গণ-অভ্যুত্থানের ২৫ বছর ‘কাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য গুলি করছেন?’ by সোহরাব হাসান

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করে বেরিয়েছেন আলিফুর রহমান। গতকাল তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ১৯৯০ সাল সম্পর্কে কী জানেন? তিনি বললেন, শুনেছি এরশাদের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন হয়েছিল। কেন আন্দোলন হয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত কিছু জানেন না। কেউ কিছু তাঁকে বলেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজের কাছে একই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এরশাদ নির্বাচিত একটি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ কারণে মানুষ আন্দোলন করে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শফিকুর রহমানের মতে, পঁচাত্তরের পর যে স্বৈরতান্ত্রিক ধারা চলে আসছিল, তারই ধারাবাহিকতায় এরশাদ ক্ষমতায় আসেন এবং নব্বইয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন।
এই প্রজন্মের তিন শিক্ষার্থীর বক্তব্য থেকে ইতিহাসের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা পূর্ণাঙ্গ নয়, খণ্ডিত। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তাদের জানতে দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মতো নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসকেও যে যার মতো করে ব্যাখ্যা করছেন, সময়ের ব্যবধানে সেই ব্যাখ্যা আবার বদলেও দিচ্ছেন। নব্বইয়ের অব্যবহিত পর আন্দোলনরত তিন জোট স্বৈরতন্ত্রের পতন ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকে ঘটা করে উদ্যাপন করলেও এখন আর কারও মধ্যে সেই জোশ লক্ষ করা যাচ্ছে না। কেউ স্বৈরাচারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের দলভুক্ত করেছেন, কেউ বা খোদ স্বৈরাচারকে ক্ষমতার শরিক করে নিয়েছেন। এ কারণেই সেদিনের পরিত্যক্ত স্বৈরশাসক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুই শীর্ষ নেত্রীকে নিয়ে উপহাস করার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন।
আজ ২ ডিসেম্বর। নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বের সপ্তম দিন। ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারি পর থেকেই ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহরে কারফিউ বলবৎ ছিল। কিন্তু ছাত্র–জনতা তা অমান্য করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এমনকি তারা নেতা–নেত্রীদের হুকুমেরও অপেক্ষা করেনি। ২ ডিসেম্বর কারফিউ উপেক্ষা করেই ছাত্ররা রাজপথে এরশাদের প্রতীকী বিচার বসিয়ে তাঁর ফাঁসি ঘোষণা করে এবং একটি গাছে তাঁর কুশপুত্তলিকা ঝুলিয়ে তা কার্যকর করে। ওই দিনই ঢাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘কাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভাইয়ের বুকে গুলি করছেন?’
২ ডিসেম্বরই এক সমাবেশে ছাত্রনেতারা ঘোষণা করেন, ‘বন্ধুদের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ঐক্য গড়েছি, এরশাদকে বিদায় না করে ঘরে ফিরব না।’
আমরা আরও পেছনে গেলে দেখতে পাব, ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর ইসলামী ছাত্রশিবির ছাড়া সব ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য পরিষদ গঠিত হয়। এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত এক থাকার ঘোষণা দেয় তারা। এরপরই আটটি যুবসংগঠন মিলে যুব সংগ্রাম পরিষদ, ১৯টি শ্রমিক সংগঠন মিলে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, ৯টি কৃষক ও খেতমজুর সংগঠন মিলে কৃষক খেতমজুর সংগ্রাম পরিষদ, ১৮টি নারী সংগঠন মিলে ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজ গঠিত হয় এবং তারা এরশাদের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করে। শতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে ১৯৮৩ সালে গঠিত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটও আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। গত চার দিনের মতো ২ ডিসেম্বরও সাংবাদিকেরা সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করেন এবং দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ থাকে।
সেদিনের ছাত্র–জনতার আন্দোলনের রূপ কী ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল, তার কিছুটা চিত্র পাওয়া যায়, এরশাদেরই এককালীন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর রাজনীতির তিনকাল বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘২৭ নভেম্বর ছাত্র–জনতা জরুরি আইন অমান্য করে মিছিল ও সমাবেশ করতে থাকে। পুলিশ ও বিডিআরের সঙ্গে ছাত্র–জনতার সংঘর্ষে সারা দেশে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়, এর মধ্যে ঢাকায় ৩০ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, রাজশাহীতে ৩ জন, খুলনায় ৩ জন, নারায়ণগঞ্জে ২ জন ও ময়মনসিংহে ৪ জন নিহত হন। তাঁর ভাষায় ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছাত্র–জনতার চলমান আন্দোলন আরও তীব্র হয়। ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীরাও লাঠিসহ মিছিল বের করে। ২৮ নভেম্বর সকালে মালিবাগে রেলপথ অবরোধ করলে লাইনে ট্রেন রেখে চালক পালিয়ে যান। ফলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর অলিতে গলিতে হাজার হাজার মানুষ কারফিউ ভেঙে মিছিল করে। বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র–জনতার খণ্ডযুদ্ধ হয় এবং প্রাণহানিও ঘটে।
মিজানুর রহমান চৌধুরীর বই থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, এরশাদ আন্দোলনকারীদের দমন করতে পুলিশ–বিডিআরের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামালেও তারা ছিল নিষ্ক্রিয়। তাদের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণেই শেষ পর্যন্ত এরশাদকে পদত্যাগ করতে হয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.