কল-কারখানায় অগ্নিকাণ্ড by মো. ফজলুল হক
অগ্নিকাণ্ড বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা আদিকাল
থেকেই ঘটে আসছে। কুপি, মাটির চুল্লি, মোমবাতি, মশার কয়েল, ছাইয়ের স্তূপ বা
বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকেই ছন ও বাঁশের কুঁড়েঘর বা টিনের ঘরে আগুন ধরে
থাকে।
মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যায় ঘরে সংরক্ষিত ধান, চাল,
পেঁয়াজ, রসুন থেকে শুরু করে গরু-ছাগলসহ সব কিছু। আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহার
হতো পুকুর, নদী, খাল ও বিলের পানি। আন্তরিকতার সঙ্গে আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে
পড়ত এলাকাবাসী। যথাসম্ভব চেষ্টা করত জানমাল রক্ষায়। এলাকাবাসী নিঃস্ব
ব্যক্তিকে সাহায্য করত বাঁশ, ছন বা টিন, কাপড় ও রান্না করা খাবার দিয়ে।
এমনকি ধান-পাটের বীজ দিয়ে সাহায্য করা হতো প্রয়োজনের সময়। অর্থাৎ মানুষের
মধ্যে যত ধরনের আন্তরিকতা থাকা দরকার তার কোনো অভাব ছিল না সেই অতীত যুগে।
বর্তমানে গ্রামগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগ হ্রাস পাওয়ার কারণ হচ্ছে
ঘরবাড়ি সব কিছুই এখন পাকা, আধাপাকা ও টিনের। এ ছাড়া মানুষও সচেতন। বর্তমানে
আগুন লাগার কারণ বা উৎস ভিন্নতর। গ্যাস, চুল্লি ও বিদ্যুৎ লাইনে
শর্টসার্কিটই প্রধান। গ্যাসের চুল্লি জ্বালিয়ে রাখা, ভুলক্রমে নেভানো
চুল্লির সুইচ চালু রাখা, গ্যাস সিলিন্ডার ও গ্যাস লাইন বিস্ফোরণ ইত্যাদি।
সবচেয়ে বিপজ্জনক কারণের অন্যতম হলো বিদ্যুৎ লাইন থেকে অগ্নিকাণ্ড। যখন
শর্টসার্কিট হয় তখন দুটি পজিটিভ ও নেগেটিভ তার একত্র হয়। এ পর্যন্ত যত বড়
ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা হলো বিদ্যুৎ লাইনের শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ড। বিগত
কয়েক বছরে অগ্নিকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের কারণে জান ও মালের অপূরণীয় ক্ষতি
সাধিত হয়েছে। যেমন ২০১১ সালে বসুন্ধরা সিটিতে অগ্নিকাণ্ড, ২০১২ সালে স্টিল
মিল করপোরেশন অফিসে অগ্নিকাণ্ড, তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে (১২০ জনের
প্রাণহানি ও কয়েক শ আহত), মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে
(মালিকের মৃত্যু), মোহাম্মদপুরে স্মার্ট এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে
(৭ শ্রমিকের মৃত্যু), রাজধানীর তল্লাবাগে অগ্নিকাণ্ডে (নিউ মডেল স্কুলের
ছাত্রের মৃত্যু), নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে অগ্নিকাণ্ড, আগারগাঁও বস্তিতে
(কয়েকটি শিশুর মৃত্যু) অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি। প্রাণনাশের পাশাপাশি আহত হয়েছে
বেশ কয়েক শ। সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ শত শত কোটি টাকা। এ ছাড়া বিশ্বের অনেক
দেশে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, গভীর বনে দাবানল ইত্যাদি। অগ্নিকাণ্ডের মূল
কারণ হচ্ছে, অদক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান দ্বারা বাসাবাড়ি ও ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যুৎ
লাইন বসানো; তারের বাইরের আবরণ Insulated wire -এর ক্ষেত্রে দুর্বল হওয়া;
তারের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত লোড ব্যবহার করা; বিদ্যুৎ Connection-এর
প্রয়োজনীয় সকেট, সুইচ ইত্যাদিতে সমস্যা; বেআইনিভাবে চোরা লাইন ব্যবহার করা;
হিটার ব্যবহার যা তারের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে
অগ্নিকাণ্ড হতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে পিপীলিকা, তেলাপোকা, ইঁদুর, টিকটিকিসহ
বিভিন্ন প্রাণীর কর্মকাণ্ড। এ ক্ষেত্রে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো পিপীলিকা
তারের বহিরাবরণ অর্থাৎ তারের প্লাস্টিক ত্বক বা আবরণ এমনভাবে খায় যে, তারকে
উন্মুক্ত করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে পজিটিভ ও নেগেটিভ তারদ্বয় একত্র হয়ে
বাসাবাড়িতে আগুন লাগার একটি বড় কারণ বলে মনে হয়। শর্টসার্কিট হলে প্রথমেই
তারের প্লাস্টিক আবরণটিতে আগুন ধরে। জ্বলন্ত আগুনসহ নিচে ঝরে পড়তে থাকে ফলে
ওই স্থানে রাখা জিনিসপত্রে আগুন লেগে সমগ্র ঘরে ছড়িয়ে পড়ে লেলিহান শিখায়।
এভাবেই বিদ্যুৎ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে গার্মেন্ট
ফ্যাক্টরি, পাটকল ও সুতার মিলগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখন আমাদের করণীয় কী?
বিগত ৫০-৬০ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, অগ্নিসংযোগ বা অগ্নিকাণ্ডের
কারণ যাই হোক না কেন সম্ভব হলে সঙ্গে সঙ্গে পানি, বালু বা ভিজা কম্বল
দ্বারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করা। সম্ভব না হলে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে
পড়ুন। সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস অফিসে খবর দিন। এ ধরনের ঘটনা যাতে
ভবিষ্যতে না ঘটে সে জন্য কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন যেমন, বাসাবাড়িতে
ভালো কম্পানির ব্র্যান্ডেড তার ব্যবহার করতে হবে; অভিজ্ঞ ইলেকট্রিশিয়ান
দ্বারা বিদ্যুৎ লাইনের কাজ করাতে হবে; কাজের তদারকির দায়িত্ব থাকবে
ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর; গ্রিডলাইন থেকে সার্ভিস তারটি হতে হবে যথাযথ ও
মানসম্পন্ন, যা প্রকৌশলীদের দ্বারা পরীক্ষিত। বাসা ও মিল-কারখানা
পিপীলিকা, তেলাপোকা, ইঁদুর, এমনকি সাপ থেকে মুক্ত রাখুন। সাপ
ট্রান্সফর্মারের বড় শত্রু। সাপের কারণে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ট্রান্সফরমার এরই মধ্যে শর্টসার্কিটের
মাধ্যমে বিকল হয়েছে। বাসা, মিল, কল-কারখানা ও ছাত্রাবাসে হিটার ব্যবহার
থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ বঙ্ েছোটখাটো পয়েন্ট বরাবর নিচে
আসবাবপত্র, কাপড়চোপড় বা দাহ্য পদার্থ রাখা নিরাপদ নয়। ফায়ার সার্ভিস,
বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার একাধিক মোবাইল বা টেলিফোন
নম্বর ঘরের দরজায় লটকে রাখুন। বাসাবাড়িতে প্রবেশপথটি এমন হতে হবে যাতে
ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুল্যান্স প্রবেশ করতে পারে; প্রতিটি বাসাবাড়িতে
অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র (ফায়ার স্টিংগুইশার) ঝুলিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজন। এ
বিষয়ে পরিবারের সব সদস্যকে ব্যবহারবিধি জানিয়ে বা শিখিয়ে দেওয়া; বাসা ত্যাগ
করার আগে ফ্যান, লাইটসহ সব কিছু বন্ধ রাখা; গ্যাস চুল্লির সুইস বন্ধ রাখার
বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। অধিক সময়ের জন্য বাসাবাড়ি ত্যাগ করলে মেইন সুইচ অফ
রাখা নিরাপদ। বাসার মধ্যে কাউকে রেখে তালাবন্ধ করা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, যা
বিগত কয়েক দিন আগে ঘটে গেল। সর্বোপরি প্রবেশ বহিরাগমন পথ প্রয়োজন অনুযায়ী
প্রশস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাল্টিস্টোরিড সুউচ্চ ভবনের ছাদে হেলিপ্যাডের
ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। অগ্নিসংযোগ একটি দুর্ঘটনা, যা যেকোনো সময়, যেকোনো
স্থানে, যেকোনো ব্যক্তির জীবনেই আসতে পারে। ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি মোকাবিলা
করতে হবে। সমাধানে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। ক্ষতির পরিমাণ বছরে কোটি কোটি
টাকা, মানুষ ও গৃহপালিত প্রাণীর জীবনও অকালে ঝরে যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ
এ কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়িতে বসবাসকারী সবাইকে
অগ্নিসংযোগের বিভিন্ন কারণ, আত্মরক্ষার কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার
জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সচেতনতা হতে পারে একটি ছোট উদ্যোগ,
যা বড় একটি দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে সম্পদ ও মূল্যবান জীবন।
লেখক : অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
fhoque.hstu@gmail.com
লেখক : অধ্যাপক, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
fhoque.hstu@gmail.com
No comments