সড়ক দুর্ঘটনার গ্লানি অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গু ওরা by হাফিজ মুহাম্মদ
সড়কে
চলছে মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় যোগ হচ্ছে শত শত মানুষের নাম।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন দেশে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৬৪ জন। আহতের সংখ্যা এর
কয়েকগুণ বেশি। আহতদের বেশিরভাগকেই বরণ করতে হয় আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব।
স্বাভাবিক কর্মক্ষম অবস্থায় তারা আর কখনো ফিরতে পারেন না। শুধু সড়ক
দুর্ঘটনার কারণেই বাংলাদেশকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির
সম্মুখীন হতে হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানই ভয়ঙ্কর সব তথ্য
দিয়েছে। তারা বলেছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিরূপণ করা গেলেও
যারা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান, তাদের হিসাব কেউ রাখে না। দেশে প্রতিদিন এত
সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন কোনো প্রভাব পড়তে দেখা যায় না।
ছোটখাটো দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনা তেমন হয় না। তবে গত সপ্তাহে
রাজধানীর কাওরানবাজারে দুই বাসের রেশারেশিতে হাত হারানো তিতুমীর কলেজের
ছাত্র রাজীব হোসেনের দুর্ঘটনা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। যানবাহন এবং
সড়কের করুণ পরিস্থিতি ফুটে উঠছে সেদিনকার এ দুর্ঘটনাতে। শরীরের একটি মূল
অঙ্গ হারিয়ে টগবগে তরুণ রাজিবকে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়।
সেদিনকার দুই বাসের মাঝে আটকে রাজীবের বিচ্ছিন্ন এক হাত ঝুলতে দেখা যায়
বিভিন্ন গণমাধ্যমে। যে ছবি দেখে টনক নড়ে সরকার ও দেশের নানা শ্রেণি-পেশার
মানুষের। রাজিবের চিকিৎসা নিয়ে হাইকোর্টে একটি রুলে জরিমানার আদেশও এসেছে।
এর আগে গত মাসে রংপুরের মহাসড়কে লোহা বোঝাই ট্রাক উল্টে ১০ শ্রমিক নিহত হন।
তখনও সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে হইচই পড়ে যায়। এসব দুর্ঘটনা কিছুদিন
আলোচনায় থাকলেও মানুষ আবার চুপসে যায়।
বাংলাদেশের সড়ক এখন মৃত্যুপুরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর প্রতিবেদনই তা ফুটে উঠেছে। তাদের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার। এ রিপোর্টের তথ্যমতে দিনে প্রাণহানি ঘটে ৬৪ থেকে ৬৫ জনের। ডব্লিউএইচও আরও বলেছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বিশাল অঙ্কের। তাদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে ক্ষতি হয় মোট জিডিপির ১ দশমিক ৬ ভাগ। আর বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ যায় ১২ হাজারের অধিক। আহতের সংখ্যা এর থেকে আরো চার-পাঁচ গুণ বেশি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯০তম।
সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিচার্স বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) তাদের গবেষণায় বলেছে, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৬৪ জন। সর্বশেষ জরিপ বলছে, ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৬৬ জন। দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে ১৪টি শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হচ্ছে ৫০ জন। সড়কে দুর্ঘটনায় পঙ্গুদের সংখ্যা আলাদাভাবে উল্লেখ করেনি। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন অপঘাতে পঙ্গুত্ববরণ করেন ৬৬০ জন এবং ৩০০ মানুষ নিহত হন বলে জানান। সিআইপিআরবি তাদের জরিপে সড়ক দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হচ্ছে চালকদের বেপরোয়া গতি, প্রতিযোগিতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও সড়ক, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতাই দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। তারা প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রকাশ করে। আর এ কাজে সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের তথ্য এবং পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্ঘটনার প্রতিবেদন নিয়েই মূলত তারা জরিপ প্রকাশ করে। তাদের মতে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১১ থেকে ১২ হাজার। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলেছে, দেশে ৫৩ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। দুর্ঘটনার ৩৭ ভাগের কারণ হচ্ছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও মাত্রাতিরিক্ত গতি। তাদের গবেষণা আরো বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। আর এ দুর্ঘটনার ৭৪ ভাগই হয় শুধু রাজধানী ঢাকায়। দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরে এমআরআই বলেছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর জিডিপির ২ ভাগ হারাতে হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশের মোট জিডিপি ১৭ লাখ কোটি টাকা। এর দুই ভাগ হয় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। তবে এই ক্ষতি বাস্তবে আরো অনেক বেশি হবে বলেও তারা মনে করেন। কেননা দুর্ঘটনার ১০০ ভাগ পরিসংখ্যান কেউ তুলে আনতে পারে না।
সরকারিভাবে বাংলাদেশে দুর্ঘটনার হিসাব রাখে পুলিশ বিভাগ। এর বাইরে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং ফায়ার সার্ভিস মাঝে দুই একটি জরিপ পরিচালনা করে। পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায় মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার। ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তারা এখনো প্রকাশ করেনি। তবে ২০১৫ সালে ২ হাজার ৪০০ জন এবং ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১০০ জন প্রাণ হারিয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে পুলিশের বিগত দশ বছরের হিসাবে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। যা বেসরকারি তথ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এসব গবেষণার বাহিরে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এবং সড়ক দুঘর্টনার সঠিক কারণ উদ্ঘাটন নিয়ে গবেষণা করেছে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক।
আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০১৭ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন। যা দিনে ২০ জন। আর আহত হয়েছে ১৬ হাজার ১৯৩ জন। সংগঠনটির ২০১৬ সালের হিসাবের তুলনায় ২০১৭ সালে বছর ২২ দশমিক ২০ ভাগ প্রাণহানি বেড়েছে।
নিরাপদ সড়ক চাই নিসচার হিসাবে ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫ হাজার ৬৪৫ জন। দিনে নিহতের সংখ্যা ১৫ জনের অধিক। তাদের হিসাবে ২০১৬ সালের চেয়ে নিহতের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার বেড়েছে।
এদিকে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা নিয়ে যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুর্ঘটনার ২৮ ভাগ ঘটেছে মহাসড়কে গড়ে ওঠা বাজারে, ১৮ ভাগ সড়কের মোড়ে। তাদের রিপোর্টে দুর্ঘটনার জন্য চালকের বেপরোয়া যান চালানো, বেপরোয়া গাড়ি চালানো ড্রাইভারদের শাস্তি না হওয়া, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতা, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার অভাব, পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ও আইনি দুর্বলতাসহ নয়টি কারণকে দায়ী করা হয়েছে। তাদের এ গবেষণায় আরো দেখা বলা হয়েছে, দেশের মহাসড়কগুলোয় মোট ২০৯টি ব্ল্যাকস্পট রয়েছে। আর এই ২০৯টি স্থানের ৫৫ কিলোমিটারজুড়েই দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি।
প্রতিদিন এত সংখ্যক দুর্ঘটনার পরেও বেসরকারি সংস্থাগুলো বলেছে, তাদের হিসাব থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেক বেশি হবে। কেননা তারা যেসব সূত্র থেকে তথ্য নিয়েছেন তার বাইরেও দুর্ঘটনার তথ্য বাদ পড়ে যায়। সেসব দুর্ঘটনার খবর পুলিশের হিসাবে কিংবা পত্রিকায় আসে না। যে কারণে প্রকৃত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা আর নিরূপণ করা যায় না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনিস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে সাধারণ জনগণ, বাস মালিক, পুলিশ ও বাস কেউ নিয়মের মধ্যে আসে না। বর্তমানে একটি মৎসল অবস্থায় আছে। এক কথায় সড়কে অরাকজতা চলছে। আমাদের দেশে দুর্ঘটনার পরিমাণ এর থেকেও আরো বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তা কমই হয়। সড়কে চলতে গেলে দেখবেন একটি গাড়ির সঙ্গে অন্যটি ঘষাঘষি করে, ওভারটেকিংয়ে প্রতিযোগিতায় চলে। বাংলাদেশে সবাই কথা বলতে পারে কেউ কাজের কাজ করে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিদিন কত সংখ্যক পঙ্গুত্ব বরণ করেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই জানিয়ে বুয়েটের এ অধ্যাপক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে নিহতের পরিসংখ্যানটাই স্টান্ডার্ড নয়। জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী দুর্ঘটনায় আহত একজন ব্যক্তিকে ৩০ দিন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ রাখতে হয়। এরমধ্যে সে মারা গেছে নাকি পঙ্গু অথবা সুস্থ হয়েছে তা রেকর্ড করতে হয়। যারা আহত হন তাদের একটা পরিসংখ্যান থাকলেও সেটাও শতভাগ ঠিক নয়। সেখানে পঙ্গুত্বর সংখ্যা কেউ বলতে পারছে না। তিনি মনে করেন, দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় যথাযথ বরাদ্দ থাকলে তা নিরূপণ করা সম্ভব।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রায় ৫০টির অধিক কারণ রয়েছে। সড়কে প্রতিবছর আমাদের যে পরিমাণ মানুষের জীবনহানী ঘটে তার দ্বিগুণেরও বেশি পঙ্গুত্ববরণ করেন। এ কারণে আমাদের জিডিপির প্রায় দুই ভাগ ক্ষতি হয়। ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে দরকার চালকদের সঠিক ট্রেনিং। তাদেরকে ঠিকভাবে ট্রেনিং দেয়া হলে তারা সঠিকভাবেই লাইসেন্স পেত। তাদের ট্রেনিং নেই বলে তারা সঠিকভাবে লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে না। আর এ কারণেই প্রতিদিন দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন নিবন্ধিত গাড়ি আছে ৩৩ লাখ অথচ সেখানে নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা মাত্র ১৩ লাখ। ২০ লাখ চালকই নিবন্ধন ছাড়া গাড়ি চালায়। যে কারণে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপরে আমাদের পথচারী সাধারণ মানুষ যারা রয়েছেন তারাও জানেন না সড়ক কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। রাস্তায় যে সতর্কতার সঙ্গে হাঁটা-চলা করতে হবে, রাস্তা পাড়ি দিতে হবে, সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে- এটা তাদের মধ্যে দেখা যায় না।
বাংলাদেশের সড়ক এখন মৃত্যুপুরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর প্রতিবেদনই তা ফুটে উঠেছে। তাদের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার। এ রিপোর্টের তথ্যমতে দিনে প্রাণহানি ঘটে ৬৪ থেকে ৬৫ জনের। ডব্লিউএইচও আরও বলেছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বিশাল অঙ্কের। তাদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে ক্ষতি হয় মোট জিডিপির ১ দশমিক ৬ ভাগ। আর বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ যায় ১২ হাজারের অধিক। আহতের সংখ্যা এর থেকে আরো চার-পাঁচ গুণ বেশি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯০তম।
সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিচার্স বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) তাদের গবেষণায় বলেছে, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৬৪ জন। সর্বশেষ জরিপ বলছে, ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৬৬ জন। দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে ১৪টি শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হচ্ছে ৫০ জন। সড়কে দুর্ঘটনায় পঙ্গুদের সংখ্যা আলাদাভাবে উল্লেখ করেনি। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন অপঘাতে পঙ্গুত্ববরণ করেন ৬৬০ জন এবং ৩০০ মানুষ নিহত হন বলে জানান। সিআইপিআরবি তাদের জরিপে সড়ক দুর্ঘটনার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হচ্ছে চালকদের বেপরোয়া গতি, প্রতিযোগিতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও সড়ক, যাত্রী ও পথচারীদের অসচেতনতাই দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। তারা প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রকাশ করে। আর এ কাজে সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের তথ্য এবং পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্ঘটনার প্রতিবেদন নিয়েই মূলত তারা জরিপ প্রকাশ করে। তাদের মতে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১১ থেকে ১২ হাজার। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলেছে, দেশে ৫৩ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। দুর্ঘটনার ৩৭ ভাগের কারণ হচ্ছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও মাত্রাতিরিক্ত গতি। তাদের গবেষণা আরো বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। আর এ দুর্ঘটনার ৭৪ ভাগই হয় শুধু রাজধানী ঢাকায়। দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরে এমআরআই বলেছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর জিডিপির ২ ভাগ হারাতে হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশের মোট জিডিপি ১৭ লাখ কোটি টাকা। এর দুই ভাগ হয় ৩৪ হাজার কোটি টাকা। তবে এই ক্ষতি বাস্তবে আরো অনেক বেশি হবে বলেও তারা মনে করেন। কেননা দুর্ঘটনার ১০০ ভাগ পরিসংখ্যান কেউ তুলে আনতে পারে না।
সরকারিভাবে বাংলাদেশে দুর্ঘটনার হিসাব রাখে পুলিশ বিভাগ। এর বাইরে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং ফায়ার সার্ভিস মাঝে দুই একটি জরিপ পরিচালনা করে। পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায় মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার। ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তারা এখনো প্রকাশ করেনি। তবে ২০১৫ সালে ২ হাজার ৪০০ জন এবং ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১০০ জন প্রাণ হারিয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে পুলিশের বিগত দশ বছরের হিসাবে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। যা বেসরকারি তথ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এসব গবেষণার বাহিরে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এবং সড়ক দুঘর্টনার সঠিক কারণ উদ্ঘাটন নিয়ে গবেষণা করেছে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক।
আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০১৭ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন। যা দিনে ২০ জন। আর আহত হয়েছে ১৬ হাজার ১৯৩ জন। সংগঠনটির ২০১৬ সালের হিসাবের তুলনায় ২০১৭ সালে বছর ২২ দশমিক ২০ ভাগ প্রাণহানি বেড়েছে।
নিরাপদ সড়ক চাই নিসচার হিসাবে ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫ হাজার ৬৪৫ জন। দিনে নিহতের সংখ্যা ১৫ জনের অধিক। তাদের হিসাবে ২০১৬ সালের চেয়ে নিহতের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার বেড়েছে।
এদিকে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা নিয়ে যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে দুর্ঘটনার ২৮ ভাগ ঘটেছে মহাসড়কে গড়ে ওঠা বাজারে, ১৮ ভাগ সড়কের মোড়ে। তাদের রিপোর্টে দুর্ঘটনার জন্য চালকের বেপরোয়া যান চালানো, বেপরোয়া গাড়ি চালানো ড্রাইভারদের শাস্তি না হওয়া, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ট্রাফিক ব্যবস্থার দুর্বলতা, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার অভাব, পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ও আইনি দুর্বলতাসহ নয়টি কারণকে দায়ী করা হয়েছে। তাদের এ গবেষণায় আরো দেখা বলা হয়েছে, দেশের মহাসড়কগুলোয় মোট ২০৯টি ব্ল্যাকস্পট রয়েছে। আর এই ২০৯টি স্থানের ৫৫ কিলোমিটারজুড়েই দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি।
প্রতিদিন এত সংখ্যক দুর্ঘটনার পরেও বেসরকারি সংস্থাগুলো বলেছে, তাদের হিসাব থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেক বেশি হবে। কেননা তারা যেসব সূত্র থেকে তথ্য নিয়েছেন তার বাইরেও দুর্ঘটনার তথ্য বাদ পড়ে যায়। সেসব দুর্ঘটনার খবর পুলিশের হিসাবে কিংবা পত্রিকায় আসে না। যে কারণে প্রকৃত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা আর নিরূপণ করা যায় না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনিস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে সাধারণ জনগণ, বাস মালিক, পুলিশ ও বাস কেউ নিয়মের মধ্যে আসে না। বর্তমানে একটি মৎসল অবস্থায় আছে। এক কথায় সড়কে অরাকজতা চলছে। আমাদের দেশে দুর্ঘটনার পরিমাণ এর থেকেও আরো বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তা কমই হয়। সড়কে চলতে গেলে দেখবেন একটি গাড়ির সঙ্গে অন্যটি ঘষাঘষি করে, ওভারটেকিংয়ে প্রতিযোগিতায় চলে। বাংলাদেশে সবাই কথা বলতে পারে কেউ কাজের কাজ করে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিদিন কত সংখ্যক পঙ্গুত্ব বরণ করেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই জানিয়ে বুয়েটের এ অধ্যাপক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে নিহতের পরিসংখ্যানটাই স্টান্ডার্ড নয়। জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী দুর্ঘটনায় আহত একজন ব্যক্তিকে ৩০ দিন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ রাখতে হয়। এরমধ্যে সে মারা গেছে নাকি পঙ্গু অথবা সুস্থ হয়েছে তা রেকর্ড করতে হয়। যারা আহত হন তাদের একটা পরিসংখ্যান থাকলেও সেটাও শতভাগ ঠিক নয়। সেখানে পঙ্গুত্বর সংখ্যা কেউ বলতে পারছে না। তিনি মনে করেন, দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় যথাযথ বরাদ্দ থাকলে তা নিরূপণ করা সম্ভব।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রায় ৫০টির অধিক কারণ রয়েছে। সড়কে প্রতিবছর আমাদের যে পরিমাণ মানুষের জীবনহানী ঘটে তার দ্বিগুণেরও বেশি পঙ্গুত্ববরণ করেন। এ কারণে আমাদের জিডিপির প্রায় দুই ভাগ ক্ষতি হয়। ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে দরকার চালকদের সঠিক ট্রেনিং। তাদেরকে ঠিকভাবে ট্রেনিং দেয়া হলে তারা সঠিকভাবেই লাইসেন্স পেত। তাদের ট্রেনিং নেই বলে তারা সঠিকভাবে লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে না। আর এ কারণেই প্রতিদিন দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন নিবন্ধিত গাড়ি আছে ৩৩ লাখ অথচ সেখানে নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা মাত্র ১৩ লাখ। ২০ লাখ চালকই নিবন্ধন ছাড়া গাড়ি চালায়। যে কারণে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপরে আমাদের পথচারী সাধারণ মানুষ যারা রয়েছেন তারাও জানেন না সড়ক কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। রাস্তায় যে সতর্কতার সঙ্গে হাঁটা-চলা করতে হবে, রাস্তা পাড়ি দিতে হবে, সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে- এটা তাদের মধ্যে দেখা যায় না।
No comments