সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কারবালার চেতনা -পবিত্র আশুরা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
প্রাচীনকাল থেকে যুগে যুগে ১০ মহররম বা আশুরা দিবসে ঐতিহাসিক বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির কাজ এদিনই সম্পন্ন করেন। হজরত আদম (আ.) খলিফা হিসেবে দুনিয়াতে আগমন করেন এবং এদিনেই তাঁর তওবা কবুল হয়। হজরত নূহ (আ.)-এর কিশিত মহাপ্লাবনের কবল থেকে রক্ষা পায়। হজরত দাউদ (আ.)-এর তওবা কবুল হয়। হজরত মূসা (আ.) ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তি পান এবং তারা সদলবলে নীলনদে নিমজ্জিত হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের আগুন থেকে নাজাত লাভ করেন। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সেরে ওঠেন। হজরত ঈসা (আ.)-কে ঊর্ধ্বাকাশে উত্তোলন করার ঘটনাও এদিনে ঘটেছিল। আশুরা দিবসে কিয়ামত সংঘটিত হবে বলেও বর্ণিত আছে। ইসলামের ইতিহাসে আশুরা দিবস বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতই এ দিবসের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
পবিত্র আশুরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত তাত্পর্যময় একটি দিবস। পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামে সব সময় সত্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরেরা ৬১ হিজরিতে এদিন ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে কারবালায় নির্মমভাবে শহীদ হন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁর এ আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগের মহিমা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। জুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এবং অসত্য ও অন্যায় প্রতিরোধে আশুরার মহান শিক্ষা জাতীয় জীবনে প্রতিফলন ঘটানো দরকার।
নবী-দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন সত্যের প্রতীক। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাতিলের রক্তচক্ষু তাঁকে এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। ক্ষমতালোভী ইয়াজিদকে সমর্থন না করায় পরিস্থিতি অনিবার্য সংঘর্ষের দিকে এগোতে থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নবী করিম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খুলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামল পর্যন্ত ইসলামি আদর্শ তথা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত হতো; কিন্তু ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর ইন্তেকালের পর মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ নিজেকে মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফা দাবি করে দামেস্ককে রাজধানী ঘোষণা করেন। কিন্তু মদিনার লোকেরা তার এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে খিলাফতের আসন গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান। ইমাম হোসাইন (রা.) নিজেকে খলিফা দাবি না করলেও ইয়াজিদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। দুর্ভাগ্যবশত খুলাফায়ে রাশেদিনের প্রতিষ্ঠিত ন্যায়নীতি লঙ্ঘন ও পদদলিত করে ইয়াজিদ অন্যায় ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মুসলিম জাহানের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং খিলাফতের পরিবর্তে প্রথম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এ পদে থেকে ইয়াজিদ ইসলামি আদর্শবিরোধী তত্পরতা শুরু করে এবং খলিফা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য সাম্রাজ্যে ভীতিসঞ্চার করে সন্ত্রাসী তত্পরতা চালায়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং বায়তুল মাল দখলকারী ইয়াজিদ অন্যায়ের কাছে মাথানত করে।
ইয়াজিদের সঙ্গে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বিরোধ ছিল আদর্শিক, ইয়াজিদ ন্যায়নিষ্ঠ শাসক ছিল না। তার ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতালোভ এবং শাসক হিসেবে ছিল হীন চরিত্রের স্বৈরতন্ত্রী। মুসলিম সমাজের যোগ্য প্রতিনিধিরা খলিফা বা আমিরুল মুমিনীন পদে তাকে মনোনয়নও দেয়নি, বরং ইয়াজিদ জবরদস্তিমূলকভাবে খলিফার পদ দখল করে বসেছিল। এ অবস্থায় ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এরই পরিণতিতে একপর্যায়ে মদিনা থেকে কুফা যাওয়ার পথে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক স্থানে ইয়াজিদের তাঁবেদার বাহিনীর হাতে তিনি সপরিবারে জীবন বিলিয়ে দেন। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কোলে যিনি লালিত-পালিত হয়েছেন, যাঁর দেহে আখেরি নবীর রক্ত প্রবাহিত, তিনি কীভাবে তাঁরই আদর্শবিরোধী পন্থায় অধিষ্ঠিত শাসকের হাতে বায়আত বা আনুগত্য গ্রহণ করতে পারেন? এ ঘটনা মানবজাতির ইতিহাসে এক মর্মন্তুদ শোকাবহ ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে। এখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ার মুসলিম সমাজ, এমনকি জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নিপীড়িত মানুষ এ শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা লাভ করেন। কারবালার ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের সুমহান আত্মত্যাগের কাহিনী নয়, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত প্রতিবাদের এক অনন্য সাধারণ বীরত্বগাথা। অপরদিকে এ ঘটনার ভেতর দিয়ে ক্ষমতালোভী মানুষের নৈতিক অধঃপতন, ক্ষমতার মোহ ও অর্থলিপ্সার হীন চরিত্র ফুটে উঠেছে।
কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ নবী বংশের আত্মত্যাগ ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য; তাই আশুরার ঘটনাবহুল ঐতিহ্য শৌর্য-বীর্য ও ত্যাগের অপূর্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) সেদিন যে জান কোরবানির অনন্য নজির স্থাপন করেন, তা যুগে যুগে শান্তিকামী মানুষকে এক দুর্দমনীয় অনুপ্রেরণাসহ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উত্সাহ দিয়ে আসছে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সেদিন ইমাম হোসাইন (রা.) যদি দুরাত্মা ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করতেন, তাহলে রাজ সিংহাসন তাঁর বশীভূত হতো। কিন্তু নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতালিন্সা তাঁকে গ্রাস করেনি। লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের চিরশাশ্বত নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত করলেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে। তাই যথার্থই বলা হয়, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়/হর কারবালা কী বাদ’—ইসলাম জীবিত হয় প্রতি কারবালার পর।
হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সপরিবারে শাহাদাতবরণের ঘটনা ১০ মহররম আশুরাকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা ও ত্যাগের মহিমা। এদিন শুধু শোক আর বেদনা নয়, বরং কারবালা আমাদের অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, আত্মত্যাগে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। ইমাম হোসাইন (রা.) অসত্য ও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদের অন্যায় দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে তিনি এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনবাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি, ইসলামের ইতিহাস তাঁদের অমর করেছে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরায় শাশ্বত বাণী তাই আমাদেরকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
বস্তুত, কারবালার ঘটনা কোনো আহাজারি কিংবা মাতমের বিষয় নয়, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইমাম হোসাইন (রা.) আজ অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গণ্য। বিশ্বজুড়েই আজ সত্য-অসত্যের ও ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে। অসত্য ও অন্যায়ই যেন প্রবলভাবে বিরাজমান। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নবী-দৌহিত্র কারবালায় আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই চেতনার অভাবের কারণে আজ অসত্য ও অন্যায়ের প্রবল প্রতাপ। আশুরার শিক্ষা আমাদের অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাহস জোগায়, আত্মত্যাগের আহ্বান জানায়। কারবালার সেই চেতনাকে ধারণ করতে না পারলে, শুধু শোক আর মাতম করে কোনো লাভ নেই। যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অসত্য ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং কোনো দেশ-জাতি-রাষ্ট্র বা সমাজে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই কারবালার অতুলনীয় শিক্ষা। আসুন না, আমরা কারবালার মহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সব অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, নিপীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। এ জন্য আশুরার শোকাবহ এদিনে অসত্য, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদর্শের লড়াইয়ের দৃপ্তকণ্ঠে বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com
পবিত্র আশুরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত তাত্পর্যময় একটি দিবস। পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামে সব সময় সত্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরেরা ৬১ হিজরিতে এদিন ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে কারবালায় নির্মমভাবে শহীদ হন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁর এ আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগের মহিমা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। জুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এবং অসত্য ও অন্যায় প্রতিরোধে আশুরার মহান শিক্ষা জাতীয় জীবনে প্রতিফলন ঘটানো দরকার।
নবী-দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন সত্যের প্রতীক। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাতিলের রক্তচক্ষু তাঁকে এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। ক্ষমতালোভী ইয়াজিদকে সমর্থন না করায় পরিস্থিতি অনিবার্য সংঘর্ষের দিকে এগোতে থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নবী করিম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খুলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামল পর্যন্ত ইসলামি আদর্শ তথা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত হতো; কিন্তু ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর ইন্তেকালের পর মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ নিজেকে মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফা দাবি করে দামেস্ককে রাজধানী ঘোষণা করেন। কিন্তু মদিনার লোকেরা তার এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে খিলাফতের আসন গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান। ইমাম হোসাইন (রা.) নিজেকে খলিফা দাবি না করলেও ইয়াজিদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। দুর্ভাগ্যবশত খুলাফায়ে রাশেদিনের প্রতিষ্ঠিত ন্যায়নীতি লঙ্ঘন ও পদদলিত করে ইয়াজিদ অন্যায় ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মুসলিম জাহানের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং খিলাফতের পরিবর্তে প্রথম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এ পদে থেকে ইয়াজিদ ইসলামি আদর্শবিরোধী তত্পরতা শুরু করে এবং খলিফা হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য সাম্রাজ্যে ভীতিসঞ্চার করে সন্ত্রাসী তত্পরতা চালায়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং বায়তুল মাল দখলকারী ইয়াজিদ অন্যায়ের কাছে মাথানত করে।
ইয়াজিদের সঙ্গে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বিরোধ ছিল আদর্শিক, ইয়াজিদ ন্যায়নিষ্ঠ শাসক ছিল না। তার ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতালোভ এবং শাসক হিসেবে ছিল হীন চরিত্রের স্বৈরতন্ত্রী। মুসলিম সমাজের যোগ্য প্রতিনিধিরা খলিফা বা আমিরুল মুমিনীন পদে তাকে মনোনয়নও দেয়নি, বরং ইয়াজিদ জবরদস্তিমূলকভাবে খলিফার পদ দখল করে বসেছিল। এ অবস্থায় ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এরই পরিণতিতে একপর্যায়ে মদিনা থেকে কুফা যাওয়ার পথে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক স্থানে ইয়াজিদের তাঁবেদার বাহিনীর হাতে তিনি সপরিবারে জীবন বিলিয়ে দেন। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কোলে যিনি লালিত-পালিত হয়েছেন, যাঁর দেহে আখেরি নবীর রক্ত প্রবাহিত, তিনি কীভাবে তাঁরই আদর্শবিরোধী পন্থায় অধিষ্ঠিত শাসকের হাতে বায়আত বা আনুগত্য গ্রহণ করতে পারেন? এ ঘটনা মানবজাতির ইতিহাসে এক মর্মন্তুদ শোকাবহ ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে। এখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ার মুসলিম সমাজ, এমনকি জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নিপীড়িত মানুষ এ শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা লাভ করেন। কারবালার ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের সুমহান আত্মত্যাগের কাহিনী নয়, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত প্রতিবাদের এক অনন্য সাধারণ বীরত্বগাথা। অপরদিকে এ ঘটনার ভেতর দিয়ে ক্ষমতালোভী মানুষের নৈতিক অধঃপতন, ক্ষমতার মোহ ও অর্থলিপ্সার হীন চরিত্র ফুটে উঠেছে।
কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ নবী বংশের আত্মত্যাগ ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য; তাই আশুরার ঘটনাবহুল ঐতিহ্য শৌর্য-বীর্য ও ত্যাগের অপূর্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) সেদিন যে জান কোরবানির অনন্য নজির স্থাপন করেন, তা যুগে যুগে শান্তিকামী মানুষকে এক দুর্দমনীয় অনুপ্রেরণাসহ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উত্সাহ দিয়ে আসছে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সেদিন ইমাম হোসাইন (রা.) যদি দুরাত্মা ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করতেন, তাহলে রাজ সিংহাসন তাঁর বশীভূত হতো। কিন্তু নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতালিন্সা তাঁকে গ্রাস করেনি। লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের চিরশাশ্বত নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত করলেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে। তাই যথার্থই বলা হয়, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়/হর কারবালা কী বাদ’—ইসলাম জীবিত হয় প্রতি কারবালার পর।
হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সপরিবারে শাহাদাতবরণের ঘটনা ১০ মহররম আশুরাকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা ও ত্যাগের মহিমা। এদিন শুধু শোক আর বেদনা নয়, বরং কারবালা আমাদের অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, আত্মত্যাগে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। ইমাম হোসাইন (রা.) অসত্য ও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদের অন্যায় দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে তিনি এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনবাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি, ইসলামের ইতিহাস তাঁদের অমর করেছে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরায় শাশ্বত বাণী তাই আমাদেরকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
বস্তুত, কারবালার ঘটনা কোনো আহাজারি কিংবা মাতমের বিষয় নয়, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইমাম হোসাইন (রা.) আজ অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গণ্য। বিশ্বজুড়েই আজ সত্য-অসত্যের ও ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে। অসত্য ও অন্যায়ই যেন প্রবলভাবে বিরাজমান। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নবী-দৌহিত্র কারবালায় আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই চেতনার অভাবের কারণে আজ অসত্য ও অন্যায়ের প্রবল প্রতাপ। আশুরার শিক্ষা আমাদের অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাহস জোগায়, আত্মত্যাগের আহ্বান জানায়। কারবালার সেই চেতনাকে ধারণ করতে না পারলে, শুধু শোক আর মাতম করে কোনো লাভ নেই। যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অসত্য ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং কোনো দেশ-জাতি-রাষ্ট্র বা সমাজে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই কারবালার অতুলনীয় শিক্ষা। আসুন না, আমরা কারবালার মহান চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সব অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, নিপীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। এ জন্য আশুরার শোকাবহ এদিনে অসত্য, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদর্শের লড়াইয়ের দৃপ্তকণ্ঠে বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments