ক্যাসিনো বাদশাহর পতন
ইসমাঈল
হোসেন চৌধুরী। রাজনীতিতে এসে নামের সঙ্গে যুক্ত করেন সম্রাট। সময়ের
পরিক্রমায় গড়ে তোলেন নিজের সাম্রাজ্য। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জুয়ার আসর,
চাঁদাবাজি ছিল তার নেশা আর পেশা। দলীয় তকমা ব্যবহার করে হেন কাজ নেই যা
তিনি করতেন না। রাজধানীর ক্লাবে ক্লাবে ক্যাসিনো বাজার গড়ে তোলার নেপথ্য
কারিগর এই সম্রাট। মাস খানেক আগে তার নাম উচ্চারণ করতেও ভয় পেতেন সাধারণ
মানুষ। সবসময় কর্মী-সমর্থক ঘেরা অবস্থায় থাকতেন তিনি।
যেখানেই যেতেন সঙ্গে থাকতো গাড়ির বিশাল বহর। দলীয় সভা-সমাবেশে দলীয় প্রধানের নামের পরেই তার নামে স্লোগান হতো। রাজধানীজুড়ে শোভা পেতো তার ব্যানার ফেস্টুন।
কাকরাইল, মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, মালিবাগ এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে গেলেই তাকে দিতে হতো মোটা অঙ্কের চাঁদা। সন্ধ্যার পর টাকার বস্তা নিয়ে সিন্ডিকেটের লোকজন হাজিরা দিতেন তার কাকরাইলের দরবারে। অপরাধ জগতের এই সম্রাটের সম্রাজ্য এখন পতনের পথে। রোববার ভোররাতে র্যাবের হাতে পাকড়াও হয়েছে এক সহযোগীসহ। গ্রেপ্তারের পর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে তাকে গতকাল রাতে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, ও ক্যাসিনো কাণ্ডের অভিযোগে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র্যাব জানিয়েছে, সম্রাটের অপরাধ সাম্রাজের প্রতিটি বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। শিগগিরই সম্রাটের গড ফাদার ও পৃষ্ঠপোষকদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান জানান, রোববার ভোর ৫টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামে অভিযান চালায় র্যাব। এসময় গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমানকে। র্যাব জানিয়েছে, কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন সম্রাট। এরমধ্যেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাদের ঢাকায় আনা হয়। র্যাব সদর দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদের পর সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে তার কাকরাইলের অফিসে অভিযান চালানো হয়। দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার অভিযানে ওই ভবন থেকে বিপুল মাদক, অস্ট্রেলিয়া থেকে অবৈধভাবে আমদানি দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া, অবৈধ অস্ত্র ও ছয় রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়।
সম্রাটের কাকরাইলের কার্যালয়ে ক্যাঙ্গারুর দুটি চামড়া পাওয়ায় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এছাড়া গ্রেপ্তারের সময় মদ্যপ থাকায় মাদক আইনে যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কাকরাইল মোড়ের রাজমনি সিনেমা হলের উল্টো পাশের বহুতল ভুঁইয়া ম্যানশনে সম্রাটের অফিসে পাওয়া গেছে ক্যাঙারুর দুটি চামড়া। এখানেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কার্যালয়। এই ভবনের চার তলাতেই বসেন সম্রাট। সম্রাটের দরবার হিসেবে পরিচিত এই ভবন। সন্ধ্যার পরে অবৈধ খাত থেকে উপার্জিত টাকা নিয়ে এই দরবারে হাজিরা দিতেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনেক কাউন্সিলর, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। এই ভবনেই বসতেন সম্রাটের ঘনিষ্ট হিসেবে আলোচিত সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে সম্রাটকে নিয়ে ওই ভবনে প্রবেশ করে র্যাব। র্যাবের হেলমেট পড়িয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সম্রাটকে অভিযানে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় কাকরাইলের ওই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। ভুঁইয়া ম্যানশন ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে র্যাব, পুলিশ। সাদা পোশাকে অবস্থান নিয়েছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও।
সরজমিনে ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, এর প্রবশে পথে এক পাশে বড় আকারে টানানো রয়েছে যুবলীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর ছবি। অন্যপাশে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদের ছবি। এর নিচে রয়েছে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ছবি। এছাড়াও দেয়ালজুড়ে যুবলীগ, মহানগর ছাত্রলীগের পোস্টার, ব্যানার। দেয়ালে সাটানো রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ছবি। সেইসঙ্গে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রচিত বিভিন্ন বইয়ের ছবি রয়েছে দেয়ালে। ভেতরে রয়েছে তার বিশাল অফিস কক্ষ। পাশে একটি বেড রুম। ওই রুমেই বিছানার নিচে পাওয়া গেছে গুলিসহ একটি পিস্তল। বিভিন্ন সংবর্ধনায় তাকে দেয়া ক্রেস্ট, রাজনৈতিক বই ছিল সেখানে। ওই ভবনের চার ও পাঁচ তলা ব্যবহার করতেন সম্রাট। ওই ভবনেই একটি কক্ষ ব্যবহার করা হতো টর্সার সেল হিসেবে। অবাধ্য হলেই জোর করে ধরে এনে বেদম মারধর করা হতো এখানে। দেয়া হতো ইলেকট্রিক যন্ত্রের শক। এরকম দুটি যন্ত্রও উদ্ধার করেছে র্যাব। র্যাব সূত্রে জানা গেছে, ওই ভবনে সম্রাটকে নিয়ে প্রবেশের পরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কোথায় কি রেখেছেন এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভুলে গেছেন বলে জবাব দিয়েছেন।
এভাবে কালক্ষেপন করছিলেন তিনি। একপর্যায়ে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শাবল দিয়ে কয়েকটি তালা ভেঙ্গে অভিযান চালায় র্যাব। কাকরাইলের কার্যালয় ঘিরে অভিযান চলাকাল সেখানে ভিড় করেন হাজারো মানুষ। উৎসুক মানুষের ভিড়ে সম্রাটের কিছু নেতাকর্মীও সেখানে অবস্থান করেন। সন্ধ্যায় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হ্যালমেট পড়িয়ে সম্রাটকে ওই কার্যালয় থেকে নামিয়ে আনা হয়। পরে গাড়িতে তুলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে। তাকে নামিয়ে আনার সময় সেখানে অবস্থানরত কিছু নেতাকর্মী স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে র্যাব সদস্যরা ধাওয়া দিলে তারা ওই এলাকা ছেড়ে যান। অভিযান শেষে র্যাব-১’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, সম্রাটের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি আগ্নেয়াস্ত্র, একটি ম্যাগাজিন, ছয় রাউন্ড গুলি, ১১৬০ পিস ইয়াবা, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, বন্যপ্রাণীর দুটি চামড়া ও দুটি ইলেকট্রিক শক দেয়ার মেশিন জব্দ করা হয়েছে। একই সময়ে শান্তিনগরে ১৩৯/১ নম্বর বাড়ির ৫/সি ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় র্যাব। ওই বাসায় থাকেন সম্রাটের মা ও ভাইয়ের পরিবার। ওই বাসায় অভিযান চলাকালে কি উদ্ধার করা হয়েছে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। সেখানে অভিযান চল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। একই সময়ে মহাখালির ডিওএইচএস এলাকায় সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরীর বাসায়ও অভিযান চালায় র্যাব। ওই বাসা থেকে কি উদ্ধার করা হয়েছে তাও র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
ওদিকে সম্রাটের সহযোগী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানের মিরপুরের বাসায় টানা ৫ ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়েছে র্যাব। এসময় সম্পত্তির কিছু দলিল ও কয়েক ব্যাংকের চেক জব্দ করা হয়েছে। র্যাবের ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক জানান, মিরপুরের সি ব্লকের এই বাড়িতে আরমানের দ্বিতীয় স্ত্রী বিথী বেগম ও চার সন্তান মিলে থাকতেন। আরমান মাঝে মাঝে এখানে যাতায়াত করতেন। তার প্রথম স্ত্রীও এই বাড়িতে মাঝেমাঝে আসতেন। অভিযানকালে বাড়িতে আরমানের স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। সম্রাটের কাকরাইলের অফিসে অভিযান শেষে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, আমরা সম্রাটকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চাইব। সম্রাট যে ক্যাসিনোর সম্রাট হয়ে উঠেছেন, তার পেছনের গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষক কারা, তাদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।
সম্রাটকে ঘিরে কিছুদিন আগেও রমরমা ছিলো এই ভবনটি। ১৮ই সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হলে গ্রেপ্তার করা হয় সম্রাটের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুবলীগের দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। তারপর থেকেই আতঙ্কে ছিলেন সম্রাট। প্রথম তিন দিন তার কর্মী-সমর্থকরা রাত-দিন ওই ভবন ঘেরাও করে গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করেন। তারপর ওই ভবন থেকে আত্মগোপনে যান সম্রাট। সূত্রমতে, আত্মগোপনে গিয়ে বনানী এলাকায় এক প্রভাবশালীর বাসায় ছিলেন তিনি। অবশেষে কুমিল্লা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বাড়ি ফেনীর পরশুরামে। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ ছিলেন রাজউকের কর্মচারী। তিন ভাইয়ের মধ্যে সম্রাট মেজো। বড় ভাই ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বাদল ও তার ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ চৌধুরী। সম্রাটের ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন তার বড় ভাই বাদল। ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে কাকরাইলে সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন সম্রাট। ১৯৯১ সালে যুবলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে পা দেন। অল্পদিনেই প্রভাবশালী হয়ে উঠেন যুবলীগের রাজনীতিতে। ঢাকায় রয়েছে সম্রাটের দুই স্ত্রী। এক কন্যা সন্তান নিয়ে প্রথম স্ত্রী থাকেন বাড্ডায়। তবে সম্প্রতি তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন বলে জানা গেছে। দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী থাকেন মহাখালীর ডিওএইচএস-এ। দ্বিতীয় স্ত্রী গর্ভজাত তার এক পুত্র সন্তান রয়েছে। সম্রাটের ছেলে লেখাপড়া করেন মালয়েশিয়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সম্রাট ও আরমানকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার: অসামাজিক কার্যকলাপ ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও সহসভাপতি এনামুল হক আরমানকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যুবলীগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। সংগঠনের কার্যনির্বাহী সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হারুন রশিদ। সম্রাটের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ছিল। রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে আটক করা হয়। এরপরই তাদের যুবলীগ থেকে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
যেখানেই যেতেন সঙ্গে থাকতো গাড়ির বিশাল বহর। দলীয় সভা-সমাবেশে দলীয় প্রধানের নামের পরেই তার নামে স্লোগান হতো। রাজধানীজুড়ে শোভা পেতো তার ব্যানার ফেস্টুন।
কাকরাইল, মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, মালিবাগ এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে গেলেই তাকে দিতে হতো মোটা অঙ্কের চাঁদা। সন্ধ্যার পর টাকার বস্তা নিয়ে সিন্ডিকেটের লোকজন হাজিরা দিতেন তার কাকরাইলের দরবারে। অপরাধ জগতের এই সম্রাটের সম্রাজ্য এখন পতনের পথে। রোববার ভোররাতে র্যাবের হাতে পাকড়াও হয়েছে এক সহযোগীসহ। গ্রেপ্তারের পর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে তাকে গতকাল রাতে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, ও ক্যাসিনো কাণ্ডের অভিযোগে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র্যাব জানিয়েছে, সম্রাটের অপরাধ সাম্রাজের প্রতিটি বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। শিগগিরই সম্রাটের গড ফাদার ও পৃষ্ঠপোষকদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান জানান, রোববার ভোর ৫টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামে অভিযান চালায় র্যাব। এসময় গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমানকে। র্যাব জানিয়েছে, কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন সম্রাট। এরমধ্যেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাদের ঢাকায় আনা হয়। র্যাব সদর দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদের পর সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে তার কাকরাইলের অফিসে অভিযান চালানো হয়। দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার অভিযানে ওই ভবন থেকে বিপুল মাদক, অস্ট্রেলিয়া থেকে অবৈধভাবে আমদানি দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া, অবৈধ অস্ত্র ও ছয় রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়।
সম্রাটের কাকরাইলের কার্যালয়ে ক্যাঙ্গারুর দুটি চামড়া পাওয়ায় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এছাড়া গ্রেপ্তারের সময় মদ্যপ থাকায় মাদক আইনে যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কাকরাইল মোড়ের রাজমনি সিনেমা হলের উল্টো পাশের বহুতল ভুঁইয়া ম্যানশনে সম্রাটের অফিসে পাওয়া গেছে ক্যাঙারুর দুটি চামড়া। এখানেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের কার্যালয়। এই ভবনের চার তলাতেই বসেন সম্রাট। সম্রাটের দরবার হিসেবে পরিচিত এই ভবন। সন্ধ্যার পরে অবৈধ খাত থেকে উপার্জিত টাকা নিয়ে এই দরবারে হাজিরা দিতেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনেক কাউন্সিলর, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। এই ভবনেই বসতেন সম্রাটের ঘনিষ্ট হিসেবে আলোচিত সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে সম্রাটকে নিয়ে ওই ভবনে প্রবেশ করে র্যাব। র্যাবের হেলমেট পড়িয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সম্রাটকে অভিযানে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় কাকরাইলের ওই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। ভুঁইয়া ম্যানশন ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে র্যাব, পুলিশ। সাদা পোশাকে অবস্থান নিয়েছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও।
সরজমিনে ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, এর প্রবশে পথে এক পাশে বড় আকারে টানানো রয়েছে যুবলীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর ছবি। অন্যপাশে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদের ছবি। এর নিচে রয়েছে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ছবি। এছাড়াও দেয়ালজুড়ে যুবলীগ, মহানগর ছাত্রলীগের পোস্টার, ব্যানার। দেয়ালে সাটানো রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ছবি। সেইসঙ্গে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রচিত বিভিন্ন বইয়ের ছবি রয়েছে দেয়ালে। ভেতরে রয়েছে তার বিশাল অফিস কক্ষ। পাশে একটি বেড রুম। ওই রুমেই বিছানার নিচে পাওয়া গেছে গুলিসহ একটি পিস্তল। বিভিন্ন সংবর্ধনায় তাকে দেয়া ক্রেস্ট, রাজনৈতিক বই ছিল সেখানে। ওই ভবনের চার ও পাঁচ তলা ব্যবহার করতেন সম্রাট। ওই ভবনেই একটি কক্ষ ব্যবহার করা হতো টর্সার সেল হিসেবে। অবাধ্য হলেই জোর করে ধরে এনে বেদম মারধর করা হতো এখানে। দেয়া হতো ইলেকট্রিক যন্ত্রের শক। এরকম দুটি যন্ত্রও উদ্ধার করেছে র্যাব। র্যাব সূত্রে জানা গেছে, ওই ভবনে সম্রাটকে নিয়ে প্রবেশের পরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কোথায় কি রেখেছেন এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভুলে গেছেন বলে জবাব দিয়েছেন।
এভাবে কালক্ষেপন করছিলেন তিনি। একপর্যায়ে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শাবল দিয়ে কয়েকটি তালা ভেঙ্গে অভিযান চালায় র্যাব। কাকরাইলের কার্যালয় ঘিরে অভিযান চলাকাল সেখানে ভিড় করেন হাজারো মানুষ। উৎসুক মানুষের ভিড়ে সম্রাটের কিছু নেতাকর্মীও সেখানে অবস্থান করেন। সন্ধ্যায় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হ্যালমেট পড়িয়ে সম্রাটকে ওই কার্যালয় থেকে নামিয়ে আনা হয়। পরে গাড়িতে তুলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে। তাকে নামিয়ে আনার সময় সেখানে অবস্থানরত কিছু নেতাকর্মী স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে র্যাব সদস্যরা ধাওয়া দিলে তারা ওই এলাকা ছেড়ে যান। অভিযান শেষে র্যাব-১’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, সম্রাটের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি আগ্নেয়াস্ত্র, একটি ম্যাগাজিন, ছয় রাউন্ড গুলি, ১১৬০ পিস ইয়াবা, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, বন্যপ্রাণীর দুটি চামড়া ও দুটি ইলেকট্রিক শক দেয়ার মেশিন জব্দ করা হয়েছে। একই সময়ে শান্তিনগরে ১৩৯/১ নম্বর বাড়ির ৫/সি ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় র্যাব। ওই বাসায় থাকেন সম্রাটের মা ও ভাইয়ের পরিবার। ওই বাসায় অভিযান চলাকালে কি উদ্ধার করা হয়েছে র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। সেখানে অভিযান চল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। একই সময়ে মহাখালির ডিওএইচএস এলাকায় সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরীর বাসায়ও অভিযান চালায় র্যাব। ওই বাসা থেকে কি উদ্ধার করা হয়েছে তাও র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
ওদিকে সম্রাটের সহযোগী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানের মিরপুরের বাসায় টানা ৫ ঘণ্টা তল্লাশি চালিয়েছে র্যাব। এসময় সম্পত্তির কিছু দলিল ও কয়েক ব্যাংকের চেক জব্দ করা হয়েছে। র্যাবের ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক জানান, মিরপুরের সি ব্লকের এই বাড়িতে আরমানের দ্বিতীয় স্ত্রী বিথী বেগম ও চার সন্তান মিলে থাকতেন। আরমান মাঝে মাঝে এখানে যাতায়াত করতেন। তার প্রথম স্ত্রীও এই বাড়িতে মাঝেমাঝে আসতেন। অভিযানকালে বাড়িতে আরমানের স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। সম্রাটের কাকরাইলের অফিসে অভিযান শেষে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলেন, আমরা সম্রাটকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চাইব। সম্রাট যে ক্যাসিনোর সম্রাট হয়ে উঠেছেন, তার পেছনের গডফাদার ও পৃষ্ঠপোষক কারা, তাদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।
সম্রাটকে ঘিরে কিছুদিন আগেও রমরমা ছিলো এই ভবনটি। ১৮ই সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হলে গ্রেপ্তার করা হয় সম্রাটের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুবলীগের দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। তারপর থেকেই আতঙ্কে ছিলেন সম্রাট। প্রথম তিন দিন তার কর্মী-সমর্থকরা রাত-দিন ওই ভবন ঘেরাও করে গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করেন। তারপর ওই ভবন থেকে আত্মগোপনে যান সম্রাট। সূত্রমতে, আত্মগোপনে গিয়ে বনানী এলাকায় এক প্রভাবশালীর বাসায় ছিলেন তিনি। অবশেষে কুমিল্লা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব। ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বাড়ি ফেনীর পরশুরামে। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ ছিলেন রাজউকের কর্মচারী। তিন ভাইয়ের মধ্যে সম্রাট মেজো। বড় ভাই ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বাদল ও তার ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ চৌধুরী। সম্রাটের ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন তার বড় ভাই বাদল। ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে কাকরাইলে সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন সম্রাট। ১৯৯১ সালে যুবলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে পা দেন। অল্পদিনেই প্রভাবশালী হয়ে উঠেন যুবলীগের রাজনীতিতে। ঢাকায় রয়েছে সম্রাটের দুই স্ত্রী। এক কন্যা সন্তান নিয়ে প্রথম স্ত্রী থাকেন বাড্ডায়। তবে সম্প্রতি তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন বলে জানা গেছে। দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী থাকেন মহাখালীর ডিওএইচএস-এ। দ্বিতীয় স্ত্রী গর্ভজাত তার এক পুত্র সন্তান রয়েছে। সম্রাটের ছেলে লেখাপড়া করেন মালয়েশিয়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সম্রাট ও আরমানকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার: অসামাজিক কার্যকলাপ ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও সহসভাপতি এনামুল হক আরমানকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যুবলীগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। সংগঠনের কার্যনির্বাহী সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হারুন রশিদ। সম্রাটের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ছিল। রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে আটক করা হয়। এরপরই তাদের যুবলীগ থেকে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।
No comments