সংসদীয় গণতন্ত্রে ছোট দলের ভূমিকা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বহুদলীয়
গণতন্ত্রে বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি, দুটি বা তিনটি প্রধান দল
জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়। ঘুরেফিরে তারাই সরকার গঠন করে, এককভাবে
অথবা কোনো ছোট দল বা দলসমূহের সঙ্গে কোয়ালিশন করে। সে কারণে বহুদলীয়
সংসদীয় গণতন্ত্রে ছোট দলের ভূমিকা কম নয়। অন্যদিকে বহু দেশে বহু বড় দল
একসময় জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিলেও কোনো একপর্যায়ে গিয়ে গুরুত্ব
হারিয়ে ফেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তানে মুসলিম লীগ। দর্শনতত্ত্ব
সম্পর্কে বলা হয়, কোনো তত্ত্ব পুরোনো হয়ে গেলে আপনা–আপনি বাতিল হয়ে
যায়, স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে, কাউকে তা ধ্বংস করার প্রয়োজন হয় না।
রাজনৈতিক দল সম্পর্কেও সে কথা প্রযোজ্য। কোনো দল পুরোনো হয়ে গেলে তার
স্বাভাবিক মৃত্যু অনিবার্য। তার স্থান পূরণ করে নতুন নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচি
নিয়ে আসা আর একটি দল। বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক,
আক্ষরিক অর্থেই বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। দলের সংখ্যা শ খানেকের কম
নয়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যাই গোটা চল্লিশ। আন্ডারগ্রাউন্ডে
যে কত বাম ও ডানপন্থী উগ্র সংগঠন আছে, তার হিসাব আমাদের গোয়েন্দারা নন,
একমাত্র বিধাতা জানেন। যা হোক, শ খানেক দলের মধ্যে বড় চারটি দল ছাড়া আর
সাত-আটটি সংগঠনের নাম ও সেগুলোর একজন করে নেতার নাম মানুষ জানে। ওই সব দলের
কার্যনির্বাহী পরিষদ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তার সদস্যদের নাম দেশের কেউ
জানে না।
যখনই জাতীয় সংসদ অথবা অন্য কোনো নির্বাচনের ঘোষণা আসে, তখনই বেশ কিছু দলের তৎপরতা মানুষ দেখতে পায়। ওই দলগুলোর অবস্থা এ রকম: আমরা এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর একটি দিনও দেরি সইল না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই কয়েকটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেয়। তাদের প্রার্থীদের তড়াক করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার আগে সাত-পাঁচ ভাবা উচিত ছিল। কারণ, তাদের দল ছোট হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ছোট দলের ভূমিকা ছোট নয়। প্রধান দুটি দলের সঙ্গে ছোট কয়েকটি দল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনটি একটি জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্ব পায়। সরকারের আকস্মিক নির্বাচনের পরিকল্পনায় ছোট দলের নেতারা যোগ দেওয়ায় তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। শুধু দেশে নয়, বিদেশে উন্নয়ন–সহযোগী দেশগুলো ও জাতিসংঘ নির্বাচনটিকে পর্যবেক্ষণ করে। কোনো পৌর কর্তৃপক্ষের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববাসীর এমন নজিরবিহীন উৎসুক্য পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। ৫/১-এর নির্বাচনটি দাতা দেশগুলো দেখেছে বলেই এই নির্বাচনটি ছিল তাদের কাছে টেস্ট কেস।
কিছুকাল যাবৎ জাতীয় পার্টির নেতা অব্যাহতভাবে বলছেন যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি শেষ, তাদের ওপর জনগণের আস্থা নেই, তাঁর দলই একমাত্র ভরসা। ভবিষ্যতে তাঁরাই সরকার গঠন করবেন। অতি সম্প্রতি কোটি কোটি টাকা খরচ করে জাতীয় পার্টি দু-একটি সমাবেশ বা সম্মেলন করেছে। ব্যানার হাতে মানুষ এবং বড় বড় বাসে ভরে গিয়েছিল ঢাকার রাস্তাঘাট। আমি নিজে ওই দিন যানজটে আটকা ছিলাম আড়াই ঘণ্টা। সরকারের এবং প্রশাসনের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায় ওই সম্মেলন অনুষ্ঠানের এন্তেজামে। সেটা জনগণের খোলা চোখেই ধরা পড়ে। ঘোষণা দেওয়া হয়, ১০ লাখ লোকের সমাবেশ হবে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এক প্রার্থী পেয়েছেন ২ হাজার ৯৫০ ভোট। গত সম্মেলনে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে যে লোক জড়ো করা হয়েছিল, তার সংখ্যা নিশ্চয়ই তিন হাজারের বেশি ছিল।
সিকি শতাব্দী যাবৎ বিরামহীন বলা হচ্ছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্র দিয়ে কিছু হবে না, দুই দলের শাসন মানুষ দেখেছে, বাম বিকল্পই পারে দেশকে উদ্ধার করতে। সেই বাম বিকল্পধারায় দলের সংখ্যা একটি বা দুটি নয়, বহু—১১, ২১ বা ৩১। যে দেশে ৫০ শতাংশ মানুষ ভালো রকম গরিব, সেখানে বাম দলগুলোর প্রতি সমর্থন উল্লেখযোগ্য হওয়াই স্বাভাবিক। দুই ঢাকার একটিতে বাম এক প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ২৯ ভোট, অন্যটিতে ২ হাজার ৪৭৫ ভোট। সিটি নির্বাচনের পর বামপন্থীদের পাড়াপড়শিদের মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়েছে। নেতাদের আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত ঘর থেকে বের হতে পারেননি তিন দিন। হাটবাজার বন্ধ। দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানই তিন হাজারের কম ভোট পেয়ে নির্বাচিত নন।
সবাই জানে কোনো নির্বাচনে কোনো দলের সব প্রার্থীই বিজয়ী হন না। অনেক প্রার্থীই জানেন তাঁরা বিজয়ী হতে পারবেন না। তবে কেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন? পরাজয় নিশ্চিত জেনেও প্রতিযোগিতারও একটি মূল্য আছে। তিনি যে দলের প্রার্থী, সেই দলের জনপ্রিয়তা যাচাই হয়। ব্যক্তিপ্রার্থী সে ক্ষেত্রে মুখ্য নন। সে জন্যই আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মতো জনপ্রিয় নেতা ও ভালো মানুষ ২০০৮-এর নির্বাচনে পরাজিত হন। যে বিপুলসংখ্যক ভোট তিনি পেয়েছিলেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার জন্য। খালেদা জিয়া তাঁকে মনোনয়ন দিলে তাঁকে পরাজিত করার শক্তি তাঁর এলাকায় আর কারও ছিল না। কোনো দলের প্রার্থী যখন পরাজিত হন, তা তাঁর নিজের কারণে কিছুটা, পরাজয়ের দায় প্রধানত দলীয় নেতৃত্বের।
কার্ল মার্ক্স যে বয়সে মারা গেছেন, ঠিক তত বছর যাবৎ উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলার কমিউনিস্টরা থিসিস নিয়ে বিতর্ক করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের বাম সংগঠনগুলোর অফিসে কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, মাও সেতুং, হো চি মিন এমনকি মহা বিপ্লবী চে’র ছবি পর্যন্ত শোভা পায়। গত ৪০ বছরে মার্ক্সবাদ দূরের কথা, মার্ক্সের নামটা উচ্চারণ করেছেন এমন কোনো বাম নেতাকে আমি দেখিনি। এমন একটি দিন নেই, যে দিন তারা বাংলার মাটি থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত না করেন।
প্রগতিশীল সমাজবাদী রাজনীতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এক জিনিস, সে জন্য শক্তিশালী বাম সংগঠন গড়ে তোলা এক জিনিস, আর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রচার সংঘ আর এক বস্তু। প্রগতিশীল রাজনীতি সাবলীল থাকলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ মাথা তুলতে পারে না। সমাজে নারীর জীবন নিরাপদ থাকে। উন্নত জাতীয় সংস্কৃতি বিকশিত হয়। অর্থনীতি স্থিতিশীল ও ভালো থাকে। সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সাম্প্রদায়িক বলে অপবাদ দিলে জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় না নেমে পারে না। সংখ্যালঘুরাও আস্থা রাখে না। তখন নির্বাচনী রাজনীতিতে না থেকে বরং সশস্ত্র অথবা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের পথে যাওয়াই ভালো।
সিটি নির্বাচনে কী হয়েছে, কী কারণে হয়েছে, তা পথে পথে পিঠে ছালা ঝুলিয়ে কাগজ ও শিশি বোতল কুড়ানো কিশোর পর্যন্ত জানে। দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সঙ্গে বৈঠকের সঙ্গে সঙ্গে ধা করে তারিখ ঘোষণার পর বাম নেতাদের তৎপরতায় আমার ভেতরে একধরনের রক্তক্ষরণ হয়। দেশের মানুষ জেনে গেল বাম নেতারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত শুধু নন, অত্যন্ত ব্যাকুল আওয়ামী লীগের নেতাদের মতোই। সেই সঙ্গে তারা আরও জেনে গেল বাম নেতাদের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা নেই। বাম নেতাদের এই অনৈক্য দুটি বড় দলেরই উপভোগ্য। যাদের মানি নেই, মাসলম্যান নেই, আছে নীতি ও আদর্শ, তাদের মধ্যে যদি ঐক্যটাও না থাকে, তাদের যারা নীতিগতভাবে সমর্থক, তাদের দুঃখের আর সীমা থাকে না। আমিও দুঃখিত।
ছোট দলগুলোর উচিত ছিল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য প্রয়োজনে মধ্য-ডান ও ডানদের সঙ্গেও ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা। যাঁরা বাম বলে দাবি করেন, তাঁদের মিলিট্যান্ট হতে হবে। মিলিট্যান্ট হওয়ার অর্থ জঙ্গিবাদী হওয়া নয়, আপসহীন লড়াইয়ের মানসিকতা থাকা। ডান-বাম সব ছোট দলেরই ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি করার অভ্যাস বহু দিনের। সেটা দেখেছি মোশতাকের পৌনে তিন মাসে, জিয়ার সময়, এরশাদের আমলে এবং ’৯১-এর পরেও। অতীতে করলেও চিরকালই তাঁরা তা করবেন—প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে—তা ভাবতে কষ্ট হয়। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি অংশগ্রহণের জন্য যাঁরা রাস্তায় নেমে পড়েন, নির্বাচন ও ফলাফল ঘোষণার ২১ দিন আগেই নির্বাচনটি লেজিটিমেসি বা বৈধতা তাঁরাই দিয়ে দেন। ফল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক হাহাকার অর্থহীন ও হাস্যকর।
ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। তা শুধু বড় বড় ও জাতীয় দলগুলোর কল্যাণে নয়, সেখানে ছোট ও আঞ্চলিক দলগুলোর ভূমিকা অসামান্য। লোকসভায় ৪০টির বেশি দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। তেলেগু দেশম পার্টি, শিরোমণি আকালি দল, দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম, বহুজন সমাজ পার্টি, তামিল মানিলা কংগ্রেস, কেরালা কংগ্রেস (এম), সিকিম ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, পিজ্যান্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি, মণিপুর স্টেট কংগ্রেস পার্টি, ভারতীয় জাতীয় লোক দল, ন্যাশনাল কনফারেন্স, হিমাচল বিকাশ কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় লোক দল, মুসলিম লীগ প্রভৃতি। বহু রকমের কংগ্রেস ও নানা রকম সমাজবাদী দল রয়েছে। শ্রীলঙ্কার সংসদেও বিভিন্ন ভাষাভাষী, জাতিসত্তা ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। নেপালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আমি একজন বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিলাম। মার্ক্সবাদী বিপ্লবী প্রচণ্ডদের প্রাধান্য ছিল, কিন্তু বিভিন্ন ছোট দল থেকেও নির্বাচিত হন। কমিউনিস্টই আছে বিভিন্ন রকম। বাংলাদেশে কেন ও রকম হলো না এবং কারা তার জন্য দায়ী? সব দোষ বড় দুই দলের ঘাড়ে চাপালে তা হবে আত্মপ্রতারণা।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাজ তাঁদের নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া। যেমন দেখেছি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টিকে শহর, বন্দর, শিল্পাঞ্চল ও গ্রাম থেকে গ্রামান্তর নেতারা চষে বেড়িয়েছেন। মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মিশেছেন। মুসলিম লীগ মানুষের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, তাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে শেষ হয়ে যায়।
বড় দুই দলের কাছে দেশের সব দল ও পেশাজীবী সংগঠন যদি আত্মসমর্পণ করে এবং দেশকে বন্ধক দেয় একখণ্ড জমির মতো, দেশে আপনা–আপনি বিরাজনীতিকরণ হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রটি যদি প্রতারণায় পূর্ণ হয়, তখন জাতি বিপর্যয়ে পড়ে। সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী শুধু বড় দল নয়; ছোট-মাঝারি দল ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো আরও বেশি দায়ী।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
যখনই জাতীয় সংসদ অথবা অন্য কোনো নির্বাচনের ঘোষণা আসে, তখনই বেশ কিছু দলের তৎপরতা মানুষ দেখতে পায়। ওই দলগুলোর অবস্থা এ রকম: আমরা এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর একটি দিনও দেরি সইল না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই কয়েকটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেয়। তাদের প্রার্থীদের তড়াক করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার আগে সাত-পাঁচ ভাবা উচিত ছিল। কারণ, তাদের দল ছোট হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ছোট দলের ভূমিকা ছোট নয়। প্রধান দুটি দলের সঙ্গে ছোট কয়েকটি দল প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনটি একটি জাতীয় নির্বাচনের গুরুত্ব পায়। সরকারের আকস্মিক নির্বাচনের পরিকল্পনায় ছোট দলের নেতারা যোগ দেওয়ায় তা গ্রহণযোগ্যতা পায়। শুধু দেশে নয়, বিদেশে উন্নয়ন–সহযোগী দেশগুলো ও জাতিসংঘ নির্বাচনটিকে পর্যবেক্ষণ করে। কোনো পৌর কর্তৃপক্ষের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববাসীর এমন নজিরবিহীন উৎসুক্য পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। ৫/১-এর নির্বাচনটি দাতা দেশগুলো দেখেছে বলেই এই নির্বাচনটি ছিল তাদের কাছে টেস্ট কেস।
কিছুকাল যাবৎ জাতীয় পার্টির নেতা অব্যাহতভাবে বলছেন যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি শেষ, তাদের ওপর জনগণের আস্থা নেই, তাঁর দলই একমাত্র ভরসা। ভবিষ্যতে তাঁরাই সরকার গঠন করবেন। অতি সম্প্রতি কোটি কোটি টাকা খরচ করে জাতীয় পার্টি দু-একটি সমাবেশ বা সম্মেলন করেছে। ব্যানার হাতে মানুষ এবং বড় বড় বাসে ভরে গিয়েছিল ঢাকার রাস্তাঘাট। আমি নিজে ওই দিন যানজটে আটকা ছিলাম আড়াই ঘণ্টা। সরকারের এবং প্রশাসনের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায় ওই সম্মেলন অনুষ্ঠানের এন্তেজামে। সেটা জনগণের খোলা চোখেই ধরা পড়ে। ঘোষণা দেওয়া হয়, ১০ লাখ লোকের সমাবেশ হবে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এক প্রার্থী পেয়েছেন ২ হাজার ৯৫০ ভোট। গত সম্মেলনে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে যে লোক জড়ো করা হয়েছিল, তার সংখ্যা নিশ্চয়ই তিন হাজারের বেশি ছিল।
সিকি শতাব্দী যাবৎ বিরামহীন বলা হচ্ছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্র দিয়ে কিছু হবে না, দুই দলের শাসন মানুষ দেখেছে, বাম বিকল্পই পারে দেশকে উদ্ধার করতে। সেই বাম বিকল্পধারায় দলের সংখ্যা একটি বা দুটি নয়, বহু—১১, ২১ বা ৩১। যে দেশে ৫০ শতাংশ মানুষ ভালো রকম গরিব, সেখানে বাম দলগুলোর প্রতি সমর্থন উল্লেখযোগ্য হওয়াই স্বাভাবিক। দুই ঢাকার একটিতে বাম এক প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ২৯ ভোট, অন্যটিতে ২ হাজার ৪৭৫ ভোট। সিটি নির্বাচনের পর বামপন্থীদের পাড়াপড়শিদের মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়েছে। নেতাদের আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত ঘর থেকে বের হতে পারেননি তিন দিন। হাটবাজার বন্ধ। দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানই তিন হাজারের কম ভোট পেয়ে নির্বাচিত নন।
সবাই জানে কোনো নির্বাচনে কোনো দলের সব প্রার্থীই বিজয়ী হন না। অনেক প্রার্থীই জানেন তাঁরা বিজয়ী হতে পারবেন না। তবে কেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন? পরাজয় নিশ্চিত জেনেও প্রতিযোগিতারও একটি মূল্য আছে। তিনি যে দলের প্রার্থী, সেই দলের জনপ্রিয়তা যাচাই হয়। ব্যক্তিপ্রার্থী সে ক্ষেত্রে মুখ্য নন। সে জন্যই আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মতো জনপ্রিয় নেতা ও ভালো মানুষ ২০০৮-এর নির্বাচনে পরাজিত হন। যে বিপুলসংখ্যক ভোট তিনি পেয়েছিলেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার জন্য। খালেদা জিয়া তাঁকে মনোনয়ন দিলে তাঁকে পরাজিত করার শক্তি তাঁর এলাকায় আর কারও ছিল না। কোনো দলের প্রার্থী যখন পরাজিত হন, তা তাঁর নিজের কারণে কিছুটা, পরাজয়ের দায় প্রধানত দলীয় নেতৃত্বের।
কার্ল মার্ক্স যে বয়সে মারা গেছেন, ঠিক তত বছর যাবৎ উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলার কমিউনিস্টরা থিসিস নিয়ে বিতর্ক করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের বাম সংগঠনগুলোর অফিসে কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, মাও সেতুং, হো চি মিন এমনকি মহা বিপ্লবী চে’র ছবি পর্যন্ত শোভা পায়। গত ৪০ বছরে মার্ক্সবাদ দূরের কথা, মার্ক্সের নামটা উচ্চারণ করেছেন এমন কোনো বাম নেতাকে আমি দেখিনি। এমন একটি দিন নেই, যে দিন তারা বাংলার মাটি থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত না করেন।
প্রগতিশীল সমাজবাদী রাজনীতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এক জিনিস, সে জন্য শক্তিশালী বাম সংগঠন গড়ে তোলা এক জিনিস, আর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রচার সংঘ আর এক বস্তু। প্রগতিশীল রাজনীতি সাবলীল থাকলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ মাথা তুলতে পারে না। সমাজে নারীর জীবন নিরাপদ থাকে। উন্নত জাতীয় সংস্কৃতি বিকশিত হয়। অর্থনীতি স্থিতিশীল ও ভালো থাকে। সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সাম্প্রদায়িক বলে অপবাদ দিলে জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় না নেমে পারে না। সংখ্যালঘুরাও আস্থা রাখে না। তখন নির্বাচনী রাজনীতিতে না থেকে বরং সশস্ত্র অথবা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের পথে যাওয়াই ভালো।
সিটি নির্বাচনে কী হয়েছে, কী কারণে হয়েছে, তা পথে পথে পিঠে ছালা ঝুলিয়ে কাগজ ও শিশি বোতল কুড়ানো কিশোর পর্যন্ত জানে। দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সঙ্গে বৈঠকের সঙ্গে সঙ্গে ধা করে তারিখ ঘোষণার পর বাম নেতাদের তৎপরতায় আমার ভেতরে একধরনের রক্তক্ষরণ হয়। দেশের মানুষ জেনে গেল বাম নেতারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত শুধু নন, অত্যন্ত ব্যাকুল আওয়ামী লীগের নেতাদের মতোই। সেই সঙ্গে তারা আরও জেনে গেল বাম নেতাদের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা নেই। বাম নেতাদের এই অনৈক্য দুটি বড় দলেরই উপভোগ্য। যাদের মানি নেই, মাসলম্যান নেই, আছে নীতি ও আদর্শ, তাদের মধ্যে যদি ঐক্যটাও না থাকে, তাদের যারা নীতিগতভাবে সমর্থক, তাদের দুঃখের আর সীমা থাকে না। আমিও দুঃখিত।
ছোট দলগুলোর উচিত ছিল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য প্রয়োজনে মধ্য-ডান ও ডানদের সঙ্গেও ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলা। যাঁরা বাম বলে দাবি করেন, তাঁদের মিলিট্যান্ট হতে হবে। মিলিট্যান্ট হওয়ার অর্থ জঙ্গিবাদী হওয়া নয়, আপসহীন লড়াইয়ের মানসিকতা থাকা। ডান-বাম সব ছোট দলেরই ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তি করার অভ্যাস বহু দিনের। সেটা দেখেছি মোশতাকের পৌনে তিন মাসে, জিয়ার সময়, এরশাদের আমলে এবং ’৯১-এর পরেও। অতীতে করলেও চিরকালই তাঁরা তা করবেন—প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে—তা ভাবতে কষ্ট হয়। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি অংশগ্রহণের জন্য যাঁরা রাস্তায় নেমে পড়েন, নির্বাচন ও ফলাফল ঘোষণার ২১ দিন আগেই নির্বাচনটি লেজিটিমেসি বা বৈধতা তাঁরাই দিয়ে দেন। ফল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক হাহাকার অর্থহীন ও হাস্যকর।
ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। তা শুধু বড় বড় ও জাতীয় দলগুলোর কল্যাণে নয়, সেখানে ছোট ও আঞ্চলিক দলগুলোর ভূমিকা অসামান্য। লোকসভায় ৪০টির বেশি দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। তেলেগু দেশম পার্টি, শিরোমণি আকালি দল, দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম, বহুজন সমাজ পার্টি, তামিল মানিলা কংগ্রেস, কেরালা কংগ্রেস (এম), সিকিম ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, পিজ্যান্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি, মণিপুর স্টেট কংগ্রেস পার্টি, ভারতীয় জাতীয় লোক দল, ন্যাশনাল কনফারেন্স, হিমাচল বিকাশ কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় লোক দল, মুসলিম লীগ প্রভৃতি। বহু রকমের কংগ্রেস ও নানা রকম সমাজবাদী দল রয়েছে। শ্রীলঙ্কার সংসদেও বিভিন্ন ভাষাভাষী, জাতিসত্তা ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। নেপালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আমি একজন বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিলাম। মার্ক্সবাদী বিপ্লবী প্রচণ্ডদের প্রাধান্য ছিল, কিন্তু বিভিন্ন ছোট দল থেকেও নির্বাচিত হন। কমিউনিস্টই আছে বিভিন্ন রকম। বাংলাদেশে কেন ও রকম হলো না এবং কারা তার জন্য দায়ী? সব দোষ বড় দুই দলের ঘাড়ে চাপালে তা হবে আত্মপ্রতারণা।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাজ তাঁদের নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া। যেমন দেখেছি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টিকে শহর, বন্দর, শিল্পাঞ্চল ও গ্রাম থেকে গ্রামান্তর নেতারা চষে বেড়িয়েছেন। মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মিশেছেন। মুসলিম লীগ মানুষের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি, তাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে শেষ হয়ে যায়।
বড় দুই দলের কাছে দেশের সব দল ও পেশাজীবী সংগঠন যদি আত্মসমর্পণ করে এবং দেশকে বন্ধক দেয় একখণ্ড জমির মতো, দেশে আপনা–আপনি বিরাজনীতিকরণ হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রটি যদি প্রতারণায় পূর্ণ হয়, তখন জাতি বিপর্যয়ে পড়ে। সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী শুধু বড় দল নয়; ছোট-মাঝারি দল ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো আরও বেশি দায়ী।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments