পাশ্চাত্যে ইসলামভীতি by সাহাদত হোসেন খান
পাশ্চাত্যের
দেশগুলোতে ইসলামকে ভীতির চোখে দেখা হচ্ছে এবং মুসলমানের প্রতি অসহিষ্ণুতা
প্রদর্শন করা হচ্ছে। ইংরেজিতে এ ভীতিকে বলা হচ্ছে ‘ইসলামোফোবিয়া’। শব্দটি
ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ অথবা তাদের ভীতি
বুঝাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড
ট্রেড সেন্টার বা টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা থেকে ‘ইসলামোফোবিয়া’
শব্দটির ব্যাপক প্রচলন। কেউ বা বলছেন, পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোতে
মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি থেকে ইসলামোফোবিয়ার জন্ম হয়েছে। এমন একটি
বর্ণবাদী ভীতি জন্ম নেয়ায় স্পষ্টত পৃথিবী উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্ট- এ দু’টি
কৃত্রিম শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেদেরকে উৎকৃষ্ট ও
মুসলমানদের নিকৃষ্ট হিসেবে গণ্য করছে।
১৯৩০-এর দশকে যেভাবে অ্যান্টি-সেমেটিক বা ইহুদি-বিরোধী ভীতিকে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে ব্যবহার করা হতো, স্নায়ুযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সেভাবে ইসলামোফোবিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৪১ সালের ২১ নভেম্বর নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের সাথে ফিলিস্তিনি আরব নেতা, মুফতি আমিন আল-হুসাইনির সাক্ষাতের একটি ছবি প্রচার করা হচ্ছে। নাৎসিবাদের সাথে একাকার করে ফেলা হচ্ছে ইসলামকে এবং এ দু’টিকে সমান্তরাল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। নাৎসিবাদের সাথে ইসলামের সাদৃশ্য বুঝাতে এঁকে দেয়া হচ্ছে নাৎসি প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন।
মেরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধান অনুযায়ী ইসলামোফোবিয়া হলো বিশেষ কোনো বস্তু, বিশেষ কোনো শ্রেণী বা পরিস্থিতির ব্যাপারে অতিরঞ্জিত, ব্যাখ্যাতীত ও অযৌক্তিক ভীতি। এ ভীতির উৎস খুঁজে বের করা কঠিন হলেও এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্নভাবে ইসলামোফোবিয়াকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি অতিরঞ্জিত ভীতি, ঘৃণা ও বৈরিতা বিরাজ করায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণ থেকে তাদের বঞ্চিত এবং কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে।
২০১১ সালের ১১-১৩ ডিসেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় ইউনাইটেড ন্যাশন্স অ্যালায়েন্স অব সিভিলাইজেশন (ইউএনএওসি) এবং এ সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, লিগ অব আরব স্টেটের চতুর্থ সম্মেলনে ইসলামোফোবিয়াকে একটি গভীর উদ্বেগের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, মার্কিন সরকার ২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে ১৬০ জনের বেশি মুসলিম-আমেরিকান সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী ও অপরাধীকে চিহ্নিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর হাজার হাজার সন্ত্রাসী ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। সরকারি নির্যাতন এবং প্রচারণার জোরে সন্দেহভাজন মুসলিম-আমেরিকানরা জাতির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন।
বামপন্থী ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা রানিমেড ট্রাস্ট ১৯৯৬ সালে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার গর্ডন কোনওয়ের নেতৃত্বে মুসলিম অ্যান্ড ইসলামোফোবিয়া-বিষয়ক একটি কমিশন গঠন করেছিল। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে ‘ইসলামোফোবিয়া : অ্যা চ্যালেঞ্জ ফর আস অল’ শিরোনামে কমিশনের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা এবং ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০০৪ সালে রানিমেড ট্রাস্ট তাদের পরবর্তী রিপোর্ট প্রকাশ করে। দ্বিতীয় রিপোর্টে দেখা যায়, সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ মুসলমানদের জীবন দুরূহ হয়ে উঠেছে। প্রথম রিপোর্টের মুখবন্ধে বলা হয়, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই ইউরোপীয় সমাজে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বৈরিতা বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন সময় এ বৈরিতা ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্পেনে প্রদর্শিত বৈরিতার সাথে ক্রুসেডে প্রদর্শিত বৈরিতার মিল নেই। একইভাবে, অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে ইউরোপীয় দেশগুলোর বিবাদকালে প্রদর্শিত বৈরিতাও এক নয়। ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুসলিম অভিবাসীর সংখ্যা দেড় কোটিতে উন্নীত হলে বৈরিতায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। আরেকটি কারণ হলো, বিশ্বমঞ্চে তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর অধিক গুরুত্ব। দেশগুলোর বেশির ভাগই মুসলিম। আরেকটি কারণ হলো, মুসলিম দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন। চতুর্থ কারণটি হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি রাজনৈতিক দলের উত্থান।
কোথাও কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে বিনা প্রমাণে ইসলাম ও মুসলমানদের দায়ী করা হয়। জিহাদকে সন্ত্রাসবাদের উৎস হিসেবে রায় দেয়া হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিম গ্রুপ পাশ্চাত্যের এ ধারণার তীব্র বিরোধিতা করছে। তারা বলছেন, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের আগ্রাসী শক্তি ইসরাইলের প্রতি পাশ্চাত্যের সহানুভূতি থেকে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হচ্ছে এবং ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের কোনো সম্পর্ক নেই।
২০০৬ সালের ২৯ আগস্ট জোহানেস ক্যান্ডেল ‘ইসলামোফোবিয়া-অন দ্য ক্যারিয়ার অব অ্যা কন্ট্রোভার্সিয়াল টার্ম’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ইসলামোফোবিয়া’ হলো, একটি অস্পষ্ট শব্দ। শব্দটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিটি বোধগম্য ও কল্পিত কার্যকলাপে পরিব্যাপ্ত। ব্রিটিশ সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক ডগলাস মারে ‘ফরগেট ইসলামোফোবিয়া : লেট’স ট্যাকল ইসলামিজম’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইসলামোফোবিয়া শব্দটি এত অযথার্থ যে, এ সংজ্ঞার মধ্যে কুরআনসহ ইসলামের প্রতি অবমাননা এবং ক্ষতিসাধনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর মার্কসবাদী ওয়েবসাইট পলিটিক্যাল ডট নেটের সাথে সাক্ষাৎকারে ‘মেকিং মুসলিম দ্য এনিমি’ শিরোনামে বইয়ের লেখক, অধ্যাপক পিটার গোটচক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার আগেও ইসলামোফোবিয়ার অস্তিত্ব ছিল। আমরা আমেরিকান বিপ্লবের আগে আমেরিকায় ইসলামোফোবিয়ার প্রমাণ দেখতে পাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্পেনীয়রা আমেরিকায় তাদের উপনিবেশগুলোতে ক্রীতদাসপ্রথা চালু করার সময় কোনো আফ্রিকান মুসলিম দাস আছে কি না, সে ব্যাপারে প্রায়ই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠত। কেননা তারা আশঙ্কা করত যে, মুসলিম ক্রীতদাসরা সম্ভবত বিদ্রোহ করবে। তাদের অধীনে যেসব দাস ছিল তাদের তারা বলপূর্বক ‘মরো বনাম খ্রিষ্টান’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করতে বাধ্য করত। এ নাটক মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে মরো মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডিং খ্রিষ্টান বাহিনীর আইবেরীয় উপদ্বীপ পুনর্দখল (রিকনকুয়েস্টা) উদযাপন করা হতো। ইতঃপূর্বে আফ্রিকান মুসলমানেরা রাজনৈতিকভাবে আইবেরীয় উপদ্বীপে আধিপত্য করত। অধ্যাপক গোটচক আরো বলেন, ইসলামোফোবিয়াকে আমেরিকার আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং রাজনৈতিক কার্টুনিস্টরা ইসলামকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন অঙ্কন করছেন।
ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক করিনা বালাশ ক্যারের মতো কয়েকজন পণ্ডিত ইসলামোফোবিয়াকে এক ধরনের বর্ণবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং ২০০৭ সালে সোসিওলোজি জার্নালের এক নিবন্ধে ইসলামোফোবিয়াকে মুসলিম বিরোধী বর্ণবাদ এবং এশীয় ও আরব বিরোধী অব্যাহত বর্ণবাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। ব্রিটিশ শ্রমিক দলের রাজনীতিবিদ জন ডেনহ্যাম লন্ডনের দ্য টাইমসে ‘ফ্যাসিজিম ফিয়ার্স’ শিরোনামে এক নিবন্ধে আধুনিক ইসলামোফোবিয়া এবং ১৯৩০-এর দশকে বিদ্যমান ইহুদিবিরোধিতার মধ্যে একটি সাদৃশ্য অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন। সাবেক সুইডিশ রাজনীতিবিদ মাউদ এলিজাবেথ ওলোফসন এবং লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের থিওলজি ও রিলিজিয়াস স্টাডিজের এমিরিটাস অধ্যাপক জান হাজারপিও অনুরূপ চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ কল্পিত ইসলামোফোবিয়া ও বর্ণবাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রিন্স আল-ওয়ালিদ ইসলামিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের গবেষণা সহযোগী জোসেলিন ক্যাসারি লিখেছেন যে, গবেষকেরা এখনো শব্দটির বৈধতা নিয়ে বিতর্ক করছেন এবং বর্ণবাদ, মুসলিমবিরোধিতা, ইসলামবিরোধিতা ও ইহুদিবিরোধিতার মতো শব্দগুলো কিভাবে ইসলামোফাবিয়া থেকে পৃথক, তা দেখানোর চেষ্টা করছেন। তুর্কি আন্ডার সেক্রেটারি বুরাক আরদেনির একটি গবেষণাধর্মী নিবন্ধে লিখেছেন: ‘সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আর্বিভাবের সময় থেকে ইউরোপে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল। তিনটি পর্বে ইউরোপে মুসলমানদের আগমন ঘটেছে। আইবেরীয় উপদ্বীপে মুর সভ্যতা বা উত্তর আফ্রিকান মুসলিম বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপে প্রথম মুসলিম অভিবাসন ঘটেছিল। উত্তরাঞ্চলীয় স্লাভ অঞ্চলে তাতার মুসলমানেরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে দ্বিতীয়পর্যায়ের অভিবাসন ঘটে। অটোমান মুসলমানদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপে তৃতীয়পর্যায়ে মুসলিম অভিবাসন ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে ইসলাম ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যায়। ক্রুসেড এবং ইউরোপে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় ও মুসলমানেরা একে অন্যের মুখোমুখি হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে মুসলমান অভিবাসীরা চতুর্থ বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলমানেরা সাবেক উপনিবেশ ও অনুন্নত দেশগুলো থেকে মূলত অভিবাসী হিসেবে ইউরোপে অভিবাসন করে।
পরবর্তী দশকগুলোয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ এবং নিজ নিজ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আরো বহু মুসলমান শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। অভিবাসী, শ্রমিক, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ইউরোপে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এতে বিদ্যমান মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগ তীব্রতর হয়ে ওঠে। কদাচিৎ তাদের ইউরোপের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তাদের সমাজ ও শহরের ঘেটোতে কোণঠাসা করে রাখা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউরোপীয়দের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল সীমিত। ইরানের ইসলামি বিপ্লব, ধর্মবিদ্বেষী, ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদিকে হত্যার ফতোয়া, ফ্রান্সে হিজাব পরিধান নিয়ে বিরোধ, মাদ্রিদ ও লন্ডনের পাতাল ট্রেনে বোমা বিস্ফোরণ এবং ডেনমার্কে মহানবীর সা: কার্টুন প্রকাশের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হলে ইউরোপে মুসলমানদের প্রতি ইতিবাচক ধারণার অবসান ঘটে। মুসলমানদের ভাবমূর্তি কথিত আগ্রাসীতে রূপান্তরিত হয়।
২০১১ সালের ১১ মার্চ ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সে অ্যালান জনসন ‘দ্য আইডিয়া অব ইসলামোফোবিয়া’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছেন, কখনো কখনো ইসলামোফোবিয়া ধর্মীয় মোড়কে বর্ণবাদ এবং বদ্ধমূল বিদ্বেষের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে দেখা দেয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন, ২০০৬ সালে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এথনিসিটি অ্যান্ড কালচার স্টাডি সেন্টারের পরিচালক তাহির আব্বাস বলেছেন, যুক্তরাজ্যকে একটি লাগামহীন ইসলামোফোবিয়া গ্রাস করছে এবং মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে বিঘ্নিত, অস্থিতিশীল ও কার্যকরভাবে অপসারণে একটি ভূরাজনৈতিক অভিযান তাকে সহায়তা করছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে আইনগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তরাজ্যকে তিনি অভিযুক্ত করেন।
১৯৩০-এর দশকে যেভাবে অ্যান্টি-সেমেটিক বা ইহুদি-বিরোধী ভীতিকে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিতে ব্যবহার করা হতো, স্নায়ুযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সেভাবে ইসলামোফোবিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৪১ সালের ২১ নভেম্বর নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের সাথে ফিলিস্তিনি আরব নেতা, মুফতি আমিন আল-হুসাইনির সাক্ষাতের একটি ছবি প্রচার করা হচ্ছে। নাৎসিবাদের সাথে একাকার করে ফেলা হচ্ছে ইসলামকে এবং এ দু’টিকে সমান্তরাল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। নাৎসিবাদের সাথে ইসলামের সাদৃশ্য বুঝাতে এঁকে দেয়া হচ্ছে নাৎসি প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন।
মেরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধান অনুযায়ী ইসলামোফোবিয়া হলো বিশেষ কোনো বস্তু, বিশেষ কোনো শ্রেণী বা পরিস্থিতির ব্যাপারে অতিরঞ্জিত, ব্যাখ্যাতীত ও অযৌক্তিক ভীতি। এ ভীতির উৎস খুঁজে বের করা কঠিন হলেও এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্নভাবে ইসলামোফোবিয়াকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি অতিরঞ্জিত ভীতি, ঘৃণা ও বৈরিতা বিরাজ করায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণ থেকে তাদের বঞ্চিত এবং কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে।
২০১১ সালের ১১-১৩ ডিসেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় ইউনাইটেড ন্যাশন্স অ্যালায়েন্স অব সিভিলাইজেশন (ইউএনএওসি) এবং এ সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, লিগ অব আরব স্টেটের চতুর্থ সম্মেলনে ইসলামোফোবিয়াকে একটি গভীর উদ্বেগের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, মার্কিন সরকার ২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে ১৬০ জনের বেশি মুসলিম-আমেরিকান সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী ও অপরাধীকে চিহ্নিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর হাজার হাজার সন্ত্রাসী ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। সরকারি নির্যাতন এবং প্রচারণার জোরে সন্দেহভাজন মুসলিম-আমেরিকানরা জাতির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন।
বামপন্থী ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা রানিমেড ট্রাস্ট ১৯৯৬ সালে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার গর্ডন কোনওয়ের নেতৃত্বে মুসলিম অ্যান্ড ইসলামোফোবিয়া-বিষয়ক একটি কমিশন গঠন করেছিল। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে ‘ইসলামোফোবিয়া : অ্যা চ্যালেঞ্জ ফর আস অল’ শিরোনামে কমিশনের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা এবং ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২০০৪ সালে রানিমেড ট্রাস্ট তাদের পরবর্তী রিপোর্ট প্রকাশ করে। দ্বিতীয় রিপোর্টে দেখা যায়, সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ মুসলমানদের জীবন দুরূহ হয়ে উঠেছে। প্রথম রিপোর্টের মুখবন্ধে বলা হয়, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই ইউরোপীয় সমাজে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বৈরিতা বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন সময় এ বৈরিতা ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্পেনে প্রদর্শিত বৈরিতার সাথে ক্রুসেডে প্রদর্শিত বৈরিতার মিল নেই। একইভাবে, অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে ইউরোপীয় দেশগুলোর বিবাদকালে প্রদর্শিত বৈরিতাও এক নয়। ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুসলিম অভিবাসীর সংখ্যা দেড় কোটিতে উন্নীত হলে বৈরিতায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। আরেকটি কারণ হলো, বিশ্বমঞ্চে তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর অধিক গুরুত্ব। দেশগুলোর বেশির ভাগই মুসলিম। আরেকটি কারণ হলো, মুসলিম দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন। চতুর্থ কারণটি হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি রাজনৈতিক দলের উত্থান।
কোথাও কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে বিনা প্রমাণে ইসলাম ও মুসলমানদের দায়ী করা হয়। জিহাদকে সন্ত্রাসবাদের উৎস হিসেবে রায় দেয়া হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিম গ্রুপ পাশ্চাত্যের এ ধারণার তীব্র বিরোধিতা করছে। তারা বলছেন, ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের আগ্রাসী শক্তি ইসরাইলের প্রতি পাশ্চাত্যের সহানুভূতি থেকে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হচ্ছে এবং ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের কোনো সম্পর্ক নেই।
২০০৬ সালের ২৯ আগস্ট জোহানেস ক্যান্ডেল ‘ইসলামোফোবিয়া-অন দ্য ক্যারিয়ার অব অ্যা কন্ট্রোভার্সিয়াল টার্ম’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ইসলামোফোবিয়া’ হলো, একটি অস্পষ্ট শব্দ। শব্দটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিটি বোধগম্য ও কল্পিত কার্যকলাপে পরিব্যাপ্ত। ব্রিটিশ সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক ডগলাস মারে ‘ফরগেট ইসলামোফোবিয়া : লেট’স ট্যাকল ইসলামিজম’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইসলামোফোবিয়া শব্দটি এত অযথার্থ যে, এ সংজ্ঞার মধ্যে কুরআনসহ ইসলামের প্রতি অবমাননা এবং ক্ষতিসাধনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর মার্কসবাদী ওয়েবসাইট পলিটিক্যাল ডট নেটের সাথে সাক্ষাৎকারে ‘মেকিং মুসলিম দ্য এনিমি’ শিরোনামে বইয়ের লেখক, অধ্যাপক পিটার গোটচক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার আগেও ইসলামোফোবিয়ার অস্তিত্ব ছিল। আমরা আমেরিকান বিপ্লবের আগে আমেরিকায় ইসলামোফোবিয়ার প্রমাণ দেখতে পাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্পেনীয়রা আমেরিকায় তাদের উপনিবেশগুলোতে ক্রীতদাসপ্রথা চালু করার সময় কোনো আফ্রিকান মুসলিম দাস আছে কি না, সে ব্যাপারে প্রায়ই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠত। কেননা তারা আশঙ্কা করত যে, মুসলিম ক্রীতদাসরা সম্ভবত বিদ্রোহ করবে। তাদের অধীনে যেসব দাস ছিল তাদের তারা বলপূর্বক ‘মরো বনাম খ্রিষ্টান’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করতে বাধ্য করত। এ নাটক মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে মরো মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডিং খ্রিষ্টান বাহিনীর আইবেরীয় উপদ্বীপ পুনর্দখল (রিকনকুয়েস্টা) উদযাপন করা হতো। ইতঃপূর্বে আফ্রিকান মুসলমানেরা রাজনৈতিকভাবে আইবেরীয় উপদ্বীপে আধিপত্য করত। অধ্যাপক গোটচক আরো বলেন, ইসলামোফোবিয়াকে আমেরিকার আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং রাজনৈতিক কার্টুনিস্টরা ইসলামকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন অঙ্কন করছেন।
ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক করিনা বালাশ ক্যারের মতো কয়েকজন পণ্ডিত ইসলামোফোবিয়াকে এক ধরনের বর্ণবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং ২০০৭ সালে সোসিওলোজি জার্নালের এক নিবন্ধে ইসলামোফোবিয়াকে মুসলিম বিরোধী বর্ণবাদ এবং এশীয় ও আরব বিরোধী অব্যাহত বর্ণবাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। ব্রিটিশ শ্রমিক দলের রাজনীতিবিদ জন ডেনহ্যাম লন্ডনের দ্য টাইমসে ‘ফ্যাসিজিম ফিয়ার্স’ শিরোনামে এক নিবন্ধে আধুনিক ইসলামোফোবিয়া এবং ১৯৩০-এর দশকে বিদ্যমান ইহুদিবিরোধিতার মধ্যে একটি সাদৃশ্য অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন। সাবেক সুইডিশ রাজনীতিবিদ মাউদ এলিজাবেথ ওলোফসন এবং লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের থিওলজি ও রিলিজিয়াস স্টাডিজের এমিরিটাস অধ্যাপক জান হাজারপিও অনুরূপ চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ কল্পিত ইসলামোফোবিয়া ও বর্ণবাদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রিন্স আল-ওয়ালিদ ইসলামিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের গবেষণা সহযোগী জোসেলিন ক্যাসারি লিখেছেন যে, গবেষকেরা এখনো শব্দটির বৈধতা নিয়ে বিতর্ক করছেন এবং বর্ণবাদ, মুসলিমবিরোধিতা, ইসলামবিরোধিতা ও ইহুদিবিরোধিতার মতো শব্দগুলো কিভাবে ইসলামোফাবিয়া থেকে পৃথক, তা দেখানোর চেষ্টা করছেন। তুর্কি আন্ডার সেক্রেটারি বুরাক আরদেনির একটি গবেষণাধর্মী নিবন্ধে লিখেছেন: ‘সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আর্বিভাবের সময় থেকে ইউরোপে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল। তিনটি পর্বে ইউরোপে মুসলমানদের আগমন ঘটেছে। আইবেরীয় উপদ্বীপে মুর সভ্যতা বা উত্তর আফ্রিকান মুসলিম বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপে প্রথম মুসলিম অভিবাসন ঘটেছিল। উত্তরাঞ্চলীয় স্লাভ অঞ্চলে তাতার মুসলমানেরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে দ্বিতীয়পর্যায়ের অভিবাসন ঘটে। অটোমান মুসলমানদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপে তৃতীয়পর্যায়ে মুসলিম অভিবাসন ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে ইসলাম ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যায়। ক্রুসেড এবং ইউরোপে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় ও মুসলমানেরা একে অন্যের মুখোমুখি হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে মুসলমান অভিবাসীরা চতুর্থ বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলমানেরা সাবেক উপনিবেশ ও অনুন্নত দেশগুলো থেকে মূলত অভিবাসী হিসেবে ইউরোপে অভিবাসন করে।
পরবর্তী দশকগুলোয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ এবং নিজ নিজ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আরো বহু মুসলমান শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। অভিবাসী, শ্রমিক, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ইউরোপে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এতে বিদ্যমান মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগ তীব্রতর হয়ে ওঠে। কদাচিৎ তাদের ইউরোপের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তাদের সমাজ ও শহরের ঘেটোতে কোণঠাসা করে রাখা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউরোপীয়দের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল সীমিত। ইরানের ইসলামি বিপ্লব, ধর্মবিদ্বেষী, ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদিকে হত্যার ফতোয়া, ফ্রান্সে হিজাব পরিধান নিয়ে বিরোধ, মাদ্রিদ ও লন্ডনের পাতাল ট্রেনে বোমা বিস্ফোরণ এবং ডেনমার্কে মহানবীর সা: কার্টুন প্রকাশের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হলে ইউরোপে মুসলমানদের প্রতি ইতিবাচক ধারণার অবসান ঘটে। মুসলমানদের ভাবমূর্তি কথিত আগ্রাসীতে রূপান্তরিত হয়।
২০১১ সালের ১১ মার্চ ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সে অ্যালান জনসন ‘দ্য আইডিয়া অব ইসলামোফোবিয়া’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছেন, কখনো কখনো ইসলামোফোবিয়া ধর্মীয় মোড়কে বর্ণবাদ এবং বদ্ধমূল বিদ্বেষের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে দেখা দেয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন, ২০০৬ সালে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এথনিসিটি অ্যান্ড কালচার স্টাডি সেন্টারের পরিচালক তাহির আব্বাস বলেছেন, যুক্তরাজ্যকে একটি লাগামহীন ইসলামোফোবিয়া গ্রাস করছে এবং মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে বিঘ্নিত, অস্থিতিশীল ও কার্যকরভাবে অপসারণে একটি ভূরাজনৈতিক অভিযান তাকে সহায়তা করছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে আইনগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তরাজ্যকে তিনি অভিযুক্ত করেন।
No comments