গল্প- শিমুর বিয়ের গল্প by আন্দালিব রাশদী
শিমু ও এখলাসুর রহমানের বয়সের
ব্যবধান—যদি দুজনই ঠিক বয়স বলে থাকে, সাড়ে ১৪ বছর। দু-চার মাস বেশিই হবে।
বয়স কমিয়ে রাখার প্রবণতাটি তো আর মিথ্যে নয়। প্রেম-ভালোবাসা করে বিয়ে
নয়। আয়োজনটা পারিবারিক। পেশাদার না হলেও ঘটকের কাজটি করেছেন শিমুর ছোট
ফুপা এ এন এম নুরুল মোস্তফা। বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল। ছোট ফুপা যে কলেজের
ভাইস প্রিন্সিপাল, সেখানেই ফিজিক্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর এখলাসুর
রহমান। এখলাসের দিক থেকে কোনো চাওয়া না থাকায় বিয়েটা চূড়ান্ত হতে সময়
লাগেনি। বরপক্ষে নুরুল মোস্তফার কাউন্টারপার্ট এখলাসের বড় দুলাভাই হোসেন
উদ্দিন বললেন, ‘বর ও কনের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য বাক্য আদান-প্রদান
জরুরি। কিন্তু তা যেন শালীনতার সীমা লঙ্ঘন না করে। সে ক্ষেত্রে বরং
টেলিফোনে সীমিত আলাপ অনুমোদন করা যায়, কী বলেন?’
তাঁর জিজ্ঞাসার কেউ জবাব দেননি। আবার প্রস্তাব যে প্রত্যাখ্যান করেছেন, এটাও মনে হয়নি।
সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর এক সন্ধিক্ষণে এখলাসুর রহমান সুরাইয়া আকতার শিমুকে ফোন করে এ কথা-সে কথার একপর্যায়ে সরাসরি বলল, ‘আপনি সত্যিই আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন তো?’
শিমু থতমত খায়, ‘মানে, আপনি কী জানতে চাইছেন? গার্ডিয়ানরা সবাই দেখেশুনে ফাইনাল করেছেন, আমার না চাওয়ার কী আছে? কেন, আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি?’
‘আমি তো নিজেই পছন্দ করেছি। দেখলেন না আপনাকে দেখতে এসে সবার সামনে কেমন বেহায়ার মতো বললাম, খুব পছন্দ হয়েছে।’
এখলাসের কথায় হেসে উঠতে চাইল শিমু, কিন্তু এখনই হাসা ঠিক হবে না ভেবে ফোনের অপর প্রান্তে মুখ চেপে ভেতরের তাগিদটা সংবরণ করল।
এখলাস বলল, ‘আমি যত দূর জানি নুরুল মোস্তফা সাহেব আপনাদের বলেছেন, আমার বয়স তিরিশের একটু বেশি। কিন্তু কত বেশি তা বলেননি। আমি যদি আমার আসল বয়সটা আপনাকে অন্তত না বলি, নিজের মধ্যে একটা অপরাধবোধ থেকে যাবে। আমার জন্ম ১৯৩৫-এর এপ্রিলে, আর এখন ১৯৭২-এর মার্চ, মানে সাঁইত্রিশ বছর—থার্টি সেভেন ইয়ার্স। আর আপনার কেবল একুশ পেরিয়েছে। এখনো বাইশও হয়নি। ব্যবধানটা প্রায় ষোলো বছরের। এটা কি একবারও চিন্তা করেছেন, আপনি যথেষ্ট ইয়ং থাকতেই আমি বুড়ো হয়ে যাব। আপনার যখন হবে পঁয়ত্রিশ, তখন আপনার ভরা যৌবন, আমার সে সময় পঞ্চাশ পেরিয়ে যাবে। আপনার যখন চুয়াল্লিশ, আমি ষাট! আপনার তখনো পূর্ণ যৌবন। ষাট বছর বয়সী একজন মানুষের কথা ভাবুন তো।’
শিমু খেপেই গেল, ‘কী সব আবোল-তাবোল বলতে আমাকে ফোন করেছেন। আমি কি ফোন রেখে দেব?’
‘ভুল বুঝবেন না। সত্যিটা আগে থেকে জানা থাকলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তা ছাড়া আমরা তো সত্যিটাকে একটু রেখেঢেকে সুবিধামতো বলে থাকি। সেজন্যই আপনাকে একটু ভাবতে বলেছিলাম।’
‘আমার এত ভাবাভাবির সময় নেই।’
এখলাস বলল, ‘আপনি জানেন না, এমনকি বুড়ো মহিলারাও বুড়ো হাজব্যান্ড পছন্দ করেন না। তাই একটু ভেবে দেখতে বলছি। তা ছাড়া বয়সটা একটু কাছাকাছি না হলে একই ওয়েভলেঙ্গথে চিন্তাও করা যায় না।’
‘ফোনে যদি আপনার এসব নসিহত আমাকে শুনতে হয় তাহলে বরং খোদা হাফেজ।’
এখলাস বলল, ‘আপনি ইচ্ছে করলেই লাইন কেটে দিতে পারেন। তবে জেনে রাখুন, আপনাকে আমার সত্যিই খুব পছন্দ হয়েছে। আমি ভেবেছি, আপনাকে বিয়ে করতে পারাটা আমার জন্য বড় ভাগ্যের ব্যাপার হবে। কিন্তু বয়স লুকিয়ে আপনার সঙ্গে প্রতারণা করে ভাগ্যবান হলে পরে বিবেকের খোঁচা খেতে হবে। আমাদের প্রায় ষোলো বছরের বয়স ব্যবধান মাথায় রেখে ঠান্ডাভাবে চিন্তা করলে ভিন্ন সিদ্ধান্ত আপনি নিতেও পারেন, সে জন্যই এটা বলা। আমার বাবা ও মায়ের বয়সের ব্যবধান আরও বেশি—তেত্রিশ বছর। মায়ের যখন আঠারো, বাবার তখন একান্ন। মা অবশ্য তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়েটা আমার মায়ের বেলায় অবশ্য প্রথম।’
এ কথাতে শিমু বেশ একটু জোর পায়। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার বাবার বয়সের কারণে আপনার মায়ের বড় কোনো সমস্যা হয়েছে কি? আমার বাবা ও মায়ের বয়সের ব্যবধানও কমপক্ষে পনেরো বছর। তাঁদের কোনো অসুবিধে হয়েছে বলে তো শুনিনি।’
‘না, আমার মাকেও কখনো অভিযোগ করতে শুনিনি।’
‘বয়স-টয়সের কথা বলে প্যাঁচ বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। আমাকে পছন্দ হয়নি—সোজাসাপটা এই কথাটি বলে ফেলুন। আমার গায়ের রংটা যে ফর্সা নয়, এটা তো আমি জানিই। চোখে আঙুল দিয়ে নতুন আর কী দেখাবেন?’
টেলিফোন কথোপকথনে ভাঙনের সুরটাই প্রবল হয়ে ওঠায় সুর পাল্টে এখলাস বিনীত কণ্ঠে শিমুকে বলল, ‘আপনি আমাদের বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইছেন? আপনাদের কার্ড তো এখনো ছাপাই হয়নি, আমাদের তো বিতরণও শেষ। এখন যদি বিয়েটা ভেঙে দেন, নিমন্ত্রিত চার-পাঁচ শ পরিবারের কাছে মুখ দেখাব কেমন করে?’
‘আপনি মেয়েলোকের মতো কথা বলছেন কেন? বিয়ে ভাঙলে কলঙ্ক হয় মেয়েদের; বিয়ে ভাঙায় পুরুষ মানুষ সমস্যায় পড়েছে এমন কখনো শুনিনি।’
এখলাস বলল, ‘আমরা এতক্ষণ যা বলেছি, দয়া করে তার সব আপনার স্মৃতি থেকে মুছে দিন। অনুষ্ঠানের আগে একবার আসুন না নিউমার্কেটে। নভেল ড্রিংস হাউসে একটু বসি, কথা বলি।’
‘আপনার পরিকল্পনাটা ভালোই। আমি যে ফরসা নই, এটা কাছে থেকে দেখে নিশ্চিত হতে চান? তারপর বয়স কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে বিয়েটা ভেঙে দেবেন। এই তো?’
এখলাস অদ্ভুত এক কর্তৃত্বের স্বরে বলল, ‘শিমু।’
নিজের নাম শুনে বশীভূত শিমু বলল, ‘জি।’
‘তেইশে মার্চ তোমার-আমার বিয়ে। তৈরি থেকো।’
শিমু বলল, ‘আচ্ছা।’
বয়সের সমস্যা কোথায় যে তলিয়ে গেল!
২.
লোকটা কি বিয়ের আগেই তাকে বশীভূত করে ফেলল। বয়সটয়স নিয়ে কীসব পণ্ডিতি করল। বিয়েশাদিতে বয়স আবার একটা বিষয় হলো নাকি?
শিমুদের পক্ষে বিয়ের অনুষ্ঠানটি হয় ২৩ মার্চ ১৯৭২, লেডিস ক্লাবে। ২৫ মার্চ এখলাসদের পক্ষে বউভাতের অনুষ্ঠান। আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারে। এক বছর আগে এমন ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে গনগনে আগুনে জ্বলেছে ঢাকা।
বউভাতের অনুষ্ঠান সেরে এখলাসদের লালবাগের বাসায় পৌঁছাতে রাত বারোটা। শিমুর মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে এখলাসকেও। তবুও শিমুকে জড়িয়ে ধরল।
‘আজ না হয় থাক।’ শিমু বলল।
এখলাস বলল, ‘আচ্ছা।’ বলেই দু-তিন মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
শিমুর ঘুম এল না। এক ধরনের অস্থিরতায় ও চাপা যন্ত্রণায় মধ্যরাত পার হয়ে গেল। তারপর ঠিক ঘুম নয়, ঝিমুনি। চোখ দুটি লেগে আসে, আবার ভেঙে যায়। যদি একটু বেশিক্ষণ লেগে থাকে, তখন কীসব দুঃস্বপ্ন এসে হাজির হয়।
রাত তখন কত হবে—তিন কি চার। এখলাস পাশ ফিরে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি ঘুমোওনি?’
‘তুমি কেমন করে বুঝলে?’
এই প্রথম শিমু এখলাসকে তুমি বলল। একবার তুমি বলে ডাকতে পারলে আর আপনিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।
‘এই তো আমার মনে হলো তুমি ঘুমোওনি।’ বলল এখলাস।
শিমু বলল, ‘আমার ভয় লাগছে।’
‘ভয় কিসের, আমি তো আছি।’
এখলাস তার একটা পা তুলে দিল সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর ওপর। একজন অন্যজনকে আঁকড়ে ধরবে, পা তুলে দেবে, বুকে মুখ ঘষবে—এটাই তো হওয়ার কথা।
শিমুকে সংসারের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তোতলা শমসের।
দুভাবে শমসের তাকে ডাকত—শিইইইইইই (ইইই বলার সময় কয়েকবার ঢোঁক গিলবে) মু; অথবা শিমউউউউউ (উউউ করার সময়ও ঢোঁক গিলবে)। শিমু বলত, ‘থাক থাক এত কষ্ট করে ডাকতে হবে না। বলো, কী বলবে?’
‘কিইইইছু না, কিছু না, এমনি ডেকেছি।’
একবার কথা শুরু করলে আর থামে না। রবিকরোজ্জ্বল কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ়-জাতীয় জটিল শব্দও অবলীলায় বলে যায়।
একই বয়সী দুজন। দু-চার মাস এদিক-ওদিক হতে পারে। শমসের দাবি করে, বেশির দিকটাতেই সে—বয়সে শিমুর চেয়ে বড়। শিমু বলে, ‘ধ্যাৎ, চার-ছয় মাসের বড় কোনো ব্যাপার হলো? যখন তুমি ন্যাংটা, আমিও ন্যাংটা।’
দুজনই তখন বিএ প্রথম বর্ষের; তখন মানে উনিশ শ সত্তরে। শিমু ইডেনে, শমসের ঢাকা কলেজে। শিক্ষা সপ্তাহের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইল অনেকে, কিন্তু তবলাবাদক একজনই, তোতলা শমসের। শিমু হারমোনিয়ামে হাত রেখেই তবলাবাদককে বলল, ‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানে বাজাতে পারবেন তো?’
শমসের এতটুকুও না তোতলিয়ে মুখের ওপর বলল, ‘আগে গানটা ধরেন, দেখি গাইতে পারেন কি না।’
শিমুল বলেই ফেলল, ‘এমন ভাব দেখাচ্ছিস যেন ওস্তাদ আল্লারাখা। বেশ গাইছি: পিয়া পিয়া পিয়া কে ডাকে আমারে মায়াময় এই মধু সন্ধ্যায়...।’
গানের শেষে আড়চোখে চেয়ে শমসের বলল, ‘অন্তরাতে তাআআল কেটে গেছে বোঝোনি?’
তাল কাটার কথা শমসের যেভাবে বলেছে, শিমু না রেগে বরং হেসে ফেলেছে। শুরুটা এভাবেই। দেখা হলে কথা-কাটাকাটিই বেশি হয়। এমনকি একপর্যায়ে শমসের শিমুকে বলেছে, ‘তোমাকে দিয়ে গান হবে না। তোমার মধ্যে সিরিয়াসনেস নেই।’
শিমু বলে, ‘তুমি কত বড় সিরিয়াস বাহাদুর, জানা আছে।’
তত দিনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সমবয়সী অনেকেই শিমুকে ডাকতে শুরু করেছে, ‘শিইইইমু।’
শিমুর মনে হলো, তোতলা শমসের তার নামের ওপর চেপে বসেছে। সেই শমসেরই একদিন রিহার্সেলের এক ফাঁকে তাকে বলল, ‘আমি কিন্তু তোমাকেই বিয়ে করব।’
‘বয়েই গেছে। তোমাকে বিয়ে করে তোতলা বাচ্চার মা হতে আমার বয়েই গেছে।’
শমসের অবাক চোখে তাকিয়েছে শিমুর দিকে—বাচ্চা হওয়ার চিন্তা তার মাথায় আসেনি, এমনকি বিয়ে কথাটাও কথার কথা—শিমু এতদূর ভেবেছে!
একাত্তরের গনগনে মার্চের প্রথম দিন শমসের তাকে ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম কমনওয়েলথ একাদশের ক্রিকেট ম্যাচ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ হইহই রইরই শুরু হলো, গ্যালারির একদিকে আগুনও ধরানো হলো। কথা ছিল মধ্যাহ্ন বিরতির সময় স্টেডিয়ামে প্রভিন্সিয়াল রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি খাবে। জাতি তখন আর খাবারের কথা ভাবছে না—কেবল ভাবছে গনগনে আগুনে পাকিস্তান জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা।
বাস, রিকশা কিছুই পায়নি। পায়ে হেঁটে পরিবাগের সরু রাস্তা দিয়ে হাতিরপুল। ওখানে দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়—শমসের ঢাকা কলেজের দিকে, শিমু ভূতের গলিতে।
শিমুদের বাড়িতে টেলিফোন ছিল। শমসেরের ফোন থাকার কথা নয়, ঠিকানাও শিমুর জানা ছিল না। শমসের যদি নিজে থেকে যোগাযোগ না করে, তাহলে বলতেই হবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
একুশে মার্চ শমসের হাজির। শিমুকে বলল, ‘এখন চলো। ধানমন্ডি স্কুলে রিহার্সেল হবে। তারপর গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে রাস্তায় নামব আমরা। একটা ট্রাকও পেয়ে যেতে পারি।’
‘কী করব?’ শিমু জিজ্ঞেস করে।
শমসের বলে, ‘ভয় কী মরণে জাগিছে সন্তানে/মাতঙ্গ মেতেছে আজ সমর রঙ্গে/তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমি দ্রিমি দ্রাম দ্রাম...। বাসা থেকে একটা গামছা নিয়ে এসো আর হারমোনিয়ামটাও।’
