চার আনা নিয়ে ঢাকায় আসা ছেলেটি by পিয়াস সরকার
পঞ্চাশের
মন্বন্তর। চলছে দুর্ভিক্ষ। কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলায় ১৯৪৬ সালের
ফেব্রুয়ারি মাসে দরিদ্র ঘরে জন্ম নেয় এক শিশু। নাম তার বদিউল আলম। এই
একমাত্র সন্তানটি বাবা-মা’র অনেক প্রতীক্ষিত সন্তান।
ড. বদিউল আলম মজুমদার আজ কর্মগুণে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার-নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি। বর্তমানে তিনি ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়া নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
তার বাবা হাইস্কুল শেষ করতে পারেননি অর্থনৈতিক কারণে। বাবা কাজ করতেন নবাব ফয়জুন্নেসার এস্টেটে নায়েব হিসেবে। মায়ের জ্ঞান নাম-স্বাক্ষর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ১৯৫৩ সালে গ্রামে ক্লাস টু’তে প্রথম লেখাপড়া শুরু করেন। এরপর লাকসাম হাইস্কুলে ভর্তি হন ক্লাস সেভেনে। আর নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। বাণিজ্য অনুষদে।
বদিউল আলম স্কুলজীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তার পাশের রুমে থাকতেন তোফায়েল আহমেদ। আব্দুল কুদ্দুস মাখন, খন্দকার মোশারফ হোসেন, মইন খান ছিলেন ব্যাচমেট। এখনকার জহুরুল হক হল তখন ছিল ইকবাল হল। সেই হলেই থাকতেন তিনি।
তিনি বলেন, আমি ঢাকায় যখন আসি তখন আমার পকেটে মাত্র ৪ আনা ছিল। হলে ক্যান্টিনের ছেলেদের পড়াতেন। এর মাধ্যমে বিনা পয়সায় খাবার খেতে পারতেন। পাশাপাশি করতেন টিউশনি।
বদিউল আলমের বাবা মারা যান ১৯৬৪ সালে। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে প্যারালাইসড হয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় পড়েছিলেন। এই সময় জায়গা-জমি বিক্রি করে করাতে হয় চিকিৎসা। নিজে চলার পাশাপাশি মাকেও পাঠাতেন টাকা।
তিনি হলে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিতত হন। ষাটের দশকের শেষ দিকে গণ-আন্দোলনের সময় ছিলেন ইকবাল হলের সাধারণ সম্পাদক। আন্দোলনে রাখেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। বলেন, এই হল থেকেই মূলত আন্দোলন পরিচালিত হতো। ১৯৬৮ সালে প্রথম চাকরি শিক্ষক হিসেবে কায়েদে আযম কলেজে। বর্তমানে যে কলেজের নাম শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ১৯৬৯ সালে। লেকচারার হিসেবে। আবার পরের বছরেই স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান আমেরিকায়। সেখানে করেন মাস্টার্স ও পিএইচডি।
আমেরিকায় যেতেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন। ছাত্র রাজনীতি করার কারণে আটকে যায় পাসপোর্ট। এসময় তাকে সহযোগিতা করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, প্রফেসর হাবিবুল্লাহসহ আরো অনেকে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার গিয়ে ‘ক্যালরিমন্ট গ্রাজুয়েট স্কুল’ থেকে মাস্টার্স করেন এবং এরপর ‘কেস ওয়েস্টার্ন রিভেন্স ইউনিভার্সিটি’ থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটোল ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও সেন্ট্রাল ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। পাশাপাশি তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’-তেও কনসালটেন্ট ছিলেন।
বিদেশে গিয়েও দেশের প্রতি ভালোবাসা অক্ষুণ্ন ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার রাজনৈতিক সদস্যসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য প্রচারণা চালান। ১৯৯১ সালে ড. বদিউল আলম মজুমদার দেশে আসেন ছুটিতে। ছুটিতে এসে সিদ্ধান্ত নেন দেশে থেকে যাবেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মার্ক টোয়েনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। ‘মানুষের জন্য দুটো দিন গুরুত্বপূর্ণ- যেদিন তার জন্ম হয় এবং আরেকটা দিন যেদিন সে অনুধাবন করে কেন তার জন্ম হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, আমি ওখানে ভালোই ছিলাম। ফুল টাইম প্রফেসর ছিলাম। আমি বাংলাদেশে ছুটিতে এসে বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি চাইলে বিভিন্ন দেশে যেতে পারতাম। আমি অনুধাবন করি আমার দেশের জন্য অনেক কিছু করার আছে। গাড়ি বাড়ি সবকিছু রেখে চার সন্তানকে নিয়ে পা রাখেন মাতৃভূমিতে। প্রথম স্ত্রী ’৮৩ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে তিনি আবার বিয়ে করেন।
দেশে এসে যোগ দেন ইউএসএআইডি’র একটি প্রজেক্টে প্রধান হিসেবে। তিনি বলেন, আমার সেসময় তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো। আমার ওপর বিভিন্ন চাপ ছিল। দুর্নীতি না করায় তাদের সঙ্গে সেই সম্পর্ক আর টিকে থাকেনি। এরপর তিনি ১৯৯৩ সালে হাঙ্গার প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হন। দারিদ্র্য দূর করাই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। ওই বছরের শেষের দিকে করেন উজ্জীবক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে দেখলাম অনেক মানুষ কাজ করছে। কেউ গাছ লাগাচ্ছে, কেউ অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, স্কুল গড়ে দিচ্ছে ইত্যাদি কাজে অংশগ্রহণ করতো।
আমরা দেখলাম তাদের মাধ্যমে অনেক কাজ হচ্ছে। তখন আমরা বেশ কিছু এলাকাকে হাঙ্গার ফ্রি জোন ঘোষণা করি। নীতি নির্ধারণে পরিবর্তন আনার জন্য ২০০২ সালে প্রফেসর মোজাফফর আহমেদসহ সৃষ্টি করলেন ‘সিটিজেন ফর ফেয়ার ইলেকশন’। ২০০৩ সালে স্থানীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সৎ মানুষ নির্বাচিত করার লক্ষ্যে প্রার্থীদের প্রোফাইল তৈরি করেন। তবে এতে অনেকইে তথ্য গোপন করেন। যার ফলে আমরা তাদের মুখোমুখি বসানোর ব্যবস্থা করি। এরপর আমদের উপলব্ধি হলো শুধু নির্বাচন নিয়ে কাজ করলে হবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ২০০৩ সালে আমরা প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে রাখি ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’।
সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচন নিয়ে বদিউল আলম মজুমদারের মূল্যায়ন, এই নির্বাচন নিয়ে তো ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। সবার জন্য সমসুযোগ সৃষ্টি হয়নি। অভিযোগ আছে নির্বাচনে কারচুপির। নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি নিরপেক্ষ আচরণ না করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। অভিযোগ আছে বিরোধীদল সমসুযোগ পায়নি। তাদের ওপর হামলা হয়েছে, মামলা হয়েছে এবং ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে বাধা দেয়াসহ আগের রাতে ব্যালটপেপার ভরে রাখার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও টিআইবি’র রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। আমি মনে করি, বর্তমান সরকারের উচিত আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার রদবদল হয় এটা আমাদের কাম্য। তা নাহলে আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবো। তিনি আরো বলেন, অভিযোগ আছে বহু লোক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারা ক্ষুব্ধ। তাদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ থেকে কেউ কেউ বিপদগামী হতে পারে।
ড. মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ অমিত সম্ভবনার দেশ। ১৯৭১ সালে আমাদের চেতনার জোয়ার ঘটেছিল। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। বাংলাদেশ ও কোরিয়া ১৯৭০-৭১ সালের দিকে একই অবস্থানে ছিল। তাদের মাথাপিছু আয় ও আমাদের মাথাপিছু আয় প্রায় একই ছিল ১শ’ ডলারের মতো। কিন্তু আমাদের এখনো ২ হাজার ছাড়ায়নি। তাদের এখন মাথাপিছু আয় ২৬-২৭ হাজার ডলার। বাংলাদেশ অনেক সম্পদশালী আর কোরিয়ার আছে কিছু নিম্নমানের কয়লামাত্র। বাংলাদেশের অনেক সম্পদ যেমন উর্বর মাটি। মিষ্টি পানি। উঠতি বয়সের কর্মক্ষম জনগণ। এছাড়াও আমারা কঠোর পরিশ্রমী, অল্পতে সন্তুষ্ট, বহু বিরূপ পরিবেশে রয়েছে কাজ করার ক্ষমতা। আমাদের দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে অনেক লোক অর্থ পাঠাচ্ছে। আমাদের নারীরা তৈরিপোশাক শিল্পে ও কৃষকরা ব্যাপক অবদান রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা সেই সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। এই সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের নীতিগত সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক স্বার্থপরতা, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, বিভক্তি, অপরাজনীতির কারণে এগিয়ে যেতে পারিনি। একটা বিভক্ত জাতি বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না।
দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের সাম্প্রতিক কার্যক্রমকে ইতিবাচক হিসেবেই তিনি দেখছেন। তিনি বলেন, দুদকের কাজ আরো বেগবান করতে হবে। অনেক দুর্নীতিবাজ তাদের আশপাশে রয়েছে। যদি কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হয়ে তবে, প্রথম ঘর থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তারাই এখন দলীয় নেতাদের মতো আচরণ করে। দলীয় নেতারাও সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এটা সুশাসনের জন্য বিরাট অন্তরায়। এসব বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয় সব দুর্নীতির ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। নিজের স্বপ্ন নিয়ে বলেন, আত্মনির্ভরশীল গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ। যেখানে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণ সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ পাবে- এটাই আমার আশা। আর এই প্রচেষ্টাতেই আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার আজ কর্মগুণে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার-নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি। বর্তমানে তিনি ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়া নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
তার বাবা হাইস্কুল শেষ করতে পারেননি অর্থনৈতিক কারণে। বাবা কাজ করতেন নবাব ফয়জুন্নেসার এস্টেটে নায়েব হিসেবে। মায়ের জ্ঞান নাম-স্বাক্ষর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ১৯৫৩ সালে গ্রামে ক্লাস টু’তে প্রথম লেখাপড়া শুরু করেন। এরপর লাকসাম হাইস্কুলে ভর্তি হন ক্লাস সেভেনে। আর নবাব ফয়জুন্নেসা কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর সুযোগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। বাণিজ্য অনুষদে।
বদিউল আলম স্কুলজীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তার পাশের রুমে থাকতেন তোফায়েল আহমেদ। আব্দুল কুদ্দুস মাখন, খন্দকার মোশারফ হোসেন, মইন খান ছিলেন ব্যাচমেট। এখনকার জহুরুল হক হল তখন ছিল ইকবাল হল। সেই হলেই থাকতেন তিনি।
তিনি বলেন, আমি ঢাকায় যখন আসি তখন আমার পকেটে মাত্র ৪ আনা ছিল। হলে ক্যান্টিনের ছেলেদের পড়াতেন। এর মাধ্যমে বিনা পয়সায় খাবার খেতে পারতেন। পাশাপাশি করতেন টিউশনি।
বদিউল আলমের বাবা মারা যান ১৯৬৪ সালে। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে প্যারালাইসড হয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় পড়েছিলেন। এই সময় জায়গা-জমি বিক্রি করে করাতে হয় চিকিৎসা। নিজে চলার পাশাপাশি মাকেও পাঠাতেন টাকা।
তিনি হলে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিতত হন। ষাটের দশকের শেষ দিকে গণ-আন্দোলনের সময় ছিলেন ইকবাল হলের সাধারণ সম্পাদক। আন্দোলনে রাখেন বলিষ্ঠ ভূমিকা। বলেন, এই হল থেকেই মূলত আন্দোলন পরিচালিত হতো। ১৯৬৮ সালে প্রথম চাকরি শিক্ষক হিসেবে কায়েদে আযম কলেজে। বর্তমানে যে কলেজের নাম শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন ১৯৬৯ সালে। লেকচারার হিসেবে। আবার পরের বছরেই স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান আমেরিকায়। সেখানে করেন মাস্টার্স ও পিএইচডি।
আমেরিকায় যেতেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন। ছাত্র রাজনীতি করার কারণে আটকে যায় পাসপোর্ট। এসময় তাকে সহযোগিতা করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, প্রফেসর হাবিবুল্লাহসহ আরো অনেকে। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার গিয়ে ‘ক্যালরিমন্ট গ্রাজুয়েট স্কুল’ থেকে মাস্টার্স করেন এবং এরপর ‘কেস ওয়েস্টার্ন রিভেন্স ইউনিভার্সিটি’ থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটোল ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও সেন্ট্রাল ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। পাশাপাশি তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’-তেও কনসালটেন্ট ছিলেন।
বিদেশে গিয়েও দেশের প্রতি ভালোবাসা অক্ষুণ্ন ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার রাজনৈতিক সদস্যসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য প্রচারণা চালান। ১৯৯১ সালে ড. বদিউল আলম মজুমদার দেশে আসেন ছুটিতে। ছুটিতে এসে সিদ্ধান্ত নেন দেশে থেকে যাবেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মার্ক টোয়েনের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। ‘মানুষের জন্য দুটো দিন গুরুত্বপূর্ণ- যেদিন তার জন্ম হয় এবং আরেকটা দিন যেদিন সে অনুধাবন করে কেন তার জন্ম হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, আমি ওখানে ভালোই ছিলাম। ফুল টাইম প্রফেসর ছিলাম। আমি বাংলাদেশে ছুটিতে এসে বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি চাইলে বিভিন্ন দেশে যেতে পারতাম। আমি অনুধাবন করি আমার দেশের জন্য অনেক কিছু করার আছে। গাড়ি বাড়ি সবকিছু রেখে চার সন্তানকে নিয়ে পা রাখেন মাতৃভূমিতে। প্রথম স্ত্রী ’৮৩ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে তিনি আবার বিয়ে করেন।
দেশে এসে যোগ দেন ইউএসএআইডি’র একটি প্রজেক্টে প্রধান হিসেবে। তিনি বলেন, আমার সেসময় তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো। আমার ওপর বিভিন্ন চাপ ছিল। দুর্নীতি না করায় তাদের সঙ্গে সেই সম্পর্ক আর টিকে থাকেনি। এরপর তিনি ১৯৯৩ সালে হাঙ্গার প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হন। দারিদ্র্য দূর করাই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। ওই বছরের শেষের দিকে করেন উজ্জীবক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে দেখলাম অনেক মানুষ কাজ করছে। কেউ গাছ লাগাচ্ছে, কেউ অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, স্কুল গড়ে দিচ্ছে ইত্যাদি কাজে অংশগ্রহণ করতো।
আমরা দেখলাম তাদের মাধ্যমে অনেক কাজ হচ্ছে। তখন আমরা বেশ কিছু এলাকাকে হাঙ্গার ফ্রি জোন ঘোষণা করি। নীতি নির্ধারণে পরিবর্তন আনার জন্য ২০০২ সালে প্রফেসর মোজাফফর আহমেদসহ সৃষ্টি করলেন ‘সিটিজেন ফর ফেয়ার ইলেকশন’। ২০০৩ সালে স্থানীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সৎ মানুষ নির্বাচিত করার লক্ষ্যে প্রার্থীদের প্রোফাইল তৈরি করেন। তবে এতে অনেকইে তথ্য গোপন করেন। যার ফলে আমরা তাদের মুখোমুখি বসানোর ব্যবস্থা করি। এরপর আমদের উপলব্ধি হলো শুধু নির্বাচন নিয়ে কাজ করলে হবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ২০০৩ সালে আমরা প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে রাখি ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’।
সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচন নিয়ে বদিউল আলম মজুমদারের মূল্যায়ন, এই নির্বাচন নিয়ে তো ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। সবার জন্য সমসুযোগ সৃষ্টি হয়নি। অভিযোগ আছে নির্বাচনে কারচুপির। নির্বাচন কমিশন তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি নিরপেক্ষ আচরণ না করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। অভিযোগ আছে বিরোধীদল সমসুযোগ পায়নি। তাদের ওপর হামলা হয়েছে, মামলা হয়েছে এবং ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে বাধা দেয়াসহ আগের রাতে ব্যালটপেপার ভরে রাখার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও টিআইবি’র রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। আমি মনে করি, বর্তমান সরকারের উচিত আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার রদবদল হয় এটা আমাদের কাম্য। তা নাহলে আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবো। তিনি আরো বলেন, অভিযোগ আছে বহু লোক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারা ক্ষুব্ধ। তাদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ থেকে কেউ কেউ বিপদগামী হতে পারে।
ড. মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ অমিত সম্ভবনার দেশ। ১৯৭১ সালে আমাদের চেতনার জোয়ার ঘটেছিল। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। বাংলাদেশ ও কোরিয়া ১৯৭০-৭১ সালের দিকে একই অবস্থানে ছিল। তাদের মাথাপিছু আয় ও আমাদের মাথাপিছু আয় প্রায় একই ছিল ১শ’ ডলারের মতো। কিন্তু আমাদের এখনো ২ হাজার ছাড়ায়নি। তাদের এখন মাথাপিছু আয় ২৬-২৭ হাজার ডলার। বাংলাদেশ অনেক সম্পদশালী আর কোরিয়ার আছে কিছু নিম্নমানের কয়লামাত্র। বাংলাদেশের অনেক সম্পদ যেমন উর্বর মাটি। মিষ্টি পানি। উঠতি বয়সের কর্মক্ষম জনগণ। এছাড়াও আমারা কঠোর পরিশ্রমী, অল্পতে সন্তুষ্ট, বহু বিরূপ পরিবেশে রয়েছে কাজ করার ক্ষমতা। আমাদের দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে অনেক লোক অর্থ পাঠাচ্ছে। আমাদের নারীরা তৈরিপোশাক শিল্পে ও কৃষকরা ব্যাপক অবদান রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা সেই সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। এই সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের নীতিগত সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক স্বার্থপরতা, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, বিভক্তি, অপরাজনীতির কারণে এগিয়ে যেতে পারিনি। একটা বিভক্ত জাতি বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না।
দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের সাম্প্রতিক কার্যক্রমকে ইতিবাচক হিসেবেই তিনি দেখছেন। তিনি বলেন, দুদকের কাজ আরো বেগবান করতে হবে। অনেক দুর্নীতিবাজ তাদের আশপাশে রয়েছে। যদি কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হয়ে তবে, প্রথম ঘর থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তারাই এখন দলীয় নেতাদের মতো আচরণ করে। দলীয় নেতারাও সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এটা সুশাসনের জন্য বিরাট অন্তরায়। এসব বিষয়ে আমাদের নজর দিতে হবে। শুধু আর্থিক দুর্নীতি নয় সব দুর্নীতির ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। নিজের স্বপ্ন নিয়ে বলেন, আত্মনির্ভরশীল গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ। যেখানে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণ সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ পাবে- এটাই আমার আশা। আর এই প্রচেষ্টাতেই আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে।
No comments