হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
সকাল ১১টা ২০ মিনিটের দিকে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর এডভোকেট তাজুল ইসলাম শুনানি শুরু করেন। শুনানির শুরুতে ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে দেশ ত্যাগকারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। একইসঙ্গে অপর একটি অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। এ সময় চিফ প্রসিকিউটর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে গুম, খুন, তথ্য প্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার পরিসংখ্যান, শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের হত্যা, আয়নাঘর, কানাডার বেগমপাড়াসহ অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান এবং সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনে বল প্রয়োগের তথ্য তুলে ধরেন। চিফ প্রসিকিউটর আদালতকে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্তে গণহত্যার প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আসামিগণ প্রভাবশালী। এখনো দেশের বিভিন্নস্থানে আসামির লোকজন বিভিন্ন পজিশনে আছে। তাই আলামত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া মামলার তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করছি।
একপর্যায়ে আদালত তার কাছে জানতে চান, রাষ্ট্রীয়ভাবে আসামির অবস্থান জানেন কিনা? জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, না। তারপর আদালত চিফ প্রসিকিউটরের আবেদন মঞ্জুর করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। একইসঙ্গে ১৮ই নভেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ রেখে এই সময়ের মধ্যে আসামিদের আদালতে হাজির করতে বলেন।
পরে তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম। আদালত আমাদের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছেন। ১৮ই নভেম্বরের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করে এই আদালতে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ বলেন, আমরা দু’টি পিটিশন দাখিল করেছি। প্রথমটিতে শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন এবং অপরটিতে ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে। ট্রাইব্যুনাল আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং ১৮ই নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন।
শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন। কোন প্রক্রিয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও আন্তর্জাতিক আইনে যেসব ব্যবস্থা আছে সেই সব প্রক্রিয়া এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করেই এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে ওবায়দুল কাদের ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক, শেখ হাসিনার ছেলে ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তবে তদন্তের স্বার্থে এবং তাদের গ্রেপ্তার নিশ্চিত করার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে চিফ প্রসিকিউটর জানিয়েছেন। অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, মক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা ও শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ, পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার, প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক র্যাব ডিজি হারুন অর রশিদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের নাম গ্রেপ্তারি পরোয়ানার তালিকায় রয়েছে।
আদালতের আদেশের পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আজকে জুলাই-আগস্টে পরিচালিত ম্যাসাকার, হত্যা, গণতহ্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করেছিলেন, তাদের প্রধান যিনি ছিলেন, সাবেক প্রধান শেখ হাসিনা, তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আমরা আজকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদনে আমরা জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, এই সব কিছুর বিস্তারিত বর্ণনা আমরা ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপন করেছি। একইসঙ্গে এই যে একটি সরকার কীভাবে দানবীয় সরকারে পরিণত হলো। কীভাবে নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্রদের গুলি করে মারলো। তার প্রেক্ষাপটও এই আদালতের কাছে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম এই অপরাধগুলো এত বিস্তৃীত মাত্রায় সারা বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে। এই অপরাধের আসামি যারা, তারা অসম্ভব রকমের প্রভাবশালী, তাদের গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করাটা কঠিন। কারণ তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ, এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে সাহসী হচ্ছেন না। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানিয়েছিলাম। ট্রাইব্যুনাল আবেদন মঞ্জুর করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। ১৮ই নভেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে এই ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় আরেকটি আবেদনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হয়েছে। সেটিও মঞ্জুর করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তাজুল ইসলাম বলেন, আপনারা জানেন এই অপরাধীরা এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছেন। সে কারণে তাদের নাম প্রকাশ করছি না। আমাদের তদন্তের স্বার্থে এবং তাদের গ্রেপ্তার নিশ্চিত করার স্বার্থে আমরা তাদের নাম প্রকাশ করছি না।
তিনি বলেন, ১৮ই নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের ধার্য তারিখ। তবে গ্রেপ্তার করা মাত্রই আসামিদের ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা যাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে সবার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রথম আবেদনে শেখ হাসিনা এবং দ্বিতীয় আবেদনে ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সবার নাম এখানে উল্লেখ করা হয়নি। আমরা ধীরে ধীরে আরও তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে বাকিদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আজকে আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি। তথ্য প্রমাণ প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
আসহাবুল ইয়ামিন হত্যাকাণ্ড: সাভারে এমআইএসটি’র শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনকে হত্যার ঘটনা ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনের নিথর দেহ টেনে নিচে ফেলার ঘটনা আদালতে বর্ণনা করেন তাজুল ইসলাম। গাড়ি টান দেয়ার সময় চাকার নিচে পড়বে বলে দেহটি টেনে দূরে সরানো হয়। তখনো সেই দেহটি নড়তে দেখা যায়। এমন একটি লোমহর্ষক ভিডিও ভাইরাল হয় নেট দুনিয়ায়। তাজুল ইসলাম বলেন, ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন। কয়েকজন সাংবাদিকও উস্কানি দেন। সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলা হয়। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়ে গণহত্যার তথ্য আড়াল করা হয়, সঠিক তথ্য জানতে বাধা দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, গণহত্যার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে।
No comments