মোদিরাজের ১০০ দিনের চড়াই-উতরাই by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
দেশের মানুষ পাঁচ বছরের জন্য যাদের দেশ
শাসনের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের কাছে প্রথম ১০০ দিন কাটানো আহামরি কিছু নয়।
তবু এক হাজার ৮২৫ দিনের মেয়াদের প্রথম ১০০ দিন উদ্যাপনের একটা ঘটা ইদানীং
ভারতে বেশ দেখা যাচ্ছে। এর একটা কারণ যদি হয় জোট-জামানায় সরকারের
মেয়াদপূর্তির নিশ্চয়তা ঘিরে ঘোর সংশয় সৃষ্টি হওয়া, অন্যটি তাহলে সকাল দেখে
দিনটা কেমন যাবে, তা অনুমানের চেষ্টা। নিজের ক্ষমতায় শাসকের আসনে বসলেও
নরেন্দ্র মোদির সরকারের শত দিন পূর্তি নিয়ে ভারতে তাই বেশ হইচই শুরু
হয়েছে।
এই ১০০ দিন মোদির সরকারের কেমন কাটল? প্রশ্নটা নাড়াচাড়ার আগে এটা বলা ভালো যে সত্যি সত্যিই এই সরকারটা একান্তভাবে মোদিরই সরকার। তিনি কেমন ধরনের, তাঁর দেশ শাসনের স্টাইল কেমন, তিনি কতটা টিম ম্যান, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-মন্দ লাগা সব বিষয়েই মোটামুটি একটা ধারণা তিনি এই কদিনে দিতে পেরেছেন। প্রথম ১০০ দিনে আর কিছু হোক না হোক, মোদি এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন, তাঁর সরকারে এক থেকে ১০০ নম্বরে একমাত্র তিনিই। বাকি সবাই অকিঞ্চিৎকর।
মোদি আরও একটি কাজ করেছেন। ‘বিড়াল প্রথম রাতেই মারতে হয়’ এই আপ্তবাক্যটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ১০০ দিনের মধ্যেই লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর জোশি, যশবন্ত সিং, যশবন্ত সিনহাদের মতো নেতাদের তিনি হেলায় ছেঁটে ফেললেন! মন্ত্রী তো করলেনই না, দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও দিলেন না। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কিকড আপস্টেয়ার্স’, সেটা করে আদভানি-জোশিকে দলের ‘মেন্টর’ করে দিলেন। এর আগে মন্ত্রীদের পছন্দমতো সহায়ক নিয়োগেও তিনি রাশ টেনেছেন। সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছেন আমলাদের সঙ্গে। দিনে ১৫-১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করছেন এবং স্বচ্ছ প্রশাসনের ওপর জোর দিতে সততাকে হাতিয়ার করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সব ফাইলে তিনি চোখ বোলাচ্ছেন। মোদি প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, ‘না ম্যায় খাউঙ্গা, না কিসিকো খানে দুঙ্গা’। মানে, নিজে ঘুষ খাব না, কাউকে খেতেও দেব না। এই হুঁশিয়ারির পরপরই কয়েকটি খবর হাওয়ায় ভাসতে লাগল যেগুলোর একটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের ছেলেকে নিয়ে। খবরটি হলো, রাজনাথ-তনয় পঙ্কজ নাকি দিল্লি পুলিশে পোস্টিংয়ের জন্য কারও কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। মোদি তা জানতে পেরে পঙ্কজকে বাড়িতে ডেকে সাবধান করে বলেছেন, যে টাকা তিনি নিয়েছেন তা যেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেওয়া হয়। খবরটি একাধিক কাগজে বেরিয়েও যায়। ক্ষুব্ধ রাজনাথকে শান্ত করতে অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় এবং দলের সভাপতি অমিত শাহ সক্রিয় হলেন। কিন্তু উত্তর প্রদেশের উপনির্বাচনে পঙ্কজের টিকিটের দাবি অগ্রাহ্য হলো। সব মিলিয়ে এই ১০০ দিনে মোদি তাঁকে ঘিরে ভয়, ভক্তি ও সমীহের একটা ঘেরাটোপ তৈরি করে ফেলেছেন। এতে দেশশাসন ঠিকঠাক হবে কি না, সেই হিসাব-নিকাশ পরে।
বহুদিনের কতগুলো প্রথাও মোদি ভেঙেছেন। একটা প্রথা হলো সাংবাদিক, মন্ত্রী, অফিসার ও পরিবারবর্গের বিশাল দল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশসফরে যাওয়া। প্রথা অনুযায়ী অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক বিনা ভাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হতেন। কোনো কোনো প্রধানমন্ত্রী ১৫ জন আত্মীয় নিয়েও বিদেশে গিয়েছেন। সেই সঙ্গে একাধিক মন্ত্রী ও অগুনতি আমলা। মোদি তালিকা ছেঁটে দিয়েছেন। আকাশবাণী, দূরদর্শন, সংবাদ সংস্থা পিটিআই এবং এএনআই ছাড়া আর কোনো সাংবাদিককে সফরসঙ্গী করছেন না। প্রথা মেনে কোনো অভিজ্ঞ সাংবাদিককে তিনি মিডিয়া উপদেষ্টাও করেননি। মোদি জমানায় মন্ত্রীদের হুট বলতে মিডিয়ার সামনে আসা প্রায় বন্ধই বলা যায়। বিদেশসফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পর্যন্ত তিনি সঙ্গী করছেন না। নিচ্ছেন সেই মন্ত্রীদের, যাঁদের নেওয়া জরুরি এবং সংশ্লিষ্ট আমলাদের।
এহেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম ১০০ দিনে আর একটা কাজের কাজ করেছেন। যোজনা কমিশন নামে সাদা হাতিটার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়েছেন। স্বাধীনতার পরে সীমিত আর্থিক সামর্থ্যের সময় যা প্রয়োজন ছিল, আজ তা অপ্রয়োজনীয়ই শুধু নয়, বিকাশের গতি রোধ করার দায়েও অভিযুক্ত। অনাবশ্যক সরকারি খরচ কমানোর জন্য মন্ত্রিসভার বহর মাত্রাছাড়া করেননি। বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ও করছেন। মন্ত্রী-সান্ত্রিদের হুট বলতে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাতেও রাশ টেনেছেন। তাঁর সম্মতি ছাড়া কোনো মন্ত্রী কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। ক্ষমতা এভাবে কেন্দ্রীভূত হওয়া ভালো না মন্দ, সেই বিচারের সময় এখনো আসেনি।
অর্থনীতির অনিশ্চয়তা বেশ কিছুটা কমেছে। এর একটা কারণ অবশ্যই মোদির আগমনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসা। দ্বিতীয় কারণ বিশ্ববাজারের মন্দাভাব ক্রমেই কেটে যাওয়া। ফলে প্রবৃদ্ধির হারে হেরফের ঘটছে। (এর মূল কৃতিত্ব অবশ্যই মনমোহন সিংয়ের
সরকারের প্রাপ্য। তাঁর নীতির সুফল মোদির খাতায় জমা হচ্ছে।) আগের সরকারের নীতি স্থবিরতা এই সরকারে দেখা যাচ্ছে না।
সংসদে সংখ্যাধিক্য মোদিকে এই সুবিধা এনে দিয়েছে। কাজেই শিল্পোদ্যোগীরা নতুন উদ্যমে কাজে নামছেন। দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা ভালো লক্ষণ।
কিন্তু দুটি ক্ষেত্রে খারাপ লক্ষণ চোখ টানছে। প্রথমটি অবশ্যই সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি, দ্বিতীয়টি পশ্চিম প্রান্তের চির বৈরী প্রতিবেশীকে ঘিরে। লাল কেল্লা থেকে ভাষণে মোদি যতই জাতপাত ও সাম্প্রদায়িকতায় ১০ বছরের বিরতির আবেদন জানান, তাঁর দল
কার্যত তাঁকে অগ্রাহ্য করে সেই বিষ ছোবল মেরেই চলেছে। তাঁর সুগ্রীব দোসর অমিত শাহ যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন, তাতে ‘লাভ জিহাদ’ মাথাচাড়া দিয়েছে। মুজাফ্ফরনগর পেরিয়ে দাঙ্গার আগুন মীরাটে ছড়িয়েছে। অনুপ্রবেশকে হাতিয়ার করে পুব সীমান্তের রাজ্যগুলোতে বিজেপি মাথাচাড়া দিচ্ছে। উত্তর প্রদেশের উপনির্বাচনে প্রচারের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গোরক্ষপুরের সাংসদ গেরুয়াধারী মহন্ত অদ্বৈতনাথকে, যাঁর স্বপ্ন হিন্দুস্তানকে শুধু হিন্দুদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। বিষ ছড়ানোর যে প্রতিযোগিতা গো বলয়ে শুরু হয়েছে, একটা সময় তা যে মোদির উন্নয়নের স্লোগানকে পরিহাস ও বিদ্রূপ করবে, তা না বোঝার মতো অর্বাচীন নরেন্দ্র মোদি নন। অথচ তিনি নীরব! অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র!
পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা মোদি খুব ভেবেচিন্তে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে একটা পরিকল্পনা, যা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কোনো রাষ্ট্রনায়ক নিতেন না। দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক ইসলামাবাদে হওয়ার কথা ছিল ২৫ আগস্ট। ১০ আগস্ট পাকিস্তানের হাইকমিশনার আবদুল বাসিত হুরিয়ত নেতাদের ফোন করে দিল্লি ডেকে পাঠান। ১৩ আগস্ট সংবাদপত্র সেই খবর ছাপিয়েও দেয়। কাজেই হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের খবরটি আচমকা বা অজানা ছিল না। এ ধরনের আলোচনা বাজপেয়ি বা মনমোহন সব জমানাতেই সব দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে পাকিস্তান রুটিন মাফিক করে এসেছে এবং ভারতের তা জানাও। এমনকি, হুরিয়ত নেতাদের পাকিস্তানে গিয়ে কথা বলাতেও ভারত অতীতে অনুমতি দিয়েছে। নওয়াজ শরিফ যখন দেশের উগ্রপন্থীদের হুমকি অগ্রাহ্য করে মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এলেন এবং হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের দাবি অগ্রাহ্য করার সাহস দেখালেন, তখন হুরিয়ত প্রসঙ্গকে মাত্রাছাড়া গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা বাতিল করে মোদি বাতাবরণটাই শুধু বিষিয়ে দেননি, পাকিস্তানি রাজনীতিতে নওয়াজ শরিফকেও দুর্বল করে দিলেন। গণতন্ত্রী শরিফকে দুর্বল করলে উগ্রপন্থী ও মৌলবাদীদেরই যে পোয়াবারো হয়, মোদি বুঝেও কেন তা বুঝলেন না, সেটা এক অপার বিস্ময়!
