নরেন বিশ্বাসের ঐতিহ্য-অঙ্গীকার by বিপ্লব বালা
প্রয়াত নরেন বিশ্বাসের আজ ৬৩তম জন্মদিন। ১৯৯৮ সালে তাঁর প্রয়াণ ঘটে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। প্রাণভরে ভালোবেসেছিলেন তিনি ভাষা, বাংলা ভাষা। তার কাব্য-সাহিত্যের বিবিধ রতন, অতুল অলংকার আর উচ্চারণ-সূত্র বিভোর আকুলতায় উপভোগ-ব্যাখ্যান করে গেছেন জীবনভর। সাধারণ শিক্ষার্থী আর আপামরজনে বিতরণ করেছেন ভাষার রূপ-রস-নন্দন। সব বাংলাভাষীর জন্য বাচিক উচ্চারণ-সূত্র একজীবনের মূল্যে প্রণয়ন-সন্ধান, দেশজোড়া নিরন্তর কর্মশালায় তার শিক্ষাচর্চা সম্পন্ন করে চলেছিলেন। বড় আকুল প্রেমভরে। শুষ্ক নিরস উচ্চারণ নিয়মরীতি তাঁর বাচনে হয়ে উঠেছিল কিশোর প্রেমিকের মুগ্ধ আশ্লেষ যেন বা। প্রণয়ের চিরবিস্ময়-লাবণ্য ভাষ!
জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জের অজ এক পাড়াগাঁয়ে। নিম্নবর্ণের বাঙাল শূদ্র, এই জলি নমো কোথায় পেয়েছিলেন তবে অপরূপ ভাষা-রাজকন্যার সন্ধান-পরিচয়? চিকন কালা কৃষ্ণ কানাইয়ার মতোই সে একলব্য-ব্রত নিষ্ঠা? বাংলা মনের এমন ঐতিহ্য অঙ্গীকারধারা বুঝি অনিঃশেষ ফল্গুধারায় আজও চিরবহমান, যার উত্তরাধিকার নাগরিকজনের আয়ত্তগম্য হয় না তত। যতই কেন পণ্ডিতমন্য অধ্যাপক সুযোগ-সুবিধার ভাষাজীবিকায় ক্ষমতালেহী হয়ে ওঠেন। তার জন্য চাই যে অন্যতর দেশ-সমাজ-মানুষ সম্বন্ধন। নিরক্ষর গ্রাম-সমাজের বিপুল বিচিত্র ভাব-ভাষা শ্রুতির অতুল ভাণ্ডার, মাতৃভাষা-রূপ খনির জোগান লাগে। সেই সব কথক-গায়েন-কবিয়াল আর গ্রামের শিক্ষক-পণ্ডিতের কাছেই হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। তাতে বাল্য-কৈশোর বেলায়ই ভাষার ভাব-রসে নাড়া-বাঁধা দীক্ষা পেয়ে যান, যাতে জীবিকার চাকরি তাঁকে কেবল বিদ্যাজীবী হতে বাদ সেধেছিল। তাই বুঝি, ভাষা সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা তাঁর অমল সরস মনটি কিংবা মুখের অমন দেশি বাংলা হাসিটি মুছে দিতে, নেভাতে পারেনি। ‘অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া/ সুখ নেই’ যে নাগরিক সমাজের।
মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন কলেজের বাংলা ক্লাসে তাঁর রক্তাক্ত প্রান্তর পাঠাভিনয় হয়ে উঠত পথচারী সাধারণজনেরও নাট্য রস-ভোক্তার অবাধ এক আসর। কে বলবে এই ওস্তাদ কথক-নটবর দাড়িয়াল শিক্ষক বামপন্থী এক কট্টর সমর্থক কর্মী শুভানুধ্যায়ী। মুক্তিযুদ্ধকালে যাঁর ভিন্ন রাজনীতির নাটক হামলা করেই বন্ধ করা হয় শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে। যদিও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর কবিতা, গান, নাটক প্রচারিতও হয়েছে। পরবর্তীকালে দেশে ফিরে, এক মন্ত্রীপ্রবরকে উদ্দেশ করে সংবর্ধনাপত্র লিখতে রাজি না হওয়ায় দিন কয়েকের হাজত নাকি মাস তিনেকের কারাবাসই ঘটেছিল।
তবে ক্রমে তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, রাজনীতির এই ডন কিহোতিপনা তাঁর মনের স্বধর্ম নয়। আশৈশব তিনি যে বাগদত্ত ভিন্ন এক প্রণয়কলায়। তাঁরও বিহনে বদনখানি নয়নজলে মলিন সে রোরুদ্যমানার—যাহার ‘ভাষা হায় সকলে ভুলিতে চায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ক্লাসেই অতঃপর শুরু হয় তাঁর বাংলা ভাষার প্রেমাভিসার। ক্রমে তাঁর অপ্রতিরোধ্য বিস্তার ঘটে টিএসসির সর্বদলীয় কর্মশালায়—আবৃত্তির, নাটকের। গণমাধ্যমগুলোতে আর দেশজোড়া বিবিধ আয়োজনে। গোপালগঞ্জী এই বাঙাল, যাঁর চ-বর্গ উচ্চারণে যতই কেন ভুল ধরতে থাকে সূক্ষ্মশীলনীরা, উচ্চারণের সূত্র তাঁকে যে গিলিয়ে মাতাতে হবে যত আঞ্চলিক সাক্ষর শিক্ষিতজনে—এমনই ছিল যেন তাঁর ‘দাবায় রাখতে পারবা না’ রোখ, বাঙালের গোঁ আর কাকে বলে! একাই প্রণয়ন করে ফেলেন ৩০ হাজার শব্দের আস্ত এক উচ্চারণ অভিধান। এই কাজে তিনি হাসিমুখে বাটিয়া দেন তাঁর মনপ্রাণদেহের একের পর এক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কড়ায়-গণ্ডায় বিনিময় মূল্য হিসেবেই যেন। সবশেষে, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও বাংলা সাহিত্যের গদ্য-পদ্য-নাটকের পঙিক্তমালা ধারণ করেন ক্যাসেট-সিডিতে—‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ নামে। আনিসুজ্জামান থেকে সুবর্ণা মুস্তফা—আবৃত্তি-অভিনয়ের সর্বসেরা কথক নট-নটীবর সহযোগে, সবার মধ্যমণি ছিলেন তবে তিনি। পূর্বকার সাহিত্যপ্রথা ভেঙেই তাই ‘আনন্দ পুরস্কার’ লাভ করেন উচ্চমন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বিপুল জোয়ারই এক জেগেছিল বুঝি নাগরিক সংস্কৃতি-সমাজে। যখন কিনা বাংলা ভাষা দুয়োরানির কালিমায় নির্বাসিতা রাষ্ট্রে, প্রশাসনে, শিক্ষায়, চাকরিতে। বছর কয়েক পর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশ্বমর্যাদা পেয়ে যায়, হতচকিত বিস্ময়ে আমাদের হতবাক করে। থোঁতা মুখ ভোঁতা করা এই মণিহার সাজে কি আজ আর আমাদের—কে আছে এমন বুকে হাত দিয়ে বলে সে কথা?
‘পাওয়া ধন খোয়ানোর’ এই দেশ-জাতি কতটাই বা মনে রাখবে তার এক নকিব বান্দায়? তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান তাই কি তাঁর নাম তেমন নেয় না —তাঁর নামে বছরওয়ারি স্মৃতিপদক দিয়ে চললেও। ‘বাক-শিল্পাচার্য’ উপাধি প্রদায়কগণের কণ্ঠবাদনও কি আজ শুনি তত? সারা দেশের নাগরিক জনমনে তবুও কি আসীন নন কোথাও নরেন বিশ্বাস—তাঁর অমন দিব্য লোক-মহিমায়? ‘স্মরণ আজিও তার হানে তরবারি’—কালের যাত্রার ধ্বনি যতই কেন পাই শুনিবারে—তার সম্মার্জনী সম্পাতে, অকরুণ ঘাতে, প্রতিঘাতে!
জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জের অজ এক পাড়াগাঁয়ে। নিম্নবর্ণের বাঙাল শূদ্র, এই জলি নমো কোথায় পেয়েছিলেন তবে অপরূপ ভাষা-রাজকন্যার সন্ধান-পরিচয়? চিকন কালা কৃষ্ণ কানাইয়ার মতোই সে একলব্য-ব্রত নিষ্ঠা? বাংলা মনের এমন ঐতিহ্য অঙ্গীকারধারা বুঝি অনিঃশেষ ফল্গুধারায় আজও চিরবহমান, যার উত্তরাধিকার নাগরিকজনের আয়ত্তগম্য হয় না তত। যতই কেন পণ্ডিতমন্য অধ্যাপক সুযোগ-সুবিধার ভাষাজীবিকায় ক্ষমতালেহী হয়ে ওঠেন। তার জন্য চাই যে অন্যতর দেশ-সমাজ-মানুষ সম্বন্ধন। নিরক্ষর গ্রাম-সমাজের বিপুল বিচিত্র ভাব-ভাষা শ্রুতির অতুল ভাণ্ডার, মাতৃভাষা-রূপ খনির জোগান লাগে। সেই সব কথক-গায়েন-কবিয়াল আর গ্রামের শিক্ষক-পণ্ডিতের কাছেই হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। তাতে বাল্য-কৈশোর বেলায়ই ভাষার ভাব-রসে নাড়া-বাঁধা দীক্ষা পেয়ে যান, যাতে জীবিকার চাকরি তাঁকে কেবল বিদ্যাজীবী হতে বাদ সেধেছিল। তাই বুঝি, ভাষা সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা তাঁর অমল সরস মনটি কিংবা মুখের অমন দেশি বাংলা হাসিটি মুছে দিতে, নেভাতে পারেনি। ‘অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া/ সুখ নেই’ যে নাগরিক সমাজের।
মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন কলেজের বাংলা ক্লাসে তাঁর রক্তাক্ত প্রান্তর পাঠাভিনয় হয়ে উঠত পথচারী সাধারণজনেরও নাট্য রস-ভোক্তার অবাধ এক আসর। কে বলবে এই ওস্তাদ কথক-নটবর দাড়িয়াল শিক্ষক বামপন্থী এক কট্টর সমর্থক কর্মী শুভানুধ্যায়ী। মুক্তিযুদ্ধকালে যাঁর ভিন্ন রাজনীতির নাটক হামলা করেই বন্ধ করা হয় শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে। যদিও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর কবিতা, গান, নাটক প্রচারিতও হয়েছে। পরবর্তীকালে দেশে ফিরে, এক মন্ত্রীপ্রবরকে উদ্দেশ করে সংবর্ধনাপত্র লিখতে রাজি না হওয়ায় দিন কয়েকের হাজত নাকি মাস তিনেকের কারাবাসই ঘটেছিল।
তবে ক্রমে তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, রাজনীতির এই ডন কিহোতিপনা তাঁর মনের স্বধর্ম নয়। আশৈশব তিনি যে বাগদত্ত ভিন্ন এক প্রণয়কলায়। তাঁরও বিহনে বদনখানি নয়নজলে মলিন সে রোরুদ্যমানার—যাহার ‘ভাষা হায় সকলে ভুলিতে চায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ক্লাসেই অতঃপর শুরু হয় তাঁর বাংলা ভাষার প্রেমাভিসার। ক্রমে তাঁর অপ্রতিরোধ্য বিস্তার ঘটে টিএসসির সর্বদলীয় কর্মশালায়—আবৃত্তির, নাটকের। গণমাধ্যমগুলোতে আর দেশজোড়া বিবিধ আয়োজনে। গোপালগঞ্জী এই বাঙাল, যাঁর চ-বর্গ উচ্চারণে যতই কেন ভুল ধরতে থাকে সূক্ষ্মশীলনীরা, উচ্চারণের সূত্র তাঁকে যে গিলিয়ে মাতাতে হবে যত আঞ্চলিক সাক্ষর শিক্ষিতজনে—এমনই ছিল যেন তাঁর ‘দাবায় রাখতে পারবা না’ রোখ, বাঙালের গোঁ আর কাকে বলে! একাই প্রণয়ন করে ফেলেন ৩০ হাজার শব্দের আস্ত এক উচ্চারণ অভিধান। এই কাজে তিনি হাসিমুখে বাটিয়া দেন তাঁর মনপ্রাণদেহের একের পর এক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কড়ায়-গণ্ডায় বিনিময় মূল্য হিসেবেই যেন। সবশেষে, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও বাংলা সাহিত্যের গদ্য-পদ্য-নাটকের পঙিক্তমালা ধারণ করেন ক্যাসেট-সিডিতে—‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ নামে। আনিসুজ্জামান থেকে সুবর্ণা মুস্তফা—আবৃত্তি-অভিনয়ের সর্বসেরা কথক নট-নটীবর সহযোগে, সবার মধ্যমণি ছিলেন তবে তিনি। পূর্বকার সাহিত্যপ্রথা ভেঙেই তাই ‘আনন্দ পুরস্কার’ লাভ করেন উচ্চমন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বিপুল জোয়ারই এক জেগেছিল বুঝি নাগরিক সংস্কৃতি-সমাজে। যখন কিনা বাংলা ভাষা দুয়োরানির কালিমায় নির্বাসিতা রাষ্ট্রে, প্রশাসনে, শিক্ষায়, চাকরিতে। বছর কয়েক পর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশ্বমর্যাদা পেয়ে যায়, হতচকিত বিস্ময়ে আমাদের হতবাক করে। থোঁতা মুখ ভোঁতা করা এই মণিহার সাজে কি আজ আর আমাদের—কে আছে এমন বুকে হাত দিয়ে বলে সে কথা?
‘পাওয়া ধন খোয়ানোর’ এই দেশ-জাতি কতটাই বা মনে রাখবে তার এক নকিব বান্দায়? তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান তাই কি তাঁর নাম তেমন নেয় না —তাঁর নামে বছরওয়ারি স্মৃতিপদক দিয়ে চললেও। ‘বাক-শিল্পাচার্য’ উপাধি প্রদায়কগণের কণ্ঠবাদনও কি আজ শুনি তত? সারা দেশের নাগরিক জনমনে তবুও কি আসীন নন কোথাও নরেন বিশ্বাস—তাঁর অমন দিব্য লোক-মহিমায়? ‘স্মরণ আজিও তার হানে তরবারি’—কালের যাত্রার ধ্বনি যতই কেন পাই শুনিবারে—তার সম্মার্জনী সম্পাতে, অকরুণ ঘাতে, প্রতিঘাতে!
No comments