বাউলসাধকদের গানে মানুষ-ভজনা by সুমনকুমার দাশ
বাংলা লোকগানে মানুষ-ভজনার বিষয়টি
সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রবহমান। বৈশ্বিক জীবনে
সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ও সংকটে লোক-গীতিকাররা মানবমহিমায় গান গেয়ে
অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়গান করেছেন। চণ্ডীদাসের বহুল প্রচলিত ‘শুনো হে
মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ পঙ্ক্তি দুটো তো রীতিমতো
প্রবাদতুল্য। এরকম শত-সহস্র মানবিকতামণ্ডিত পদাবলি বাংলা গানের ভুবনকে
আলোকিত ও সমৃদ্ধ করেছে।
বৈষ্ণব সাহিত্য ও দর্শনে এবং লৌকিক প্রণয়-গীতিতেও জাতপাত আর উঁচু-নিচু ভেদাভেদের বিরুদ্ধে শুদ্ধ প্রেমের শাশ্বত বাণী উচ্চারিত হয়েছে। চৈতন্য ও চৈতন্যোত্তর যুগ পেরিয়ে ‘নানারূপ সঙ্গীতে- লৌকিক গাথা ও গীতিকাব্যে’ মানুষ-বন্দনার অসামান্য প্রভাব ছিল গীতিকারদের মধ্যে। গ্রামীণ নিরক্ষর এসব গীতিকারদের কাব্যরসে উন্নততর গুণের প্রমাণ স্পষ্ট। অনেকটা নীরবে-নিভৃতে মানবপ্রেমের বিকাশ ঘটাতে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন অসংখ্য চেনা-অচেনা পল্লী গীতিকার-গায়ক।
বাংলার বাউল-ফকির পরম্পরায় সাধকদের কণ্ঠেও একইভাবে মানবপ্রেম সঞ্চারিত হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার সুর তাদের গানের অন্যতম বিষয়বস্তু। আশরাফ-আতরাফ, ধনী-গরিব, কালো-সাদা, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, জাত-পাত ভেদাভেদ দূরে ঠেলে সাধকরা যুগে-যুগে কালে-কালে অভিন্নভাবে ভারতবর্ষে মানবপ্রেমের মহিমা ছড়িয়েছেন। মানবিকবোধ-সংক্রান্ত উচ্চ চিন্তামূলক মনোভাব তাদের গানে দেখতে পাওয়া যায়।
বাউল-ফকির মতবাদের প্রচার ও প্রসারে কুষ্টিয়ার বাউলসাধক লালনের (১৭৭৪-১৮৯০) নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়ে থাকে। তার একাধিক গানেও মানুষ-বন্দনার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়। বলা যায়, তিনিই পরবর্তীকালে বাউল-ফকিরদের মধ্যে মানুষ ভজনার দর্শন প্রচারের সেতু তৈরি করেছেন। লালন লিখেছেন- ‘মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/সে কি অন্য তত্ত্ব মানে’ কিংবা ‘এমন মানব জনম আর কি হবে-/অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই/দেব দেবতাগণ করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে’। উপর্যুক্ত গান দুটির অন্তরালে মানবপ্রেমের অন্তঃশীল সত্য প্রতিভাসিত হয়েছে। এ ধারা পরবর্তী সঙ্গীতসাধকদের মধ্যেও প্রবাহিত ছিল। যেমনটা রয়েছে বর্তমানের সঙ্গীতকারদের মধ্যেও।
সংকীর্ণ মৌলবাদ ও ভ্রান্ত সাম্প্রদায়িক চেতনা যখনই সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই যুথবদ্ধভাবে বাউলসাধকরা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়েছেন। মানবসমাজে সম্প্রীতিতে যেন চির না-ধরে সেজন্য গ্রাম-জনপদ কাঁপিয়ে সাধকরা কণ্ঠে তুলেছেন মানবতার জয়গান। অথচ মানবধর্মের জয়গান-সংবলিত এসব গানকে অনেকটা অসচেতনতায় যথার্থভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না তেমনভাবে। তবে আবহমানকাল গ্রামীণ সাধারণ শ্রোতারা সেসব গান শুনেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হতেন।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা চরম সংকট তৈরি করেছে। এ সংকট তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্র বাউলগানের বিস্তৃতি কমে যাওয়ার বিষয়টিও একটি অন্যতম কারণ। বাউলগানের আসর একদিকে দ্রুত কমে যাচ্ছে অপরদিকে ওয়াজ মাহফিলের পরিসর ক্রমশ বাড়ছে।
বাউলগানের আসরে মানবমহিমার যেসব গান গীত হতো, তা লোপ পাওয়ায় মানুষ-বন্দনা সম্পর্কিত মতবাদ প্রচারে অনেকটা ভাটা পড়েছে। প্রায় নীরবে-নিভৃতে চোখের অলক্ষে হারিয়ে যেতে বসেছে উজ্জ্বল সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হওয়া মানবপ্রেমের বন্দনামূলক গানের ক্ষেত্রটি। অথচ এর রোধ ঠেকাতে আমরা অনেকটাই নির্বিকার ভূমিকা পালন করছি। যদি মানবমুখী এসব গানের বিস্তৃতি ও পরিসর বাড়ানো সম্ভব হতো তাহলে ধর্মের নামে যেসব কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস সমাজে প্রচলিত রয়েছে সেসব থেকে সহজেই উত্তরণ সম্ভব হতো।
যশোরের দুদ্দু শাহ (১৮৪১-১৯১১) লিখেছিলেন- ‘কালী কিংবা মক্কায় যাও রে মন/দেখতে পাবে মানুষের বদন’। দুদ্দু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজ্যদেবী কালী কিংবা মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান মক্কায় মানুষের সত্তার অনুধাবন করার বিষয়টিতে জোরারোপ করে চিরায়ত মানববন্দনার বিষয়টিকেই উপস্থাপন করেছেন। একইভাবে সিলেটের একলিমুর রাজার কণ্ঠেও একই অভিমত প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন- ‘মনেতে মথুরা আছে/মক্কা কাবার ঘর-/তারই মাঝে বিরাজিছে/মানুষ সুন্দর’। আর কুবির গোঁসাই তো সরাসরি ‘মানুষে নিষ্ঠারতি’ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
সৃষ্টিকর্তা আসলে মানুষের ভেতরেই অবস্থান করছেন, এমনটিই বাউল-ফকিরদের মতবাদ। সে কারণেই নিত্য খ্যাপা বলেছেন- ‘মানুষেতে মানুষ আছে মানুষ নাচায় মানুষই নাচে/মানুষ যায় মানুষের কাছে মানুষ হইতে’। এ-রকম হাজারো সাধু-সন্তের বাণী মানবপ্রেমের মহিমাকে ধারাবাহিকভাবে চির উদ্ভাসিত করে রেখেছে। সাধক খোদা বক্শ শাহ মানুষ-ভজনার বিষয়টি এভাবেই গুরুত্ব দিয়েছেন :
মানুষ ভজন করব বলে মনেতে করি বাসনা
বনফুলে পুঁজি মানুষ মনফুল তো ফুটিল না।
মানবলীলা সব লীলার সার শুনেছি তাই শ্রবণে
কী রূপে ভজিব মানুষ তাহার সন্ধান জানিনে
সেবা কিংবা ভক্তি দিলে
তাই কি মানুষভজা বলে
চন্দন প্রদীপ আর বনফুলে কীসে হয় মানুষের ভজনা।
মানুষে মনহুঁশ কামনা করি বল কেমনে
ফুল তুলিতে বেলা গেল মালা গাঁথব কখনে
মম মনসুতা নাইকো ভালো
কেমনে মালা গাঁথব বলো
গাঁথতে গাঁথতে বেলা গেল কণ্ঠে পরাব কখনা।
ত্রিলোকের মনোহরা রূপ নববপু তাহার স্বরূপ
পুঁজিলে কি মেলে মানুষ গঙ্গাজল তুলসী দিলে ধূপ
উচ্চ করে আসন দিলে
তাই কি মানুষভজা বলে
শুকচাঁদ সাঁই মোর কীসে মেলে দীন বক্শর সদা এই ভাবনা।
সাধুসন্তরা ‘অন্তর-মন্দিরে’ মানুষকে স্থান দিয়ে তার মহিমা প্রচারে সদা ব্যস্ত ছিলেন। খোদাকে পেতে হলে মানুষ ভজনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। গোপাল দাস সে বিষয়ে ইঙ্গিত করেই প্রশ্ন করেছিলেন : ‘মানুষ না ধরিলে/মানুষ না ভজিলে/খোদা কি মেলে-’। প্রকৃতপক্ষে তা-ই। বস্তুবাদী চেতনার অধিকারী নেত্রকোনা অঞ্চলের সাধক জালাল উদ্দীন খাঁ-তো সরাসরিই খোদাকে আক্রমণ করে বসেছেন :
আমি না-থাকিলে খোদা তোমার জায়গা ভবে নাই
স্থান না-পেয়ে অন্য কোথাও আমাতে লয়েছ ঠাঁই।
মানুষ থুইয়া খোদা ভজো এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে
মানুষ ভজো কোরান খুঁজো পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।
বিচার করলে নাই রে বিভেদ কে হিন্দু কে মুসলমান
রক্ত মাংস একই বটে সবার ঘটে একই প্রাণ।
জালাল উদ্দীন খাঁ যেমন করে মানুষের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা-প্রীতিকে সবার আগে ঠাঁই দিয়েছেন তেমনি হাউড়ে গোঁসাই, পাগলা কানাই, পাঞ্জু শাহ, দ্বিজদাস, মনোমোহন, হাসন রাজা, রশিদ উদ্দিন, দীন শরৎ, ফুলবাস উদ্দিন, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, ভবা পাগলা, মহিন শাহসহ কতশত পদাকর্তাও একই ধারার পথিক ছিলেন।
বাউলেরা অনুমানে বিশ্বাস করেন না বলেই বস্তুবাদ তথা অস্তিত্ববাদী হিসেবে নিজেদের মনে করে থাকেন। এ কারণেই তারা মানুষের মধ্যে খোদাকে খুঁজে বেড়ান।
ভারতবর্ষের বাউল-ফকিররা যুগযুগান্তর ধরে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্ব মানুষের মিলনের ক্ষেত্রে একটা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের আকুলতা ছিল তাদের গানে। মুসলমান সাধকের হিন্দু শিষ্য কিংবা হিন্দু সাধকের মুসলমান শিষ্য- এ রকম অসংখ্য উদাহরণ বাউল অনুসারীদের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা যায়। মানবধর্ম প্রচারের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক ভেদবিচারের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাবকেই পরিস্ফুট করেছে। বাউল-ফকির মতবাদের ঐতিহ্যগত পরম্পরায় ক্ষীণমাত্রায় হলেও সে ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে- সেটিই আশাবাদের বিষয়।
বৈষ্ণব সাহিত্য ও দর্শনে এবং লৌকিক প্রণয়-গীতিতেও জাতপাত আর উঁচু-নিচু ভেদাভেদের বিরুদ্ধে শুদ্ধ প্রেমের শাশ্বত বাণী উচ্চারিত হয়েছে। চৈতন্য ও চৈতন্যোত্তর যুগ পেরিয়ে ‘নানারূপ সঙ্গীতে- লৌকিক গাথা ও গীতিকাব্যে’ মানুষ-বন্দনার অসামান্য প্রভাব ছিল গীতিকারদের মধ্যে। গ্রামীণ নিরক্ষর এসব গীতিকারদের কাব্যরসে উন্নততর গুণের প্রমাণ স্পষ্ট। অনেকটা নীরবে-নিভৃতে মানবপ্রেমের বিকাশ ঘটাতে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন অসংখ্য চেনা-অচেনা পল্লী গীতিকার-গায়ক।
বাংলার বাউল-ফকির পরম্পরায় সাধকদের কণ্ঠেও একইভাবে মানবপ্রেম সঞ্চারিত হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতার সুর তাদের গানের অন্যতম বিষয়বস্তু। আশরাফ-আতরাফ, ধনী-গরিব, কালো-সাদা, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, জাত-পাত ভেদাভেদ দূরে ঠেলে সাধকরা যুগে-যুগে কালে-কালে অভিন্নভাবে ভারতবর্ষে মানবপ্রেমের মহিমা ছড়িয়েছেন। মানবিকবোধ-সংক্রান্ত উচ্চ চিন্তামূলক মনোভাব তাদের গানে দেখতে পাওয়া যায়।
বাউল-ফকির মতবাদের প্রচার ও প্রসারে কুষ্টিয়ার বাউলসাধক লালনের (১৭৭৪-১৮৯০) নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়ে থাকে। তার একাধিক গানেও মানুষ-বন্দনার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়। বলা যায়, তিনিই পরবর্তীকালে বাউল-ফকিরদের মধ্যে মানুষ ভজনার দর্শন প্রচারের সেতু তৈরি করেছেন। লালন লিখেছেন- ‘মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/সে কি অন্য তত্ত্ব মানে’ কিংবা ‘এমন মানব জনম আর কি হবে-/অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই/দেব দেবতাগণ করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে’। উপর্যুক্ত গান দুটির অন্তরালে মানবপ্রেমের অন্তঃশীল সত্য প্রতিভাসিত হয়েছে। এ ধারা পরবর্তী সঙ্গীতসাধকদের মধ্যেও প্রবাহিত ছিল। যেমনটা রয়েছে বর্তমানের সঙ্গীতকারদের মধ্যেও।
সংকীর্ণ মৌলবাদ ও ভ্রান্ত সাম্প্রদায়িক চেতনা যখনই সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই যুথবদ্ধভাবে বাউলসাধকরা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়েছেন। মানবসমাজে সম্প্রীতিতে যেন চির না-ধরে সেজন্য গ্রাম-জনপদ কাঁপিয়ে সাধকরা কণ্ঠে তুলেছেন মানবতার জয়গান। অথচ মানবধর্মের জয়গান-সংবলিত এসব গানকে অনেকটা অসচেতনতায় যথার্থভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না তেমনভাবে। তবে আবহমানকাল গ্রামীণ সাধারণ শ্রোতারা সেসব গান শুনেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হতেন।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা চরম সংকট তৈরি করেছে। এ সংকট তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্র বাউলগানের বিস্তৃতি কমে যাওয়ার বিষয়টিও একটি অন্যতম কারণ। বাউলগানের আসর একদিকে দ্রুত কমে যাচ্ছে অপরদিকে ওয়াজ মাহফিলের পরিসর ক্রমশ বাড়ছে।
বাউলগানের আসরে মানবমহিমার যেসব গান গীত হতো, তা লোপ পাওয়ায় মানুষ-বন্দনা সম্পর্কিত মতবাদ প্রচারে অনেকটা ভাটা পড়েছে। প্রায় নীরবে-নিভৃতে চোখের অলক্ষে হারিয়ে যেতে বসেছে উজ্জ্বল সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হওয়া মানবপ্রেমের বন্দনামূলক গানের ক্ষেত্রটি। অথচ এর রোধ ঠেকাতে আমরা অনেকটাই নির্বিকার ভূমিকা পালন করছি। যদি মানবমুখী এসব গানের বিস্তৃতি ও পরিসর বাড়ানো সম্ভব হতো তাহলে ধর্মের নামে যেসব কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস সমাজে প্রচলিত রয়েছে সেসব থেকে সহজেই উত্তরণ সম্ভব হতো।
যশোরের দুদ্দু শাহ (১৮৪১-১৯১১) লিখেছিলেন- ‘কালী কিংবা মক্কায় যাও রে মন/দেখতে পাবে মানুষের বদন’। দুদ্দু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজ্যদেবী কালী কিংবা মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান মক্কায় মানুষের সত্তার অনুধাবন করার বিষয়টিতে জোরারোপ করে চিরায়ত মানববন্দনার বিষয়টিকেই উপস্থাপন করেছেন। একইভাবে সিলেটের একলিমুর রাজার কণ্ঠেও একই অভিমত প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন- ‘মনেতে মথুরা আছে/মক্কা কাবার ঘর-/তারই মাঝে বিরাজিছে/মানুষ সুন্দর’। আর কুবির গোঁসাই তো সরাসরি ‘মানুষে নিষ্ঠারতি’ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
সৃষ্টিকর্তা আসলে মানুষের ভেতরেই অবস্থান করছেন, এমনটিই বাউল-ফকিরদের মতবাদ। সে কারণেই নিত্য খ্যাপা বলেছেন- ‘মানুষেতে মানুষ আছে মানুষ নাচায় মানুষই নাচে/মানুষ যায় মানুষের কাছে মানুষ হইতে’। এ-রকম হাজারো সাধু-সন্তের বাণী মানবপ্রেমের মহিমাকে ধারাবাহিকভাবে চির উদ্ভাসিত করে রেখেছে। সাধক খোদা বক্শ শাহ মানুষ-ভজনার বিষয়টি এভাবেই গুরুত্ব দিয়েছেন :
মানুষ ভজন করব বলে মনেতে করি বাসনা
বনফুলে পুঁজি মানুষ মনফুল তো ফুটিল না।
মানবলীলা সব লীলার সার শুনেছি তাই শ্রবণে
কী রূপে ভজিব মানুষ তাহার সন্ধান জানিনে
সেবা কিংবা ভক্তি দিলে
তাই কি মানুষভজা বলে
চন্দন প্রদীপ আর বনফুলে কীসে হয় মানুষের ভজনা।
মানুষে মনহুঁশ কামনা করি বল কেমনে
ফুল তুলিতে বেলা গেল মালা গাঁথব কখনে
মম মনসুতা নাইকো ভালো
কেমনে মালা গাঁথব বলো
গাঁথতে গাঁথতে বেলা গেল কণ্ঠে পরাব কখনা।
ত্রিলোকের মনোহরা রূপ নববপু তাহার স্বরূপ
পুঁজিলে কি মেলে মানুষ গঙ্গাজল তুলসী দিলে ধূপ
উচ্চ করে আসন দিলে
তাই কি মানুষভজা বলে
শুকচাঁদ সাঁই মোর কীসে মেলে দীন বক্শর সদা এই ভাবনা।
সাধুসন্তরা ‘অন্তর-মন্দিরে’ মানুষকে স্থান দিয়ে তার মহিমা প্রচারে সদা ব্যস্ত ছিলেন। খোদাকে পেতে হলে মানুষ ভজনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। গোপাল দাস সে বিষয়ে ইঙ্গিত করেই প্রশ্ন করেছিলেন : ‘মানুষ না ধরিলে/মানুষ না ভজিলে/খোদা কি মেলে-’। প্রকৃতপক্ষে তা-ই। বস্তুবাদী চেতনার অধিকারী নেত্রকোনা অঞ্চলের সাধক জালাল উদ্দীন খাঁ-তো সরাসরিই খোদাকে আক্রমণ করে বসেছেন :
আমি না-থাকিলে খোদা তোমার জায়গা ভবে নাই
স্থান না-পেয়ে অন্য কোথাও আমাতে লয়েছ ঠাঁই।
মানুষ থুইয়া খোদা ভজো এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে
মানুষ ভজো কোরান খুঁজো পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।
বিচার করলে নাই রে বিভেদ কে হিন্দু কে মুসলমান
রক্ত মাংস একই বটে সবার ঘটে একই প্রাণ।
জালাল উদ্দীন খাঁ যেমন করে মানুষের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা-প্রীতিকে সবার আগে ঠাঁই দিয়েছেন তেমনি হাউড়ে গোঁসাই, পাগলা কানাই, পাঞ্জু শাহ, দ্বিজদাস, মনোমোহন, হাসন রাজা, রশিদ উদ্দিন, দীন শরৎ, ফুলবাস উদ্দিন, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, ভবা পাগলা, মহিন শাহসহ কতশত পদাকর্তাও একই ধারার পথিক ছিলেন।
বাউলেরা অনুমানে বিশ্বাস করেন না বলেই বস্তুবাদ তথা অস্তিত্ববাদী হিসেবে নিজেদের মনে করে থাকেন। এ কারণেই তারা মানুষের মধ্যে খোদাকে খুঁজে বেড়ান।
ভারতবর্ষের বাউল-ফকিররা যুগযুগান্তর ধরে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্ব মানুষের মিলনের ক্ষেত্রে একটা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের আকুলতা ছিল তাদের গানে। মুসলমান সাধকের হিন্দু শিষ্য কিংবা হিন্দু সাধকের মুসলমান শিষ্য- এ রকম অসংখ্য উদাহরণ বাউল অনুসারীদের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা যায়। মানবধর্ম প্রচারের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক ভেদবিচারের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাবকেই পরিস্ফুট করেছে। বাউল-ফকির মতবাদের ঐতিহ্যগত পরম্পরায় ক্ষীণমাত্রায় হলেও সে ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে- সেটিই আশাবাদের বিষয়।
No comments