দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন নয় by বদিউল আলম মজুমদার
সম্প্রতি মন্ত্রিসভা দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা মনে করি যে এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে রাজনীতিতে দলের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। আরেকটি যুক্তি হলো যে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করলে নির্বাচনটি হবে ‘রাজনৈতিক’, ফলে নির্দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ‘বিরাজনীতিকরণের’ পথ রুদ্ধ হবে। এ ছাড়া আমাদের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সম্প্রতি দাবি করেছেন যে শুধু দলীয়ভাবে নির্বাচনের মাধ্যমেই তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। উপরন্তু, নির্দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও, যেহেতু দলগুলো তা মানে না, তাই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানই হবে যুক্তিযুক্ত। যেহেতু দলীয়ভাবেই নির্বাচন হয়ে আসছে, আইন করে তা করতে ক্ষতি কী! আমাদের মতে, এই সব কটি যুক্তিই অসার।
দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়ে আসা যাক। বলা হয় যে দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে দলের মনোনয়ন নিয়ে জয়ী প্রার্থীদের অবৈধ, অনৈতিক ও অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা যাবে, ফলে তাঁরা দায়িত্বশীল আচরণ করতে বাধ্য হবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিরাজমান দলান্ধতার সংস্কৃতির কারণে আমাদের রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। অর্থাৎ আমাদের দলগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলাবোধই অনুপস্থিত।
নির্বাচন—দলভিত্তিক হোক বা নির্দলীয় হোক—এটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তাই নির্দলীয় নির্বাচন রাজনীতিবিবর্জিত নয়। সুতরাং, যাঁরা যুক্তি দেখান যে নির্দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বিরাজনীতিকরণ হয়, তাঁদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কেই ধারণা অস্পষ্ট। আর আমাদের রাজনীতি আজ, মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষায়, ‘ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে গিয়েছে,’ যার প্রধান কারণ হলো মনোনয়ন-বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে প্রবেশ। আমাদের দলগুলোর অর্বাচীনতার কারণেই আজ আমাদের সাংসদদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবসায়ী।
গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন, আর এ সম্মতি অর্জিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিরা—যাঁরা দলীয় হতে পারেন বা নির্দলীয়ও হতে পারেন—যদি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করেন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয়। এর মাধ্যমে একঝাঁক নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির পথও সুগম হয়। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়ে দলভিত্তিক নির্বাচন আর রাজনীতি যেমন এক কথা নয়, তেমনিভাবে গণতন্ত্রও দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের ওপর নির্ভর করে না।
অনেকেই বলেন যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় নির্বাচনের নিয়মনীতি মেনে চলে না, তাই নিয়মনীতি পরিবর্তন করতে হবে। এই যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের জন্য গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। দলকে কোটরি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকাও আবশ্যক। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে আমরা যথার্থ রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। আমাদের আশঙ্কা যে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন দলের নামে দলাদলি ও মারামারি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে এটি সুস্পষ্ট যে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষের যুক্তিগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমরা মনে করি যে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও এ ব্যাপারে সরকারের সামনে অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে না। বস্তুত, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, যেখানে ন্যূনতম মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা হয় না, আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই। এ অবস্থায় দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
গণতন্ত্রের অন্যতম মূল্যবোধ হলো বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ ও ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অসহ্যই করে না, তারা সাংঘর্ষিক রাজনীতিতে জড়িত। এ ধরনের পরিবেশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুকূলে নয়। সুতরাং, দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার চেয়ে দলতন্ত্র ও দলবাজি তথা দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকেই উৎসাহিত করবে। প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক দল জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চার জন্য অপরিহার্য হলেও দলতন্ত্র গণতন্ত্রের শত্রু।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের জন্য গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। দলকে কোটরি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকাও আবশ্যক। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে আমরা যথার্থ রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। বহু বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আফসোস করে বলেছিলেন, বাঙালি দলাদলিই করতে পারে, কিন্তু দল গড়ে তুলতে পারে না। আমাদের আশঙ্কা যে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন দলের নামে দলাদলি ও মারামারি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।
তাই দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের সুফল অর্জনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক আচরণ ও মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে একটি ব্যাপক ভিত্তিতে সংলাপের আয়োজন আবশ্যক।
প্রস্তাবিত সংলাপের উদ্দেশ্য হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক ও দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো, যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। একই সঙ্গে মনোনয়নের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থার প্রচলন করা। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ আচরণ নিশ্চিত করা। কারণ, এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতদুষ্টতা প্রহসনের নির্বাচনের পথই সুগম করে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও দলের প্রস্তাবিত সংস্কার ব্যতীত দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য হবে ব্যাপক টাকার খেলা ও পেশিশক্তির ব্যবহার, যা প্রার্থীর যোগ্যতাকে নিম্নমুখী করতে বাধ্য। এ ছাড়া ভয়ভীতি প্রদর্শন, মামলা-হামলা দ্বারা বিরোধী দলের প্রার্থীদের হয়রানি করা হতে পারে। এ কাজে দলীয় ক্যাডার ও সরকারি ক্ষমতা ব্যবহৃত হতে পারে। এমনকি এভাবে প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকেও বিরত রাখা হতে পারে।
উল্লেখ্য, কালের কণ্ঠ–এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন (১২ অক্টোবর ২০১৫) অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের বাধার কারণে ২৫ শতাংশ প্রার্থী তাঁদের মনোনয়নপত্রই জমা দিতে পারেননি। এটি সবারই জানা যে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ দলনিরপেক্ষ এবং পশ্চিমবঙ্গের আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলতন্ত্রের শিকার নয়।
তাই প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও দলের সংস্কার ছাড়া দলভিত্তিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে বলেই আমাদের আশঙ্কা। আর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরওÿ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইতিমধ্যে দলীয় প্রশাসক নিয়োগের কারণে জেলা পরিষদ ক্ষমতাসীন দলের কবজায়। সাংসদেরা উপজেলা পরিষদের ওপরও খবরদারি করে থাকেন। এখন অবশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানেও ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে তাদের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ হবে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। গণতন্ত্র হলো সবাইকে নিয়ে পথচলা এবং সব স্তরে একটি শক্তিশালী বিরোধী প্রতিপক্ষের উপস্থিতি।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ এবং দলতন্ত্রের চর্চা বিরোধী দলের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের, সাধারণ মানুষ, এমনকি সরকারি দলের ভিন্নমতের সমর্থকদেরও গুরুত্বপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত করতে পারে। দলীয় প্রতীকের কর্তৃত্ববাদী প্রভাবের কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থী, যাঁরা অনেক ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ভালো, নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে যেতে পারেন। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দল স্বল্পসংখ্যক নারীকে মনোনয়ন দেবে। ফলে স্থানীয় সরকারে নারীদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগও সংকুচিত হবে। এভাবে দলভিত্তিক নির্বাচন শুধু স্থানীয় প্রতিনিধিদের গুণগত মানেরই অবনতি ঘটবে না, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বের বিকাশও ব্যাহত করবে।
প্রসঙ্গত, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্তমান সরকারের অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তগুলোর অন্যতম। ১৯ অক্টোবর রংপুরে এ বিষয়ে একটি আলোচনা সভায় আমার অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়, যাতে ইউনিয়ন পরিষদের দুজন চেয়ারম্যান, বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদসহ সমাজের সব ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্বকারী ৬২ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় ২৮ জন ব্যক্তি অংশ নেন, তার মধ্যে ২০ জন এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে, চারজন এর পক্ষে বক্তব্য দেন এবং চারজন কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান নেননি (যার মধ্যে দুজন এই ইস্যুতে জনমত যাচাইয়ের পক্ষে মত দেন)। উল্লেখ্য, দুজন চেয়ারম্যানই এর বিপক্ষে অবস্থান নেন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে রাজনীতিতে দলের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। আরেকটি যুক্তি হলো যে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করলে নির্বাচনটি হবে ‘রাজনৈতিক’, ফলে নির্দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ‘বিরাজনীতিকরণের’ পথ রুদ্ধ হবে। এ ছাড়া আমাদের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সম্প্রতি দাবি করেছেন যে শুধু দলীয়ভাবে নির্বাচনের মাধ্যমেই তৃণমূলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। উপরন্তু, নির্দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও, যেহেতু দলগুলো তা মানে না, তাই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানই হবে যুক্তিযুক্ত। যেহেতু দলীয়ভাবেই নির্বাচন হয়ে আসছে, আইন করে তা করতে ক্ষতি কী! আমাদের মতে, এই সব কটি যুক্তিই অসার।
দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়ে আসা যাক। বলা হয় যে দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে দলের মনোনয়ন নিয়ে জয়ী প্রার্থীদের অবৈধ, অনৈতিক ও অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা যাবে, ফলে তাঁরা দায়িত্বশীল আচরণ করতে বাধ্য হবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিরাজমান দলান্ধতার সংস্কৃতির কারণে আমাদের রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। অর্থাৎ আমাদের দলগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলাবোধই অনুপস্থিত।
নির্বাচন—দলভিত্তিক হোক বা নির্দলীয় হোক—এটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তাই নির্দলীয় নির্বাচন রাজনীতিবিবর্জিত নয়। সুতরাং, যাঁরা যুক্তি দেখান যে নির্দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বিরাজনীতিকরণ হয়, তাঁদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কেই ধারণা অস্পষ্ট। আর আমাদের রাজনীতি আজ, মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষায়, ‘ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে গিয়েছে,’ যার প্রধান কারণ হলো মনোনয়ন-বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে প্রবেশ। আমাদের দলগুলোর অর্বাচীনতার কারণেই আজ আমাদের সাংসদদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবসায়ী।
গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন, আর এ সম্মতি অর্জিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিরা—যাঁরা দলীয় হতে পারেন বা নির্দলীয়ও হতে পারেন—যদি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করেন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক শাসনের সূচনা হয়। এর মাধ্যমে একঝাঁক নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির পথও সুগম হয়। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়ে দলভিত্তিক নির্বাচন আর রাজনীতি যেমন এক কথা নয়, তেমনিভাবে গণতন্ত্রও দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের ওপর নির্ভর করে না।
অনেকেই বলেন যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় নির্বাচনের নিয়মনীতি মেনে চলে না, তাই নিয়মনীতি পরিবর্তন করতে হবে। এই যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের জন্য গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। দলকে কোটরি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকাও আবশ্যক। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে আমরা যথার্থ রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। আমাদের আশঙ্কা যে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন দলের নামে দলাদলি ও মারামারি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে এটি সুস্পষ্ট যে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষের যুক্তিগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমরা মনে করি যে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও এ ব্যাপারে সরকারের সামনে অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে না। বস্তুত, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, যেখানে ন্যূনতম মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা হয় না, আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই। এ অবস্থায় দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
গণতন্ত্রের অন্যতম মূল্যবোধ হলো বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ ও ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অসহ্যই করে না, তারা সাংঘর্ষিক রাজনীতিতে জড়িত। এ ধরনের পরিবেশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুকূলে নয়। সুতরাং, দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার চেয়ে দলতন্ত্র ও দলবাজি তথা দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকেই উৎসাহিত করবে। প্রসঙ্গত, রাজনৈতিক দল জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চার জন্য অপরিহার্য হলেও দলতন্ত্র গণতন্ত্রের শত্রু।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের জন্য গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। দলকে কোটরি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকাও আবশ্যক। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে আমরা যথার্থ রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। বহু বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আফসোস করে বলেছিলেন, বাঙালি দলাদলিই করতে পারে, কিন্তু দল গড়ে তুলতে পারে না। আমাদের আশঙ্কা যে দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন দলের নামে দলাদলি ও মারামারি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।
তাই দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনের সুফল অর্জনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক আচরণ ও মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে একটি ব্যাপক ভিত্তিতে সংলাপের আয়োজন আবশ্যক।
প্রস্তাবিত সংলাপের উদ্দেশ্য হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক ও দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো, যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। একই সঙ্গে মনোনয়নের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থার প্রচলন করা। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ আচরণ নিশ্চিত করা। কারণ, এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতদুষ্টতা প্রহসনের নির্বাচনের পথই সুগম করে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও দলের প্রস্তাবিত সংস্কার ব্যতীত দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য হবে ব্যাপক টাকার খেলা ও পেশিশক্তির ব্যবহার, যা প্রার্থীর যোগ্যতাকে নিম্নমুখী করতে বাধ্য। এ ছাড়া ভয়ভীতি প্রদর্শন, মামলা-হামলা দ্বারা বিরোধী দলের প্রার্থীদের হয়রানি করা হতে পারে। এ কাজে দলীয় ক্যাডার ও সরকারি ক্ষমতা ব্যবহৃত হতে পারে। এমনকি এভাবে প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকেও বিরত রাখা হতে পারে।
উল্লেখ্য, কালের কণ্ঠ–এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন (১২ অক্টোবর ২০১৫) অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের বাধার কারণে ২৫ শতাংশ প্রার্থী তাঁদের মনোনয়নপত্রই জমা দিতে পারেননি। এটি সবারই জানা যে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ দলনিরপেক্ষ এবং পশ্চিমবঙ্গের আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দলতন্ত্রের শিকার নয়।
তাই প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও দলের সংস্কার ছাড়া দলভিত্তিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে বলেই আমাদের আশঙ্কা। আর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরওÿ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইতিমধ্যে দলীয় প্রশাসক নিয়োগের কারণে জেলা পরিষদ ক্ষমতাসীন দলের কবজায়। সাংসদেরা উপজেলা পরিষদের ওপরও খবরদারি করে থাকেন। এখন অবশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানেও ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে তাদের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ হবে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। গণতন্ত্র হলো সবাইকে নিয়ে পথচলা এবং সব স্তরে একটি শক্তিশালী বিরোধী প্রতিপক্ষের উপস্থিতি।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ এবং দলতন্ত্রের চর্চা বিরোধী দলের প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের, সাধারণ মানুষ, এমনকি সরকারি দলের ভিন্নমতের সমর্থকদেরও গুরুত্বপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত করতে পারে। দলীয় প্রতীকের কর্তৃত্ববাদী প্রভাবের কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থী, যাঁরা অনেক ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ভালো, নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে যেতে পারেন। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দল স্বল্পসংখ্যক নারীকে মনোনয়ন দেবে। ফলে স্থানীয় সরকারে নারীদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগও সংকুচিত হবে। এভাবে দলভিত্তিক নির্বাচন শুধু স্থানীয় প্রতিনিধিদের গুণগত মানেরই অবনতি ঘটবে না, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বের বিকাশও ব্যাহত করবে।
প্রসঙ্গত, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্তমান সরকারের অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তগুলোর অন্যতম। ১৯ অক্টোবর রংপুরে এ বিষয়ে একটি আলোচনা সভায় আমার অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়, যাতে ইউনিয়ন পরিষদের দুজন চেয়ারম্যান, বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদসহ সমাজের সব ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্বকারী ৬২ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় ২৮ জন ব্যক্তি অংশ নেন, তার মধ্যে ২০ জন এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে, চারজন এর পক্ষে বক্তব্য দেন এবং চারজন কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান নেননি (যার মধ্যে দুজন এই ইস্যুতে জনমত যাচাইয়ের পক্ষে মত দেন)। উল্লেখ্য, দুজন চেয়ারম্যানই এর বিপক্ষে অবস্থান নেন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments