সাগরে অমানুষিক নির্যাতন চালায় দালালরা by আবদুল মাবুদ ও নুরুল করিম রাসেল
উত্তর আচেহর একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরা |
ফরিদপুরের
বোয়ালমারী উপজেলার জালাল মল্লিকের ছেলে আহমদ (২৩)। ৭০ দিন সাগরে ভাসার পর
অবশেষে মঙ্গলবার বিকালে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি এলাকা থেকে কোস্টগার্ড
তাকে উদ্ধার করে। তিনি জানান, যখন থাইল্যান্ডের বড় ট্রলারটিতে তিনি উঠেন
তখন সেখানে মাত্র ১২ জন যাত্রী ছিলেন। এরপর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলের
বিভিন্ন পয়েন্টে দালালরা ছোট ছোট ট্রলারে করে যাত্রী এনে বড় ট্রলারটিতে
উঠাতে থাকে। এভাবে প্রায় ১৭০ জন যাত্রীর ঠাঁই হয় ট্রলারে। এরমধ্যে
মিয়ানমারের ১৮ রোহিঙ্গা নারীও ছিলেন। কিন্তু পর্যাপ্ত যাত্রী না হওয়ায় সেটি
মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হচ্ছিল না। তারা ভাসতে থাকেন সাগরে। সকালে তাদের
চিড়া-মুড়ি দেয়া হতো আর রাতে দেয়া হতো ওষুধ মেশানো ভাত- যা খেয়ে অনেকেই বমি
করে ফেলত। আর দালালদের বিরুদ্ধে কথা বলা তো দূরে থাক, মাথা ঘুরালেই
অমানুুষিক নির্যাতন চালাত তারা।
মঙ্গলবার টেকনাফ উপকূল থেকে কোস্টগার্ড যে ১১৬ যাত্রীকে উদ্ধার করেছে, আহমদ তাদেরই একজন। বুধবার তাদেরকে টেকনাফ কোস্টগার্ড স্টেশনে আনার পর যুগান্তরকে এসব কথা জানান আহমদ। তিনি বলেন, এলাকায় টেক্সটাইল মিলে কাজ করতেন তিনি। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দালাল মিন্টুর সঙ্গে আড়াই লাখ টাকার চুক্তিতে তিনি মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমান। অগ্রিম ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিল মিন্টুকে। অবশিষ্ট টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছলে তার পরিবার থেকে দেয়া হতো। এদিন মঙ্গলবার উদ্ধার ১১৬ এবং বিজিবির হাতে আটক ১১ জনকে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
ফরিদপুরের আহমদ, সিরাজগঞ্জের রিপন, নরসিংদীর মঙ্গল মিয়া, কক্সবাজারের মহেশখালীর তানভীরসহ ট্রলার থেকে উদ্ধার হওয়া আরও অনেকে জানান, মালয়েশিয়াগামী ট্রলারটির অবস্থান ছিল সেন্টমার্টিন থেকে প্রায় ২০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে সীতা পাহাড় নামক স্থানে। সেখানে আরও ৮টি মানব পাচারের ট্রলার এভাবে অপেক্ষমাণ ছিল। থাইল্যান্ডে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়া এবং টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে ৩ শীর্ষ মানব পাচারকারী নিহত হওয়ার পর বেকায়দায় পড়ে যায় ট্রলারে থাকা দালাল ও ক্রুরা। তারা না পারছিল থাইল্যান্ডের দিকে যেতে, না পারছিল টেকনাফ উপকূলে ভিড়তে। এই অবস্থায় সোমবার ট্রলারটি সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি চলে আসে। এ সময় দালালরা মোবাইল যোগাযোগে টেকনাফ থেকে ছোট ট্রলার এনে যাত্রীদের উপকূলে নেমে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এভাবে দুটি ট্রলারে ৪৮ জন রোববার রাতে থাইল্যান্ডের ট্রলার থেকে নেমে আসে। এর মধ্যে চকরিয়ার নুরুল ইসলাম ভুট্টোসহ ৩০ জন একটি ট্রলারে টেকনাফ উপকূলে নেমে পালানোর সময় ১১ জন বিজিবির হাতে ধরা পড়ে। এই ১১ জনের দলটিকে টেকনাফ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। এছাড়া অপর একটি ট্রলারে ১৮ রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমারে ফিরে যায়।
ট্রলারে থাকা অবশিষ্ট ১১৬ যাত্রীকে কূলে নামিয়ে দিতে না পেরে ট্রলারটি আবারও মিয়ানমার সীমান্তের দিকে ফিরে যাচ্ছিল। এ সময় অবস্থা বেগতিক দেখে যাত্রীরা সবাই মিলে ট্রলারের ৫ ক্রুকে সাগরে ফেলে দিয়ে ট্রলারটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে রিপন নামে এক যাত্রী কোনো মতে ট্রলারটি এলোমেলো চালিয়ে সেন্টমার্টিনের পশ্চিমে চলে আসে। এ অবস্থায় সোমবার বিকালে কোস্টগার্ড নৌবাহিনী জাহাজ বিএনএস রুহুল আমিনের সহায়তায় তাদেরকে উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়া সবাই বাংলাদেশী নাগরিক। এরমধ্যে রয়েছে কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, পাবনা, যশোর ও ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা।
সোমবার সন্ধ্যায় কোস্টগার্ড ট্রলারসহ উদ্ধার যাত্রীদের নিয়ে টেকনাফের দিকে রওনা হলেও রাতে শাহপরীর দ্বীপ ঘোলার চরে ট্রলারটি আটকা পড়ে। পরে সেন্টমার্টিন থেকে দুটি ট্রলার এনে যাত্রীদের টেকনাফে নিয়ে আসে। মঙ্গলবার সকালে উদ্ধার যাত্রীরা টেকনাফে পৌঁছলে মেডিকেল টিম তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। পরে তাদেরকে টেকনাফ থানায় সোপর্দ করা হয়।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মেডিকেল দল উদ্ধার ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেন। মেডিকেল অফিসার ডা. সোমেন পালিত বলেন, উদ্ধার অভিবাসীরা তাদেরকে শরীরের ক্ষতস্থান দেখিয়েছে। তাদেরকে পাচারকারীরা বেদম প্রহার করেছিল।
সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. ডিকশন চৌধুরী জানান, আটককৃত মালয়েশিয়াগামীদের থানায় হস্তান্তর করে জড়িত দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
যেভাবে পাচার করা হয়েছিল : ফিরে আসা সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি উপজেলার একডালা এলাকার মো. রিপন জানান, মো. জাকির নামে এক বন্ধু টেকনাফ ভ্রমণের কথা বলে নিয়ে আসে। টেকনাফে পৌঁছলে ওই বন্ধু তাকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। দালালরা তাকে জোরপূর্বক একটি সিএনজিতে তুলে নিয়ে রাতেই সাগরে অপেক্ষামাণ ট্রলারে নিয়ে যায়।
নরসিংদী জেলার মুরাদনগরের হোসেন মিয়ার ছেলে জাহাঙ্গীর জানান, সেসহ আরও ২১ জন ৪৫ দিন ধরে ট্রলারে ছিলেন। চট্টগ্রামের ইউসুফ নামক এক দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে টেকনাফের সাবরাং থেকে ট্রলারে উঠেছিলেন তিনি। তিনি বলেন, সকালের খাদ্য হিসেবে চিড়া ও গুড় এবং রাতের বেলা ওষুধ মিশানো ভাত খেতে দিত তারা। যা খেলে বমি আসত। তাছাড়া লবণ পানি পান করতে হতো।
কক্সবাজার জেলার উখিয়ার উপজেলার নতুন বাজারের আবদুল হাফিজের ছেলে নুরুল হাকিম জানান, পানি চাওয়া হলে এবং বেশি নড়াচড়া করলে শারীরিক নির্যাতন করত ট্রলারে থাকা দালালরা। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারত না। ঘাড় ঘুরালেই তারা মারধর করত।
মাদারীপুর জেলার মো. গাউজ বেপারীর ছেলে মো. মাসুম জানায়, টেকনাফের নবী হোছন ও বাবুল নামক দু’জন দালাল সার্বক্ষণিক তাদের ওপর নির্যাতন চালাত।
এদিকে আরও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ স্ব-ইচ্ছায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশে এলেও অনেককে জোরপূর্বক ট্রলারে উঠানো হয়েছে। তারা আরও জানায়, ট্রলারে খাবার দেয়া হতো সকালে চিড়া-মুড়ি, বিকালে শুকনো মরিচের সঙ্গে ভাত। অল্প পরিমাণ পানি পান করতে দেয়া হতো।
কক্সবাজার সৈকতের ৪ ফটোগ্রাফার : ফিরে আসা যাত্রীদের মধ্যে কক্সবাজার সৈকতের ৪ ফটোগ্রাফার রয়েছেন। তারা টেকনাফে ভ্রমণে এলে টেকনাফের সাবরাং জিপ স্টেশন থেকে সন্ধ্যা বেলায় ৪/৫ জন লোক একটি সিএনজিতে করে ট্রলারে উঠিয়ে দেয় তাদের। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি ক্যামরা ও ৪টি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া হয়। এরা হচ্ছে- কক্সবাজারের কলাতলী এলাকার আবুল কালামের ছেলে মো. রফিক, আবদুল মজিদের ছেলে আবুল কাশেম, নুর মোহাম্মদের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ হোছনের ছেলে মো. হাসেম। তারা সবাই জনি নামক একটি স্টুডিওর তত্ত্বাবধানে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করত।
আইওএম’র সংস্থার ডা. সৌমেন জানান, যাত্রীদের মধ্যে আশংকাজনক কেউ নেই। তবে খাদ্যজনিত অভাবে দুর্বলতা রয়েছে।
বিজিবির হাতে আটক ১১ : রোববার রাতে ট্রলারটি থেকে নেমে আসা ৩০ যাত্রীর মধ্যে ১১ জনকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে আটক করেছে বিজিবি। এরা কোস্টগার্ডের হাতে আটক ১১৬ যাত্রীর ট্রলারেরই যাত্রী ছিল। ৪২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের শাহপরীর দ্বীপ বিওপিতে কর্মরত নায়েক কলাপ্র“ মার্মার নেতৃত্বে একটি নিয়মিত টহল দল মঙ্গলবার রাত ১১টার সময় গোলাপাড়া চর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভয়াবহ অভিবাসী সংকটে সহযোগিতার জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাগরে ভাসমান এবং উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছে দেশটি।
দারিদ্র্যতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমানের বিশেষ করে রোহিঙ্গা যুবকরা পাচারকারী চক্রের দালালদের হাত ধরে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। কিছুদিন আগে হাজার হাজার অভিবাসীকে সাগরে এবং থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ফেলে চলে যায় পাচারকারীরা।
মার্কিন দূতাবাসের একজন মুখপাত্র এএফপিকে বলেন, শুধু দারিদ্র্যতা নয়, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার ভয়েও অনেকে দেশ ছেড়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এটি একটি আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ। সামুদ্রিক আইন ও নিয়মাবলী অনুযায়ী একে আঞ্চলিকভাবে সুরাহা করতে হবে। এজন্য থাইল্যান্ড চলতি মাসের শেষ দিকে একটি আঞ্চলিক সম্মেলনের ডাক দিয়েছে।
এদিকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যে বলেছে, তারা উপকূলে ভিড়তে চাইলে কোনো নৌকাকে বাধা দেবে না। যদিও মঙ্গলবার শত শত অভিবাসীকে তীর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ।
উদ্ধার ৬০০ অভিবাসী ইন্দোনেশিয়ার আচেহ ক্যাম্পে : ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উত্তরে মাছ ধরার শহর কুয়ালা ক্যানকইয়ের বড় একটি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৬০০ বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের অভিবাসীকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখানে আছে তিনটি ভবন এবং ছোট একটি মসজিদ। সুনামির পর এখানে এই আশ্রয় কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছিল। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) কর্মীরা বুধবার বিকালে দেশটির লোকসুকন শহরের স্পোর্টস সেন্টার থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে যায়।
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর কর্মকর্তা স্টেভ হ্যামিল্টন এএফপিকে বলেন, এসব অভিবাসী এখানে প্রায় এক মাস অবস্থান করতে পারবেন। দেশটির কর্তৃপক্ষ ও আইওএম কর্মীরা তাদের দেখভাল করছেন এবং তাদের পরিচয়, ছবি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করছেন। উদ্ধার এ ছয়শ’ ছাড়াও সাগরে আরও প্রায় দেড় হাজার অভিবাসী ভাসছে। তারা খাদ্য ও পানীয় সংকটে আছে।
এদিকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া উপকূলে সাগরে ভাসছেন এখন প্রায় কয়েক হাজার অভিবাসী। বুধবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের আশ্রয় কেন্দ্রে বাংলাদেশের সাইফুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমান নামে দু’বন্ধু সংবাদ মাধ্যমকে জানান, সাগরে তাদের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। অনেক দিন না খেয়ে দু’জনই খুব ক্লান্ত-শ্রান্ত ছিলেন। তারা জানান, দাললরা তাদের ঠিকমতো খাবার দিত না। সব সময় চালাত অমানুষিক নির্যাতন।
জাতিসংঘের উদ্বেগ : মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সমুদ্রে ভাসমান অসহায় অভিবাসীদের বহনকারী নৌকা দেশগুলোর উপকূলে ভিড়তে না দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। সোমবার ইন্দোনেশিয়া উপকূল থেকে একটি অভিবাসী নৌকাকে সমুদ্রের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এর আগে মালয়েশিয়ার সামুদ্রিক এজেন্সি ঘোষণা দেয়, তারা কোনো বিদেশী জাহাজকে তীরে ভিড়তে দেবে না। ইউএনএইচসিআর’র অ্যাসিসট্যান্ট হাইকমিশনার ভলকার টার্ক বলেন, ‘জীবন বাঁচানোকেই আমাদের সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। তাদের রক্ষা করা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দায়িত্ব।’ তিনি বলেন, তাদের জীবনকে পাচারকারীদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া কখনই উচিত হবে না।
মঙ্গলবার টেকনাফ উপকূল থেকে কোস্টগার্ড যে ১১৬ যাত্রীকে উদ্ধার করেছে, আহমদ তাদেরই একজন। বুধবার তাদেরকে টেকনাফ কোস্টগার্ড স্টেশনে আনার পর যুগান্তরকে এসব কথা জানান আহমদ। তিনি বলেন, এলাকায় টেক্সটাইল মিলে কাজ করতেন তিনি। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দালাল মিন্টুর সঙ্গে আড়াই লাখ টাকার চুক্তিতে তিনি মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমান। অগ্রিম ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিল মিন্টুকে। অবশিষ্ট টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছলে তার পরিবার থেকে দেয়া হতো। এদিন মঙ্গলবার উদ্ধার ১১৬ এবং বিজিবির হাতে আটক ১১ জনকে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
ফরিদপুরের আহমদ, সিরাজগঞ্জের রিপন, নরসিংদীর মঙ্গল মিয়া, কক্সবাজারের মহেশখালীর তানভীরসহ ট্রলার থেকে উদ্ধার হওয়া আরও অনেকে জানান, মালয়েশিয়াগামী ট্রলারটির অবস্থান ছিল সেন্টমার্টিন থেকে প্রায় ২০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে সীতা পাহাড় নামক স্থানে। সেখানে আরও ৮টি মানব পাচারের ট্রলার এভাবে অপেক্ষমাণ ছিল। থাইল্যান্ডে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়া এবং টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে ৩ শীর্ষ মানব পাচারকারী নিহত হওয়ার পর বেকায়দায় পড়ে যায় ট্রলারে থাকা দালাল ও ক্রুরা। তারা না পারছিল থাইল্যান্ডের দিকে যেতে, না পারছিল টেকনাফ উপকূলে ভিড়তে। এই অবস্থায় সোমবার ট্রলারটি সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি চলে আসে। এ সময় দালালরা মোবাইল যোগাযোগে টেকনাফ থেকে ছোট ট্রলার এনে যাত্রীদের উপকূলে নেমে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এভাবে দুটি ট্রলারে ৪৮ জন রোববার রাতে থাইল্যান্ডের ট্রলার থেকে নেমে আসে। এর মধ্যে চকরিয়ার নুরুল ইসলাম ভুট্টোসহ ৩০ জন একটি ট্রলারে টেকনাফ উপকূলে নেমে পালানোর সময় ১১ জন বিজিবির হাতে ধরা পড়ে। এই ১১ জনের দলটিকে টেকনাফ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। এছাড়া অপর একটি ট্রলারে ১৮ রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমারে ফিরে যায়।
ট্রলারে থাকা অবশিষ্ট ১১৬ যাত্রীকে কূলে নামিয়ে দিতে না পেরে ট্রলারটি আবারও মিয়ানমার সীমান্তের দিকে ফিরে যাচ্ছিল। এ সময় অবস্থা বেগতিক দেখে যাত্রীরা সবাই মিলে ট্রলারের ৫ ক্রুকে সাগরে ফেলে দিয়ে ট্রলারটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে রিপন নামে এক যাত্রী কোনো মতে ট্রলারটি এলোমেলো চালিয়ে সেন্টমার্টিনের পশ্চিমে চলে আসে। এ অবস্থায় সোমবার বিকালে কোস্টগার্ড নৌবাহিনী জাহাজ বিএনএস রুহুল আমিনের সহায়তায় তাদেরকে উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়া সবাই বাংলাদেশী নাগরিক। এরমধ্যে রয়েছে কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, পাবনা, যশোর ও ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা।
সোমবার সন্ধ্যায় কোস্টগার্ড ট্রলারসহ উদ্ধার যাত্রীদের নিয়ে টেকনাফের দিকে রওনা হলেও রাতে শাহপরীর দ্বীপ ঘোলার চরে ট্রলারটি আটকা পড়ে। পরে সেন্টমার্টিন থেকে দুটি ট্রলার এনে যাত্রীদের টেকনাফে নিয়ে আসে। মঙ্গলবার সকালে উদ্ধার যাত্রীরা টেকনাফে পৌঁছলে মেডিকেল টিম তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। পরে তাদেরকে টেকনাফ থানায় সোপর্দ করা হয়।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মেডিকেল দল উদ্ধার ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেন। মেডিকেল অফিসার ডা. সোমেন পালিত বলেন, উদ্ধার অভিবাসীরা তাদেরকে শরীরের ক্ষতস্থান দেখিয়েছে। তাদেরকে পাচারকারীরা বেদম প্রহার করেছিল।
সেন্টমার্টিন কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. ডিকশন চৌধুরী জানান, আটককৃত মালয়েশিয়াগামীদের থানায় হস্তান্তর করে জড়িত দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
যেভাবে পাচার করা হয়েছিল : ফিরে আসা সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি উপজেলার একডালা এলাকার মো. রিপন জানান, মো. জাকির নামে এক বন্ধু টেকনাফ ভ্রমণের কথা বলে নিয়ে আসে। টেকনাফে পৌঁছলে ওই বন্ধু তাকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। দালালরা তাকে জোরপূর্বক একটি সিএনজিতে তুলে নিয়ে রাতেই সাগরে অপেক্ষামাণ ট্রলারে নিয়ে যায়।
নরসিংদী জেলার মুরাদনগরের হোসেন মিয়ার ছেলে জাহাঙ্গীর জানান, সেসহ আরও ২১ জন ৪৫ দিন ধরে ট্রলারে ছিলেন। চট্টগ্রামের ইউসুফ নামক এক দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে টেকনাফের সাবরাং থেকে ট্রলারে উঠেছিলেন তিনি। তিনি বলেন, সকালের খাদ্য হিসেবে চিড়া ও গুড় এবং রাতের বেলা ওষুধ মিশানো ভাত খেতে দিত তারা। যা খেলে বমি আসত। তাছাড়া লবণ পানি পান করতে হতো।
কক্সবাজার জেলার উখিয়ার উপজেলার নতুন বাজারের আবদুল হাফিজের ছেলে নুরুল হাকিম জানান, পানি চাওয়া হলে এবং বেশি নড়াচড়া করলে শারীরিক নির্যাতন করত ট্রলারে থাকা দালালরা। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারত না। ঘাড় ঘুরালেই তারা মারধর করত।
মাদারীপুর জেলার মো. গাউজ বেপারীর ছেলে মো. মাসুম জানায়, টেকনাফের নবী হোছন ও বাবুল নামক দু’জন দালাল সার্বক্ষণিক তাদের ওপর নির্যাতন চালাত।
এদিকে আরও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ স্ব-ইচ্ছায় মালয়েশিয়ার উদ্দেশে এলেও অনেককে জোরপূর্বক ট্রলারে উঠানো হয়েছে। তারা আরও জানায়, ট্রলারে খাবার দেয়া হতো সকালে চিড়া-মুড়ি, বিকালে শুকনো মরিচের সঙ্গে ভাত। অল্প পরিমাণ পানি পান করতে দেয়া হতো।
কক্সবাজার সৈকতের ৪ ফটোগ্রাফার : ফিরে আসা যাত্রীদের মধ্যে কক্সবাজার সৈকতের ৪ ফটোগ্রাফার রয়েছেন। তারা টেকনাফে ভ্রমণে এলে টেকনাফের সাবরাং জিপ স্টেশন থেকে সন্ধ্যা বেলায় ৪/৫ জন লোক একটি সিএনজিতে করে ট্রলারে উঠিয়ে দেয় তাদের। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি ক্যামরা ও ৪টি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া হয়। এরা হচ্ছে- কক্সবাজারের কলাতলী এলাকার আবুল কালামের ছেলে মো. রফিক, আবদুল মজিদের ছেলে আবুল কাশেম, নুর মোহাম্মদের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ হোছনের ছেলে মো. হাসেম। তারা সবাই জনি নামক একটি স্টুডিওর তত্ত্বাবধানে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করত।
আইওএম’র সংস্থার ডা. সৌমেন জানান, যাত্রীদের মধ্যে আশংকাজনক কেউ নেই। তবে খাদ্যজনিত অভাবে দুর্বলতা রয়েছে।
বিজিবির হাতে আটক ১১ : রোববার রাতে ট্রলারটি থেকে নেমে আসা ৩০ যাত্রীর মধ্যে ১১ জনকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে আটক করেছে বিজিবি। এরা কোস্টগার্ডের হাতে আটক ১১৬ যাত্রীর ট্রলারেরই যাত্রী ছিল। ৪২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের শাহপরীর দ্বীপ বিওপিতে কর্মরত নায়েক কলাপ্র“ মার্মার নেতৃত্বে একটি নিয়মিত টহল দল মঙ্গলবার রাত ১১টার সময় গোলাপাড়া চর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভয়াবহ অভিবাসী সংকটে সহযোগিতার জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাগরে ভাসমান এবং উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছে দেশটি।
দারিদ্র্যতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমানের বিশেষ করে রোহিঙ্গা যুবকরা পাচারকারী চক্রের দালালদের হাত ধরে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। কিছুদিন আগে হাজার হাজার অভিবাসীকে সাগরে এবং থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ফেলে চলে যায় পাচারকারীরা।
মার্কিন দূতাবাসের একজন মুখপাত্র এএফপিকে বলেন, শুধু দারিদ্র্যতা নয়, জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার ভয়েও অনেকে দেশ ছেড়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এটি একটি আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ। সামুদ্রিক আইন ও নিয়মাবলী অনুযায়ী একে আঞ্চলিকভাবে সুরাহা করতে হবে। এজন্য থাইল্যান্ড চলতি মাসের শেষ দিকে একটি আঞ্চলিক সম্মেলনের ডাক দিয়েছে।
এদিকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যে বলেছে, তারা উপকূলে ভিড়তে চাইলে কোনো নৌকাকে বাধা দেবে না। যদিও মঙ্গলবার শত শত অভিবাসীকে তীর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ।
উদ্ধার ৬০০ অভিবাসী ইন্দোনেশিয়ার আচেহ ক্যাম্পে : ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের উত্তরে মাছ ধরার শহর কুয়ালা ক্যানকইয়ের বড় একটি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৬০০ বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের অভিবাসীকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখানে আছে তিনটি ভবন এবং ছোট একটি মসজিদ। সুনামির পর এখানে এই আশ্রয় কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছিল। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) কর্মীরা বুধবার বিকালে দেশটির লোকসুকন শহরের স্পোর্টস সেন্টার থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে যায়।
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর কর্মকর্তা স্টেভ হ্যামিল্টন এএফপিকে বলেন, এসব অভিবাসী এখানে প্রায় এক মাস অবস্থান করতে পারবেন। দেশটির কর্তৃপক্ষ ও আইওএম কর্মীরা তাদের দেখভাল করছেন এবং তাদের পরিচয়, ছবি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করছেন। উদ্ধার এ ছয়শ’ ছাড়াও সাগরে আরও প্রায় দেড় হাজার অভিবাসী ভাসছে। তারা খাদ্য ও পানীয় সংকটে আছে।
এদিকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া উপকূলে সাগরে ভাসছেন এখন প্রায় কয়েক হাজার অভিবাসী। বুধবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের আশ্রয় কেন্দ্রে বাংলাদেশের সাইফুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমান নামে দু’বন্ধু সংবাদ মাধ্যমকে জানান, সাগরে তাদের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। অনেক দিন না খেয়ে দু’জনই খুব ক্লান্ত-শ্রান্ত ছিলেন। তারা জানান, দাললরা তাদের ঠিকমতো খাবার দিত না। সব সময় চালাত অমানুষিক নির্যাতন।
জাতিসংঘের উদ্বেগ : মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সমুদ্রে ভাসমান অসহায় অভিবাসীদের বহনকারী নৌকা দেশগুলোর উপকূলে ভিড়তে না দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। সোমবার ইন্দোনেশিয়া উপকূল থেকে একটি অভিবাসী নৌকাকে সমুদ্রের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এর আগে মালয়েশিয়ার সামুদ্রিক এজেন্সি ঘোষণা দেয়, তারা কোনো বিদেশী জাহাজকে তীরে ভিড়তে দেবে না। ইউএনএইচসিআর’র অ্যাসিসট্যান্ট হাইকমিশনার ভলকার টার্ক বলেন, ‘জীবন বাঁচানোকেই আমাদের সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। তাদের রক্ষা করা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দায়িত্ব।’ তিনি বলেন, তাদের জীবনকে পাচারকারীদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া কখনই উচিত হবে না।
No comments