বিজয় দিবস -পৌষের এই দিনে by আনিসুল হক
উত্তাপটা টের পাচ্ছিলাম কোপেনহেগেনে বসেই। প্রধানত ফেসবুকে। ফেসবুকের বন্ধুরা তাদের মুখচ্ছবি হিসেবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতীয় পতাকা, যার মাঝখানে আছে হলুদ রঙের মানচিত্র। কেউ কেউ ব্যবহার করছে রাইফেলের ডগায় বাঁধা সেই পতাকাটি। তার মানে বাংলাদেশে এসে গেছে বিজয়ের মাস। ঢাকা শহরে ঢুকতেই দেখি, গাড়িতে গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে। কেউ কেউ বনেটে সেঁটেও দিয়েছেন জাতীয় পতাকা। বুকের ভেতরে কী যে একটা শিরশির অনুভূত হয়! চোখ ছলছল করে। আহা, আমার বাংলাদেশ। নিজেদের মধ্যে কত অনৈক্য, কত ভুল বোঝাবুঝি, কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই একমত—দেশ, একটা প্রেম, সবার ওপরে; দেশ, দেশপ্রেম। আমি জানি না, পৃথিবীতে আর কোনো জনগোষ্ঠী আছে কি না, যারা দেশের নামে এভাবে আবেগাপ্লুত বোধ করে।
আমাদের দেশপ্রেমের প্রধান প্রতীক আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর আমাদের বিজয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সারাক্ষণ পথ দেখায়, আমাদের বলে দেয়, আমরাও ঐক্যবদ্ধ হতে জানি, আমরাও পারি আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে, আমরাও পারি সাহসিকতা ও বীরত্বের উজ্জ্বলতম ইতিহাস সৃষ্টি করতে।
কিন্তু আজকে যার বয়স ৩৮, সে তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। আমাদের জনসংখ্যার বেশির ভাগ মানুষই তো মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্মের। তাহলে আজও মুক্তিযুদ্ধ আর বিজয় কেন আমাদের এতটা উদ্দীপিত করে? কীভাবে করে?
কিছুদিন আগে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সপ্তাহের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার। ওখানকার ছেলেমেয়েরা কয়েক ঘণ্টাব্যাপী একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করল। ওই অনুষ্ঠান দেখে আমি হাঁ হয়ে গেছি। আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার ছাত্র ছিলাম আশির দশকে। আমরাও অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এখনো এ ধরনের নানা অনুষ্ঠানের আয়োজনের পেছনে আমি বুদ্ধি ও শ্রম ব্যয় করে থাকি। লেখালেখির সুবাদে টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গেও আমার কিছুটা হলেও আলাপ-পরিচয় ও মেলামেশা আছে। কিন্তু খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা যা দেখিয়েছে, তা আমার প্রত্যাশার সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের সময়ে আমরা হারমোনিয়াম, তবলা, বড়জোর কি-বোর্ড-সহযোগে নজরুল-রবীন্দ্রসংগীত-আধুনিক গান পরিবেশন করতাম। তারপর দেশের কোনো খ্যাতিমান দল বা শিল্পী যখন গান ধরতেন, তখন দর্শকের সংখ্যা বাড়ত। কিন্তু খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে কোনো অতিথি শিল্পী ছিলেন না। যা করার তা নিজেরা করেছে। ধরা যাক, একটা নাচ হলো। নেচেছে ওখানকার ছেলেমেয়েরাই, নিজেরা শিখে নিয়ে। তারপর একটা গান হবে। দুটো পরিবেশনার ফাঁকের সময়টাতে কী হবে। ওরা যা করেছে তা হলো, ওই সময়টায় পর্দায় দেখিয়েছে একটা করে ছোট্ট চলচ্চিত্র। এক মিনিট দেড় মিনিট বা দুই-চার মিনিটের এই চলচ্চিত্রগুলোর কোনোটায় ছিল ছোট্ট কাহিনিচিত্র, কোনোটা মিউজিক ভিডিও। প্রায় বিশ-ত্রিশটা শর্টফিল্ম এরা প্রদর্শন করল অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে। মজার ব্যাপার হলো, এই ছবিগুলো তারা নিজেরা বানিয়েছে। ক্যামেরা বলতে সাধারণ স্থিরচিত্র তোলার ক্যামেরা। সেটাতে যে দুই-চার মিনিট ভিডিও করা যায়, তা-ই তারা করেছে। তারপর সেই ভিডিও তারা কপি করে নিয়েছে কম্পিউটারে। ইন্টারনেট থেকে সম্পাদনার সফটওয়্যার নামিয়ে নিয়ে তারা সম্পাদনার কাজ সেরেছে নিজেরাই। নিজেরাই শব্দ ও সংগীত যোজনা করেছে। কাহিনিও তাদের নিজেদের রচনা। অভিনয়ও করেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আমি আগেই বলেছি, আমি দেশের টেলিভিশনগুলোর নাটক ইত্যাদি লিখে থাকি। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের মান সম্পর্কে আমার একটা ধারণা আছে। আমি স্পষ্টভাবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ভিডিওচিত্রগুলোর মান জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে কোনো অংশে খারাপ তো নয়ই, বরং কোনো কোনোটা খুবই ভালো। কোনো রকম কাঁচামো নেই। নিজেদের ক্যাম্পাসের মজার ঘটনা, পড়ার চাপ, পরীক্ষা নিয়ে তারা রসিকতা করেছে, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা চমত্কার উদ্দীপনামূলক কাহিনি ফেঁদেছে, আবার দেশাত্মবোধক গান নিয়ে বানিয়েছে অনেকগুলো সংগীতচিত্র। কিন্তু একটা বিষয় ঘুরেফিরে এসেছে। সেটা হলো, দেশ। দেশের ইতিহাস। মুুক্তিযুদ্ধ। একটা ভিডিওচিত্রে তো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলো দেখানো হলো। আর আছে আমাদের ক্রিকেট দলের শটের শট। মাথায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা বাঁধা ক্রিকেটার যখন ছক্কা মারেন, তখন কার না ভালো লাগে। শুধু ভিডিওচিত্রতে নয়, মঞ্চেও তারা যা পরিবেশন করল, তাতেও ঘুরেফিরে আসে দেশের কথা, মুক্তির কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা। প্রথমেই ছিল একটা কোরিওগ্রাফি, দেশ নিয়ে, পতাকা হাতে। আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত তাদের কাজ দেখে। আবৃত্তির দল যে আবৃত্তি করল, তার মান কোনো অংশেই কম নয়। এই ছেলেমেয়েরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। প্রান্তবর্তী শহরে থাকে। পরীক্ষা আর ক্লাস-টেস্টের চাপে এরা সারাক্ষণ থাকে পিষ্টপ্রায়। অথচ কী তাদের সৃজনশীলতা, চর্চা ও কল্পনাশক্তি ও সাংগঠনিক ক্ষমতার অপূর্ব বহিঃপ্রকাশ! এদের কারও কারও সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। তারা বলে, তারা ছবি দেখে দেশ-বিদেশের। তারা কম্পিউটারে ইন্টারনেটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলো ডাউনলোড করে নেয়। কখনো এক সপ্তাহ লেগে যায় ছবি নামাতে। তবু নামায়, তবু দেখে।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরের প্রজন্ম এরা। আমাদের সঙ্গে এদের প্রজন্মের পার্থক্য অনেক। সব দিক থেকেই এরা চৌকস, চটপটে, স্মার্ট। এরা কম্পিউটারকে এদের এগিয়ে যাওয়ার আর সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে খেলনার মতো ব্যবহার করে। এরা ক্রিকেট খেলে। এরা সংগীতের দল গড়ে। কিন্তু একটা বিষয়ে ওদের সঙ্গে আমাদের কোনো জেনারেশন-গ্যাপ বা প্রজন্ম-ব্যবধান নেই, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ, দেশ, পতাকা, জাতীয় সংগীতের প্রতি তাদের ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই।
নতুন প্রজন্ম আসছে। বাংলাদেশকে পাল্টে দিতে। এরা চিন্তায় আধুনিক, চেতনায় এদের মুক্তিযুদ্ধ।
সারাটা দেশ আজ কীভাবে মেতে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টাকে উদ্যাপন করে নিতে। এসব আনুষ্ঠানিকতারও দরকার আছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে শোষণ থেকে মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে দেশের জন্য নিজেকে উত্সর্গ করতে প্রস্তুত থাকা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে গণতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে আধুনিক, অগ্রসর, সুখী ও আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে কাজটিই করবে। সেই কাজটিই করছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একটা কথা বলেন। কথাটা তিনি বলেন সক্রেটিসকে উদ্ধৃত করে। প্লেটো জিজ্ঞেস করেছিলেন সক্রেটিসকে, সর্বোচ্চ দেশপ্রেম কী? প্লেটো জবাব দিয়েছিলেন, সর্বোত্তমভাবে নিজের কাজটুকু করা। আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিজের কাজটুকু সুন্দরভাবে, উত্তমভাবে করছে। যে ক্রিকেট খেলছে, সে আন্তর্জাতিক মানে যাওয়ার জন্য খেলছে। যে লেখাপড়া করছে, সে মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। কম্পিউটার ইন্টারনেটে সে মুহূর্তে জেনে নিচ্ছে পৃথিবীর দূরতম অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ তথ্যটা।
আর এরা যুক্ত হচ্ছে বইপড়া, সংগীতচর্চা, নাটক, বিতর্ক, আবৃত্তি, চলচ্চিত্র ইত্যাদি কার্যক্রমে। সে শুধু নিজেকে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে না, নিজের মধ্যে গড়ে তুলছে সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেতৃত্বের গুণ।
এই ছেলেমেয়েরা আসছে। হাজার হাজার জন। লক্ষ লক্ষ জন। এরা আসছে এক বিজয় থেকে আরেক বিজয়ে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে বলে। এদের কাছে দেশপ্রেম মানে কেবল বানানো কথার ফেনানো তুবড়ি নয়, এদের কাছে দেশপ্রেম মানে কাজ, নিজের কাজ।
আমরা একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছিলাম, আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলাম একটা ভয়ংকর সেনাবাহিনীকে। কিন্তু আমরা যে বিজয় সামনে অর্জন করতে যাচ্ছি, সেটা খুব অবিশ্বাস্য রকম কিছু নয়। মধ্য আয়ের একটা দেশ, অগ্রসর, বাসযোগ্য একটা দেশ, আলোকিত পরমতসহিষ্ণু ও বৈষম্যহীন একটা সমাজ। ষোলোই ডিসেম্বরের বিজয়ের পতাকার মাঝখানে লাল সূর্যটা আমাদের অভয় দিচ্ছে, শহীদদের শুভেচ্ছা আছে আমাদের সঙ্গে, আমরা পারবই।
বিদেশ থেকে বাংলাদেশের মাটিতে নেমে বিজয়ের স্মারক বাংলাদেশের পতাকা চারদিকে উড়তে দেখে সেই আশ্বাসই পাই। পৌষ মাস আমাদের উত্সবের মাস। আসলে অগ্রহায়ণ মাসে ধানকাটা, মাড়াই, সেদ্ধ করা, শুকানো, আমাদের জনপদবাসীর ব্যস্ততার কাল। পৌষ মাস হলো আমাদের উত্সবের মাস। নবান্নের আসল উত্সব হয় পৌষেই। ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে ছুটে আয়, ডালা যে তার ভরে গেছে পাকা ফসলে...’ এই গানের তাত্পর্য এইখানে। ছোটবেলায় গ্রামে ছড়া শুনেছি, ‘আগন মাসে ধান কাটিব, পৌষ মাসে বেটার বিয়া লো লো লো...।’ পৌষে চিরন্তন নবান্নের উত্সবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিজয়ের উত্সব। এ যেন সোনায় সোহাগা। এই উত্সব ১৬ কোটি মানুষের হূদয়কে উদ্দীপিত করুক, এগিয়ে নিয়ে যাক আমাদের বাংলাদেশকে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
আমাদের দেশপ্রেমের প্রধান প্রতীক আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর আমাদের বিজয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সারাক্ষণ পথ দেখায়, আমাদের বলে দেয়, আমরাও ঐক্যবদ্ধ হতে জানি, আমরাও পারি আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে, আমরাও পারি সাহসিকতা ও বীরত্বের উজ্জ্বলতম ইতিহাস সৃষ্টি করতে।
কিন্তু আজকে যার বয়স ৩৮, সে তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। আমাদের জনসংখ্যার বেশির ভাগ মানুষই তো মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্মের। তাহলে আজও মুক্তিযুদ্ধ আর বিজয় কেন আমাদের এতটা উদ্দীপিত করে? কীভাবে করে?
কিছুদিন আগে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সপ্তাহের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার। ওখানকার ছেলেমেয়েরা কয়েক ঘণ্টাব্যাপী একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করল। ওই অনুষ্ঠান দেখে আমি হাঁ হয়ে গেছি। আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার ছাত্র ছিলাম আশির দশকে। আমরাও অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এখনো এ ধরনের নানা অনুষ্ঠানের আয়োজনের পেছনে আমি বুদ্ধি ও শ্রম ব্যয় করে থাকি। লেখালেখির সুবাদে টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গেও আমার কিছুটা হলেও আলাপ-পরিচয় ও মেলামেশা আছে। কিন্তু খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা যা দেখিয়েছে, তা আমার প্রত্যাশার সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের সময়ে আমরা হারমোনিয়াম, তবলা, বড়জোর কি-বোর্ড-সহযোগে নজরুল-রবীন্দ্রসংগীত-আধুনিক গান পরিবেশন করতাম। তারপর দেশের কোনো খ্যাতিমান দল বা শিল্পী যখন গান ধরতেন, তখন দর্শকের সংখ্যা বাড়ত। কিন্তু খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে কোনো অতিথি শিল্পী ছিলেন না। যা করার তা নিজেরা করেছে। ধরা যাক, একটা নাচ হলো। নেচেছে ওখানকার ছেলেমেয়েরাই, নিজেরা শিখে নিয়ে। তারপর একটা গান হবে। দুটো পরিবেশনার ফাঁকের সময়টাতে কী হবে। ওরা যা করেছে তা হলো, ওই সময়টায় পর্দায় দেখিয়েছে একটা করে ছোট্ট চলচ্চিত্র। এক মিনিট দেড় মিনিট বা দুই-চার মিনিটের এই চলচ্চিত্রগুলোর কোনোটায় ছিল ছোট্ট কাহিনিচিত্র, কোনোটা মিউজিক ভিডিও। প্রায় বিশ-ত্রিশটা শর্টফিল্ম এরা প্রদর্শন করল অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে। মজার ব্যাপার হলো, এই ছবিগুলো তারা নিজেরা বানিয়েছে। ক্যামেরা বলতে সাধারণ স্থিরচিত্র তোলার ক্যামেরা। সেটাতে যে দুই-চার মিনিট ভিডিও করা যায়, তা-ই তারা করেছে। তারপর সেই ভিডিও তারা কপি করে নিয়েছে কম্পিউটারে। ইন্টারনেট থেকে সম্পাদনার সফটওয়্যার নামিয়ে নিয়ে তারা সম্পাদনার কাজ সেরেছে নিজেরাই। নিজেরাই শব্দ ও সংগীত যোজনা করেছে। কাহিনিও তাদের নিজেদের রচনা। অভিনয়ও করেছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আমি আগেই বলেছি, আমি দেশের টেলিভিশনগুলোর নাটক ইত্যাদি লিখে থাকি। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের মান সম্পর্কে আমার একটা ধারণা আছে। আমি স্পষ্টভাবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ভিডিওচিত্রগুলোর মান জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে কোনো অংশে খারাপ তো নয়ই, বরং কোনো কোনোটা খুবই ভালো। কোনো রকম কাঁচামো নেই। নিজেদের ক্যাম্পাসের মজার ঘটনা, পড়ার চাপ, পরীক্ষা নিয়ে তারা রসিকতা করেছে, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা চমত্কার উদ্দীপনামূলক কাহিনি ফেঁদেছে, আবার দেশাত্মবোধক গান নিয়ে বানিয়েছে অনেকগুলো সংগীতচিত্র। কিন্তু একটা বিষয় ঘুরেফিরে এসেছে। সেটা হলো, দেশ। দেশের ইতিহাস। মুুক্তিযুদ্ধ। একটা ভিডিওচিত্রে তো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলো দেখানো হলো। আর আছে আমাদের ক্রিকেট দলের শটের শট। মাথায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা বাঁধা ক্রিকেটার যখন ছক্কা মারেন, তখন কার না ভালো লাগে। শুধু ভিডিওচিত্রতে নয়, মঞ্চেও তারা যা পরিবেশন করল, তাতেও ঘুরেফিরে আসে দেশের কথা, মুক্তির কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা। প্রথমেই ছিল একটা কোরিওগ্রাফি, দেশ নিয়ে, পতাকা হাতে। আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত তাদের কাজ দেখে। আবৃত্তির দল যে আবৃত্তি করল, তার মান কোনো অংশেই কম নয়। এই ছেলেমেয়েরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। প্রান্তবর্তী শহরে থাকে। পরীক্ষা আর ক্লাস-টেস্টের চাপে এরা সারাক্ষণ থাকে পিষ্টপ্রায়। অথচ কী তাদের সৃজনশীলতা, চর্চা ও কল্পনাশক্তি ও সাংগঠনিক ক্ষমতার অপূর্ব বহিঃপ্রকাশ! এদের কারও কারও সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। তারা বলে, তারা ছবি দেখে দেশ-বিদেশের। তারা কম্পিউটারে ইন্টারনেটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলো ডাউনলোড করে নেয়। কখনো এক সপ্তাহ লেগে যায় ছবি নামাতে। তবু নামায়, তবু দেখে।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরের প্রজন্ম এরা। আমাদের সঙ্গে এদের প্রজন্মের পার্থক্য অনেক। সব দিক থেকেই এরা চৌকস, চটপটে, স্মার্ট। এরা কম্পিউটারকে এদের এগিয়ে যাওয়ার আর সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে খেলনার মতো ব্যবহার করে। এরা ক্রিকেট খেলে। এরা সংগীতের দল গড়ে। কিন্তু একটা বিষয়ে ওদের সঙ্গে আমাদের কোনো জেনারেশন-গ্যাপ বা প্রজন্ম-ব্যবধান নেই, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ, দেশ, পতাকা, জাতীয় সংগীতের প্রতি তাদের ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই।
নতুন প্রজন্ম আসছে। বাংলাদেশকে পাল্টে দিতে। এরা চিন্তায় আধুনিক, চেতনায় এদের মুক্তিযুদ্ধ।
সারাটা দেশ আজ কীভাবে মেতে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়টাকে উদ্যাপন করে নিতে। এসব আনুষ্ঠানিকতারও দরকার আছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে শোষণ থেকে মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে দেশের জন্য নিজেকে উত্সর্গ করতে প্রস্তুত থাকা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে গণতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে আধুনিক, অগ্রসর, সুখী ও আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে কাজটিই করবে। সেই কাজটিই করছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একটা কথা বলেন। কথাটা তিনি বলেন সক্রেটিসকে উদ্ধৃত করে। প্লেটো জিজ্ঞেস করেছিলেন সক্রেটিসকে, সর্বোচ্চ দেশপ্রেম কী? প্লেটো জবাব দিয়েছিলেন, সর্বোত্তমভাবে নিজের কাজটুকু করা। আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিজের কাজটুকু সুন্দরভাবে, উত্তমভাবে করছে। যে ক্রিকেট খেলছে, সে আন্তর্জাতিক মানে যাওয়ার জন্য খেলছে। যে লেখাপড়া করছে, সে মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। কম্পিউটার ইন্টারনেটে সে মুহূর্তে জেনে নিচ্ছে পৃথিবীর দূরতম অঞ্চলে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ তথ্যটা।
আর এরা যুক্ত হচ্ছে বইপড়া, সংগীতচর্চা, নাটক, বিতর্ক, আবৃত্তি, চলচ্চিত্র ইত্যাদি কার্যক্রমে। সে শুধু নিজেকে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে না, নিজের মধ্যে গড়ে তুলছে সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেতৃত্বের গুণ।
এই ছেলেমেয়েরা আসছে। হাজার হাজার জন। লক্ষ লক্ষ জন। এরা আসছে এক বিজয় থেকে আরেক বিজয়ে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে বলে। এদের কাছে দেশপ্রেম মানে কেবল বানানো কথার ফেনানো তুবড়ি নয়, এদের কাছে দেশপ্রেম মানে কাজ, নিজের কাজ।
আমরা একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছিলাম, আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলাম একটা ভয়ংকর সেনাবাহিনীকে। কিন্তু আমরা যে বিজয় সামনে অর্জন করতে যাচ্ছি, সেটা খুব অবিশ্বাস্য রকম কিছু নয়। মধ্য আয়ের একটা দেশ, অগ্রসর, বাসযোগ্য একটা দেশ, আলোকিত পরমতসহিষ্ণু ও বৈষম্যহীন একটা সমাজ। ষোলোই ডিসেম্বরের বিজয়ের পতাকার মাঝখানে লাল সূর্যটা আমাদের অভয় দিচ্ছে, শহীদদের শুভেচ্ছা আছে আমাদের সঙ্গে, আমরা পারবই।
বিদেশ থেকে বাংলাদেশের মাটিতে নেমে বিজয়ের স্মারক বাংলাদেশের পতাকা চারদিকে উড়তে দেখে সেই আশ্বাসই পাই। পৌষ মাস আমাদের উত্সবের মাস। আসলে অগ্রহায়ণ মাসে ধানকাটা, মাড়াই, সেদ্ধ করা, শুকানো, আমাদের জনপদবাসীর ব্যস্ততার কাল। পৌষ মাস হলো আমাদের উত্সবের মাস। নবান্নের আসল উত্সব হয় পৌষেই। ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে ছুটে আয়, ডালা যে তার ভরে গেছে পাকা ফসলে...’ এই গানের তাত্পর্য এইখানে। ছোটবেলায় গ্রামে ছড়া শুনেছি, ‘আগন মাসে ধান কাটিব, পৌষ মাসে বেটার বিয়া লো লো লো...।’ পৌষে চিরন্তন নবান্নের উত্সবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিজয়ের উত্সব। এ যেন সোনায় সোহাগা। এই উত্সব ১৬ কোটি মানুষের হূদয়কে উদ্দীপিত করুক, এগিয়ে নিয়ে যাক আমাদের বাংলাদেশকে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
No comments