তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নতুন বিতর্ক -বদিউল আলম মজুমদার
কয়েক মাস থেকে শোনা যাচ্ছিল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে আগ্রহী। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে আলাপ-আলোচনাও চলে আসছে। প্রথম আলোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন (২ সেপ্টেম্বর ২০০৯) থেকে মনে হচ্ছে, সরকার এ ব্যাপারে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেওয়া শুরু করেছে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এ প্রস্তুতির অংশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এ নিয়ে সারা দেশে একটি তুমুল বিতর্ক হওয়া আবশ্যক। একটি জাতীয় মতৈক্যের ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা প্রচলিত হয়, তাই এর বিলুপ্তির জন্যও আরেকটি জাতীয় মতৈক্য আবশ্যক।
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের সময়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে তিন জোটের ‘যুক্ত ঘোষণা’য় প্রথমবারের মতো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি ওঠে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে এমন একটি সরকার গঠিত হয়। একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালোভাবে ওঠে ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কারচুপি এবং তা ঠেকাতে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর তুমুল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একতরফা নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে একটি ‘নির্বাচিত’ সরকার তার মেয়াদ শেষে একজন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি ‘অনির্বাচিত’ উপদেষ্টা পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিধান করা হয়, যা গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের ওপর অনাস্থারই প্রতিফলন। উপরন্তু এ ব্যবস্থার ফলে রাজনৈতিক দলগুলো ‘দায়িত্বহীন’ আচরণে উত্সাহিত হয় এ ধারণা থেকে যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব—তাদের নয়। নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করার লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বৃদ্ধি, দলের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদান প্রভৃতি এমন আচরণেরই প্রতিফলন। সর্বোপরি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে উচ্চ আদালত দলীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। এসব কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের গণতান্ত্রিক অবকাঠামো ও সংস্কৃতিতে গুরুতর ক্ষতি সাধন করেছে। তাই রাষ্ট্রে একটি সত্যিকারের কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির কোনো বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা (আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫) গ্রন্থে তিন মেয়াদের পর এর বিলুপ্তির কথা বলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমরা আগামী তিনটি নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চেয়েছি, যাতে করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত ত্রুটি রয়েছে, ধীরে ধীরে তা সংস্কার ও ত্রুটিমুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে পারি।’ অর্থাত্ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তির কথা বলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এসব সংস্কার এখনো হয়নি এবং অতীতের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে হবে বলেও আস্থা রাখা দুরূহ।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করাসহ একটি বলিষ্ঠ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির প্রভাবে এবং এর বিহিতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে পরবর্তীকালে আমাদের পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে, যার প্রেক্ষাপটে জারি হয় জরুরি অবস্থা এবং সৃষ্টি হয় প্রায় দুই বছরের আরেকটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সরকারের আমলে, এমনকি তার আগ থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় জোট নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলের সংস্কার ও প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার দাবি করে আসছিল। শেখ হাসিনা ১৫ জুলাই ২০০৫ তারিখে একটি সংবাদ সম্মেলনে জোটের পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাবগুলো প্রথম জাতির সামনে তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত মহাজোটের মহাসমাবেশে ২৩ দফা ‘অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি’ প্রকাশের মাধ্যমে এসব সংস্কার প্রস্তাবের প্রতি পুনরায় সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এসব প্রস্তাব সংসদেও উত্থাপন করেন।
পরবর্তীকালে পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২০০৭ সালের শেষ দিকে অনেকগুলো মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করা, নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংস্কারের ব্যাপারে এসব মতবিনিময় সভায় কতগুলো মতৈক্যও সৃষ্টি হয়। আরও মতৈক্য সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক দলের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পক্ষে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, দলের প্রত্যেক স্তরের কমিটিতে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিলুপ্তিকরণ, দলের তৃণমূলের কমিটিগুলোর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে দলের মনোনয়ন চূড়ান্তকরণ প্রভৃতি শর্ত সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন এসব সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক দলগুলো এসব শর্ত অমান্য করলে নির্বাচন কমিশনকে নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারেও মতৈক্য সৃষ্টি হয়। এর পর সংস্কার প্রস্তাবগুলো একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার অধীনে ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নির্বাচিত সরকারের আমলে নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনে অধ্যাদেশটি অনুমোদনকালে এতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। নিবন্ধনের উপরিউক্ত শর্তগুলো না মানলে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা রহিতকরণ ছিল যার অন্যতম। অর্থাত্ এ পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে একটি সাক্ষীগোপাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত মেনে না চললে কিংবা যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হলে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার থাকবে না। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি তাদের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে নিবন্ধনের শর্তগুলো প্রায় পুরোপুরি উপেক্ষা করেছে। অর্থাত্ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নব্বইয়ের পর আবারও তাদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ভঙ্গ করল। নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়িত করে শক্তিশালী করার পরিবর্তে আরও দুর্বল করা হলো। তাই রাজনৈতিক দলগুলো আসলেই সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগ্রহী কি না, তা নিয়ে নাগরিকদের মনে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতীতে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, এখন আবার সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়িত করার কথা বলছে। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন: ক. ক্ষমতাসীন সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশ্নাতীত নিরপেক্ষতা; খ. রাজনৈতিক দলগুলোর সদাচরণ; গ. নাগরিক সচেতনতা ও নাগরিক সমাজের সোচ্চার ভূমিকা; ঘ. প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন; ঙ. যথাযথ আইনি কাঠামো; চ. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, পক্ষপাতহীন আচরণ ও দক্ষতা প্রভৃতি।
অর্থাত্ নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী হলেই চলবে না, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আরও অনেকগুলো উপাদান আবশ্যক। প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও সহযোগিতা এসবের অন্যতম। সারা দেশে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রায় ১০ লাখ ব্যক্তির সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া এত বিরাট জনবল সংগঠিত করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়—এত লোকবল কমিশনের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া অসম্ভব। আর এ বিরাট সহায়ক শক্তির নিরপেক্ষতা নির্ভর করবে ক্ষমতাসীন সরকারের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো থেকে এ বিষয়ে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। পর্যবেক্ষকদের মতে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হলেও, নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে ২২ জানুয়ারি ২০০৯ অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন ছিল সমস্যাসংকুল। যেসব কর্মকর্তা জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন, তাঁরাই উপজেলা নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ আচরণ করেননি বা করতে পারেননি। এ ছাড়া অনিয়মের তদন্তকালে তাঁরা নিরপেক্ষভাবে সাক্ষ্য দিতেও পারেননি।
উপরন্তু নির্বাচনকালে কোনোরূপ অন্যায় বা অনিয়ম লক্ষ করলে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু এই নির্দেশ পরিপূর্ণভাবে প্রতিপালনের জন্য সরকারের আন্তরিকতা আবশ্যক। আবশ্যক প্রশাসনিক পদক্ষেপ। কর্মকর্তারা নির্দেশ অমান্য করলে বাস্তবে কমিশনের তেমন কিছুই করার থাকে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর সদাচরণ ছাড়াও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল ছলে-বলে-কৌশলে নির্বাচনে জিততে বদ্ধপরিকর হলে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও টাকার খেলায় লিপ্ত হলে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন ও সবচেয়ে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। বস্তুত রাজনৈতিক দলের অসদাচরণের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সৃষ্টি। এ ছাড়া সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও সহযোগিতা। উদাহরণস্বরূপ, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০ জন প্রার্থীর ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত কমিশনের সিদ্ধান্ত পাল্টে দেন। দণ্ড পাওয়া ব্যক্তি, ঋণখেলাপি কিংবা অন্যান্য অযোগ্যতার কারণে কমিশন কর্তৃক মনোনয়নপত্র বাতিল করা হলেও, তাঁদের অনেকে আদালতের হস্তক্ষেপের ফলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান এবং বিজয়ীও হন।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন একটি বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত দ্বীপে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে না। কমিশনের কার্যক্রম পারিপার্শ্বিকতা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যেমন—উচ্চ আদালত নিরপেক্ষ না হলে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে কমিশনের পক্ষে এককভাবে স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। ফলে একটি সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে না উঠলে কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা আকাশকুসুম কল্পনা বই কিছু নয়।
তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নিই যে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী কমিশন এককভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে, কিন্তু সে নির্বাচনী ফলাফল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরাজিত দল সব সময়ই কারচুপির অভিযোগ তুলেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ফলাফল প্রত্যাখ্যানও করেছে। একটি জাতীয় মতৈক্য ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলে নির্বাচনী ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও নতুন জটিলতার সৃষ্টি হতে বাধ্য।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই এর বিলুপ্তি অপরিহার্য। তবে তা করার আগে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন ও শক্তিশালী করা আবশ্যক। কিন্তু এ আবশ্যকীয় কাজটিই যথেষ্ট নয়। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো সদাচরণ না করলে এবং ক্ষমতাসীন সরকার পরিপূর্ণভাবে সহায়তা না করলে সবচেয়ে শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভবপর নয়। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে আমরা এর আলামত কিছুটা দেখেছি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির আগে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়িত ও শক্তিশালী করা জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের সংস্কার। প্রয়োজন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। আরও প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা।
প্রসঙ্গত, অনেকের ধারণা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান না থাকলে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি হতো, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতো না। অনেকে আরও ধারণা করেন, একটি জাতীয় মতৈক্য ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলে এই ইস্যুতে নির্বাচন বয়কটের আশঙ্কাও থেকে যায়। ফলে আমাদের পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের সময়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে তিন জোটের ‘যুক্ত ঘোষণা’য় প্রথমবারের মতো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি ওঠে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে এমন একটি সরকার গঠিত হয়। একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালোভাবে ওঠে ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কারচুপি এবং তা ঠেকাতে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর তুমুল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একতরফা নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে একটি ‘নির্বাচিত’ সরকার তার মেয়াদ শেষে একজন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি ‘অনির্বাচিত’ উপদেষ্টা পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিধান করা হয়, যা গণতান্ত্রিক চেতনা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অসংগতিপূর্ণ। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের ওপর অনাস্থারই প্রতিফলন। উপরন্তু এ ব্যবস্থার ফলে রাজনৈতিক দলগুলো ‘দায়িত্বহীন’ আচরণে উত্সাহিত হয় এ ধারণা থেকে যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব—তাদের নয়। নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করার লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বৃদ্ধি, দলের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদান প্রভৃতি এমন আচরণেরই প্রতিফলন। সর্বোপরি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে উচ্চ আদালত দলীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা বিচার বিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। এসব কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের গণতান্ত্রিক অবকাঠামো ও সংস্কৃতিতে গুরুতর ক্ষতি সাধন করেছে। তাই রাষ্ট্রে একটি সত্যিকারের কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির কোনো বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা (আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫) গ্রন্থে তিন মেয়াদের পর এর বিলুপ্তির কথা বলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমরা আগামী তিনটি নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চেয়েছি, যাতে করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত ত্রুটি রয়েছে, ধীরে ধীরে তা সংস্কার ও ত্রুটিমুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে পারি।’ অর্থাত্ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তির কথা বলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এসব সংস্কার এখনো হয়নি এবং অতীতের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে হবে বলেও আস্থা রাখা দুরূহ।
নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করাসহ একটি বলিষ্ঠ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির প্রভাবে এবং এর বিহিতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে পরবর্তীকালে আমাদের পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে, যার প্রেক্ষাপটে জারি হয় জরুরি অবস্থা এবং সৃষ্টি হয় প্রায় দুই বছরের আরেকটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সরকারের আমলে, এমনকি তার আগ থেকেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় জোট নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলের সংস্কার ও প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার দাবি করে আসছিল। শেখ হাসিনা ১৫ জুলাই ২০০৫ তারিখে একটি সংবাদ সম্মেলনে জোটের পক্ষ থেকে সংস্কার প্রস্তাবগুলো প্রথম জাতির সামনে তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত মহাজোটের মহাসমাবেশে ২৩ দফা ‘অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি’ প্রকাশের মাধ্যমে এসব সংস্কার প্রস্তাবের প্রতি পুনরায় সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এসব প্রস্তাব সংসদেও উত্থাপন করেন।
পরবর্তীকালে পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২০০৭ সালের শেষ দিকে অনেকগুলো মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও স্বাধীন করা, নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংস্কারের ব্যাপারে এসব মতবিনিময় সভায় কতগুলো মতৈক্যও সৃষ্টি হয়। আরও মতৈক্য সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক দলের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পক্ষে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, দলের প্রত্যেক স্তরের কমিটিতে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন বিলুপ্তিকরণ, দলের তৃণমূলের কমিটিগুলোর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে দলের মনোনয়ন চূড়ান্তকরণ প্রভৃতি শর্ত সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন এসব সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক দলগুলো এসব শর্ত অমান্য করলে নির্বাচন কমিশনকে নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারেও মতৈক্য সৃষ্টি হয়। এর পর সংস্কার প্রস্তাবগুলো একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার অধীনে ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নির্বাচিত সরকারের আমলে নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনে অধ্যাদেশটি অনুমোদনকালে এতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। নিবন্ধনের উপরিউক্ত শর্তগুলো না মানলে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা রহিতকরণ ছিল যার অন্যতম। অর্থাত্ এ পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে একটি সাক্ষীগোপাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত মেনে না চললে কিংবা যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হলে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার থাকবে না। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি তাদের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে নিবন্ধনের শর্তগুলো প্রায় পুরোপুরি উপেক্ষা করেছে। অর্থাত্ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নব্বইয়ের পর আবারও তাদের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ভঙ্গ করল। নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়িত করে শক্তিশালী করার পরিবর্তে আরও দুর্বল করা হলো। তাই রাজনৈতিক দলগুলো আসলেই সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগ্রহী কি না, তা নিয়ে নাগরিকদের মনে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতীতে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, এখন আবার সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়িত করার কথা বলছে। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয়, কিন্তু যথেষ্ট নয়। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন: ক. ক্ষমতাসীন সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশ্নাতীত নিরপেক্ষতা; খ. রাজনৈতিক দলগুলোর সদাচরণ; গ. নাগরিক সচেতনতা ও নাগরিক সমাজের সোচ্চার ভূমিকা; ঘ. প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন; ঙ. যথাযথ আইনি কাঠামো; চ. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, পক্ষপাতহীন আচরণ ও দক্ষতা প্রভৃতি।
অর্থাত্ নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী হলেই চলবে না, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আরও অনেকগুলো উপাদান আবশ্যক। প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা ও সহযোগিতা এসবের অন্যতম। সারা দেশে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রায় ১০ লাখ ব্যক্তির সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া এত বিরাট জনবল সংগঠিত করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়—এত লোকবল কমিশনের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া অসম্ভব। আর এ বিরাট সহায়ক শক্তির নিরপেক্ষতা নির্ভর করবে ক্ষমতাসীন সরকারের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো থেকে এ বিষয়ে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। পর্যবেক্ষকদের মতে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হলেও, নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে ২২ জানুয়ারি ২০০৯ অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন ছিল সমস্যাসংকুল। যেসব কর্মকর্তা জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন, তাঁরাই উপজেলা নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ আচরণ করেননি বা করতে পারেননি। এ ছাড়া অনিয়মের তদন্তকালে তাঁরা নিরপেক্ষভাবে সাক্ষ্য দিতেও পারেননি।
উপরন্তু নির্বাচনকালে কোনোরূপ অন্যায় বা অনিয়ম লক্ষ করলে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু এই নির্দেশ পরিপূর্ণভাবে প্রতিপালনের জন্য সরকারের আন্তরিকতা আবশ্যক। আবশ্যক প্রশাসনিক পদক্ষেপ। কর্মকর্তারা নির্দেশ অমান্য করলে বাস্তবে কমিশনের তেমন কিছুই করার থাকে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর সদাচরণ ছাড়াও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল ছলে-বলে-কৌশলে নির্বাচনে জিততে বদ্ধপরিকর হলে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও টাকার খেলায় লিপ্ত হলে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন ও সবচেয়ে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। বস্তুত রাজনৈতিক দলের অসদাচরণের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সৃষ্টি। এ ছাড়া সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও সহযোগিতা। উদাহরণস্বরূপ, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০ জন প্রার্থীর ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত কমিশনের সিদ্ধান্ত পাল্টে দেন। দণ্ড পাওয়া ব্যক্তি, ঋণখেলাপি কিংবা অন্যান্য অযোগ্যতার কারণে কমিশন কর্তৃক মনোনয়নপত্র বাতিল করা হলেও, তাঁদের অনেকে আদালতের হস্তক্ষেপের ফলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান এবং বিজয়ীও হন।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন একটি বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত দ্বীপে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে না। কমিশনের কার্যক্রম পারিপার্শ্বিকতা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যেমন—উচ্চ আদালত নিরপেক্ষ না হলে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে কমিশনের পক্ষে এককভাবে স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। ফলে একটি সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে না উঠলে কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা আকাশকুসুম কল্পনা বই কিছু নয়।
তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নিই যে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী কমিশন এককভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে, কিন্তু সে নির্বাচনী ফলাফল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরাজিত দল সব সময়ই কারচুপির অভিযোগ তুলেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ফলাফল প্রত্যাখ্যানও করেছে। একটি জাতীয় মতৈক্য ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলে নির্বাচনী ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও নতুন জটিলতার সৃষ্টি হতে বাধ্য।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই এর বিলুপ্তি অপরিহার্য। তবে তা করার আগে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন ও শক্তিশালী করা আবশ্যক। কিন্তু এ আবশ্যকীয় কাজটিই যথেষ্ট নয়। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো সদাচরণ না করলে এবং ক্ষমতাসীন সরকার পরিপূর্ণভাবে সহায়তা না করলে সবচেয়ে শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভবপর নয়। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে আমরা এর আলামত কিছুটা দেখেছি। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির আগে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়িত ও শক্তিশালী করা জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের সংস্কার। প্রয়োজন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। আরও প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা।
প্রসঙ্গত, অনেকের ধারণা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান না থাকলে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি হতো, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতো না। অনেকে আরও ধারণা করেন, একটি জাতীয় মতৈক্য ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলে এই ইস্যুতে নির্বাচন বয়কটের আশঙ্কাও থেকে যায়। ফলে আমাদের পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
No comments