রাজনীতি -গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু ফায়দাতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র by বদিউল আলম মজুমদার
সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা খুললেই প্রতিদিন চোখে পড়ে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা বা তাঁদের অনুগত-সমর্থকেরা বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন বা পাচ্ছেন। এসব সুযোগ-সুবিধা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈধ, আবার ক্ষেত্রবিশেষে অবৈধ। এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতও সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় সারা দেশ থেকেই প্রতিনিয়ত এমন ধরনের অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগ গুরুতর এবং এগুলো আমাদের বিকাশমান গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থার জন্য চরম ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে এ ব্যবস্থা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অন্যতম একটি বড় বাধা।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরাও এ দেশের নাগরিক, তাঁদেরও বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে সমস্যার সৃষ্টি হয় তাঁদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করলে। অর্থাত্ তাঁদের সরকারি চাকরি, আবাসিক এলাকায় প্লট কিংবা বিভিন্ন নির্মাণকাজের টেন্ডার দিতে গিয়ে যদি তাঁদের থেকে যোগ্য কাউকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে এটা হবে ফায়দা প্রদান। এ ধরনের বঞ্চনা চরম অন্যায় ও অবিচারের শামিল, যা নৈতিকতার দিক থেকে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। একই সঙ্গে অন্যায়ভাবে ফায়দা দেওয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও সহায়ক নয়। গণতন্ত্র নৈতিকতা ও আইনের শাসনের ওপর ভর করা একটি ব্যবস্থা। তাই গণতন্ত্র আর ফায়দাতন্ত্র কোনোভাবেই সহাবস্থান করতে পারে না।
এ ছাড়া দলবাজি ও ফায়দাবাজির মাধ্যমে সম্পদের অপব্যবহার ও অপচয় হয়। যেমন, দলীয় ব্যক্তিদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে নির্মাণকাজের ঠিকাদারি কোনো অযোগ্য-অদক্ষ লুটপাটের হোতাকে দিলে, বড়জোর অতি-নিম্নমানের কাজ হবে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো কাজই হবে না, কিন্তু টাকা গচ্চা যাবে। সরকারি ক্রয়-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে শিথিলতা আনা হয়েছে, তাতে সম্পদের এমন অপচয় হওয়াই স্বাভাবিক। দুর্বল অর্থনীতি ও সীমিত সম্পদের দেশ হিসেবে এ ধরনের অপচয় আমাদের সংগতির বাইরে এবং এগুলো আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টাকেও ব্যাহত করছে।
পরিবারতন্ত্রও ক্রমাগতভাবে আমাদের ওপর জেঁকে বসছে। পরিবারতন্ত্রের নগ্নতম উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দলের প্রধান এবং তাঁর ছেলে তারেক রহমানকে দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে নির্ধারণ করা শুধু দৃষ্টিকটুই ছিল না, এর মাধ্যমে দল পুরোপুরি পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটিও আমাদের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি। প্রসঙ্গত, বেগম জিয়াকে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন’কেও চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আইনানুযায়ী, দলের সব স্তরের কমিটি নির্বাচিত হওয়ার কথা। আইনি বিধানের প্রতি এমন অবজ্ঞাও কোনোভাবেই আইনের শাসনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞার দিকে তাকালেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। গণতন্ত্র হলো এমনই একটি ব্যবস্থা, যেখানে জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—অর্জিত হয়েছে তাদের কতগুলো অধিকার। বহুলাংশে নিশ্চিত হয়েছে নাগরিকদের মধ্যে সমতা ও তাদের জন্য সম-সুযোগ। এটি ‘লিবারেল’ বা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞা।
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য জনগণের ‘ফ্রি উইল’ বা স্বাধীন মতামত অর্থাত্ সম্মতি আবশ্যক। নির্বাচন—অর্থাত্ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে যা অর্জিত হয়, তা-ই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়—অর্থাত্ জনগণই সব ক্ষমতার উত্স—রাজা-মহারাজা বা কুলীনেরা নন। প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স শহরে লটারির মাধ্যমে সরাসরি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও, বর্তমান বিশ্বে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের চর্চা হয়। নির্বাচিত পার্লামেন্ট ও নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যা রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করে।
দ্বিতীয়ত, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ কতগুলো স্বাধীনতা বা অধিকার ভোগ করে। যেমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা, যার যার ধর্মচর্চার স্বাধীনতা ইত্যাদি। এসব অধিকার সাধারণত লিখিত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমাদের সংবিধানেও মৌলিক অধিকার হিসেবে এগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং এগুলো মেনে চলা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা হলে, তা বলবত্ করার জন্য সে নাগরিক আদালতের আশ্রয় নিতে পারে। ভোট দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগও আজ রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত।
নাগরিকের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে অনেক বিপ্লব-সংগ্রামের প্রয়োজন হয়েছে। দিতে হয়েছে বহু প্রাণ। লিঙ্গ ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্কদের অবাধ নির্বাচনের সুযোগ অর্জনের জন্য প্রতিটি মানবসমাজের বহু শতাব্দী লেগেছে। যেমন, ১৮৩০ সালে মাত্র ২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশ এবং অনেক গণতান্ত্রিক ইউরোপের অধিবাসীদের ভোটাধিকার ছিল। ১৮৬৭ সালে এই হার এসে দাঁড়িয়েছে ৭ এবং ১৮৮০ সালে প্রায় ৪০ শতাংশে। এ অগ্রগতির জন্য তাদের অবশ্য কম মূল্য দিতে হয়নি। বিংশ শতাব্দীর আগে পাশ্চাত্যের নারীরা ভোটাধিকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে এখন প্রতিটি দেশেই—যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরই ভোট দেওয়ার অধিকার অন্তত আইনগতভাবে স্বীকৃত হয়েছে।
তৃতীয়ত, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সম-সুযোগের অধিকার নিশ্চিত থাকে। অন্যান্য অধিকার থেকে এ অধিকারের ভিন্নতা রয়েছে, যদিও এটিকে সাধারণত মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়। ভিন্নতা ও গুরুত্বের কারণে এটি আংশিক অর্জন করতেও ঐতিহাসিকভাবে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এর জন্য লেগেছে বহু শতাব্দী ধরে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও বহু আত্মত্যাগ। ইউরোপের ‘এইজ অব এনলাইটেনমেন্ট’ বা আলোর যুগ ও তার পরবর্তী সময় পর্যন্ত এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর মাধ্যমেই ভোটাধিকার ও অন্য অনেক ক্ষেত্রে সাদা-কালো, নারী-পুরুষ প্রমুখের মধ্যে বৈষম্য বহুলাংশে দূর করা গেছে।
উল্লেখ্য, নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো কিছুটা এগিয়ে গেলেও সারা পৃথিবীতেই নারীরা এখনো অধস্তন অবস্থায় রয়েছে এবং তারা ব্যাপক বঞ্চনার শিকার। জাতিগত ও বর্ণবৈষম্যের সমস্যা থেকেও মানবজাতি এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য সারা পৃথিবীতেই দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তবুও পাশ্চাত্যের দেশগুলোয়—যেখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই সমতা অর্জনের সুযোগ বহুলাংশে সৃষ্টি হয়েছে।
এসব মৌলিক বৈশিষ্ট্য—সম্মতি, স্বাধীনতা ও সমতা পূরণ না হলে সত্যিকারার্থে গণতন্ত্র কায়েম হয় না। অর্থাত্ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারদের সম্মতি অর্জন করা গেলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। অর্থাত্ নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। এমনকি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। বস্তুত নির্বাচনের পরই গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয়। দুই নির্বাচনের মাঝখানে কী হয় না হয়, তার ওপরই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত এবং এর কার্যকরতা অর্জিত হলো কি না, তা নির্ভর করে। তাই শুধু নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলার অবকাশ নেই, যদিও এ দুটির মধ্যে অনেকেই অহরহ তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তাই নির্বাচনকে গণতন্ত্র বলা আংশিক সত্য বলার শামিল। অন্যভাবে বলতে গেলে, ক্ষমতাসীন সরকার গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা না করলে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা না করলে গণতন্ত্র কায়েম হয় না।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা এগিয়ে গেলেও, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে সম-সুযোগ থেকে আমাদের অধিকাংশ নাগরিক বঞ্চিত। আমাদের দেশে সমাজের ওপরের তলার একদল ব্যক্তি ভিআইপি নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত, যাঁরা সব ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত, যদিও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নাগরিকদের মধ্যে এ ধরনের বিভাজন করার কোনো অবকাশ নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় দলবাজির কারণে এ বঞ্চনা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। যারা ক্ষমতাসীন দলের অনুগত নয়, তারা প্রতিনিয়ত নাগরিক হিসেবে তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, যা গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পুরোপুরি অসংগতিপূর্ণ। অর্থাত্ দলবাজি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় অন্তরায়।
