ভারত-কানাডা বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা কে এই লরেন্স বিষ্ণোই?

ভারতের আহমেদাবাদের সবরমতি সেন্ট্রাল জেলে বন্দী দুর্ধর্ষ গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোই ভারত-কানাডা কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে একটি নতুন কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কানাডায় অপরাধমূলক কার্যক্রম চালানোর জন্য তার গ্যাংয়ের সঙ্গে ভারত সরকারের যোগসাজশের অভিযোগ তুলেছে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি)। যদিও তারা কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সরবরাহ করেনি। সালমান খানকে খুনের হুমকি, সিধু মুসেওয়ালার নৃশংস হত্যাকাণ্ড, দক্ষিণ দিল্লির জিম মালিককে গুলি করে খুন এবং এনসিপি নেতা বাবা সিদ্দিকি হত্যা, এই সবকটা ঘটনা এক সুতোয় গাঁথা। আর সেই সুতোর নাম লরেন্স বিষ্ণোই। জেল বন্দী হলেও লরেন্স বিষ্ণোইকে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না। শুধু একটা মোবাইল ফোন আর ভিপিএন কানেকশনই তার হাতিয়ার। জেল থেকেই চালাচ্ছেন পুরো গ্যাং। পুলিশ ও প্রশাসনের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে জেলবন্দী এই আসামি।

পাঞ্জাবের ফেরজোপুর জেলার ধাতারানওয়ালি গ্রামের এক ধনী কৃষক পরিবারের সন্তান লরেন্স বিষ্ণোই। বর্তমানে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা। বর্তমানে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের বয়স ৩১ বছর। ২০১০ সালে তিনি চণ্ডীগড় কলেজে ভর্তি হন। কিছুদিনের মধ্যেই যোগ দেন ছাত্র রাজনীতিতে। ২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। ২০১০ সালের এপ্রিলে খুনের চেষ্টার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রথম ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়। একই সঙ্গে বেআইনি অনুপ্রবেশের অভিযোগে দায়ের হয় এফআইআর। দুটি মামলাই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ২০১২ সালে জেল হয় বিষ্ণোইয়ের। মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অব অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্টে তাকে তিহাড়ে স্থানান্তর করা হয়।

২০১৩ সালে তিনি সরকারি কলেজ নির্বাচনের জয়ী প্রার্থী এবং লুধিয়ানা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে গুলি করে খুন করেন। বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতাদের খুন, চাঁদাবাজিসহ এক ডজনের বেশি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তার গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মদ ও অস্ত্র চোরাচালানের কারবার চালানোর অভিযোগও রয়েছে। সীমান্ত চোরাচালানের একটি মামলায় তাকে গুজরাটে নিয়ে যায় এটিএস। এনআইএ-এর বক্তব্য অনুযায়ী, বিষ্ণোইয়ের গ্যাংয়ে ৫টি রাজ্যে ৭০০-এর বেশি শুটার রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ শুটার পাঞ্জাবের।

২০২২ সালের ২৯ মে পাঞ্জাবি র‌্যাপার সিধু মুজ ওয়ালার হত্যাকাণ্ডে যুক্ত হয়ে প্রথম আলোচনায় আসে বিষ্ণোই। মুজওয়ালা ভারতের বিরোধী কংগ্রেস দলের সদস্যও ছিলেন। বিষ্ণোইয়ের সহযোগীরা হত্যার দায় স্বীকার করে। গত সপ্তাহে মুম্বাইয়ের অভিজাত বান্দ্রা এলাকায় ৬৬ বছর বয়সী মুসলিম রাজনীতিবিদ বাবা সিদ্দিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে বিষ্ণোইয়ের দল। সিদ্দিক মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের তিনবারের বিধায়ক এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বলিউড সেলিব্রিটিদের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে অভিনেতা সালমান খানের সাথে।

সিদ্দিকের হত্যার দায় স্বীকার করে বিষ্ণোইয়ের একজন সহযোগী এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, আমাদের কারো সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু যে কেউ সালমান খানকে সাহায্য করেন ... তারা সাবধানে থাকুন। ১৯৯৮ সালে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাজস্থানে একটি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় সালমান খান দু’টি হরিণ হত্যা করেছিলেন। সেই থেকে বিষ্ণোইয়ের সঙ্গে তার বিরোধ, সেটি প্রায় ২৬ বছর আগের। বিষ্ণোই ধর্মীয় সম্প্রদায় হরিণকে পবিত্র বলে মনে করে।

ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত ডোভাল সিঙ্গাপুরে তার কানাডিয়ান প্রতিপক্ষের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করেছেন। যেখানে তারা কানাডায় খালিস্তানপন্থী হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যায় বিষ্ণোই গ্যাংয়ের কথিত জড়িত থাকার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ভারত দৃঢ়ভাবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। নিজ্জার হত্যায় নয়াদিল্লির জড়িত থাকার অটোয়ার দাবিকে ‘রাজনৈতিক লাভের জন্য ভারতকে বদনাম করার একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল’ হিসেবে খারিজ করে দিয়েছে তারা। কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ভারত একটি বড় ভুল করেছে। আমরা কানাডার মাটিতে কানাডিয়ান নাগরিকদের হুমকি এবং হত্যা করার পেছনে বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি কখনই বরদাস্ত করব না। তবে ভারত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। একই সঙ্গে দাবির স্বআঃপক্ষে প্রমাণ চেয়ে অটোয়াকে চ্যালেঞ্জ করেছে।  

শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদ বা তথাকথিত খালিস্তান আন্দোলনের ইস্যুটি কয়েক দশক ধরে ভারত-কানাডার সম্পর্কের কাঁটা হয়ে আছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো জানাচ্ছে, ১৯৮০-এর দশকে ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো দমন-পীড়ন পাঞ্জাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেসামরিক শিখদের বিচারবহির্ভূত হত্যার দিকে পরিচালিত করেছিল। অনেক শিখ পরিবার সেইসময় কানাডায় চলে যায়। ১৯৮৫ সালে কট্টরপন্থী শিখ বিদ্রোহীরা কানাডার মন্ট্রিল থেকে লন্ডন এবং নয়াদিল্লি হয়ে ভারতের মুম্বাইগামী এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানকে উড়িয়ে দেয়। আটলান্টিক মহাসাগরের উপর মধ্য আকাশে বিমান বিস্ফোরণে ৩২৯ জনের সবাই নিহত হয়েছিলেন। যাদের বেশিরভাগই ছিলেন কানাডিয়ান নাগরিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খালিস্তান আন্দোলন কানাডাসহ কয়েকটি প্রবাসী শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের তদন্ত সংস্থা একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী সুখদুল সিংকে ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত করে। তালিকভুক্ত করার একদিনেরও কম সময়ের মধ্যে কানাডার উইনিপেগ শহরে বন্দুকের গুলিতে তিনি নিহত হন।

এরপর বিষ্ণোইয়ের দল এই হত্যার দায় স্বীকার করে তাকে ‘মাদক আসক্ত’ বলে উল্লেখ করে। তারা বলে, ‘আমরা আমাদের শত্রুদের খুঁজে বের করব, তারা যেখানেই থাকুক না কেন।’

এদিকে কানাডা সরকার বিষ্ণোইকে তাদের দেশের হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ রাখার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। নয়াদিল্লি এই সপ্তাহে ‘দৃঢ়ভাবে’ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

সূত্র: আলজাজিরা

mzamin

No comments

Powered by Blogger.