দুই পাশের আংটার সঙ্গে গামছার দুই প্রান্ত বেঁধে তখনই হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে নিল শমসের। তবলাবাদক হারমোনিয়াম বাজাতেও জানে। গুনগুন করে গাইলও।
‘তুমি গাইলেই পারতে। গলাটা তো ভালোই।’
শমসের বলল, ‘একজনও তোতলা শিল্পীর নাম বলতে পারবে? তোতলারা গায়ক হয় না, বাদক হয়।’
ধানমন্ডি স্কুলের কয়েকটি রুম খোলাই ছিল। হারমোনিয়াম-তবলাও সাজানো। তবলার সামনে বসে শমসের বলল, ‘আগে হাত দুটো চালু করে নিই। শিমু, একটা গান ধরো তো।’
অমনি হারমোনিয়ামে আঙুল চালাল শিমু। গাইতে শুরু করল: ‘আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি/মোর নিশিথ বাসরশয্যায়/মন বলে ভালোবেসেছি/আঁখি বলিতে পারে না লজ্জায়।’
মুখটুকু গাওয়ার পর শমসেরকে ধমকে উঠল সে, ‘তুমি বাজাচ্ছ না কেন?’
‘শুনতেই ভালো লাগছে।’
‘ধ্যাৎ।’
‘অন্তরাটা ধরো।’
‘পারব না।’
৩.
ট্রাক এল দুটি। শিল্পীরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। শিমু গেল দক্ষিণে, শমসের উত্তরে। শিমু চাইছিল শমসেরের সঙ্গে থাকতে, কিন্তু হলো না।
সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরল শিমু। রাত এগারোটার মধ্যেও যখন হারমোনিয়াম ফেরত দিতে এল না, শমসেরের ওপর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল তার।
সকালে বাবা ধমকাল শিমুকে, ‘কাদের সঙ্গে চলাফেরা করিস। একটা বদমাশ রাত সাড়ে বারোটার সময় একটা হারমোনিয়াম রেখে গেছে। এসব পাগল-ছাগলের সঙ্গে মেশামেশা বন্ধ কর। তুই যে মেয়েমানুষ, এটা মনে রাখিস। হারমোনিয়ামের প্যা-পো-প্যা-পো বাজিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করা যাবে না, এটাও মনে রাখিস।’
শমসেরের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। কথাও না।
অবরুদ্ধ স্বদেশে শিমু ভূতের গলির বাসা ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের বাড়িতে, কখনো এই গাঁয়ে, কখনো ওই গাঁয়ে একাত্তরের ডিসেম্বর পার করেছে। ডিসেম্বরের শেষ দিন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় নিজেদের বাড়িতে ঢুকে তার চোখ আটকে যায় দুই আংটায় গামছা বাঁধা হারমোনিয়ামে। তোতলা শমসেরটা এমনই পাষণ্ড, একবার খোঁজও নিল না। অবশ্য কোথায় খোঁজ নেবে। শিমু ঢাকায় ছিল না। যেসব জায়গায় ছিল, শমসের তার ঠিকানা পাবে কোথায়?
অস্থির শিমু তার পক্ষে যতটা সম্ভব খোঁজ নিয়েছে। শমসের—কোন শমসের? তোতলা শমসের! প্রায় সবাই বলেছে, ‘চিনি না।’ দু-একজন বলেছে, ‘মুক্তিতে যোগ দিয়েছিল। মরেটরে গেছে বোধ হয়। তাকে কী দরকার?’
এ প্রশ্নের জবাব শিমুর অন্তরে জমাট বেঁধে ছিল, ‘আমি একটি তোতলা সন্তানের মা হতে চাই।’
৪.
শিমু সশব্দেই এখলাসকে বলল, ‘এত বয়স বয়স কোরো না। বয়স তো কেবল একটা সংখ্যা—একুশও যা, সাতাশও তা, সাঁইত্রিশও একই কথা।’
বিয়ের আগে এখলাস যখন শিমুকে বয়সের কথা বলেছে, তার মনে হয়েছিল, বিয়ে ভেঙে দেওয়ার এটাও একটা হুমকি। সেদিন এখলাসের সঙ্গে কথা শেষ করে ঘর থেকে শিমু বেরিয়ে যায় তোতলা শমসেরের খোঁজে। ঢাকা কলেজে কেবল তরুণদের ভিড়ে একটি মাত্র তরুণী, সে শিমু; সে জনে জনে জিজ্ঞেস করে ওই যে শমসের—একটু তোতলায়, ভালো তবলা বাজায়, নাকটা খাড়া, চোখ খুব উজ্জ্বল, একাত্তরে বিএর ছাত্র। কেউ শনাক্ত করতে পারে না। নামের রেজিস্টার দেখে একজন বলল, ‘শমসের নামে বিএ-তে আমাদের কোনো ছাত্র ছিল না—সত্তরেও না, একাত্তরেও না, এ বছরও নেই।’
‘কিন্তু আমি তো তা-ই জানতাম।’ শিমু বলল কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে।
‘আপনি ভুল জানতেন। দেশটা ঠগ-প্রতারকে ভরে গেছে।’
তারই পাশে বসা অন্য আরেক কেরানি বলল, ‘আমাদের মাইজদিতে শমসের নামের এক মুক্তিকে জিপের সঙ্গে বেঁধে তিন মাইল হেঁচড়ে নিয়েছে। আধমাইল টানার পরই তাঁর মৃত্যু হয়। পরের আড়াই মাইল না টানলেও চলত।’
শিমুর পা টলছে। কেরানিকে বলল, ‘একটু বসি।’
‘এটা ব্যাটাছেলেদের কলেজ। এখানে মেয়েমানুষ বসতে পারবে না।’
মাথাটা চক্কর দিল শিমুর, শরীরটা মনে হলো ওজনশূন্য। যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই বসে পড়ল। কোনোভাবে মাথা ঘুরানো ব্ল্যাকআউট কাটিয়ে উঠে বলল, ‘আমার মনে হয় আমি এই শমসেরের কথাই বলছি।’
আধঘণ্টা পর তাকে রিকশায় তুলে দিয়ে কেরানি বলল, ‘শমসেরের জন্য বেহুদা চিন্তা কইরা লাভ নাই। পুরুষমানুষকে বিশ্বাস করলে ঠকবেন। শমসের নামে কেউ নেই। যদি থাকেও দেখবেন আপনার শমসের এখন কোথাও ঘরসংসার করছে।’
তাকে এত দূর এগিয়ে দিতে আসা লোকটির ওপর মেজাজ খারাপ হলো শিমুর। ধমকের স্বরে বলল, ‘বাজে কথা বলবেন না। এসব শুনতে আমার ভালো লাগে না।’
১৯৭২-এর ২৫ মার্চ, মধ্যরাতে ঘুমাক্রান্ত এখলাস যখন খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য শিমুকে জড়িয়ে ধরে, শিমু তখন তার একান্ত ব্যক্তিগত জগতে—একটি মিলিটারি জিপের সঙ্গে বাঁধা দড়ি তারই সমবয়সী তোতলা শমসেরকে মাইজদির এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তখনো প্রাণ যায়নি তার। অস্ফুট কণ্ঠে বলছে, ‘শিইইইমু, আমি কিন্তু তোমাকে বিয়ে করব।’
শিমু জবাব দেয়, ‘তোমার মতো বাচ্চা ছেলেকে কে বিয়ে করে। আমার সঙ্গে আমার হাজব্যান্ডের বয়সের ব্যবধান হতে হবে পনেরো থেকে কুড়ি বছর। ষোলো হলে সবচেয়ে ভালো। আমার হাজব্যান্ড এখলাসের বয়স সাঁইত্রিশ, আর আমার একুশ।’
No comments