লুকোচুরি না করে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা হোক -টিফা চুক্তি by আবুল কালাম আজাদ
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রেক্ষাপটে টিফা বা ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট আবারও আলোচনায় এসেছে। এ বিষয়ে সংবাদপত্রে বেশ কিছু লেখালেখি ও টেলিভিশনের বিভিন্ন টক শোতে আলোচনা হচ্ছে। এসব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ টিফা চুক্তি সই না করে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে এবং পৃথিবীর স্বল্পোন্নত থেকে উন্নত যে অর্ধশতাধিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ চুক্তি সই করেছে, তারা কত বোকা! কয়েক সপ্তাহ আগে এক টেলিভিশনের রাত ১১টার টক শোতে এক বিজ্ঞ আলোচক বললেন, টিফা সই করলে নাকি পেটেন্ট রাইটসের কারণে আমাদের দেশে প্যারাসিটামলের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। কী সাংঘাতিক কথা! প্যারাসিটামলের পেটেন্ট রাইটস তো কয়েক যুগ আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাই প্যারাসিটামল বা যেসব ওষুধের পেটেন্ট রাইটস ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে, সেগুলোর দাম বাড়ার প্রশ্ন অবান্তর। এভাবে জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার কেন করা হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।
টিফা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কাঠামো চুক্তি। এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে এতদ্সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে টিফা সম্পাদনে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। ১৯৮৯ সালে তারা প্রথম এ ধরনের চুক্তি করে ফিলিপাইনের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশসহ মোট ৪১টি দেশ ও পাঁচটি আঞ্চলিক সংস্থার (যেমন ক্যারিকম, কমেসা, আসিয়ান ইত্যাদি) সঙ্গে টিফা সম্পাদন করেছে।
২০০৩ সালের প্রথম দিকে সম্ভবত জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের বিবেচনার জন্য টিফার প্রথম খসড়াটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। অন্যান্য যেকোনো চুক্তির মতো টিফাও দুটি অংশে বিভক্ত—প্রিয়েম্বল বা প্রস্তাবনা এবং আর্টিকেল বা অনুচ্ছেদ। ২০০৩ সালের খসড়ায় ১৭টি (বর্তমানে ১৯টি) প্রস্তাবনা ও সাতটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। প্রস্তাবনার ১৭টির মধ্যে দুটি বিষয়ে বাংলাদেশের জোরালো আপত্তি ছিল। এর একটি হলো মেধাসম্পদ অধিকারের সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্বীকার করা এবং অন্যটি নিজ নিজ দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্বীকার করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমমান বজায় রাখা। এ খসড়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধের ইচ্ছাসংক্রান্ত প্রস্তাবনাটি ছিল না। প্রকৃত পক্ষে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যেসব টিফা স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলোতে এটি ছিল না। যক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি পরিবর্তনের ফলে ২০০৫ সাল থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধের ইচ্ছাসংক্রান্ত প্রস্তাবনাটি যোগ করা হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের খসড়ায় নিজ নিজ দেশের আইন অনুযায়ী পরিবেশ সংরক্ষণ উন্নয়নের গুরুত্ব স্বীকার করার বিষয়টিও প্রস্তাবনায় যোগ করা হয়েছে। প্রস্তাবনার এই চারটি বিষয়ে বাংলাদেশ আপত্তি তুলেছে।
টিফার অনুচ্ছেদ অংশে যে বিধানাবলি সন্নিবেশিত হয়েছে, তা মোটামুটিভাবে নিম্নরূপ: ১. বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং পণ্য ও সেবা বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উভয় পক্ষের দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা। ২. উভয় পক্ষের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠন, কাউন্সিল বছরে অন্তত পক্ষে একবার সভা করবে এবং কাউন্সিল তার কাজে সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। ৩. দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ ও বাণিজ্য উন্নয়নে কাউন্সিলের কার্যপরিধি। ৪. কাউন্সিলের সভা ডাকার পদ্ধতি। ৫. উভয় দেশের বলবত্ আইন বা অন্য কোনো চুক্তির দায়দায়িত্ব ও অধিকারকে টিফা দ্বারা ক্ষুণ্ন না করা। ৬. স্বাক্ষরের দিন থেকে চুক্তি কার্যকর হওয়া এবং ৭. ছয় মাসের নোটিশে চুক্তি বাতিল করার বিধান।
যেকোনো চুক্তির প্রস্তাবনায় কিছু স্বীকৃতি ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয় এবং সেগুলো বিবেচনায় এনে অনুচ্ছেদ অংশের বিধানাবলি প্রতিপালনে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সম্মত হয়। তাই অনুচ্ছেদ অংশের বিধানাবলি অবশ্যপালনীয়, পক্ষান্তরে প্রস্তাবনার বিষয়গুলো অভিপ্রায়মাত্র। টিফার অনুচ্ছেদ অংশে আপত্তির কিছু নেই এবং বাংলাদেশও এই অংশে কোনো আপত্তি তোলেনি। টিফার প্রস্তাবনা অংশের যে বিষয়গুলো নিয়ে জনমনে ভীতি বা সংশয় আছে, সেগুলোর ওপর কিছু আলোকপাত করা সমীচীন মনে করছি। প্রথমেই ধরা যাক, নিজ নিজ দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্বীকার করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমমান বজায় রাখার প্রস্তাবনা। নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন, এটা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের হাত মোচড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি-সুবিধা ভোগ করছে, এমন দেশের (বাংলাদেশসহ) হাত মোচড়াতে টিফার প্রয়োজন নেই; জিএসপি আইনেই তারা সেটি করতে পারে। বাংলাদেশের ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন-ব্যবস্থা নেই, এমন অভিযোগ এনে এ দেশের জিএসপি বাতিলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরে আবেদন দিয়েছে সে দেশের শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইও। আবেদনটি এখনো বিবেচনাধীন। আমরা আমাদের শ্রম আইন ও আইএলও কনভেনশন যদি মেনে চলি, তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া বাইরের চাপে যদি আমাদের শ্রমিকদের কল্যাণ হয়, তাতে সর্বনাশটা কোথায়?
দ্বিতীয়ত, মেধাসম্পদ অধিকারের (Intellectual Property Rights) সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্বীকার করাসংক্রান্ত প্রস্তাবনা। এ বিষয়ে বিশিষ্টজনেরা সংশয় প্রকাশ করেছেন, টিফায় ট্রিপস ঢুকলে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশের গাছপালা, গরু-ছাগল, মাছসহ সব পণ্যের ওপর পেটেন্ট করার অধিকার পেয়ে যাবে। এটি অমূলক। পেটেন্ট আইনমতে, নতুন কোনো আবিষ্কারের জন্যই কেবল আবিষ্কারক পেটেন্ট রাইটস পেতে পারেন। এই আবিষ্কারের নতুনত্ব (Novelty) ও Inventive steps থাকতে হবে; জানা কোনো কিছুর পেটেন্ট মঞ্জুর করা যায় না। অনেকে বলছেন, টিফা স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ ট্রিপসের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ ধারণাটিও ঠিক নয়। কারণ এ বিষয়ে টিফার প্রিয়েম্বল বা প্রস্তাবনায় নিম্নরূপ রক্ষাকবচ রয়েছে: ‘...noting that this Agreement is without prejudice to each Party’s rights and obligations, where applicable, under the Marrakesh Agreement Establishing the WTO and the agreements, understandings, and other instruments relating thereto or concluded under the auspices of the WTO’. অর্থাত্ ডব্লিউটিওর আওতায় ট্রিপসসহ বিভিন্ন চুক্তিতে বাংলাদেশের যে দায়দায়িত্ব ও অধিকার বিদ্যমান আছে, তা টিফা দ্বারা ক্ষুণ্ন হবে না। অনুরূপভাবে বাণিজ্য ও পরিবেশ (Trade and Environment) বিষয়টি ডব্লিউটিওর দোহা রাউন্ডে আলোচিত হচ্ছে। সেখানে কোনো চুক্তি হলে বাংলাদেশ তার সুবিধা-অসবিধা দুটোই ভোগ করবে। তা ছাড়া পরিবেশের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আমাদের নিজেদের জন্যও অতি গুরুত্বপূর্ণ।
এরপর আসছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধের ইচ্ছাসংক্রান্ত প্রস্তাবনাটি। আগেই বলেছি, এটি ২০০৩ সালের প্রথম খসড়ায় ছিল না, ২০০৫ সালে যোগ করা হয়েছে। ওই সময় ঢাকায় টিফা নিয়ে নেগোসিয়েশনের সময় ইউএসটিআর দপ্তরের বাংলাদেশ ডেস্ক অফিসার মিজ বেটসি স্টিলম্যান To eliminate bribery and corruption-এর পরিবর্তে favor good governance শব্দগুলো প্রতিস্থাপনে নিমরাজি হলেও ওয়াশিংটনে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তা মেনে নেয়নি। প্রকৃতপক্ষে ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো টিফাই এটি ছাড়া হয়নি। এমনকি দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিত আইসল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডের টিফায়ও এটি আছে। এটি টিফায় সন্নিবেশের কারণে ওই সব দেশের মান না গেলে আমাদের মান যাবে কেন? উপরন্তু এতে যদি বাংলাদেশের ঘুষ ও দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে, তাতে ক্ষতি তো কিছু দেখছি না। বরং বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান বাড়বে, মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট (এমসিএ) থেকে সহায়তা প্রাপ্তিও সহজতর হবে।
কম্বোডিয়া, ইয়েমেন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে সম্ভবত বাংলাদেশের মতো এত বিশেষজ্ঞ সার্জন নেই, তাই টিফা নামক ফোঁড়া কাটতে তারা অত শত চিন্তা করেনি। ভিয়েতনামের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশও তাদের এককালের শত্রুর সঙ্গে টিফা সম্পাদন করেছে এবং তাও আবার বিদ্যুত্গতিতে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ভিয়েতনাম ডব্লিউটিওর সদস্যপদ লাভ করে। ওই বছরের মার্চ মাসে টিফা নেগোসিয়েশন শুরু করে জুন মাসে চুক্তি সই করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রপ্তানি তর তর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ বিগত প্রায় সাত বছরেও টিফা সম্পাদন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিরোধ আলোচনার জন্য আমাদের কোনো আনুষ্ঠানিক ফোরাম নেই। টিফা এই শূন্যস্থানটি পূরণ করে দিতে পারে। তা ছাড়া টিফাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই আর লুকোচুরি না করে টিফার ওপরে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা হোক এবং দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে অবিলম্বে এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।
আবুল কালাম আজাদ: অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও সাবেক ইকোনমিক মিনিস্টার, বাংলাদেশ দূতাবাস, ওয়াশিংটন ডিসি।
টিফা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি কাঠামো চুক্তি। এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে এতদ্সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে টিফা সম্পাদনে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। ১৯৮৯ সালে তারা প্রথম এ ধরনের চুক্তি করে ফিলিপাইনের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশসহ মোট ৪১টি দেশ ও পাঁচটি আঞ্চলিক সংস্থার (যেমন ক্যারিকম, কমেসা, আসিয়ান ইত্যাদি) সঙ্গে টিফা সম্পাদন করেছে।
২০০৩ সালের প্রথম দিকে সম্ভবত জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের বিবেচনার জন্য টিফার প্রথম খসড়াটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। অন্যান্য যেকোনো চুক্তির মতো টিফাও দুটি অংশে বিভক্ত—প্রিয়েম্বল বা প্রস্তাবনা এবং আর্টিকেল বা অনুচ্ছেদ। ২০০৩ সালের খসড়ায় ১৭টি (বর্তমানে ১৯টি) প্রস্তাবনা ও সাতটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। প্রস্তাবনার ১৭টির মধ্যে দুটি বিষয়ে বাংলাদেশের জোরালো আপত্তি ছিল। এর একটি হলো মেধাসম্পদ অধিকারের সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্বীকার করা এবং অন্যটি নিজ নিজ দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্বীকার করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমমান বজায় রাখা। এ খসড়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধের ইচ্ছাসংক্রান্ত প্রস্তাবনাটি ছিল না। প্রকৃত পক্ষে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যেসব টিফা স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলোতে এটি ছিল না। যক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতি পরিবর্তনের ফলে ২০০৫ সাল থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধের ইচ্ছাসংক্রান্ত প্রস্তাবনাটি যোগ করা হয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের খসড়ায় নিজ নিজ দেশের আইন অনুযায়ী পরিবেশ সংরক্ষণ উন্নয়নের গুরুত্ব স্বীকার করার বিষয়টিও প্রস্তাবনায় যোগ করা হয়েছে। প্রস্তাবনার এই চারটি বিষয়ে বাংলাদেশ আপত্তি তুলেছে।
টিফার অনুচ্ছেদ অংশে যে বিধানাবলি সন্নিবেশিত হয়েছে, তা মোটামুটিভাবে নিম্নরূপ: ১. বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং পণ্য ও সেবা বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উভয় পক্ষের দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা। ২. উভয় পক্ষের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠন, কাউন্সিল বছরে অন্তত পক্ষে একবার সভা করবে এবং কাউন্সিল তার কাজে সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। ৩. দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ ও বাণিজ্য উন্নয়নে কাউন্সিলের কার্যপরিধি। ৪. কাউন্সিলের সভা ডাকার পদ্ধতি। ৫. উভয় দেশের বলবত্ আইন বা অন্য কোনো চুক্তির দায়দায়িত্ব ও অধিকারকে টিফা দ্বারা ক্ষুণ্ন না করা। ৬. স্বাক্ষরের দিন থেকে চুক্তি কার্যকর হওয়া এবং ৭. ছয় মাসের নোটিশে চুক্তি বাতিল করার বিধান।
যেকোনো চুক্তির প্রস্তাবনায় কিছু স্বীকৃতি ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয় এবং সেগুলো বিবেচনায় এনে অনুচ্ছেদ অংশের বিধানাবলি প্রতিপালনে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সম্মত হয়। তাই অনুচ্ছেদ অংশের বিধানাবলি অবশ্যপালনীয়, পক্ষান্তরে প্রস্তাবনার বিষয়গুলো অভিপ্রায়মাত্র। টিফার অনুচ্ছেদ অংশে আপত্তির কিছু নেই এবং বাংলাদেশও এই অংশে কোনো আপত্তি তোলেনি। টিফার প্রস্তাবনা অংশের যে বিষয়গুলো নিয়ে জনমনে ভীতি বা সংশয় আছে, সেগুলোর ওপর কিছু আলোকপাত করা সমীচীন মনে করছি। প্রথমেই ধরা যাক, নিজ নিজ দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্বীকার করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমমান বজায় রাখার প্রস্তাবনা। নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন, এটা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের হাত মোচড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি-সুবিধা ভোগ করছে, এমন দেশের (বাংলাদেশসহ) হাত মোচড়াতে টিফার প্রয়োজন নেই; জিএসপি আইনেই তারা সেটি করতে পারে। বাংলাদেশের ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন-ব্যবস্থা নেই, এমন অভিযোগ এনে এ দেশের জিএসপি বাতিলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরে আবেদন দিয়েছে সে দেশের শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইও। আবেদনটি এখনো বিবেচনাধীন। আমরা আমাদের শ্রম আইন ও আইএলও কনভেনশন যদি মেনে চলি, তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া বাইরের চাপে যদি আমাদের শ্রমিকদের কল্যাণ হয়, তাতে সর্বনাশটা কোথায়?
দ্বিতীয়ত, মেধাসম্পদ অধিকারের (Intellectual Property Rights) সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্ব স্বীকার করাসংক্রান্ত প্রস্তাবনা। এ বিষয়ে বিশিষ্টজনেরা সংশয় প্রকাশ করেছেন, টিফায় ট্রিপস ঢুকলে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশের গাছপালা, গরু-ছাগল, মাছসহ সব পণ্যের ওপর পেটেন্ট করার অধিকার পেয়ে যাবে। এটি অমূলক। পেটেন্ট আইনমতে, নতুন কোনো আবিষ্কারের জন্যই কেবল আবিষ্কারক পেটেন্ট রাইটস পেতে পারেন। এই আবিষ্কারের নতুনত্ব (Novelty) ও Inventive steps থাকতে হবে; জানা কোনো কিছুর পেটেন্ট মঞ্জুর করা যায় না। অনেকে বলছেন, টিফা স্বাক্ষর করলে বাংলাদেশ ট্রিপসের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ ধারণাটিও ঠিক নয়। কারণ এ বিষয়ে টিফার প্রিয়েম্বল বা প্রস্তাবনায় নিম্নরূপ রক্ষাকবচ রয়েছে: ‘...noting that this Agreement is without prejudice to each Party’s rights and obligations, where applicable, under the Marrakesh Agreement Establishing the WTO and the agreements, understandings, and other instruments relating thereto or concluded under the auspices of the WTO’. অর্থাত্ ডব্লিউটিওর আওতায় ট্রিপসসহ বিভিন্ন চুক্তিতে বাংলাদেশের যে দায়দায়িত্ব ও অধিকার বিদ্যমান আছে, তা টিফা দ্বারা ক্ষুণ্ন হবে না। অনুরূপভাবে বাণিজ্য ও পরিবেশ (Trade and Environment) বিষয়টি ডব্লিউটিওর দোহা রাউন্ডে আলোচিত হচ্ছে। সেখানে কোনো চুক্তি হলে বাংলাদেশ তার সুবিধা-অসবিধা দুটোই ভোগ করবে। তা ছাড়া পরিবেশের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আমাদের নিজেদের জন্যও অতি গুরুত্বপূর্ণ।
এরপর আসছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধের ইচ্ছাসংক্রান্ত প্রস্তাবনাটি। আগেই বলেছি, এটি ২০০৩ সালের প্রথম খসড়ায় ছিল না, ২০০৫ সালে যোগ করা হয়েছে। ওই সময় ঢাকায় টিফা নিয়ে নেগোসিয়েশনের সময় ইউএসটিআর দপ্তরের বাংলাদেশ ডেস্ক অফিসার মিজ বেটসি স্টিলম্যান To eliminate bribery and corruption-এর পরিবর্তে favor good governance শব্দগুলো প্রতিস্থাপনে নিমরাজি হলেও ওয়াশিংটনে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তা মেনে নেয়নি। প্রকৃতপক্ষে ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো টিফাই এটি ছাড়া হয়নি। এমনকি দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিত আইসল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডের টিফায়ও এটি আছে। এটি টিফায় সন্নিবেশের কারণে ওই সব দেশের মান না গেলে আমাদের মান যাবে কেন? উপরন্তু এতে যদি বাংলাদেশের ঘুষ ও দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে, তাতে ক্ষতি তো কিছু দেখছি না। বরং বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান বাড়বে, মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট (এমসিএ) থেকে সহায়তা প্রাপ্তিও সহজতর হবে।
কম্বোডিয়া, ইয়েমেন, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে সম্ভবত বাংলাদেশের মতো এত বিশেষজ্ঞ সার্জন নেই, তাই টিফা নামক ফোঁড়া কাটতে তারা অত শত চিন্তা করেনি। ভিয়েতনামের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশও তাদের এককালের শত্রুর সঙ্গে টিফা সম্পাদন করেছে এবং তাও আবার বিদ্যুত্গতিতে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ভিয়েতনাম ডব্লিউটিওর সদস্যপদ লাভ করে। ওই বছরের মার্চ মাসে টিফা নেগোসিয়েশন শুরু করে জুন মাসে চুক্তি সই করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রপ্তানি তর তর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ বিগত প্রায় সাত বছরেও টিফা সম্পাদন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিরোধ আলোচনার জন্য আমাদের কোনো আনুষ্ঠানিক ফোরাম নেই। টিফা এই শূন্যস্থানটি পূরণ করে দিতে পারে। তা ছাড়া টিফাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই আর লুকোচুরি না করে টিফার ওপরে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করা হোক এবং দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে অবিলম্বে এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক।
আবুল কালাম আজাদ: অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও সাবেক ইকোনমিক মিনিস্টার, বাংলাদেশ দূতাবাস, ওয়াশিংটন ডিসি।
No comments