ভেজাল ওষুধে নিহত নামহীন শিশুরা
ভেজাল প্যারাসিটামল সেবনের পর অকালমৃত্যুর শিকার ২৮টি শিশু এখন শুধুই পরিসংখ্যান। ২০০৯ সালের জুন থেকে আগস্ট—এই তিন মাসের মধ্যে প্যারাসিটামল নামের ‘বিষাক্ত’ ওষুধ সেবনে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ওই শিশুগুলোকে বিষ প্রয়োগের জন্য কাউকে দায়ী করা যাচ্ছে না। ওদের হত্যাকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ওই প্যারাসিটামলের প্রস্তুতকারক ওষুধ কোম্পানি রিড ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং, ভেজাল ওষুধ অথবা মানহীন কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের কারণে মৃত্যুর কবলে পড়া পরিসংখ্যানের তালিকায় এই ২৮টি শিশুর সংখ্যা যোগ হবে ঠিকই; কিন্তু তাদের পরিবারগুলো যে চরম অবিচার তথা অনাচারের শিকার হলো, তার কোনো প্রতিকার রাষ্ট্র ও সমাজ দিতে পারল না। শিশুগুলোর প্রত্যেকের আলাদা নাম ছিল। বাবা-মা, দাদা-নানা, দাদি-নানি কিংবা পরিবারের অন্যরা খুব ভেবেচিন্তে তাদের নাম রেখেছিলেন। প্রতিটি শিশুরই নাম ছিল তার বাবা-মায়ের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। প্রত্যেকেই ছিল খুব আদরের।
সে জন্যই তো সামান্য জ্বর হওয়া বা ঠান্ডা লেগে যাওয়ায় তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। ডাক্তারের কথামতোই তো শিশুসন্তানের জন্য ওষুধ কেনা হয়েছিল। অথচ জ্বরের ওষুধ খেয়ে ছোট ছেলেটা অথবা মেয়েটার কিডনি অচল হয়ে গেল। পেশাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কী কষ্টটাই না ওরা পেয়েছে। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ওদের ঢাকায় নিয়ে আসার পর জানা গেল যে ওষুধ মনে করে আদরের ধনকে বাবা-মা যা খাইয়েছেন, তা ছিল বিষ—ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল। ঢাকার ওষুধবিষয়ক (ড্রাগ) আদালত রায় দিয়েছেন যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর মামলাটি করার ক্ষেত্রে আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করেনি। আইন না মেনে ত্রুটিপূর্ণ মামলা করায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়নি। আমরা এখন রিড ফার্মাসিউটিক্যালসের খালাস পাওয়া পরিচালকদের নাম জানি। ওষুধ প্রশাসনের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক যিনি মামলা করেছিলেন, তাঁর নামটিও খবরে ছাপা হয়েছে। শুধু জানি না ওই সব শিশুর নাম। যে শিশুগুলোর সম্ভাবনাময় জীবন কেড়ে নিয়েছে অসাধুতা-আশ্রয়ী ব্যবসায়ী, অযোগ্য ও অদক্ষ তদারকব্যবস্থা এবং প্রশাসন। আর ওই সব সন্তানহারা বাবা-মায়ের প্রতি বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা নিষ্ঠুরতম পরিহাস করল তাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে। এই বিষাক্ত প্যারাসিটামলে শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে এই রিড ফার্মাসিউটিক্যালসই প্রথম নয়, এর আগে আরও অনেকের মৃত্যুর কারণ হয়েছে এই বিষাক্ত প্যারাসিটামল।
সেসব ক্ষেত্রে প্রস্তুতকারক ছিল ভিন্ন। একটি সংবাদপত্র বলছে যে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২—এই চার বছরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি ভেজাল প্যারাসিটামল সেবনের কারণে ২ হাজার ৭০০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে (রোগীর প্রাণ গেলেও হাত গুটিয়ে ঔষধ প্রশাসন, কালের কণ্ঠ, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬)। পত্রিকাটির উদ্ধৃত সংখ্যার সূত্র উল্লেখ না থাকায় এর নির্ভরযোগ্যতা শতভাগ নিশ্চিত করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে সরকারের উচিত হবে এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করা। ওই সময় অ্যাডফ্রেম নামের একটি কোম্পানি ফ্ল্যামোডল নামের প্যারাসিটামল তৈরি করে ঢাকা শিশু হাসপাতালে সরবরাহ করত। ওই শিশু হাসপাতালে ৭৬টি শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ১৯৯২ সালে দায়ের হওয়া মামলায় ২২ বছর পর ২০১৪ সালে অ্যাডফ্রেমের পরিচালকসহ তিনজনের ১০ বছর করে সাজা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটিই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত সেটিই শেষ মামলা, যাতে ভেজাল ওষুধের জন্য প্রস্তুতকারী হিসেবে কারও বিচার সম্পন্ন এবং সাজা হয়েছে। ওই একই সময়ে অপর দুটি প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) ও পলিক্যাম ফার্মাসিউটিক্যালের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অন্য চারটি মামলার বিচার গত ২৪ বছরেও শেষ হয়নি। রিড ফার্মার মতোই রেক্স ফার্মা নামে ময়মনসিংহের আরেকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে ওষুধ প্রশাসনের মামলা তদন্তজনিত দুর্বলতার কারণে টেকেনি।
অ্যাডফ্রেমের পরিচালকদের বিরুদ্ধে যে মামলাটির বিচার শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে, সেটির কৃতিত্ব অনেকটাই সংবাদপত্রের, বিশেষত দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর। তারা মামলাটির প্রতিটি পর্যায়ে ঘনিষ্ঠ নজরদারি অব্যাহত রাখায় কালক্ষেপণের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। তবে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দোষী ব্যক্তিদের আপিল এখন উচ্চ আদালতে বিবেচনাধীন। দেশের চিকিৎসাসেবার বিদ্যমান অবস্থায় ত্যক্ত-বিরক্ত ভুক্তভোগী আমরা অনেকেই হরহামেশা চিকিৎসকদের শাপান্ত করে থাকি। কিন্তু সেই চিকিৎসকদেরই একজন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ হলেন এই ভেজাল প্যারাসিটামল কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনের মূল নায়ক। তিনিই প্রথম অস্বাভাবিক হারে শিশুদের কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করে এর অভিন্ন কারণ হিসেবে বিষাক্ত প্যারাসিটামলকে চিহ্নিত করে সবার নজর কাড়েন। এখন রিড ফার্মাসিউটিক্যালসের মামলা ব্যর্থ হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এটি শুধু আমার জন্য নয়, পুরো জাতির জন্যই দুঃখজনক।’ এভাবে এত বেশি সংখ্যায় শিশুমৃত্যুর ঘটনা কোনো দেশকেই আলোড়িত না করে পারে না। এই অস্বাভাবিকতার কারণ অনুসন্ধানে তাই বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে সে রকম কিছু ঘটেনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর লোকদেখানো বিভাগীয় তদন্ত করে দায়সারা মামলা দায়েরেই তাদের কর্তব্য সমাধা করেছে। কোনো তদন্ত কমিশন কিংবা গণশুনানিও হয়নি। রিড ফার্মাসিউটিক্যালসের মামলায় জানা গেল যে মারা যাওয়া ২৮ শিশুর ময়নাতদন্তও হয়নি।
যে কারণে ওষুধের মধ্যে বিষাক্ত উপাদান থাকলেও সেটাই যে ওই সব শিশুর মৃত্যুর কারণ, সে রকম কোনো সরাসরি সংযোগ প্রতিষ্ঠা কোনো দিনই সম্ভব হতো না। মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশে যে করোনাররা আছেন এবং যাঁদের আইনগত দায়িত্ব হচ্ছে মৃত্যুর কারণ নিরূপণ করে সেই অনুযায়ী সার্টিফিকেট ইস্যু করা, সে রকম ব্যবস্থায় অস্বাভাবিক মৃত্যু ধামাচাপা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। আমাদের দেশে পুলিশ যদি কোনো মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মনে না করে, তাহলে তার ময়নাতদন্ত হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। সুতরাং, অপরাধ আড়াল করার সহজ উপায়ও আমাদের নাগালের মধ্যে। বিকল্পটি আমরা কবে ভাবব, তা নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও অন্য রাজনীতিকদের কোনো ভাবনার কথা আমরা শুনতে পাই না। আদালত, তা সে ফৌজদারি বা দেওয়ানি যেটিই হোক না কেন, সেখানে বিচার দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান এবং দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুপারিশ তৈরির দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের আইন কমিশনের। কমিশনটির কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর তারা অনেক বিষয়েই সময়ে সময়ে সরকারের কাছে আইন সংস্কারের সুপারিশ করে এসেছে। কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান খায়রুল হকের কিছু কিছু মন্তব্য ও মতামত এবং বিচারপতি হিসেবে দেওয়া রায় নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিশনের একটি কাজের প্রশংসা করতেই হয়। অ্যাডফ্রেম ফার্মাসিউটিক্যালসের ভেজাল প্যারাসিটামল তৈরির মামলায় ২২ বছর সময় কেন লাগল, তা অনুসন্ধান করে আইন কমিশন একটি সুপারিশমালা তৈরি করেছে। তারা দেখেছে যে মামলাটিতে মোট সময় লেগেছে ২১ বছর ৭ মাস, যার মধ্যে শুধু হাইকোর্টেই ফৌজদারি রিভিশনে কেটেছে ১৪ বছর ৩ মাস। আবার রিভিশন শেষ হওয়ার পর সেই মামলার রায়ের নথি বিচারিক আদালতের সেরেস্তাদার আলমারিতেই রেখে দিয়েছিলেন ১ বছর ১১ মাস। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হাজির না হওয়া, আসামিপক্ষের সময় প্রার্থনা ইত্যাদি মিলিয়ে কমিশনের ভাষায় অপব্যয়িত সময় ১৯ বছর ২ মাস। কমিশন বলছে যে অহেতুক সময় নষ্ট না হলে দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে বিচারটি সম্পন্ন হওয়া সম্ভব ছিল। কমিশন মোট ১৬ দফা সুপারিশ করেছে, যাতে তাদের আশা ‘অসহনীয় বিচারিক পরিস্থিতি’র সংস্কার সম্ভব হবে।
১৬ দফা সুপারিশের প্রথম চারটিই হচ্ছে সাক্ষীদের হাজির করানোর বিষয়ে। হাইকোর্টে রিভিশনের ক্ষেত্রে রুল জারির বিষয়েও কমিশন একাধিক পদক্ষেপের সুপারিশ করেছে, যার একটি হচ্ছে ছয় মাসের মধ্যে রুলের নিষ্পত্তি না হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। তাঁদের এসব সুপারিশের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিচার ত্বরান্বিত করা। তবে আইন কমিশনের সব সুপারিশকেই যে সরকার সমান গুরুত্ব দেয়, তা নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। ঔষধ প্রশাসন-সম্পর্কিত বিচারব্যবস্থায় ওই আইনি সংস্কারের পথে সরকার এখনো অগ্রসর হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তবে ওই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নেই যে বিচারহীনতার অবসান ঘটবে, তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। একই অপরাধে একই সন্দেহভাজন লোকজনের একাধিকবার বিচার না করার যে আইন (ডাবল জিওপার্ডি), সেটির সংশোধন প্রয়োজন। এর আগে গত মাসেই রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা নামের এক কলেজছাত্রী হত্যার মামলা একইভাবে নিষ্ফল হওয়ার পর বুশরার পরিবারের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। তখনো আমি ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায় ‘ডাবল জিওপার্ডি’ আইন সংস্কারের দৃষ্টান্ত দিয়ে আমাদের দেশে একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছি (বুশরার মা কেন ন্যায়বিচার পাবেন না? প্রথম আলো, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬)। ভেজাল ওষুধে মৃত্যুর বিচার প্রশ্নেও সেই একই কথা বলতে হচ্ছে। গুরুতর অপরাধের শিকার মানুষ, তাদের পরিবার, স্বজেনরা ন্যায়বিচার থেকে কেন বঞ্চিত হবেন? আইন কমিশনের কথায় ‘অসহনীয় বিচারিক পরিস্থিতি’ কোনো সমাজেই অনন্তকাল চলতে পারে না।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments