জ্বালানি ও জাতীয় স্বার্থের তর্ক-বিতর্ক -উন্নয়ন by জোবায়ের জামান
দীর্ঘদিনের সিদ্ধান্তহীনতার ইতি টেনে সম্প্রতি সরকার গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়েছে। দুটি বহুজাতিক কোম্পানি কনোকো ফিলিপস ও টাল্লোর সঙ্গে গভীর সমুদ্র এলাকায় তিনটি ব্লকে ‘উত্পাদন অংশীদারি চুক্তি’ (পিএসসি) স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিলম্বে হলেও দেশের জ্বালানি সংকট বিবেচনায় এটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে বিবেচনায় রাখতে হবে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। অনুসন্ধানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পরও প্রাপ্তির খাতা শূন্য হয়ে যেতে পারে। আবার অনেক আবিষ্কারও বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উত্তোলনের নিশ্চয়তা বহন করে না। স্থলভাগের যে মাপের আবিষ্কার বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য বিবেচিত হবে, গভীর সমুদ্র এলাকায় সে আকারের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বিবেচিত নাও হতে পারে। অর্থাত্ কোনো চুক্তি স্বাক্ষর মানে তেল-গ্যাস প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নয়।
বাংলাদেশের সাগরবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সাগরবক্ষে অনুসন্ধান পরিচালনার মতো আর্থিক ও কারিগরি সামর্থ্য নেই এবং তা রাতারাতি অর্জিতও হবে না। ১৯৯৮-১৯৯৯ সালের দিকে শেল এবং কেয়ার্ন এনার্জিসহ আরও কিছু বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশের অগভীর সমুদ্রে ব্যাপক অনুসন্ধান জরিপ চালায়। সেই সময়ের জরিপে সম্ভাবনাময় বলে বিবেচিত ‘হাতিয়া’ ও ‘মগনামা’য় ড্রিলিংয়ে দুটো স্ট্রাকচারে গ্যাসের বাণিজ্যিক উত্তোলনযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। আরও ব্যয়বহুল ত্রিমাত্রিক সাইসমিক জরিপের প্রস্তাব রয়েছে। অর্থাত্ এসব অঞ্চলে এক দশক ধরে বিপুল ব্যয়ে পরিচালিত অনুসন্ধান আমাদের গ্যাস সম্পদে নতুন কোনো কিছু যোগ করতে পারেনি। বর্তমান পিএসসির আওতায় পরিচালিত অনুসন্ধানেও দ্রুত গ্যাসপ্রাপ্তি আশা করা যায় না, অন্তত আগামী সাত-নয় বছরের মধ্যে তো নয়ই।
গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং নিজেদের আর্থিক ও কারিগরি সামর্থ্য না থাকায় বিভিন্ন দেশ নানা আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। আবিষ্কৃত গ্যাসের বাজারজাতকরণের নিশ্চয়তা বা বাজারজাতকরণের সুযোগ প্রদানও এক ধরনের প্রণোদনার অংশ। অন্যথায় কোনো বিনিয়োগকারীই ঝুঁকিপূর্ণ এ বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে না। তৃতীয় মডেল পিএসসিতে আবিষ্কৃত গ্যাসের বাজারজাতকরণের বাস্তব এ দিকটি যথাযথ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের উপকূল থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে গভীর সমুদ্রে আবিষ্কৃত কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য গ্যাস নিয়ে আসা খুবই ব্যয়বহুল হবে, যদি না বিশাল বা ‘মেগা গ্যাসক্ষেত্র’ আবিষ্কৃত হয়। তাই ‘তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস’ (এলএনজি) প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস বাজারজাতকরণ/রপ্তানি একটি যৌক্তিক প্রস্তাব। তবে তাও আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের আকারের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণত গভীর সমুদ্র এলাকায় চার থেকে পাঁচ টিসিএফের নিচের কোনো গ্যাসক্ষেত্রের জন্য এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বলে বিবেচিত হয় না। এখানে উল্লেখ্য, পিএসসি মোতাবেক গ্যাসের যেকোনো রপ্তানির ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা বা দেশে তৃতীয় কোনো ব্যবহারকারী/পক্ষ গ্যাস কিনতে অপারগতা প্রকাশ করলেই কেবল পেট্রোবাংলার সম্মত শর্তে এলএনজি হিসেবে রপ্তানির সুযোগ আসবে। যাঁরা গভীর সমুদ্র অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের আর্থিক, কারিগরি ও অনিশ্চয়তার দিকটি উপলব্ধি না করে জনগণের আবেগকে পুঁজি করে সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন, তাঁরা কতটুকু বাস্তবতার কথা ভাবছেন আর কতটুকু স্বপ্নবিলাসী, তা বিবেচনাযোগ্য।
এরই মধ্যে মিয়ানমার, ভারত গভীর সমুুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করেছে। সমুদ্রসীমা নিয়েও তাদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ রয়েছে। পত্রপত্রিকায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সচিবের উদ্ধৃতি দিয়ে গ্যাসব্লক বিষয়ে মিয়ানমার ও ভারতের আপত্তির সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এমনকি যে তিনটি ব্লকে পিএসসি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে তিনটি ব্লকের ব্যাপারেও তারা আপত্তি জানিয়েছে। এ অবস্থায় সাগরবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে বরং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর স্বার্থই রক্ষিত হবে, বাংলাদেশের নয়।
গ্যাসের মতো কয়লা অনুসন্ধান ও খনি উন্নয়নের বিপুল মূলধনী বিনিয়োগের জন্য উত্তোলিত কয়লার বাজারজাতকরণও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সে জন্য খনি উন্নয়ন চুক্তিতে কয়লা রপ্তানির সুযোগ রাখা আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ‘প্রথম অধিকার’ নিশ্চিত করা আছে। সরকার অনাগ্রহী বা অপারগতা প্রকাশ করলেই কেবল তৃতীয় পক্ষ বা দেশের কাছে রপ্তানির সুযোগ আসবে। তবে বর্তমানে দেশে জ্বালানির বিপুল অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানির প্রশ্নটি প্রায় অবান্তর। তা ছাড়া কয়লা রপ্তানির জন্য দেশে অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। রেল উন্নয়নের পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে কয়লা হ্যান্ডলিং সুবিধা-সংবলিত টার্মিনাল স্থাপন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজারে উত্তোলিত কয়লা বাজারজাতকরণের নিশ্চয়তা পেলে কোনো বিনিয়োগকারীই রপ্তানির জন্য অবকাঠামো খাতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। তবে এ ধরনের বিনিয়োগ দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক বিবেচিত হতে পারে। দেশের মজুদ কয়লা আমাদের ভবিষ্যত্ চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অবকাঠামো সুবিধা থাকলে প্রয়োজন অনুসারে কয়লা আমদানি বা রপ্তানি দুটিই ভাবা যেতে পারে। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহারকারী দেশ চীন ও ভারত নিজেদের সুবিধা ও চাহিদা মোতাবেক কয়লা আমদানি ও রপ্তানি দুটোই করছে। ভারতকে বর্তমান অর্থবছরেই প্রায় ৭০ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে এবং ২০১১-১২ সাল নাগাদ তা ২০০ মিলিয়ন টনের বেশি ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে।
প্রাথমিক জ্বালানির অভাবে দেশ আজ বিদ্যুত্ উত্পাদনে হিমশিম খাচ্ছে। একক জ্বালানি-নির্ভরতার কারণে দেশে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুত্ ও গ্যাসসংকটে নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না, পুরোনো কারখানাগুলোতেও উত্পাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। জনদুর্ভোগ চরমে। গ্যাসের অভাবে বর্তমানে বিদ্যুত্ উত্পাদন প্রায় ৬০০ মেগাওয়াটের মতো হ্রাস পেলেও বিকল্প জ্বালানির অভাবে অসহায় সরকারকে নতুন করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে বিদ্যুত্ ও গ্যাসসংকট উভয়ই প্রবল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবানুগ পদ্ধতিতে সময়মতো দেশের কয়লা সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হলে এরই মধ্যে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের মতো প্রাথমিক জ্বালানি পাওয়া যেত। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে আরও ১৫০০-২০০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করা যেত। ফলে গ্যাসের অধিকতর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত হতো। কিন্তু কয়লা খাত উন্নয়নবিরোধী সক্রিয় প্রচারণা ও বিরোধিতার ফলে এ ক্ষেত্রেও এক ধরনের স্থবিরতা ও সিদ্ধান্তহীনতা বিরাজ করছে। মনে রাখা ভালো, জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন ক্রমেই যেভাবে জ্বালানি সম্পদ উন্নয়নবিরোধী ও বাস্তব পৃথিবীর নিয়মের বিরোধিতা করছে, তাতে দেশের জ্বালানি প্রাপ্যতা আরও দুরূহ হবে এবং সর্বোপরি জ্বালানি ও পণ্যমূল্য উভয়ই দুর্লভ হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ১০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ বি এম মূসার লেখায় উত্থাপিত প্রসঙ্গের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই। জনগণ আমদানি-রপ্তানি বুঝে না, তারা চায় বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ। চায় ঘরের চুলায় গ্যাস, শিল্পকারখানায় গ্যাস। এ জন্য জনগণ রাস্তায় নামতেও দ্বিধা করবে না। এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি করতে হবে নির্বাচিত সরকারকেই, কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীকে নয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও সরকারের। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে গ্যাস, কয়লাসহ দেশীয় সব জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপাত তা অপ্রিয় হলেও। সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুত্ খাতের প্রকৃত চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। অন্যথায় জ্বালানি ও বিদ্যুত্ খাতের বর্তমান সংকট ভবিষ্যতে আরও তীব্র হবে। এ জন্য জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতের আমাদের অনেক অর্জনও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সেটা নিশ্চয় আমরা কেউ চাই না।
জোবায়ের জামান: ভূতত্ত্ববিদ।
বাংলাদেশের সাগরবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সাগরবক্ষে অনুসন্ধান পরিচালনার মতো আর্থিক ও কারিগরি সামর্থ্য নেই এবং তা রাতারাতি অর্জিতও হবে না। ১৯৯৮-১৯৯৯ সালের দিকে শেল এবং কেয়ার্ন এনার্জিসহ আরও কিছু বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশের অগভীর সমুদ্রে ব্যাপক অনুসন্ধান জরিপ চালায়। সেই সময়ের জরিপে সম্ভাবনাময় বলে বিবেচিত ‘হাতিয়া’ ও ‘মগনামা’য় ড্রিলিংয়ে দুটো স্ট্রাকচারে গ্যাসের বাণিজ্যিক উত্তোলনযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি। আরও ব্যয়বহুল ত্রিমাত্রিক সাইসমিক জরিপের প্রস্তাব রয়েছে। অর্থাত্ এসব অঞ্চলে এক দশক ধরে বিপুল ব্যয়ে পরিচালিত অনুসন্ধান আমাদের গ্যাস সম্পদে নতুন কোনো কিছু যোগ করতে পারেনি। বর্তমান পিএসসির আওতায় পরিচালিত অনুসন্ধানেও দ্রুত গ্যাসপ্রাপ্তি আশা করা যায় না, অন্তত আগামী সাত-নয় বছরের মধ্যে তো নয়ই।
গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং নিজেদের আর্থিক ও কারিগরি সামর্থ্য না থাকায় বিভিন্ন দেশ নানা আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। আবিষ্কৃত গ্যাসের বাজারজাতকরণের নিশ্চয়তা বা বাজারজাতকরণের সুযোগ প্রদানও এক ধরনের প্রণোদনার অংশ। অন্যথায় কোনো বিনিয়োগকারীই ঝুঁকিপূর্ণ এ বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবে না। তৃতীয় মডেল পিএসসিতে আবিষ্কৃত গ্যাসের বাজারজাতকরণের বাস্তব এ দিকটি যথাযথ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের উপকূল থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে গভীর সমুদ্রে আবিষ্কৃত কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য গ্যাস নিয়ে আসা খুবই ব্যয়বহুল হবে, যদি না বিশাল বা ‘মেগা গ্যাসক্ষেত্র’ আবিষ্কৃত হয়। তাই ‘তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস’ (এলএনজি) প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস বাজারজাতকরণ/রপ্তানি একটি যৌক্তিক প্রস্তাব। তবে তাও আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের আকারের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণত গভীর সমুদ্র এলাকায় চার থেকে পাঁচ টিসিএফের নিচের কোনো গ্যাসক্ষেত্রের জন্য এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বলে বিবেচিত হয় না। এখানে উল্লেখ্য, পিএসসি মোতাবেক গ্যাসের যেকোনো রপ্তানির ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা বা দেশে তৃতীয় কোনো ব্যবহারকারী/পক্ষ গ্যাস কিনতে অপারগতা প্রকাশ করলেই কেবল পেট্রোবাংলার সম্মত শর্তে এলএনজি হিসেবে রপ্তানির সুযোগ আসবে। যাঁরা গভীর সমুদ্র অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের আর্থিক, কারিগরি ও অনিশ্চয়তার দিকটি উপলব্ধি না করে জনগণের আবেগকে পুঁজি করে সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন, তাঁরা কতটুকু বাস্তবতার কথা ভাবছেন আর কতটুকু স্বপ্নবিলাসী, তা বিবেচনাযোগ্য।
এরই মধ্যে মিয়ানমার, ভারত গভীর সমুুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করেছে। সমুদ্রসীমা নিয়েও তাদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ রয়েছে। পত্রপত্রিকায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সচিবের উদ্ধৃতি দিয়ে গ্যাসব্লক বিষয়ে মিয়ানমার ও ভারতের আপত্তির সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এমনকি যে তিনটি ব্লকে পিএসসি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে তিনটি ব্লকের ব্যাপারেও তারা আপত্তি জানিয়েছে। এ অবস্থায় সাগরবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে বরং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর স্বার্থই রক্ষিত হবে, বাংলাদেশের নয়।
গ্যাসের মতো কয়লা অনুসন্ধান ও খনি উন্নয়নের বিপুল মূলধনী বিনিয়োগের জন্য উত্তোলিত কয়লার বাজারজাতকরণও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সে জন্য খনি উন্নয়ন চুক্তিতে কয়লা রপ্তানির সুযোগ রাখা আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ‘প্রথম অধিকার’ নিশ্চিত করা আছে। সরকার অনাগ্রহী বা অপারগতা প্রকাশ করলেই কেবল তৃতীয় পক্ষ বা দেশের কাছে রপ্তানির সুযোগ আসবে। তবে বর্তমানে দেশে জ্বালানির বিপুল অভ্যন্তরীণ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানির প্রশ্নটি প্রায় অবান্তর। তা ছাড়া কয়লা রপ্তানির জন্য দেশে অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। রেল উন্নয়নের পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে কয়লা হ্যান্ডলিং সুবিধা-সংবলিত টার্মিনাল স্থাপন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজারে উত্তোলিত কয়লা বাজারজাতকরণের নিশ্চয়তা পেলে কোনো বিনিয়োগকারীই রপ্তানির জন্য অবকাঠামো খাতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। তবে এ ধরনের বিনিয়োগ দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক বিবেচিত হতে পারে। দেশের মজুদ কয়লা আমাদের ভবিষ্যত্ চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অবকাঠামো সুবিধা থাকলে প্রয়োজন অনুসারে কয়লা আমদানি বা রপ্তানি দুটিই ভাবা যেতে পারে। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহারকারী দেশ চীন ও ভারত নিজেদের সুবিধা ও চাহিদা মোতাবেক কয়লা আমদানি ও রপ্তানি দুটোই করছে। ভারতকে বর্তমান অর্থবছরেই প্রায় ৭০ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে এবং ২০১১-১২ সাল নাগাদ তা ২০০ মিলিয়ন টনের বেশি ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে।
প্রাথমিক জ্বালানির অভাবে দেশ আজ বিদ্যুত্ উত্পাদনে হিমশিম খাচ্ছে। একক জ্বালানি-নির্ভরতার কারণে দেশে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুত্ ও গ্যাসসংকটে নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না, পুরোনো কারখানাগুলোতেও উত্পাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। জনদুর্ভোগ চরমে। গ্যাসের অভাবে বর্তমানে বিদ্যুত্ উত্পাদন প্রায় ৬০০ মেগাওয়াটের মতো হ্রাস পেলেও বিকল্প জ্বালানির অভাবে অসহায় সরকারকে নতুন করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে বিদ্যুত্ ও গ্যাসসংকট উভয়ই প্রবল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবানুগ পদ্ধতিতে সময়মতো দেশের কয়লা সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হলে এরই মধ্যে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের মতো প্রাথমিক জ্বালানি পাওয়া যেত। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে আরও ১৫০০-২০০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন করা যেত। ফলে গ্যাসের অধিকতর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত হতো। কিন্তু কয়লা খাত উন্নয়নবিরোধী সক্রিয় প্রচারণা ও বিরোধিতার ফলে এ ক্ষেত্রেও এক ধরনের স্থবিরতা ও সিদ্ধান্তহীনতা বিরাজ করছে। মনে রাখা ভালো, জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন ক্রমেই যেভাবে জ্বালানি সম্পদ উন্নয়নবিরোধী ও বাস্তব পৃথিবীর নিয়মের বিরোধিতা করছে, তাতে দেশের জ্বালানি প্রাপ্যতা আরও দুরূহ হবে এবং সর্বোপরি জ্বালানি ও পণ্যমূল্য উভয়ই দুর্লভ হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ১০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ বি এম মূসার লেখায় উত্থাপিত প্রসঙ্গের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই। জনগণ আমদানি-রপ্তানি বুঝে না, তারা চায় বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ। চায় ঘরের চুলায় গ্যাস, শিল্পকারখানায় গ্যাস। এ জন্য জনগণ রাস্তায় নামতেও দ্বিধা করবে না। এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি করতে হবে নির্বাচিত সরকারকেই, কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীকে নয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও সরকারের। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে গ্যাস, কয়লাসহ দেশীয় সব জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়ন বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপাত তা অপ্রিয় হলেও। সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুত্ খাতের প্রকৃত চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। অন্যথায় জ্বালানি ও বিদ্যুত্ খাতের বর্তমান সংকট ভবিষ্যতে আরও তীব্র হবে। এ জন্য জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হতে পারে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতের আমাদের অনেক অর্জনও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সেটা নিশ্চয় আমরা কেউ চাই না।
জোবায়ের জামান: ভূতত্ত্ববিদ।
No comments