পরিবারতন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে আরও বড় অন্তরায়। সত্যিকারার্থেই গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে এবং গণতন্ত্রের সুফল সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হলে, সবচেয়ে সত্, যোগ্য ও নিবেদিত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ থাকতে হবে। তাদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার পথ উন্মুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু দলে পরিবারতন্ত্র সে পথ রুদ্ধ করে দেয়—এ ব্যবস্থায় দলীয় পদ একান্ত অনুগতদের মধ্যে ফায়দা হিসেবে বিতরণ করা হয়। পক্ষান্তরে, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা সে সুযোগ অবারিত করে। তাই পরিবারতন্ত্র গণতন্ত্রের সমতার বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ফলে পরিবারতন্ত্র সৃষ্টি করে রাষ্ট্রে কোনোভাবেই গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না।
এ ছাড়া পরিবারতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের দলীয় নেতৃত্বে আসার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। পরিবারের বাইরের ব্যক্তিদের মধ্যে করুণার ভিত্তিতে ফায়দা হিসেবে দলীয় পদ বিতরণ করা হয় বলে, সর্বাধিক অনুগত ব্যক্তিরা এবং বাগাড়ম্বর ও মোসাহেবিপনায় পটুরাই সাধারণত ক্ষমতার—বলতে গেলে, অনেকটা উচ্ছিষ্টাংশ পায়। ফলে জনগণ যোগ্য নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। বস্তুত এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপরই মানুষের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়।
প্রসঙ্গত, এ কারণেই প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের মতো মনীষীরা খ্রিষ্টপূর্ব চার-পাঁচ শতাব্দীর এথেন্সের সরাসরি গণতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করেছিলেন। তাঁদের মতে, তখনকার গ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অদক্ষ, অযোগ্য ও বাগাড়ম্বরে পটু ব্যক্তিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ফলে সমাজের অবক্ষয় ঘটে এবং চারদিকে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। দুর্ভাগ্যবশত ২৫০০ থেকে ২৬০০ বছর পরে প্লেটো-অ্যারিস্টটলের ধারণাই আমাদের দেশে সত্যে পরিণত হচ্ছে। এ-ই আমাদের নিয়তি!
প্রসঙ্গত, নাগরিক হিসেবে আমরা নিশ্চিত নই, বিএনপি কী করার চেষ্টা করছে? ইতিহাসে ছয় ধরনের সরকার দেখা যায়: রাজতন্ত্র (monarchy), অভিজাত (aristocracy), কতিপয়তন্ত্র (oligarchy), ধর্মতন্ত্র (theocracy), একনায়কতন্ত্র (dictatorship) ও গণতন্ত্র (democracy)। রাজতন্ত্রে রাজার ছেলে কিংবা রাজার মেয়ে যোগ্যতানির্বিশেষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতো। অর্থ ও বংশানুক্রমিতায় সৃষ্ট কুলীনেরা অভিজাততন্ত্রের ধারক ছিল। ক্ষমতা অতি সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে ওলিগার্সি বা কতিপয়তন্ত্র সৃষ্টি হতো। ধর্মের দোহাই দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করলে ধর্মতন্ত্র কায়েম হতো। এক ব্যক্তি শাসনক্ষমতা দখল করলে তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হতো। বিএনপি কোনটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে—রাজতন্ত্র, অভিজাত, কতিপয়তন্ত্র? না অন্য কিছু? গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েই বা তিনি কী করার চেষ্টা করছেন? আশা করি, বেগম জিয়া ও তাঁর আস্থাভাজনেরা ভাবনা-চিন্তা করেই এবং তাঁদের সিদ্ধান্তের পরিণতির কথা বিবেচনা করেই অগ্রসর হচ্ছেন। আমাদের আশঙ্কা, তাঁদের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ পরিণাম শুধু বিএনপিই নয়, পুরো জাতিকেই বহন করতে হবে।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে তেলে-জলে যেমন মেশে না, পরিবারতন্ত্র ও গণতন্ত্রও একত্রে যায় না। আমাদের আশঙ্কা, সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের দলবাজি, ফায়দাবাজি ও পরিবারতন্ত্রের চর্চা—আশা করি, ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগও পরিবারতন্ত্রের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে না, যদিও আশাবাদী হওয়া দুরূহ—আত্মঘাতী এবং পুরো জাতিকেই ভবিষ্যতে এর চরম মূল্য দিতে হবে। ভাবতেও কষ্ট লাগে, আমাদের নেত্রীদ্বয়ের আশপাশের এত শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি এসব গর্হিত কাজে সায় দিয়ে যাচ্ছেন! আমাদের নাগরিক সমাজও কি চুপ করে বসে থাকবে? যদি আমরা সবাই দর্শকের ভূমিকা নিই, তাহলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দুর্যোগ এড়ানো সম্ভবপর হবে কী করে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরাও এ দেশের নাগরিক, তাঁদেরও বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে সমস্যার সৃষ্টি হয় তাঁদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করলে। অর্থাত্ তাঁদের সরকারি চাকরি, আবাসিক এলাকায় প্লট কিংবা বিভিন্ন নির্মাণকাজের টেন্ডার দিতে গিয়ে যদি তাঁদের থেকে যোগ্য কাউকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে এটা হবে ফায়দা প্রদান। এ ধরনের বঞ্চনা চরম অন্যায় ও অবিচারের শামিল, যা নৈতিকতার দিক থেকে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। একই সঙ্গে অন্যায়ভাবে ফায়দা দেওয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও সহায়ক নয়। গণতন্ত্র নৈতিকতা ও আইনের শাসনের ওপর ভর করা একটি ব্যবস্থা। তাই গণতন্ত্র আর ফায়দাতন্ত্র কোনোভাবেই সহাবস্থান করতে পারে না।
এ ছাড়া দলবাজি ও ফায়দাবাজির মাধ্যমে সম্পদের অপব্যবহার ও অপচয় হয়। যেমন, দলীয় ব্যক্তিদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে নির্মাণকাজের ঠিকাদারি কোনো অযোগ্য-অদক্ষ লুটপাটের হোতাকে দিলে, বড়জোর অতি-নিম্নমানের কাজ হবে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো কাজই হবে না, কিন্তু টাকা গচ্চা যাবে। সরকারি ক্রয়-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে শিথিলতা আনা হয়েছে, তাতে সম্পদের এমন অপচয় হওয়াই স্বাভাবিক। দুর্বল অর্থনীতি ও সীমিত সম্পদের দেশ হিসেবে এ ধরনের অপচয় আমাদের সংগতির বাইরে এবং এগুলো আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টাকেও ব্যাহত করছে।
পরিবারতন্ত্রও ক্রমাগতভাবে আমাদের ওপর জেঁকে বসছে। পরিবারতন্ত্রের নগ্নতম উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দলের প্রধান এবং তাঁর ছেলে তারেক রহমানকে দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে নির্ধারণ করা শুধু দৃষ্টিকটুই ছিল না, এর মাধ্যমে দল পুরোপুরি পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটিও আমাদের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি। প্রসঙ্গত, বেগম জিয়াকে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন’কেও চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আইনানুযায়ী, দলের সব স্তরের কমিটি নির্বাচিত হওয়ার কথা। আইনি বিধানের প্রতি এমন অবজ্ঞাও কোনোভাবেই আইনের শাসনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
গণতন্ত্রের সংজ্ঞার দিকে তাকালেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। গণতন্ত্র হলো এমনই একটি ব্যবস্থা, যেখানে জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—অর্জিত হয়েছে তাদের কতগুলো অধিকার। বহুলাংশে নিশ্চিত হয়েছে নাগরিকদের মধ্যে সমতা ও তাদের জন্য সম-সুযোগ। এটি ‘লিবারেল’ বা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞা।
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য জনগণের ‘ফ্রি উইল’ বা স্বাধীন মতামত অর্থাত্ সম্মতি আবশ্যক। নির্বাচন—অর্থাত্ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে যা অর্জিত হয়, তা-ই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয়—অর্থাত্ জনগণই সব ক্ষমতার উত্স—রাজা-মহারাজা বা কুলীনেরা নন। প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স শহরে লটারির মাধ্যমে সরাসরি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও, বর্তমান বিশ্বে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের চর্চা হয়। নির্বাচিত পার্লামেন্ট ও নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যা রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করে।
দ্বিতীয়ত, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ কতগুলো স্বাধীনতা বা অধিকার ভোগ করে। যেমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা, যার যার ধর্মচর্চার স্বাধীনতা ইত্যাদি। এসব অধিকার সাধারণত লিখিত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকে। আমাদের সংবিধানেও মৌলিক অধিকার হিসেবে এগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং এগুলো মেনে চলা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা হলে, তা বলবত্ করার জন্য সে নাগরিক আদালতের আশ্রয় নিতে পারে। ভোট দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগও আজ রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত।
নাগরিকের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে অনেক বিপ্লব-সংগ্রামের প্রয়োজন হয়েছে। দিতে হয়েছে বহু প্রাণ। লিঙ্গ ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্কদের অবাধ নির্বাচনের সুযোগ অর্জনের জন্য প্রতিটি মানবসমাজের বহু শতাব্দী লেগেছে। যেমন, ১৮৩০ সালে মাত্র ২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশ এবং অনেক গণতান্ত্রিক ইউরোপের অধিবাসীদের ভোটাধিকার ছিল। ১৮৬৭ সালে এই হার এসে দাঁড়িয়েছে ৭ এবং ১৮৮০ সালে প্রায় ৪০ শতাংশে। এ অগ্রগতির জন্য তাদের অবশ্য কম মূল্য দিতে হয়নি। বিংশ শতাব্দীর আগে পাশ্চাত্যের নারীরা ভোটাধিকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে এখন প্রতিটি দেশেই—যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরই ভোট দেওয়ার অধিকার অন্তত আইনগতভাবে স্বীকৃত হয়েছে।
তৃতীয়ত, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সম-সুযোগের অধিকার নিশ্চিত থাকে। অন্যান্য অধিকার থেকে এ অধিকারের ভিন্নতা রয়েছে, যদিও এটিকে সাধারণত মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়। ভিন্নতা ও গুরুত্বের কারণে এটি আংশিক অর্জন করতেও ঐতিহাসিকভাবে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এর জন্য লেগেছে বহু শতাব্দী ধরে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও বহু আত্মত্যাগ। ইউরোপের ‘এইজ অব এনলাইটেনমেন্ট’ বা আলোর যুগ ও তার পরবর্তী সময় পর্যন্ত এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর মাধ্যমেই ভোটাধিকার ও অন্য অনেক ক্ষেত্রে সাদা-কালো, নারী-পুরুষ প্রমুখের মধ্যে বৈষম্য বহুলাংশে দূর করা গেছে।
উল্লেখ্য, নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো কিছুটা এগিয়ে গেলেও সারা পৃথিবীতেই নারীরা এখনো অধস্তন অবস্থায় রয়েছে এবং তারা ব্যাপক বঞ্চনার শিকার। জাতিগত ও বর্ণবৈষম্যের সমস্যা থেকেও মানবজাতি এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য সারা পৃথিবীতেই দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তবুও পাশ্চাত্যের দেশগুলোয়—যেখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই সমতা অর্জনের সুযোগ বহুলাংশে সৃষ্টি হয়েছে।
এসব মৌলিক বৈশিষ্ট্য—সম্মতি, স্বাধীনতা ও সমতা পূরণ না হলে সত্যিকারার্থে গণতন্ত্র কায়েম হয় না। অর্থাত্ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারদের সম্মতি অর্জন করা গেলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। অর্থাত্ নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। এমনকি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। বস্তুত নির্বাচনের পরই গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয়। দুই নির্বাচনের মাঝখানে কী হয় না হয়, তার ওপরই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত এবং এর কার্যকরতা অর্জিত হলো কি না, তা নির্ভর করে। তাই শুধু নির্বাচনকেই গণতন্ত্র বলার অবকাশ নেই, যদিও এ দুটির মধ্যে অনেকেই অহরহ তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তাই নির্বাচনকে গণতন্ত্র বলা আংশিক সত্য বলার শামিল। অন্যভাবে বলতে গেলে, ক্ষমতাসীন সরকার গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা না করলে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা না করলে গণতন্ত্র কায়েম হয় না।
নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা এগিয়ে গেলেও, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে সম-সুযোগ থেকে আমাদের অধিকাংশ নাগরিক বঞ্চিত। আমাদের দেশে সমাজের ওপরের তলার একদল ব্যক্তি ভিআইপি নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত, যাঁরা সব ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত, যদিও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নাগরিকদের মধ্যে এ ধরনের বিভাজন করার কোনো অবকাশ নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় দলবাজির কারণে এ বঞ্চনা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। যারা ক্ষমতাসীন দলের অনুগত নয়, তারা প্রতিনিয়ত নাগরিক হিসেবে তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, যা গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পুরোপুরি অসংগতিপূর্ণ। অর্থাত্ দলবাজি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় অন্তরায়।
পরিবারতন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে আরও বড় অন্তরায়। সত্যিকারার্থেই গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে এবং গণতন্ত্রের সুফল সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হলে, সবচেয়ে সত্, যোগ্য ও নিবেদিত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ থাকতে হবে। তাদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার পথ উন্মুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু দলে পরিবারতন্ত্র সে পথ রুদ্ধ করে দেয়—এ ব্যবস্থায় দলীয় পদ একান্ত অনুগতদের মধ্যে ফায়দা হিসেবে বিতরণ করা হয়। পক্ষান্তরে, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা সে সুযোগ অবারিত করে। তাই পরিবারতন্ত্র গণতন্ত্রের সমতার বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ফলে পরিবারতন্ত্র সৃষ্টি করে রাষ্ট্রে কোনোভাবেই গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না।
এ ছাড়া পরিবারতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের দলীয় নেতৃত্বে আসার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। পরিবারের বাইরের ব্যক্তিদের মধ্যে করুণার ভিত্তিতে ফায়দা হিসেবে দলীয় পদ বিতরণ করা হয় বলে, সর্বাধিক অনুগত ব্যক্তিরা এবং বাগাড়ম্বর ও মোসাহেবিপনায় পটুরাই সাধারণত ক্ষমতার—বলতে গেলে, অনেকটা উচ্ছিষ্টাংশ পায়। ফলে জনগণ যোগ্য নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। বস্তুত এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপরই মানুষের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়।
প্রসঙ্গত, এ কারণেই প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের মতো মনীষীরা খ্রিষ্টপূর্ব চার-পাঁচ শতাব্দীর এথেন্সের সরাসরি গণতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করেছিলেন। তাঁদের মতে, তখনকার গ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অদক্ষ, অযোগ্য ও বাগাড়ম্বরে পটু ব্যক্তিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ফলে সমাজের অবক্ষয় ঘটে এবং চারদিকে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। দুর্ভাগ্যবশত ২৫০০ থেকে ২৬০০ বছর পরে প্লেটো-অ্যারিস্টটলের ধারণাই আমাদের দেশে সত্যে পরিণত হচ্ছে। এ-ই আমাদের নিয়তি!
প্রসঙ্গত, নাগরিক হিসেবে আমরা নিশ্চিত নই, বিএনপি কী করার চেষ্টা করছে? ইতিহাসে ছয় ধরনের সরকার দেখা যায়: রাজতন্ত্র (monarchy), অভিজাত (aristocracy), কতিপয়তন্ত্র (oligarchy), ধর্মতন্ত্র (theocracy), একনায়কতন্ত্র (dictatorship) ও গণতন্ত্র (democracy)। রাজতন্ত্রে রাজার ছেলে কিংবা রাজার মেয়ে যোগ্যতানির্বিশেষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতো। অর্থ ও বংশানুক্রমিতায় সৃষ্ট কুলীনেরা অভিজাততন্ত্রের ধারক ছিল। ক্ষমতা অতি সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে ওলিগার্সি বা কতিপয়তন্ত্র সৃষ্টি হতো। ধর্মের দোহাই দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করলে ধর্মতন্ত্র কায়েম হতো। এক ব্যক্তি শাসনক্ষমতা দখল করলে তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হতো। বিএনপি কোনটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে—রাজতন্ত্র, অভিজাত, কতিপয়তন্ত্র? না অন্য কিছু? গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েই বা তিনি কী করার চেষ্টা করছেন? আশা করি, বেগম জিয়া ও তাঁর আস্থাভাজনেরা ভাবনা-চিন্তা করেই এবং তাঁদের সিদ্ধান্তের পরিণতির কথা বিবেচনা করেই অগ্রসর হচ্ছেন। আমাদের আশঙ্কা, তাঁদের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ পরিণাম শুধু বিএনপিই নয়, পুরো জাতিকেই বহন করতে হবে।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে তেলে-জলে যেমন মেশে না, পরিবারতন্ত্র ও গণতন্ত্রও একত্রে যায় না। আমাদের আশঙ্কা, সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের দলবাজি, ফায়দাবাজি ও পরিবারতন্ত্রের চর্চা—আশা করি, ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগও পরিবারতন্ত্রের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে না, যদিও আশাবাদী হওয়া দুরূহ—আত্মঘাতী এবং পুরো জাতিকেই ভবিষ্যতে এর চরম মূল্য দিতে হবে। ভাবতেও কষ্ট লাগে, আমাদের নেত্রীদ্বয়ের আশপাশের এত শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি এসব গর্হিত কাজে সায় দিয়ে যাচ্ছেন! আমাদের নাগরিক সমাজও কি চুপ করে বসে থাকবে? যদি আমরা সবাই দর্শকের ভূমিকা নিই, তাহলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দুর্যোগ এড়ানো সম্ভবপর হবে কী করে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’।
No comments