গ্রেপ্তার: উপেক্ষিত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা by উৎপল রায়
ফৌজদারি
কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের
আপিল বিভাগের নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে। গ্রেপ্তার বিষয়ে সাম্প্রতিক
বেশকিছু ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের নির্দেশনা না
মানার অভিযোগ উঠেছে। সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, পুলিশের
সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ বা নির্দেশনা
অবজ্ঞা করা আদালত অবমাননার শামিল। আর যারা আদালতের নির্দেশনা পালন করছেন না
তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ড বিষয়ে ২০০৩ সালের এপ্রিলে হাইকোর্টের দেয়া রায় ২০১৬ সালের ২৪শে মে বহাল রাখে আপিল বিভাগ। পরে ওই বছরের ১০ই নভেম্বর এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য সাত দফা সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে আদালত বেশকিছু নির্দেশনা দিয়ে রায়ে উল্লেখ করেন, আইন সংশোধনের আগে এইসব নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। নির্দেশনার মধ্যে ছিল, আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না, কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ বাধ্যতামূলকভাবে তার পরিচয়পত্র দেখাবে। এছাড়া গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টি জানাতে হবে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ দিতে হবে। অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা বার বারই অবজ্ঞা করা হচ্ছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী তিন নেতাকে সোমবার (১৬ই এপ্রিল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটক থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছুক্ষণ পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরে ওই তিন নেতা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন তাদেরকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। যদিও ডিবি পুলিশ দাবি করে, ওই তিনজনকে চোখ বেঁধে তুলে নেয়া হয়নি। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, এ ঘটনার পর কোটা সংস্কার আন্দোলকারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মানবজমিনকে বলেন, এসব ঘটনা এবং অন্যান্য অনেক ঘটনায় এটি স্পষ্ট যে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ বা নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমলে নেয় না বললেই চলে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন নেতাকে ডিবি পুলিশ যেভাবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল এটাতো আইনের শাসন এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো হয়েছে।
গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। রায় ঘোষণার আগে ও পরে রাজধানীসহ সারা দেশে বিএনপি’র অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযোগ ওঠে গ্রেপ্তারের অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পালন করা হয়নি। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি পালনের সময় বিভিন্ন সময়ে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এসএম মিজানুর রহমান ও সহ-সভাপতি জাকির হোসেন মিলনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ও তেজগাঁও ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন মিলনকে গত ৬ই মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে তিনদিনের রিমান্ড শেষে ১১ই মার্চ আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন (১২ই মার্চ) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান জাকির হোসেন মিলন। পরে এই চার নেতার গ্রেপ্তারের বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তাদের গ্রেপ্তারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২৯শে মার্চ হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে ২রা এপ্রিল রুল জারি করেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই চার নেতাকে জবরদস্তিমূলকভাবে গ্রেপ্তার করা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। একই সঙ্গে ওই চার নেতাকে গ্রেপ্তারে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে না- রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়। রাজধানীর কাপ্তানবাজারে কিশোর রাকিব হাওলাদার (১৫)কে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে- এমন অভিযোগে ওয়ারী থানার ওসিসহ চারজনের বিরুদ্ধে গত ১১ই এপ্রিল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. কামরুল হোসেন মোল্লার আদালতে মামলা দায়ের করেন রাকিবের মা রীতা আক্তার। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের বিভিন্ন ধারায় দায়ের করা এই মামলায় আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। এ মামলার আসামিরা হলেন, ওয়ারী থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম, ওসি (তদন্ত) মো. সেলিম, এসআই জ্যোতি ও সোর্স মোশারফ। বাদী রীতা আক্তারের অভিযোগ গত ৪ঠা এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টার দিকে তার ছেলে রাকিব হাওলাদারকে (১৫) কাপ্তানবাজার এলাকা থেকে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই আটক করে ওয়ারী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তারের পর রাকিবের সঙ্গে তাকে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। পরে ৬ই এপ্রিল সকাল ১১টায় বাদীর পিতাকে (রাকিবের নানা) থানা থেকে ফোন করে জানানো হয় তার নাতি (রাকিব) ক্রসফায়ারে মারা গেছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। পরে রীতা আক্তার ঢামেকের মর্গে গিয়ে ছেলের লাশে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান বলে আর্জিতে অভিযোগ করেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মানবজমিনকে বলেন, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে তা মানা উচিত। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ পালন তো করতে হবে। যদি পালন করা না হয় সেটি তো অপরাধ হলো। যারা তা মানবে না তাদের বিরুদ্ধে তাদের ডিপার্টমেন্ট ব্যবস্থা নেবে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই পিছিয়ে যাচ্ছি। যেসব বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা পাওয়া গেছে সেই সব নির্দেশনা বার বার উপেক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে কিছু ঘটনার বর্ণনায় তা আমরা পাচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন নিজেদেরকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবে তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাগুলো শুধু উদ্বেজনকই নয়, দুঃখজনক এবং ভয়াবহ। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী তিন নেতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। কিন্তু আদালতের নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এটি করা হয়েছে। এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খোঁজ নেয়া এবং দোষীদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নূর খান লিটন বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলো সুশাসন, স্বচ্ছতা এগুলোকে অবজ্ঞা করে আমরা শুধু উন্নয়নের ঢেঁকুর তুলছি। আইনের শাসনকে যদি সমুন্নত রাখা না যায় তাহলে তা কারো জন্যই ভালো হবে না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মো. নুরুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, যেহেতু এসব বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে, তাই এসব নির্দেশনা মানতে হবে। এক্ষেত্রে যদি আদালত অবমাননা হয় তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ক্ষেত্র বিশেষে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ ধরনের উদ্যোগের অভাব কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, উদ্যোগ থাকা উচিত। মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। আর যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহারও থাকে। অপপ্রয়োগ যাতে না হয় সেজন্য এ সমস্ত (বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা) প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ড বিষয়ে ২০০৩ সালের এপ্রিলে হাইকোর্টের দেয়া রায় ২০১৬ সালের ২৪শে মে বহাল রাখে আপিল বিভাগ। পরে ওই বছরের ১০ই নভেম্বর এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য সাত দফা সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে আদালত বেশকিছু নির্দেশনা দিয়ে রায়ে উল্লেখ করেন, আইন সংশোধনের আগে এইসব নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। নির্দেশনার মধ্যে ছিল, আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না, কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ বাধ্যতামূলকভাবে তার পরিচয়পত্র দেখাবে। এছাড়া গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টি জানাতে হবে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ দিতে হবে। অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা বার বারই অবজ্ঞা করা হচ্ছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী তিন নেতাকে সোমবার (১৬ই এপ্রিল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটক থেকে তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছুক্ষণ পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরে ওই তিন নেতা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন তাদেরকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। যদিও ডিবি পুলিশ দাবি করে, ওই তিনজনকে চোখ বেঁধে তুলে নেয়া হয়নি। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, এ ঘটনার পর কোটা সংস্কার আন্দোলকারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক মানবজমিনকে বলেন, এসব ঘটনা এবং অন্যান্য অনেক ঘটনায় এটি স্পষ্ট যে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ বা নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমলে নেয় না বললেই চলে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন নেতাকে ডিবি পুলিশ যেভাবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল এটাতো আইনের শাসন এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো হয়েছে।
গত ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। রায় ঘোষণার আগে ও পরে রাজধানীসহ সারা দেশে বিএনপি’র অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযোগ ওঠে গ্রেপ্তারের অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পালন করা হয়নি। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি পালনের সময় বিভিন্ন সময়ে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এসএম মিজানুর রহমান ও সহ-সভাপতি জাকির হোসেন মিলনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ও তেজগাঁও ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন মিলনকে গত ৬ই মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে তিনদিনের রিমান্ড শেষে ১১ই মার্চ আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন (১২ই মার্চ) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান জাকির হোসেন মিলন। পরে এই চার নেতার গ্রেপ্তারের বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তাদের গ্রেপ্তারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২৯শে মার্চ হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে ২রা এপ্রিল রুল জারি করেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই চার নেতাকে জবরদস্তিমূলকভাবে গ্রেপ্তার করা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। একই সঙ্গে ওই চার নেতাকে গ্রেপ্তারে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে না- রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়। রাজধানীর কাপ্তানবাজারে কিশোর রাকিব হাওলাদার (১৫)কে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে- এমন অভিযোগে ওয়ারী থানার ওসিসহ চারজনের বিরুদ্ধে গত ১১ই এপ্রিল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. কামরুল হোসেন মোল্লার আদালতে মামলা দায়ের করেন রাকিবের মা রীতা আক্তার। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের বিভিন্ন ধারায় দায়ের করা এই মামলায় আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। এ মামলার আসামিরা হলেন, ওয়ারী থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম, ওসি (তদন্ত) মো. সেলিম, এসআই জ্যোতি ও সোর্স মোশারফ। বাদী রীতা আক্তারের অভিযোগ গত ৪ঠা এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টার দিকে তার ছেলে রাকিব হাওলাদারকে (১৫) কাপ্তানবাজার এলাকা থেকে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই আটক করে ওয়ারী থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তারের পর রাকিবের সঙ্গে তাকে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। পরে ৬ই এপ্রিল সকাল ১১টায় বাদীর পিতাকে (রাকিবের নানা) থানা থেকে ফোন করে জানানো হয় তার নাতি (রাকিব) ক্রসফায়ারে মারা গেছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। পরে রীতা আক্তার ঢামেকের মর্গে গিয়ে ছেলের লাশে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান বলে আর্জিতে অভিযোগ করেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক মানবজমিনকে বলেন, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে তা মানা উচিত। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ পালন তো করতে হবে। যদি পালন করা না হয় সেটি তো অপরাধ হলো। যারা তা মানবে না তাদের বিরুদ্ধে তাদের ডিপার্টমেন্ট ব্যবস্থা নেবে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই পিছিয়ে যাচ্ছি। যেসব বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা পাওয়া গেছে সেই সব নির্দেশনা বার বার উপেক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে কিছু ঘটনার বর্ণনায় তা আমরা পাচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন নিজেদেরকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভাবে তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাগুলো শুধু উদ্বেজনকই নয়, দুঃখজনক এবং ভয়াবহ। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী তিন নেতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। কিন্তু আদালতের নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এটি করা হয়েছে। এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খোঁজ নেয়া এবং দোষীদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নূর খান লিটন বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলো সুশাসন, স্বচ্ছতা এগুলোকে অবজ্ঞা করে আমরা শুধু উন্নয়নের ঢেঁকুর তুলছি। আইনের শাসনকে যদি সমুন্নত রাখা না যায় তাহলে তা কারো জন্যই ভালো হবে না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মো. নুরুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, যেহেতু এসব বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে, তাই এসব নির্দেশনা মানতে হবে। এক্ষেত্রে যদি আদালত অবমাননা হয় তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ক্ষেত্র বিশেষে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ ধরনের উদ্যোগের অভাব কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, উদ্যোগ থাকা উচিত। মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। আর যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহারও থাকে। অপপ্রয়োগ যাতে না হয় সেজন্য এ সমস্ত (বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা) প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
No comments