ইসরাইল এখন কেন সবার প্রিয়? by শাই ফেল্ডম্যান ও তামারা কফম্যান
এই
মুহূর্তে আরব বিশ্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশ্চর্য্যজনক বিষয়টি হলো, ইসরাইল
ইস্যুটি সেখানে এখন তেমন বিতর্কিত নয় বললেই চলে। আমাদের ১১ দিনের সৌদি আরব ও
কুয়েত সফরে আমরা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বিষয়টি শুনেছি মাত্র একবার। একে
বেশ নাটকীয় পরিবর্তনই বলা চলে। অথচ, কয়েক দশক ধরে ইসরাইলের প্রতি সামগ্রিক
শত্রুতাই ছিল আরব দেশগুলোর বিরল ঐক্যের কারণ।
ব্রান্ডেইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাউন সেন্টার ফর মিডল স্টাডিজে গত বছর অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে আমাদের একজন আরব সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আরব দেশগুলো কবে ইসরাইলকে মেনে নেবে?’ খুব সংক্ষেপে তিনি সঠিক জবাবটি দিয়েছিলেন। তার উত্তর ছিল এই যে, ‘যেদিন তারা (আরব রাষ্ট্রসমূহ) বুঝতে পারবে যে ইসরাইল না থাকার চেয়ে, থাকাটাই তাদের জন্য মঙ্গলকর।’
ইসরাইলের অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক বলে থাকেন, নিরাপত্তাই এখানে মূখ্য বিষয়। তারা দাবি করেন, আরব রাষ্ট্রসমূহ ও ইসরাইল উভয়ের অভিন্ন হুমকি হলো ইরান ও ইসলামি চরমপন্থা। এই অভিন্ন নিরাপত্তা হুমকিই ইসরাইল ও গুরুত্বপূর্ণ আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্যের জন্ম দিয়েছে। আরব সরকারগুলো প্রতিপক্ষকে নাজেহাল রাখতে ও আরও স্বস্তিদায়ক আঞ্চলিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ইসরাইলকে অংশ মনে করে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসরাইলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাকে আরব দেশগুলো নিজেদের স্বার্থের পক্ষে ভাবার আরও বিস্তৃত কারণ আছে। এক্ষেত্রে গত দশকের দুইটি ঘটনাপ্রবাহ বড় প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, আঞ্চলিক জ্বালানি বিপ্লবের ফলে ইসরাইল জ্বালানির দিক দিয়ে শুধু স্বনির্ভর রাষ্ট্রই নয়, বরং জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ইসরাইল ও মিশরীয় কোম্পানির মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রির যেই ১৫০০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা ছিল রীতিমত ‘গেম চেঞ্জার’। এই চুক্তির ফলে মিশর ইসরাইলের কাছ থেকে যে গ্যাস কিনবে, তা দেশটি তরলীকৃত করে ইউরোপ ও আফ্রিকায় রপ্তানি করতে পারবে। মিশরের সামনে এখন অন্যতম আঞ্চলিক জ্বালানি কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠার হাতছানি। পাশাপাশি, প্রাক্তন বৈরীভাবাপন্ন দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছে।
ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর জোট জিসিসি’র মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়ার কারণে উভয়ের জন্য যেই নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা-ও এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, উপসাগরীয় দেশগুলো ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবিলায় ইসরাইলি সহায়তা পাচ্ছে। ব্যবহার করছে ইসরাইলের অত্যাধুনিক নজরদারিমূলক প্রযুক্তি। দুই পক্ষ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ও করে থাকে। এছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলো ক্রমেই তাদের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। তেল ও গ্যাস-নির্ভর অর্থনীতিকে আরও বেশি সেবা, প্রযুক্তি ও জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সম্ভাবনা ব্যাপক।
আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যুর প্রতি আরব সরকারগুলোর আগ্রহ হ্রাসের ফলে। এই আরব দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও ফিলিস্তিনি দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। কিন্তু ফিলিস্তিনের পক্ষে সর্বাত্মক সমর্থন প্রদর্শনের ব্যাপারে এই দেশগুলো এখন অত আগ্রহ পায় না। এর আংশিক কারণ হলো, ফিলিস্তিনিদের প্রতি প্রায় সাত দশকের নিরঙ্কুশ আরব সমর্থন থেকে তেমন কোনো ফল আসেনি বললেই চলে।
কিন্তু এর চেয়ে বড় কারণ হলো, অকার্যকর ও বিবদমান ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের প্রতি ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে আরব সরকারগুলোর। বিভিন্ন আরব দেশ ও ইরান ফিলিস্তিনের বিভিন্ন রাজনৈতিক অংশকে স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান হিসেবে মাহমুদ আব্বাসের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, তা নিয়ে ক্রমেই বিরোধ প্রকাশ্য হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের দাবি এগিয়ে নেওয়ার চেয়ে আরব দেশগুলো এখন নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ এগিয়ে নিতে চায়। তারা নিজ নিজ পক্ষের ফিলিস্তিনি অংশকে সমর্থন দিয়ে, অন্য অংশকে দমাতে চায়।
এই সব কিছুর সামগ্রিক ফলাফল যেটা দাঁড়ালো তা হলো সুন্নি আরব সরকারগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতে নাটকীয় পরিবর্তন চলে এসেছে। ইসরাইলের প্রতি একসময় যেই দেশগুলো চরম শত্রুতা পোষণ করতো, সেই দেশগুলোই ভাবতে শুরু করেছে এই অঞ্চলে ইসরাইলের উপস্থিতি বরং তাদের জন্য মঙ্গলজনক। ফলস্বরূপ, ইসরাইলের বর্তমান সরকার সহ অনেক ইসরাইলি মনে করেন, ফিলিস্তিনি ইস্যুতে ইসরাইলের আর এখন কোনো বাধা নেই। এমনকি একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গোটা বিরোধ নিজেদের পক্ষে ফয়সালা করতে চাইলেও ইসরাইলকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করলেও, বর্তমান পরিবেশে ইসরাইলের জন্য বাধাবিপত্তিও আছে। প্রথম সীমাবদ্ধতা হলো যে, বেশিরভাগ আরব শাসক গোষ্ঠী যদিও এখন নিজেদের অভ্যন্তরীন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেশি চিন্তিত ও ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দের প্রতি বিরক্ত, তবুও আরব জনগণের কাছে কিন্তু ফিলিস্তিন ইস্যুর গুরুত্ব ওভাবে কমে যায় নি। সাধারণ আরবরা এখনও ফিলিস্তিনি ইস্যু নিয়ে চিন্তিত। আঞ্চলিক গণমাধ্যমের বরাতে তারা প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে একবার করে হলেও ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে পারে। আরব শাসকগোষ্ঠী সাধারণত বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমত সহ্য না করলেও, ২০১১ সালের আরব বসন্ত থেকে এই শিক্ষা পেয়েছে যে জনমত অস্বীকার করলে কী পরিণতি হতে পারে।
জিসিসি-ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো কুয়েত। ইসরাইলকে অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের বিষয়টি তদারকির দায়িত্বে আরব লীগের যেই কমিশন রয়েছে, সেটি কুয়েতেই অবস্থিত। দেশটিতে আগে ফিলিস্তিনি অনেক নেতা থাকতেন। তবে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত যখন সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখলে সমর্থন দিলেন, তখন দেশটি থেকে গণহারে ফিলিস্তিনিদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু তারপরও কুয়েতি জনগণের মনে ফিলিস্তিনি ইস্যুটি এখনও বেশ গভীরে প্রোথিত। ২০০৪ সালে কুয়েত ও ফিলিস্তিনের সম্পর্ক পুনর্গঠিত হয়। ফিলিস্তিনের পক্ষে মনোভাব তুঙ্গে রাখতে কুয়েতের পার্লামেন্ট বড় ভূমিকা রাখে। দেশটির ইসলামী আন্দোলন ও বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও ফিলিস্তিনের পক্ষে সরব।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, কুয়েত এখনও ফিলিস্তিনের পক্ষে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্বস্ত। কুয়েত ঘোষণা দিয়েছে, যেসব ব্যক্তির পাসপোর্টে ইসরাইল সফরের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে তারা কুয়েতে ঢুকতে পারবে না। এ বছর ফিলিস্তিনি ভূখে দূতাবাস স্থাপনেরও ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।
সৌদি আরবেরও একই অবস্থা। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব রুখতে ইসরাইলের ভূমিকা নিয়ে সৌদি নেতারা সন্তুষ্ট। কিন্তু জনমত ও ধর্মীয় প্রভাবের কারণে এখনও সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্যে বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি নয়। সৌদি আরব এখনও বলে থাকে, ইসরাইলের উচিত হবে ২০০২ সালের আরব শান্তি উদ্যোগ গ্রহণ করা। এর ভিত্তিতেই আরব-ইসরাইল সংঘাতের নিরসন হওয়া উচিত। কিন্তু বলাই বাহুল্য বর্তমান ইসরাইল সরকার এটি মানবে না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর আরব দেশগুলোর ম্রিয়মান প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রকারান্তরে ট্রাম্পের ওই পদক্ষেপ মেনে নিয়ে আরব দেশগুলো শুধু ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেই খ্রান্ত দেয়। ইসরাইল এ থেকে প্রতীকী বিজয় অর্জন করে। কিন্তু ইসরাইল যদি একতরফাভাবে আরও কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোরালো অবস্থান না নেওয়া ছাড়া আরব দেশগুলোর কোনো পথ থাকবে না। ইসরাইল সরকার যদি আরব দেশগুলোর সঙ্গে মৈত্রী এগিয়ে নিতে চায়, তাহলে আরব দেশগুলোর সমস্যা নিয়েও দেশটিকে সচেতন থাকতে হবে।
আবার সুন্নী দেশগুলোর সঙ্গে এই মৈত্রীর ফলে ইসরাইলের সামনে নতুন কিছু সমস্যা এসে উপস্থিত হয়েছে। শত্রুতা থাকাকালে এসব সমস্যা ছিল না। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আরব দেশগুলো বর্তমানে যেই আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র ও প্রযুক্তি কিনছে, সেটা সম্পর্ক রক্ষা করার স্বার্থে সহ্য করতে হচ্ছে ইসরাইলকে। সাধারণত, অতীতে ইসরাইল নিজের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এমনকি রাশিয়াকেও আরব দেশগুলোর কাছে আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে জোর আপত্তি জানিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। এছাড়া আরব দেশগুলোর কাছে সংবেদনশীল পারমানবিক প্রযুক্তি স্থানান্তর নিয়েও বিরোধীতা ছিল ইসরাইলের।
কিন্তু এখন সেই আরব দেশগুলো ইসরাইলের ‘নতুন বন্ধু’। এখন আরব দেশগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান কিনতে চাইলে ইসরাইল কি আগের মতো বিরোধীতা করতে পারবে? কিছুকাল আগে মিশরের কাছে জার্মানির অত্যাধুনিক সাবমেরিন বিক্রির ক্ষেত্রে ইসরাইল এই সমস্যায় পড়েছে। এছাড়া সৌদি আরব সম্প্রতি পারমানবিক প্রযুক্তি পেতে যেভাবে সরব হয়েছে, তাতেও ইসরাইল বিপাকে পড়েছে। উভয় দেশই ইরানকে পারমানবিক প্রযুক্তি পেতে দিতে চায় না। কিন্তু সৌদি আরবের হাতে পারমানবিক প্রযুক্তি থাকা নিয়েও স্বস্তি বোধ করে না ইসরাইল।
এটি স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলার দরুন কিছু অদ্ভুত মৈত্রী তৈরি হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রায় ৭০ বছর ধরে একঘরে থাকা ইসরাইলের জন্য নতুন সম্ভাবনা খুবই আকর্ষনীয়। কিন্তু ইসরাইল এখন তাদের বন্ধু-শত্রু আরব দেশগুলোকে নিয়ে উভয়সংকটে।
(শাই ফেল্ডম্যান ও তামারা কফম্যান হলেন যথাক্রমে ব্রান্ডেইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাউন সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের পরিচালক ও ব্রুকিং ইন্সটিটিউশনের সেন্টার ফর মিডল ইস্ট পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো। ফরেইন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাদের নিবন্ধ অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
ব্রান্ডেইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাউন সেন্টার ফর মিডল স্টাডিজে গত বছর অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে আমাদের একজন আরব সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আরব দেশগুলো কবে ইসরাইলকে মেনে নেবে?’ খুব সংক্ষেপে তিনি সঠিক জবাবটি দিয়েছিলেন। তার উত্তর ছিল এই যে, ‘যেদিন তারা (আরব রাষ্ট্রসমূহ) বুঝতে পারবে যে ইসরাইল না থাকার চেয়ে, থাকাটাই তাদের জন্য মঙ্গলকর।’
ইসরাইলের অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক বলে থাকেন, নিরাপত্তাই এখানে মূখ্য বিষয়। তারা দাবি করেন, আরব রাষ্ট্রসমূহ ও ইসরাইল উভয়ের অভিন্ন হুমকি হলো ইরান ও ইসলামি চরমপন্থা। এই অভিন্ন নিরাপত্তা হুমকিই ইসরাইল ও গুরুত্বপূর্ণ আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্যের জন্ম দিয়েছে। আরব সরকারগুলো প্রতিপক্ষকে নাজেহাল রাখতে ও আরও স্বস্তিদায়ক আঞ্চলিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ইসরাইলকে অংশ মনে করে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসরাইলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাকে আরব দেশগুলো নিজেদের স্বার্থের পক্ষে ভাবার আরও বিস্তৃত কারণ আছে। এক্ষেত্রে গত দশকের দুইটি ঘটনাপ্রবাহ বড় প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, আঞ্চলিক জ্বালানি বিপ্লবের ফলে ইসরাইল জ্বালানির দিক দিয়ে শুধু স্বনির্ভর রাষ্ট্রই নয়, বরং জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ইসরাইল ও মিশরীয় কোম্পানির মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রির যেই ১৫০০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা ছিল রীতিমত ‘গেম চেঞ্জার’। এই চুক্তির ফলে মিশর ইসরাইলের কাছ থেকে যে গ্যাস কিনবে, তা দেশটি তরলীকৃত করে ইউরোপ ও আফ্রিকায় রপ্তানি করতে পারবে। মিশরের সামনে এখন অন্যতম আঞ্চলিক জ্বালানি কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠার হাতছানি। পাশাপাশি, প্রাক্তন বৈরীভাবাপন্ন দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছে।
ইসরাইল ও আরব দেশগুলোর জোট জিসিসি’র মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়ার কারণে উভয়ের জন্য যেই নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা-ও এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, উপসাগরীয় দেশগুলো ইতিমধ্যেই সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবিলায় ইসরাইলি সহায়তা পাচ্ছে। ব্যবহার করছে ইসরাইলের অত্যাধুনিক নজরদারিমূলক প্রযুক্তি। দুই পক্ষ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ও করে থাকে। এছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলো ক্রমেই তাদের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। তেল ও গ্যাস-নির্ভর অর্থনীতিকে আরও বেশি সেবা, প্রযুক্তি ও জ্ঞান নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার সম্ভাবনা ব্যাপক।
আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যুর প্রতি আরব সরকারগুলোর আগ্রহ হ্রাসের ফলে। এই আরব দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও ফিলিস্তিনি দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। কিন্তু ফিলিস্তিনের পক্ষে সর্বাত্মক সমর্থন প্রদর্শনের ব্যাপারে এই দেশগুলো এখন অত আগ্রহ পায় না। এর আংশিক কারণ হলো, ফিলিস্তিনিদের প্রতি প্রায় সাত দশকের নিরঙ্কুশ আরব সমর্থন থেকে তেমন কোনো ফল আসেনি বললেই চলে।
কিন্তু এর চেয়ে বড় কারণ হলো, অকার্যকর ও বিবদমান ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের প্রতি ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে আরব সরকারগুলোর। বিভিন্ন আরব দেশ ও ইরান ফিলিস্তিনের বিভিন্ন রাজনৈতিক অংশকে স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান হিসেবে মাহমুদ আব্বাসের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, তা নিয়ে ক্রমেই বিরোধ প্রকাশ্য হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের দাবি এগিয়ে নেওয়ার চেয়ে আরব দেশগুলো এখন নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ এগিয়ে নিতে চায়। তারা নিজ নিজ পক্ষের ফিলিস্তিনি অংশকে সমর্থন দিয়ে, অন্য অংশকে দমাতে চায়।
এই সব কিছুর সামগ্রিক ফলাফল যেটা দাঁড়ালো তা হলো সুন্নি আরব সরকারগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতে নাটকীয় পরিবর্তন চলে এসেছে। ইসরাইলের প্রতি একসময় যেই দেশগুলো চরম শত্রুতা পোষণ করতো, সেই দেশগুলোই ভাবতে শুরু করেছে এই অঞ্চলে ইসরাইলের উপস্থিতি বরং তাদের জন্য মঙ্গলজনক। ফলস্বরূপ, ইসরাইলের বর্তমান সরকার সহ অনেক ইসরাইলি মনে করেন, ফিলিস্তিনি ইস্যুতে ইসরাইলের আর এখন কোনো বাধা নেই। এমনকি একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গোটা বিরোধ নিজেদের পক্ষে ফয়সালা করতে চাইলেও ইসরাইলকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করলেও, বর্তমান পরিবেশে ইসরাইলের জন্য বাধাবিপত্তিও আছে। প্রথম সীমাবদ্ধতা হলো যে, বেশিরভাগ আরব শাসক গোষ্ঠী যদিও এখন নিজেদের অভ্যন্তরীন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেশি চিন্তিত ও ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দের প্রতি বিরক্ত, তবুও আরব জনগণের কাছে কিন্তু ফিলিস্তিন ইস্যুর গুরুত্ব ওভাবে কমে যায় নি। সাধারণ আরবরা এখনও ফিলিস্তিনি ইস্যু নিয়ে চিন্তিত। আঞ্চলিক গণমাধ্যমের বরাতে তারা প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে একবার করে হলেও ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা সম্পর্কে জানতে পারে। আরব শাসকগোষ্ঠী সাধারণত বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমত সহ্য না করলেও, ২০১১ সালের আরব বসন্ত থেকে এই শিক্ষা পেয়েছে যে জনমত অস্বীকার করলে কী পরিণতি হতে পারে।
জিসিসি-ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো কুয়েত। ইসরাইলকে অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের বিষয়টি তদারকির দায়িত্বে আরব লীগের যেই কমিশন রয়েছে, সেটি কুয়েতেই অবস্থিত। দেশটিতে আগে ফিলিস্তিনি অনেক নেতা থাকতেন। তবে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত যখন সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখলে সমর্থন দিলেন, তখন দেশটি থেকে গণহারে ফিলিস্তিনিদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু তারপরও কুয়েতি জনগণের মনে ফিলিস্তিনি ইস্যুটি এখনও বেশ গভীরে প্রোথিত। ২০০৪ সালে কুয়েত ও ফিলিস্তিনের সম্পর্ক পুনর্গঠিত হয়। ফিলিস্তিনের পক্ষে মনোভাব তুঙ্গে রাখতে কুয়েতের পার্লামেন্ট বড় ভূমিকা রাখে। দেশটির ইসলামী আন্দোলন ও বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও ফিলিস্তিনের পক্ষে সরব।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, কুয়েত এখনও ফিলিস্তিনের পক্ষে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্বস্ত। কুয়েত ঘোষণা দিয়েছে, যেসব ব্যক্তির পাসপোর্টে ইসরাইল সফরের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে তারা কুয়েতে ঢুকতে পারবে না। এ বছর ফিলিস্তিনি ভূখে দূতাবাস স্থাপনেরও ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।
সৌদি আরবেরও একই অবস্থা। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব রুখতে ইসরাইলের ভূমিকা নিয়ে সৌদি নেতারা সন্তুষ্ট। কিন্তু জনমত ও ধর্মীয় প্রভাবের কারণে এখনও সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে প্রকাশ্যে বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি নয়। সৌদি আরব এখনও বলে থাকে, ইসরাইলের উচিত হবে ২০০২ সালের আরব শান্তি উদ্যোগ গ্রহণ করা। এর ভিত্তিতেই আরব-ইসরাইল সংঘাতের নিরসন হওয়া উচিত। কিন্তু বলাই বাহুল্য বর্তমান ইসরাইল সরকার এটি মানবে না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর আরব দেশগুলোর ম্রিয়মান প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রকারান্তরে ট্রাম্পের ওই পদক্ষেপ মেনে নিয়ে আরব দেশগুলো শুধু ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেই খ্রান্ত দেয়। ইসরাইল এ থেকে প্রতীকী বিজয় অর্জন করে। কিন্তু ইসরাইল যদি একতরফাভাবে আরও কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে জোরালো অবস্থান না নেওয়া ছাড়া আরব দেশগুলোর কোনো পথ থাকবে না। ইসরাইল সরকার যদি আরব দেশগুলোর সঙ্গে মৈত্রী এগিয়ে নিতে চায়, তাহলে আরব দেশগুলোর সমস্যা নিয়েও দেশটিকে সচেতন থাকতে হবে।
আবার সুন্নী দেশগুলোর সঙ্গে এই মৈত্রীর ফলে ইসরাইলের সামনে নতুন কিছু সমস্যা এসে উপস্থিত হয়েছে। শত্রুতা থাকাকালে এসব সমস্যা ছিল না। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আরব দেশগুলো বর্তমানে যেই আধুনিক অস্ত্রসস্ত্র ও প্রযুক্তি কিনছে, সেটা সম্পর্ক রক্ষা করার স্বার্থে সহ্য করতে হচ্ছে ইসরাইলকে। সাধারণত, অতীতে ইসরাইল নিজের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এমনকি রাশিয়াকেও আরব দেশগুলোর কাছে আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে জোর আপত্তি জানিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। এছাড়া আরব দেশগুলোর কাছে সংবেদনশীল পারমানবিক প্রযুক্তি স্থানান্তর নিয়েও বিরোধীতা ছিল ইসরাইলের।
কিন্তু এখন সেই আরব দেশগুলো ইসরাইলের ‘নতুন বন্ধু’। এখন আরব দেশগুলো অত্যাধুনিক অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান কিনতে চাইলে ইসরাইল কি আগের মতো বিরোধীতা করতে পারবে? কিছুকাল আগে মিশরের কাছে জার্মানির অত্যাধুনিক সাবমেরিন বিক্রির ক্ষেত্রে ইসরাইল এই সমস্যায় পড়েছে। এছাড়া সৌদি আরব সম্প্রতি পারমানবিক প্রযুক্তি পেতে যেভাবে সরব হয়েছে, তাতেও ইসরাইল বিপাকে পড়েছে। উভয় দেশই ইরানকে পারমানবিক প্রযুক্তি পেতে দিতে চায় না। কিন্তু সৌদি আরবের হাতে পারমানবিক প্রযুক্তি থাকা নিয়েও স্বস্তি বোধ করে না ইসরাইল।
এটি স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্যে বিশৃঙ্খলার দরুন কিছু অদ্ভুত মৈত্রী তৈরি হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রায় ৭০ বছর ধরে একঘরে থাকা ইসরাইলের জন্য নতুন সম্ভাবনা খুবই আকর্ষনীয়। কিন্তু ইসরাইল এখন তাদের বন্ধু-শত্রু আরব দেশগুলোকে নিয়ে উভয়সংকটে।
(শাই ফেল্ডম্যান ও তামারা কফম্যান হলেন যথাক্রমে ব্রান্ডেইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাউন সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের পরিচালক ও ব্রুকিং ইন্সটিটিউশনের সেন্টার ফর মিডল ইস্ট পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো। ফরেইন পলিসি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাদের নিবন্ধ অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
No comments