বিচারের বাণী
বিচারব্যবস্থা বলতে আমরা মানে সাধারণ লোকজন কী বুঝি? বুঝি যে, এ এমন এক ব্যবস্থা যা যে কোনো বিষয়ের সত্যাসত্য নির্ধারণ করে, সত্যের পক্ষে রায় দেয় বা ব্যবস্থা নেয়। এখানে কঠোর যুক্তির অধিকার, কল্পনাবিলাসের কোনো স্থান নেই। কারও মনগড়া কথা, কারও মিথ্যা জল্পনা, কোনো অলীক অনুমান সভ্য মানুষের বিচারব্যবস্থায় স্থান পায় না, তা নির্মম নিরপেক্ষতায় শুধু সত্যেরই অধিকার স্বীকার আর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। সে জন্যই মানুষ বিচারব্যবস্থায় আস্থা রাখতে চায়, যেমন আস্থা রাখতে চায় রোগ নিরাময়কারী ডাক্তারদের ওপর। অন্যদিকে বিচারক যারা হন, তাদের ক্ষেত্রে আমরা ভাবি আইনে তাদের নিঃসংশয় অধিকার, বিচার ব্যবসায়ীদের মধ্যেও তারা বিশেষ মেধাবী ও বিজ্ঞ, অভিজ্ঞতায় পোক্ত হয়ে তারা বিচারের সব অন্ধিসন্ধি বুঝে নিয়েছেন, এবার সরকার তাদের আইন জ্ঞান ও বিচক্ষণতার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে। তাদের হাতে সত্যের স্বার্থ, সেই সঙ্গে দেশের নিরপরাধ মানুষের স্বার্থ সম্পূর্ণ অক্ষত থাকবে। তারা সবাই সত্য আর ন্যায়ের পথ দেখাবেন। অপরাধীকে শনাক্ত করবেন, তার উপযুক্ত শাস্তির বিধান দেবেন।
দেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করবেন। বলা বাহুল্য, সবাই জানেন, বাস্তব ক্ষেত্রে এ আস্থা প্রায়ই বিচলিত হয়, কী বিচারের ওপর, কী ডাক্তারদের ওপর। উকিল-অ্যাডভোকেট-ব্যারিস্টারদের সুচতুর কুযুক্তি অনেক সময় সত্য থেকে বিচারকে ভ্রষ্ট করে, যেমন ডাক্তারদের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের সম্ভাবনা তৈরি হয়। পক্ষপাতদুষ্ট বিচার যেমন অপরাধীকে রেহাই দেয়, তেমনি অসাধু বা অনিশ্চিত চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের লোভ অনেক সময় রোগী আর তার পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে। দু’ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক ভ্রান্তির একটা পরিসর নিশ্চয়ই আছে, কারণ ভুল মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক; কিন্তু ভ্রান্তির স্থান যখন নেয় স্বার্থ, তখন প্রায়ই বিচারের ক্ষেত্র থাকে ইংরেজিতে ‘miscarriage of justice’ বা ‘বিচারভ্রংশ’ বলে তাই ঘটে, ডাক্তারির ক্ষেত্রে চিকিৎসাভ্রংশ। কিন্তু ডাক্তারদের বিষয়টি পৃথক রেখে আপাতত বিচার ক্ষেত্রের দু-একটি তাজ্জব ঘটনা বলি। ঘটনাস্থল ভারত, ভারতের।
২. এ সাধারণ কথাগুলো অনেকের কাছে বেশি তাত্ত্বিক ও বায়বীয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের এক বিচারপতির আপ্ত-উচ্চারণ দেখে মনে হল পুরো দেশটা উন্মাদ হয়ে গেছে, নইলে এসব কথা আমরা শুনছি কী করে? অবশ্য আমার এ আক্ষেপের কোনো অর্থ হয় না, কারণ আমাদের কলকাতার ওপারে হাওড়াতে এক পাল মশাই দীর্ঘদিন ধরে দেয়ালে লিখে লিখে প্রচার করে গেছেন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এবং পৃথিবী গোলাকার নয়, চৌকোনা, এবং এ নিয়ে তারা ট্রেনে-বাসে বই ছাপিয়েও বিক্রি করতেন। আমেরিকার ক্রিয়েশনিস্ট নামক একদল খ্রিস্টান দাবি করে, খ্রিস্টীয় ঈশ্বর দশ হাজার বছর আগে একদিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ পৃথিবী আর জীবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। তারা তাদের এ তত্ত্ব মার্কিন দেশের পাঠ্য তালিকায় ঢোকানোর চেষ্টা করে সফল হননি, এখন ট্রাম্পের আমলে আর একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে, সব দেশে, একটা ‘পাগলা-প্রান্ত’ থাকেই (ইংরেজিতে lunatic fringe) যারা এ ধরনের কথাবার্তা বলবে। কিন্তু তাই বলে বিচারক? ন্যায়মূর্তি? মহামান্য আদালতের সর্বোচ্চ কেদারায় সমাসীন মহাজন? কথাগুলো বলেছেন রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা, তার অবসরগ্রহণের দিনে। তার কথার মণিমুক্তাগুলো এরকম-
১. গরু নিজে একটি সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হাসপাতাল- অর্থাৎ তাতে সবধরনের চিকিৎসা পাবে মানুষ। বিচারক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বলেছেন কিনা জানি না, সংবাদপত্রে (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘গণশক্তি’ ইত্যাদি, কলকাতা ১ জুন ২০১৭) তার উল্লেখ নেই। কী গুণে গরুর এ মাহাত্ম্য তা-ও ব্যাখ্যা করেছেন বিচারক-
২. গোমূত্র পান করলে পূর্বজন্মের সব পাপ ধুয়ে যায়;
৩. গরুর দুধ খেলে রক্তকণিকায় ক্যান্সার ঢুকতে পারে না; ৪. গরুর মধ্যে বাস করছেন ৩৩ কোটি হিন্দু দেবদেবী; ৫. হিন্দুপুরাণের সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্র থেকে লক্ষ্মীর সঙ্গে নাকি গরুরও আবির্ভাব হয়েছিল; ৬. গোমূত্র পান করলে বার্ধক্য বিলম্বিত হয়; ৭. গোবর দিয়ে দেয়াল লেপে রাখলে পারমাণবিক বিকিরণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অবশ্য এ কথাটি তিনি নিজের আবিষ্কার হিসেবে জাহির করেননি, অথরিটি হিসেবে এক ‘রুশ বিজ্ঞানী’র কথা বলেছেন, যদিও সেই বিজ্ঞানীর নামটি উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন; ৮. গোবরে (তা খেতে হবে না মাখতে হবে, তা তিনি বলেননি বা কাগজে উল্লেখ করেনি) কলেরার জীবাণু মরে যায়; ৯. গরুর হাম্বা ডাক বাতাসে ভেসে থাকা জীবাণু ধ্বংস করে। আর এতেই গো-মহিমার শেষ নয়, গরু নাকি নিঃশ্বাসে অক্সিজেন নেয় আর প্রশ্বাসে অক্সিজেন ছাড়ে। আর গরু একমাত্র স্তন্যপায়ী জীব, যার বৃহদন্ত্র ১৮০ ফুট লম্বা। এত সব গুণান্বয়ের জন্য তিনি গরুকে ভারতের জাতীয় পশু হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন! এ সূত্রেই ময়ূর কেন ভারতের জাতীয় পাখি, তারও একটি অভাবিত যুক্তি দিয়েছেন মহামান্য শর্মা। ময়ূর নাকি একটি ‘ব্রহ্মচারী’ পাখি। অর্থাৎ ময়ূরশিশু (বা ডিম) পয়দা করতে হলে তার নাকি ময়ূরীর সঙ্গে সঙ্গমের দরকার নেই, সে ময়ূরীর সামনে দাঁড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে চোখের জল ফেলে, ময়ূরী (ময়ূরের গায়ে পাখা বোলাতে বোলাতে) সেই চোখের জল গিলে ফেললেই গর্ভবতী হয়। এ কি পরিহাস, না উন্মাদের প্রলাপ? কিছুই না, অন্তত ন্যায়াধীশ শ্রীশর্মা তা মনে করেন না। তিনি বিচারালয়ের একটি মামলার ১৪৫ পৃষ্ঠার একটি বৈধ ‘রায়’-এ এসব মহাবাণী উচ্চারণ করেছেন। রাজস্থান সরকার পরিচালিত হিঙ্গোনিয়া গোশালায় গত বছর নাকি শতাধিক গরুর মৃত্যু হয়েছিল। গরু একটি সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও কেন এমন অপঘাত মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি, সে প্রশ্ন বিচারক শর্মা করেননি। একজন সেই গোশালার অস্বাস্থ্যকর অবস্থা নিয়ে রাজস্থানের হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছিল, তারই রায়ে তিনি এসব অবিস্মরণীয় সব কথা বলেছেন। তার মতে, গোহত্যার শাস্তি হওয়া উচিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড- রাজস্থানের হিসাবে তা দশ বছরের জেল। বেচারি জনস্বার্থ মামলা যে করেছিল, সে এতসব চায়নি, সে শুধু গোশালাটির রক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতি চেয়েছিল। এসব কথাকে সে ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’ হিসেবে দেখবে কিনা জানি না। বিচারপতি বেদপুরাণ থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে তার জ্ঞানগভীরতার প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হল, আদালতের মহৎ আঙিনায় এসব কথা এমন অবলীলাক্রমে বলা যায়? একজন বিচারক, যার নির্মাণে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, তিনি বিশ্বাস আর সত্যের মধ্যে তফাত করবেন না, অলীক গালগল্প তৈরি করতে তার এতটুকু দ্বিধা হবে না? তিনি এটুকু স্বীকার করেছেন, এসব বিশ্বাসের ব্যাপার, কিন্তু আদালতের বিচারকের রায়ে এই ‘বিশ্বাস’ ঢুকে পড়া কি বৈধ? এই রায় কি আদালত বা সরকার গ্রহণ করবে? এটাই এখন আমাদের কাছে কোটি টাকার (কালো টাকা নয়) প্রশ্ন।
প্রয়াত ও স্নেহাস্পদ নবারুণ ভট্টাচার্য ভারতের এক বিশেষ সময়ের স্মরণে লিখেছিল, ‘এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ নয়’। আমাদের মাঝে মাঝে মনে হয়, এই গোবরলিপ্ত অন্ধকারময় ভূমি আমার দেশ নয়। কিন্তু ‘দেশ নয়’ বলে যাব কোথায়? দেশে থেকেই এই মূঢ়তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, মানুষের পক্ষে।
পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা; লেখক
২. এ সাধারণ কথাগুলো অনেকের কাছে বেশি তাত্ত্বিক ও বায়বীয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের এক বিচারপতির আপ্ত-উচ্চারণ দেখে মনে হল পুরো দেশটা উন্মাদ হয়ে গেছে, নইলে এসব কথা আমরা শুনছি কী করে? অবশ্য আমার এ আক্ষেপের কোনো অর্থ হয় না, কারণ আমাদের কলকাতার ওপারে হাওড়াতে এক পাল মশাই দীর্ঘদিন ধরে দেয়ালে লিখে লিখে প্রচার করে গেছেন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এবং পৃথিবী গোলাকার নয়, চৌকোনা, এবং এ নিয়ে তারা ট্রেনে-বাসে বই ছাপিয়েও বিক্রি করতেন। আমেরিকার ক্রিয়েশনিস্ট নামক একদল খ্রিস্টান দাবি করে, খ্রিস্টীয় ঈশ্বর দশ হাজার বছর আগে একদিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ পৃথিবী আর জীবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। তারা তাদের এ তত্ত্ব মার্কিন দেশের পাঠ্য তালিকায় ঢোকানোর চেষ্টা করে সফল হননি, এখন ট্রাম্পের আমলে আর একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে, সব দেশে, একটা ‘পাগলা-প্রান্ত’ থাকেই (ইংরেজিতে lunatic fringe) যারা এ ধরনের কথাবার্তা বলবে। কিন্তু তাই বলে বিচারক? ন্যায়মূর্তি? মহামান্য আদালতের সর্বোচ্চ কেদারায় সমাসীন মহাজন? কথাগুলো বলেছেন রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা, তার অবসরগ্রহণের দিনে। তার কথার মণিমুক্তাগুলো এরকম-
১. গরু নিজে একটি সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হাসপাতাল- অর্থাৎ তাতে সবধরনের চিকিৎসা পাবে মানুষ। বিচারক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল বলেছেন কিনা জানি না, সংবাদপত্রে (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘গণশক্তি’ ইত্যাদি, কলকাতা ১ জুন ২০১৭) তার উল্লেখ নেই। কী গুণে গরুর এ মাহাত্ম্য তা-ও ব্যাখ্যা করেছেন বিচারক-
২. গোমূত্র পান করলে পূর্বজন্মের সব পাপ ধুয়ে যায়;
৩. গরুর দুধ খেলে রক্তকণিকায় ক্যান্সার ঢুকতে পারে না; ৪. গরুর মধ্যে বাস করছেন ৩৩ কোটি হিন্দু দেবদেবী; ৫. হিন্দুপুরাণের সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্র থেকে লক্ষ্মীর সঙ্গে নাকি গরুরও আবির্ভাব হয়েছিল; ৬. গোমূত্র পান করলে বার্ধক্য বিলম্বিত হয়; ৭. গোবর দিয়ে দেয়াল লেপে রাখলে পারমাণবিক বিকিরণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অবশ্য এ কথাটি তিনি নিজের আবিষ্কার হিসেবে জাহির করেননি, অথরিটি হিসেবে এক ‘রুশ বিজ্ঞানী’র কথা বলেছেন, যদিও সেই বিজ্ঞানীর নামটি উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন; ৮. গোবরে (তা খেতে হবে না মাখতে হবে, তা তিনি বলেননি বা কাগজে উল্লেখ করেনি) কলেরার জীবাণু মরে যায়; ৯. গরুর হাম্বা ডাক বাতাসে ভেসে থাকা জীবাণু ধ্বংস করে। আর এতেই গো-মহিমার শেষ নয়, গরু নাকি নিঃশ্বাসে অক্সিজেন নেয় আর প্রশ্বাসে অক্সিজেন ছাড়ে। আর গরু একমাত্র স্তন্যপায়ী জীব, যার বৃহদন্ত্র ১৮০ ফুট লম্বা। এত সব গুণান্বয়ের জন্য তিনি গরুকে ভারতের জাতীয় পশু হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন! এ সূত্রেই ময়ূর কেন ভারতের জাতীয় পাখি, তারও একটি অভাবিত যুক্তি দিয়েছেন মহামান্য শর্মা। ময়ূর নাকি একটি ‘ব্রহ্মচারী’ পাখি। অর্থাৎ ময়ূরশিশু (বা ডিম) পয়দা করতে হলে তার নাকি ময়ূরীর সঙ্গে সঙ্গমের দরকার নেই, সে ময়ূরীর সামনে দাঁড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে চোখের জল ফেলে, ময়ূরী (ময়ূরের গায়ে পাখা বোলাতে বোলাতে) সেই চোখের জল গিলে ফেললেই গর্ভবতী হয়। এ কি পরিহাস, না উন্মাদের প্রলাপ? কিছুই না, অন্তত ন্যায়াধীশ শ্রীশর্মা তা মনে করেন না। তিনি বিচারালয়ের একটি মামলার ১৪৫ পৃষ্ঠার একটি বৈধ ‘রায়’-এ এসব মহাবাণী উচ্চারণ করেছেন। রাজস্থান সরকার পরিচালিত হিঙ্গোনিয়া গোশালায় গত বছর নাকি শতাধিক গরুর মৃত্যু হয়েছিল। গরু একটি সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও কেন এমন অপঘাত মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি, সে প্রশ্ন বিচারক শর্মা করেননি। একজন সেই গোশালার অস্বাস্থ্যকর অবস্থা নিয়ে রাজস্থানের হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছিল, তারই রায়ে তিনি এসব অবিস্মরণীয় সব কথা বলেছেন। তার মতে, গোহত্যার শাস্তি হওয়া উচিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড- রাজস্থানের হিসাবে তা দশ বছরের জেল। বেচারি জনস্বার্থ মামলা যে করেছিল, সে এতসব চায়নি, সে শুধু গোশালাটির রক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতি চেয়েছিল। এসব কথাকে সে ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’ হিসেবে দেখবে কিনা জানি না। বিচারপতি বেদপুরাণ থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়ে তার জ্ঞানগভীরতার প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হল, আদালতের মহৎ আঙিনায় এসব কথা এমন অবলীলাক্রমে বলা যায়? একজন বিচারক, যার নির্মাণে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, তিনি বিশ্বাস আর সত্যের মধ্যে তফাত করবেন না, অলীক গালগল্প তৈরি করতে তার এতটুকু দ্বিধা হবে না? তিনি এটুকু স্বীকার করেছেন, এসব বিশ্বাসের ব্যাপার, কিন্তু আদালতের বিচারকের রায়ে এই ‘বিশ্বাস’ ঢুকে পড়া কি বৈধ? এই রায় কি আদালত বা সরকার গ্রহণ করবে? এটাই এখন আমাদের কাছে কোটি টাকার (কালো টাকা নয়) প্রশ্ন।
প্রয়াত ও স্নেহাস্পদ নবারুণ ভট্টাচার্য ভারতের এক বিশেষ সময়ের স্মরণে লিখেছিল, ‘এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ নয়’। আমাদের মাঝে মাঝে মনে হয়, এই গোবরলিপ্ত অন্ধকারময় ভূমি আমার দেশ নয়। কিন্তু ‘দেশ নয়’ বলে যাব কোথায়? দেশে থেকেই এই মূঢ়তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, মানুষের পক্ষে।
পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা; লেখক
No comments