তাহলে মোদি সরকার তা করল কেন? কারণটা জম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচন। মোদি-শাহ জুটির নজরে জ্বলজ্বল করছে এই রাজ্যের বিধানসভার ভোট, যে রাজ্যে আজ পর্যন্ত কোনো হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী হননি। অমিত শাহ কাশ্মীরে গিয়ে সে কথা জানিয়েও এসেছেন, ‘এই রাজ্যের একতা ও অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে একটা জাতীয়তাবাদী সরকার গঠনই আমাদের লক্ষ্য। কাশ্মীরকে শেষ করে দিয়েছে আবদুল্লাহ ও মুফতি পরিবার। এঁদের হাত থেকে এই রাজ্যকে মুক্ত করতে হবে।’
মোদি-শাহ জুটির সেই পরিকল্পনার নাম ‘মিশন ৪৪’।
মোদি-শাহ জুটি স্বপ্ন দেখলেও জম্মু-কাশ্মীরকে বিজেপির দখলে আনা নিতান্তই কঠিন কাজ। যে তিনটি অঞ্চলে এই রাজ্য বিভাজিত, সেগুলোর মধ্যে জম্মুতে দলের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ভালোই। লাদাখ অঞ্চলের একমাত্র লোকসভা আসনে এই প্রথম বিজেপি জিতেছে। কিন্তু আবদুল্লাহ পরিবারের ন্যাশনাল কনফারেন্স, মুফতি পরিবারের পিডিপি এবং কংগ্রেসের মুঠোর বাইরে উপত্যকা এযাবৎ কোথাও যায়নি। সেখানে বিজেপির উপস্থিতি দ্বিতীয়ার চাঁদের মতোই। সেই বিজেপিকে তাহলে কোন ভরসায় রাজ্যে ক্ষমতায় দেখতে চাইছেন মোদি-শাহ জুটি?
জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার মোট আসন ১১১। কিন্তু ২৪টি আসন পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে হওয়ায় আজ পর্যন্ত কোনো দিন ওই আসনগুলোতে ভোট করানো যায়নি। ফলে রাজ্য বিধানসভায় কার্যকর আসনসংখ্যা ৮৭। এই ৮৭ আসনের মধ্যে জম্মুতে রয়েছে ৩৭টি, লাদাখে চারটি ও কাশ্মীর উপত্যকায় ৪৬টি আসন। মোদি–হাওয়ায় ভর দিয়ে গত লোকসভা ভোটে বিজেপি গোটা রাজ্যে ৩৩টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল। এগুলোর মধ্যে জম্মুতেই ছিল ৩০টি। শাহ চাইছেন মোদির উন্নয়নের স্লোগান এবং হিন্দুত্বে ভর দিয়ে জম্মু ও লাদাখের ৪১টি আসনই দখল করতে। কঠিন কাজ সন্দেহ নেই। সেই কঠিন কাজে সফল হলেও ক্ষমতা দখলের জন্য প্রয়োজন অন্তত ৪৪টি আসন। তার মানে, উপত্যকার ৪৬ আসনে ভাগ বসাতে হবে। তা করতে অমিত শাহ উপত্যকার তিনটি ছোট অথচ প্রভাবশালী দলের সঙ্গে জোট বাঁধার রাস্তায় অনেকটা এগিয়েছেন। এই দলগুলোর মধ্যে রয়েছে সাজ্জাদ লোনের পিপলস কনফারেন্স, ইমাম খোমেইনি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ও আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টি। কারগিল-জানস্কার অঞ্চলে ট্রাস্টের প্রভাব আছে। আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির প্রভাব রয়েছে বারামুলা ও অনন্তনাগে। সাজ্জাদ লোনের সমর্থকেরা কমবেশি উপত্যকার সর্বত্র। এই অঙ্কের সঙ্গে বিজেপি মেশাতে চাইছে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের স্বার্থ। পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের জন্য গত বাজেটে ৫০০ কোটি রুপি বরাদ্দও হয়েছে।
কিন্তু এসবই শেষ পর্যন্ত সব নয়। দরকার বাড়তি কিছু। পাকিস্তানকে ধমকে-চমকে আলোচনার রাস্তা ফের বন্ধ করে উপত্যকায় নিজেদের প্রাধান্য কায়েমের স্বপ্নকেই সাকার করতে চাইছে নরেন্দ্র মোদির দল। তাঁর ১০০ দিনের ভালো-মন্দের খতিয়ানের জন্য নিদেনপক্ষে আরও ১০০ দিন অপেক্ষাতেই থাকা যাক।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments