেষ্টনীতে কী করে প্রবেশ করলেন এবং শুধু তা-ই নয়, তিনি টেপটি কোথায় আছে, সে বিষয়েও জেনে যান এবং কোনো এক সুযোগে সেটা চুরি করে বাইরে চলে আসেন। দ্বিতীয়ত, যদি সত্যই কোনো সাংবাদিক এ কাজটি করে থাকেন, তাহলে তাঁর পরিচয়টি প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের জানার কোনো উপায় নেই, আদৌ ওই সাংবাদিক-সংক্রান্ত বিষয়টি সত্য কি না। তবে এই দেশের ইতিহাসে যে কখনো কখনো কোনো কোনো সাংবাদিক দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের গোড়ায় এক সাংবাদিক পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন, ভারতীয়দের পক্ষ থেকে বন্দী তাজউদ্দীন আহমদকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি পত্র সরকারের হাতে এসে পড়েছে। এবং সেটা ছিল খন্দকার মোশতাকের বেআইনি প্রশাসন। এই তথাকথিত তথ্য প্রকাশের এক দিনের মাথায় তাজউদ্দীন এবং তাঁর তিন সহযোগীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। তারও বেশ কয়েক বছর পর যখন ওই সাংবাদিককে সেই পত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি নাকি বলেছিলেন, পত্র তিনি দেখেননি। পত্রের ব্যাপারে কেবল তিনি শুনেছেন।
সে যা-ই হোক। এখন আমাদের জন্য জরুরি কাজটি হলো, জলিল সাহেবের যে টেপ বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সেই টেপের নেপথ্যে যদি কোনো সাংবাদিক থেকে থাকেন, তাঁকে খুঁজে বের করা। আর যদি সাংবাদিকবিষয়ক কোনো ঘটনা ঘটেই না থাকে, সে বিষয়েও অনুসন্ধান চালাতে হবে। এবং এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে অনুসন্ধান হয়েছে। ২১ আগস্ট বিষয়ে নতুন করে তদন্ত চলছে। একইভাবে আমাদের উচিত হবে ওই সব ব্যক্তিকে শনাক্ত করা, যারা ২০০৭ সালে শুধু টেপ-ই নয়, বরং বিভিন্ন ব্যক্তিকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, সেই সব মানুষকে শনাক্ত করা এবং আইনের সামনে উপস্থিত করা। যখনই কোনো ব্যক্তির আত্মমর্যাদার ওপর আক্রমণ করা হয়, তখনই মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। দুর্নীতির দায়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা এক বিষয়, আর তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্থ-অপমান করা অন্য বিষয়। নাগরিককে তুলে নিয়ে তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করা কোনো সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে না। কোনো ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাকে অবশ্যই গ্রেপ্তার করা যায়। কিন্তু সে পলাতক হলে তার পরিবারের অন্য সদস্যকে একরকম জিম্মি করে থানায় নিয়ে যেতে হবে, এ কেমন কথা?
ফিরে যাওয়া যাক আব্দুল জলিলের বিষয়ে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বক্তব্য তিনি বিদেশে গিয়ে দিয়েছেন, সে ব্যাপারে আমরা তাঁর সঙ্গে একমত নই; যেমন আমরা তাঁর সঙ্গে কয়েক বছর আগে একমত ছিলাম না, যখন তিনি আমাদের দিনের পর দিন বলে যাচ্ছিলেন, কোন এক ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন হবে। সেদিন সরকার পতনের কোনো নৈতিক ও আইনগত কারণ ছিল না। অথচ জলিল নাটকীয়তা করে গেলেন। কিন্তু তাই বলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই বক্তব্য যতই উদ্ভট আর যুক্তিবিবর্জিত হোক না কেন, এর জন্য তাঁর মানসিক ভারসাম্য নিয়ে একজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে কথা বলবেন, সেটাই বা কেমন রাজনীতি হলো? অনেকের মতো আব্দুল জলিলও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক অপমান সয়েছেন। যারা তাঁকে এবং অন্য সবাইকে এত কষ্ট দিয়েছে, এত গভীরভাবে তাদের আত্মসম্মানকে আঘাত করল, ওই সব মানুষকে আইনের মুখোমুখি করা কি খুবই কঠিন কাজ? আমরা কেউ চাইব না একই ধরনের চিত্র ভবিষ্যতে আবার আমাদের সামনে উঠে আসুক। এবং ভবিষ্যতে যাতে নতুন কোনো আঁধার আমাদের জীবনে নেমে না আসে, সেই আশঙ্কা এই বর্তমানেই রোধ করা প্রয়োজন।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
এখন জলিল সাহেব কেন এ কাজটি করতে গেলেন? নাকি এই কাজটি তাঁকে দিয়ে করানো হয়েছে, সেটা দেখার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, যদি বিগত নির্বাচন সম্পর্কে জলিল সাহেবের কোনো সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে তিনি জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে তাঁর মনের কথাগুলো বলতে পারতেন। সেটা অবশ্য তিনি করেননি। এরই মধ্যে তিনি তাঁর বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তাঁর আনুগত্য ও বিশ্বাস পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। এতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যেই তিনি জাতীয় সংসদের একটি স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ হারিয়েছেন। তিনি দেশে ফিরেছেন। দলের ভেতরে এবং দেশের রাজনীতিতে তাঁর ভবিষ্যত্ কী হবে, সে বিষয়ে বোধকরি আমরা কেউই হলফ করে কিছু বলতে পারব না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অবশ্য জাতিকে জানিয়েছেন যে তিনি মনে করেন, দলের উচিত হবে জলিলকে ক্ষমা করে দেওয়া। অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের বলেছেন এবং যথার্থই বলেছেন যে আব্দুল জলিল ক্ষমা চাইতে পারেন, তবে তাঁর ইদানীংকালের কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে শাস্তি পেতে হবে।
আব্দুল জলিল যে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক নির্যাতিত হয়েছেন, সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এই ক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার একটা স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু জলিল সাহেব কেন? যে অসম্মানজনকভাবে দেশের অন্যান্য নেতাকে সেই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেপ্তার করা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়, সেই বিষয়ে একটি পুনঃ তদন্ত হওয়া খুবই দরকার এবং এই কারণে যে ভবিষ্যতে যেন দেশের বরেণ্য রাজনীতিবিদদের অপমান করার স্পর্ধা আর কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান না করে। আমাদের এখনো স্মরণে রয়েছে, কী নাটকীয়ভাবে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এমনভাবে ভোরবেলায় তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়, যেন সবাইকে বোঝানো হচ্ছে যে এইভাবে কাজটি সম্পন্ন না হলে তিনি পলাতক বা ফেরারি হয়ে যাবেন অথবা যেতেন। এ ধরনের অপমানজনক গ্রেপ্তারের ঘটনা আরও অনেক রয়েছে। মহীউদ্দীন খান আলমগীর তাঁর নিজ অভিজ্ঞতার কথা সদ্য রচিত একটি বইয়ে তুলে ধরেছেন। মওদুদ আহমদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি আমরা, কী অকথ্য ভাষায় তাঁকে গ্রেপ্তারের পর সরকারি নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা গালাগাল করেছেন। যেসব ব্যক্তিকে কোনো দিন কোনো মন্দ কথা স্বয়ং তাঁদের পিতা-মাতার মুখ থেকে শুনতে হয়নি, সেই মন্দ কথাগুলো শুনতে হয়েছে ওই সব লোকের মুখ থেকে।
তাঁদের রাতের আঁধারে গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁরাই বলবেন, কী জঘন্যভাবে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা আব্দুল জলিলের হয়েছে। তাঁর মতো একজন সম্মানিত রাজনীতিক, যাঁর বয়স আবার অন্যদের তুলনায় একটু বেশি, তাঁকেও রিমান্ডে নেওয়া হয়। এবং আমাদের এই দেশে রিমান্ডে নিয়ে ব্যক্তিকে কী কঠিন অবস্থার মধ্যে ফেলা হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সবারই মোটামুটি একটা ধারণা রয়েছে। জলিল সাহেবের বিষয় একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে, রিমান্ডে থাকা অবস্থায় তাঁকে যে প্রশ্ন করা হয় এবং তিনি যে উত্তরগুলো দেন, সেগুলো টেপ আকারে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ এক অদ্ভুত কাণ্ড! সভ্য সমাজে ও দেশে এ ধরনের কার্যকলাপ লক্ষ করা গেছে, সে কথা আমরা বলতে পারি না! আমাদের এই বাংলাদেশেই তো অনেক অন্যায়-অবিচার হয়েছে। অনেকে কারাগারে গেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। কই? তাঁদেরকে কেন্দ্র করে কোনো টেপ তো সারা দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। আব্দুল জলিলের ক্ষেত্রে তাহলে এমনটি হলো কেন? এবং এর জন্য কারা দায়ী? জলিল সাহেব অবশ্য এ ব্যাপারে আমাদের কিছুটা বলেছেন। তিনি নাকি মুক্ত হওয়ার পর এবং সম্ভবত নির্বাচনের পর জানতে চেয়েছিলেন, কী করে সেই টেপ অর্থাত্ টেপে ধারণ করা তাঁর কথা বাজারে পৌঁছে? তাঁকে নাকি কে বা কারা বলেছেন যে টেপটি একজন সাংবাদিক চুরি করে বাজারে ছেড়ে দেন। এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন উঠে আসে। প্রথমত, সেই সাংবাদিক সরকারি নিরাপত্তার এই ধরনের কড়া ও কঠিন বেষ্টনীতে কী করে প্রবেশ করলেন এবং শুধু তা-ই নয়, তিনি টেপটি কোথায় আছে, সে বিষয়েও জেনে যান এবং কোনো এক সুযোগে সেটা চুরি করে বাইরে চলে আসেন। দ্বিতীয়ত, যদি সত্যই কোনো সাংবাদিক এ কাজটি করে থাকেন, তাহলে তাঁর পরিচয়টি প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের জানার কোনো উপায় নেই, আদৌ ওই সাংবাদিক-সংক্রান্ত বিষয়টি সত্য কি না। তবে এই দেশের ইতিহাসে যে কখনো কখনো কোনো কোনো সাংবাদিক দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের গোড়ায় এক সাংবাদিক পৃথিবীকে জানিয়ে দিলেন, ভারতীয়দের পক্ষ থেকে বন্দী তাজউদ্দীন আহমদকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি পত্র সরকারের হাতে এসে পড়েছে। এবং সেটা ছিল খন্দকার মোশতাকের বেআইনি প্রশাসন। এই তথাকথিত তথ্য প্রকাশের এক দিনের মাথায় তাজউদ্দীন এবং তাঁর তিন সহযোগীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। তারও বেশ কয়েক বছর পর যখন ওই সাংবাদিককে সেই পত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি নাকি বলেছিলেন, পত্র তিনি দেখেননি। পত্রের ব্যাপারে কেবল তিনি শুনেছেন।
সে যা-ই হোক। এখন আমাদের জন্য জরুরি কাজটি হলো, জলিল সাহেবের যে টেপ বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সেই টেপের নেপথ্যে যদি কোনো সাংবাদিক থেকে থাকেন, তাঁকে খুঁজে বের করা। আর যদি সাংবাদিকবিষয়ক কোনো ঘটনা ঘটেই না থাকে, সে বিষয়েও অনুসন্ধান চালাতে হবে। এবং এ কাজটি সরকারকেই করতে হবে। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে অনুসন্ধান হয়েছে। ২১ আগস্ট বিষয়ে নতুন করে তদন্ত চলছে। একইভাবে আমাদের উচিত হবে ওই সব ব্যক্তিকে শনাক্ত করা, যারা ২০০৭ সালে শুধু টেপ-ই নয়, বরং বিভিন্ন ব্যক্তিকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, সেই সব মানুষকে শনাক্ত করা এবং আইনের সামনে উপস্থিত করা। যখনই কোনো ব্যক্তির আত্মমর্যাদার ওপর আক্রমণ করা হয়, তখনই মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। দুর্নীতির দায়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা এক বিষয়, আর তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্থ-অপমান করা অন্য বিষয়। নাগরিককে তুলে নিয়ে তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করা কোনো সভ্য সমাজের রীতি হতে পারে না। কোনো ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাকে অবশ্যই গ্রেপ্তার করা যায়। কিন্তু সে পলাতক হলে তার পরিবারের অন্য সদস্যকে একরকম জিম্মি করে থানায় নিয়ে যেতে হবে, এ কেমন কথা?
ফিরে যাওয়া যাক আব্দুল জলিলের বিষয়ে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বক্তব্য তিনি বিদেশে গিয়ে দিয়েছেন, সে ব্যাপারে আমরা তাঁর সঙ্গে একমত নই; যেমন আমরা তাঁর সঙ্গে কয়েক বছর আগে একমত ছিলাম না, যখন তিনি আমাদের দিনের পর দিন বলে যাচ্ছিলেন, কোন এক ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন হবে। সেদিন সরকার পতনের কোনো নৈতিক ও আইনগত কারণ ছিল না। অথচ জলিল নাটকীয়তা করে গেলেন। কিন্তু তাই বলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেই বক্তব্য যতই উদ্ভট আর যুক্তিবিবর্জিত হোক না কেন, এর জন্য তাঁর মানসিক ভারসাম্য নিয়ে একজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে কথা বলবেন, সেটাই বা কেমন রাজনীতি হলো? অনেকের মতো আব্দুল জলিলও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক অপমান সয়েছেন। যারা তাঁকে এবং অন্য সবাইকে এত কষ্ট দিয়েছে, এত গভীরভাবে তাদের আত্মসম্মানকে আঘাত করল, ওই সব মানুষকে আইনের মুখোমুখি করা কি খুবই কঠিন কাজ? আমরা কেউ চাইব না একই ধরনের চিত্র ভবিষ্যতে আবার আমাদের সামনে উঠে আসুক। এবং ভবিষ্যতে যাতে নতুন কোনো আঁধার আমাদের জীবনে নেমে না আসে, সেই আশঙ্কা এই বর্তমানেই রোধ করা প্রয়োজন।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments