বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’ by মিজানুর রহমান খান
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. গোলাম রাব্বানী আলোচনার সূচনাতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বিচারকদের রাখার বিধান বহাল রাখা সমর্থন করলেন। তিনি বললেন, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিরাই সবচেয়ে নিরপেক্ষ। তাই এই পদে বিচারকদের রাখলে ক্ষতি নেই। সবিনয়ে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন ড. আকবর আলি খান। তাঁর কথায় আশ্বস্ত হলাম। ড. খানের যুক্তি: বিচারকদের উপদেষ্টা রাখার কারণে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি নানাবিধ বিকল্পের কথা বললেন। আমি তাঁকে সমর্থন জানালাম। বললাম, স্যার, নিনিয়ানের ৫+৫+১ ফর্মুলা এখনো উত্তম মনে করি। তবে যা-ই হোক, এ নিয়ে একটা ফয়সালার চেষ্টা এখনই শুরু করা উচিত। লগি-বৈঠার পরিবেশে সংবিধানসম্মত সুরাহা আশা করা চলে না। সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচাতে হবে। আদালতকে বাদ দিয়ে অন্য যেকোনো বিকল্প বের করতে হবে।
গত সপ্তাহে এই আলোচনা হচ্ছিল আরটিভির ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’ অনুষ্ঠানে। বললাম, এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় আছে। শুধু রায় বললে কম বলা হবে। এটা একটা মাইলফলক রায়। শুধু প্রধান উপদেষ্টা কেন, অবসরের পরবর্তী প্রথম তিন বছরে যাতে তাঁরা কোনো পদই না নেন, তা হোক লাভজনক বা অলাভজনক, সে বিষয়ে বিচারপতি খায়রুল হকের একটি অনন্যসাধারণ রায় আছে। এটা শুধু অবসরপ্রাপ্তদের জন্য নয়, কর্মরতদেরও জন্য প্রযোজ্য। কর্মরতদের জন্য নির্বাচন কমিশনের পদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছে এই রায়। বাংলায় লেখা এই শ্রমসাধ্য দীর্ঘ রায়টি পড়লে আপনার সামনে ছবির মতো ভেসে উঠবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের হাজার বছরের ইতিহাস। অবাক বিস্ময়ে আমরা সেই ইতিহাস পড়েছি। স্পন্দিত হয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, এই রায়টি হয়েছে জরুরি অবস্থায়, ১২ ডিসেম্বর ২০০৭। পূর্ণাঙ্গ রায় এসেছে আরও অনেক পরে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তখন বাতাসে ভাসছে।
প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তাঁর রায়ে স্পষ্ট বলেছেন, অবসরে গিয়ে এ ধরনের পদপদবি গ্রহণের সুযোগ বিচারকদের জন্য রাখা হলে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ওই আলোচনায় সে কথা উল্লেখ করে বলি, এর সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। তিনি এখন এ ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। বিচারপতি মো. গোলাম রাব্বানী এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের রায় সম্পর্কে আমার ‘আইডিয়া’ না থাকার কথা বলেন। তাঁর যুক্তি: বিচারকেরা রায়ের মাধ্যমে কথা বলেন। এর বাইরে কথা বলেন না। তাঁর মতে, বিচারপতি খায়রুল হকের তরফে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করা বা না-করা প্রশ্নে মন্তব্যের সময় এখনো আসেনি। টিভি উপস্থাপক অতঃপর ড. আকবর আলি খানের মন্তব্য জানতে চান। তিনি বিচারপতি রাব্বানীর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। তাঁর ভাষায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতে এখনো অনেক দেরি আছে। সুতরাং এখন বলার সুযোগ নেই।
তাঁদের প্রতিক্রিয়ার দুটি দিক আছে। একটি হলো, এখনই মতামত দিতে সংবিধান বাধা দেয় কি না। দ্বিতীয়ত, এখনই বলার সুযোগ আছে কি না। একটি আইনগত, অন্যটি রাজনৈতিক। আমি শুধু বললাম, বিজ্ঞ দুই আলোচক যে অভিমত রেখেছেন, সেটা আমি ধরে নিচ্ছি যে তাঁরা তাঁদের যুক্তি আইন ও সংবিধানের আলোকে করেছেন। প্রধান বিচারপতির এখন কথা বলা বারণ। টিভিতে শুধু বললাম, আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি।
এম এ আজিজ কর্মরত বিচারক থাকতে সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস (প্রধান বিচারপতি তাঁকে বিতর্কের মুখে অতিরিক্ত বিচারক পদে সম্প্রতি শপথ দেন)। এ মামলায় সিইসি পদে আজিজের নিয়োগ অবৈধ ঘোষিত হয়। এই রায়ে কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়, একটি নীতি মীমাংসিত হয়। টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুল ইসলাম, এম আমীর-উল ইসলাম, এম কে রহমান (বর্তমানে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল) ও ড. শাহ্দীন মালিক ছিলেন অ্যামিকাস কিউরি। বার ও বেঞ্চ এক বিরল মতৈক্যে পৌঁছান। তাঁরা বলেন যে অবসরে গিয়েও কোনো লাভজনক পদ গ্রহণ করা বিচারকের জন্য সমীচীন নয়। সামরিক ও বেসামরিক আমলারা গত কয়েক বছরে অবসর নিয়ে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছিলেন। আইন করে অবসর গ্রহণের তিন বছরের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয়। বাকি ছিলেন বিচারকেরা। এই রায় সেখানে শক্ত দেয়াল তুলে দেয়।
বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদটি পঞ্চম সংশোধনী মামলায় ফিরে আসতে পারত। তাহলে আমরা দেখতাম ত্রয়োদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিল হয়ে গেছে। বিচারপতি খায়রুল হক তা সযত্নে এড়িয়ে যান। কিন্তু এটা যে একটা বিরাট স্ববিরোধিতা ছিল, তা হয়তো তাঁকে পীড়িত করছিল। তাই আমরা দেখি, ২০০৫ সালে তাঁর ওই দৃশ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক পলায়ন দুই বছর বাদে তিনি বীরোচিতভাবেই মোকাবিলা করেন। তফাত শুধু এই যে ৯৯ অনুচ্ছেদকে বাঁচিয়ে তুলতে তিনি পুনর্মুদ্রণের সুযোগ সৃষ্টি করেননি। নির্দিষ্টভাবে সংসদকে শোধরাতে বলেছেন। পাঠক খেয়াল করবেন, নিজেদের পায়ের মাপের সঙ্গে এটা যায় না বলে দুই বড় দল ও তদীয় মিত্রজীবীরা এ বিষয়ে যথারীতি চুপচাপ আছেন।
বাহাত্তরের সংবিধানে কেন বলা হয়েছিল যে অবসরে গিয়ে বিচারকেরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে অযোগ্য হবেন, তার ইতিহাস তুলে ধরেছেন বিচারপতি খায়রুল হক। ক্রুদ্ধ রাজার সামনে ‘ভূমিতে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণামরত’ অবস্থায় থাকা প্রধান বিচারপতি কোক থেকে পরের ৪০০ বছরের ইতিহাসের অতল স্পর্শ করেন তিনি। রাজনীতিক ও বিচারবহির্ভূত পদপদবি গ্রহণে আগ্রহী বিচারকদের চোখে তিনি সজোরে অঙ্গুলি চালিয়েছেন। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘একটি জাতির সামনে এমন কোনো পরিস্থিতিই আসা স্বাভাবিক নয়, যখন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা লাভজনক পদে নিযুক্ত হবেন।’ আমাদের সমাজের কতিপয় লোক, গণতন্ত্র কিংবা বাংলাদেশি বাস্তবতার নিরিখে এখনো বিচারকদের রেহাই দিতে চান না, তাঁদের প্রতিও তিনি এই রোদনভরা বাণী দিয়েছেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
বিচারপতি খায়রুল হক প্রকারান্তরে লিখেছেন, বিচারকদের সামনে এ ধরনের পদের মুলো ঝুলিয়ে রাখা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। পাঠক যদি বলেন আপনি মুলো কথাটি বললেন, সেটা কি তিনি ব্যবহার করেছেন? আমি বলব, না, ঠিক মুলো নয়, তিনি এটাকে ‘ঘুষ’ বলেছেন। বলেছেন, এটা হলো ‘প্রলুব্ধকরণ’ বা সম্মোহন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কিন্তু অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে ১৯৮৯ সালে ঠিক এ কথাই বলেছিলেন। আবার এক বছর না যেতেই সেই তিনি তিন জোটের ঐতিহাসিক রূপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পদ গ্রহণ করেছিলেন। বিচারপতি খায়রুল হক যথার্থ বলেছেন, ‘নেহাত দুর্ভাগ্য ব্যতিরেকে কোনো জাতির জীবনে এই রূপ অস্বাভাবিক অবস্থা একাধিকবার আসে না। এবং সমস্যা সমাধানের অজুহাতে কখনোই নতুন কোনো স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।’ সুতরাং এরশাদের পতনের পর একটি বিশেষ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছিল। সেটাকে মডেল দেখিয়ে নির্বাহী বিভাগে বিচারকদের পদায়ন ছিল অবৈধ। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
তথাকথিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিচারিক যাচাই-বাছাই একেবারে কম হয়নি। ১৯৯৬ সাল। বিচারপতি এম এম হক ও বিচারপতি এম এ মতিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের সামনে সম্ভবত প্রথম প্রশ্ন এসেছিল। বলা হয়েছিল, এই সংশোধনীর জন্য গণভোট দরকার ছিল। ওই বেঞ্চ সরাসরি রিট নাকচ করে বলেছিলেন, গণভোট দরকার নেই। পরে ১৯৯৯ সালে আরেকটি রিটে যথার্থ প্রশ্ন তোলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে কি না? বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টার পদ গ্রহণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি ছিল এই রিটের অন্যতম প্রতিপাদ্য। বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এই প্রশ্নে বিভক্ত রায় দিয়েছিলেন। সে কারণে তিন সদস্যের একটি বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ গঠিত হয়েছিল। ২০০৪ সালে তাঁরা রায় দেন। এতে সার্বিকভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনী টিকে যায়। কিন্তু বিচারকদের উপদেষ্টা হওয়ার বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায়। বিচারকেরা যথেষ্ট রক্ষণশীলতার সঙ্গে সমর্থন দেন। তাঁরা বলেন, কেউ যদি নিজেকে পক্ষপাত বা কোনো দলের বিজয় দেখতে আগ্রহী হন, তাহলে তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ নেবেন না। তাঁরা আরও বলেন, সংসদ চাইলে তার আপন প্রজ্ঞায় বদলে নিতে পারে। তদুপরি আমরা হাইকোর্টের রায়ের সমালোচনা করি। কারণ তাঁরা বিচারকদের ‘প্রধানমন্ত্রীর’ মতো রাজনৈতিক পদ গ্রহণের বিষয়টিকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিধ্বংসী হিসেবে ঘোষণা করতে অসমর্থ হয়েছিলেন। হাইকোর্টের রায়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘সংসদের প্রজ্ঞা’র ওপর জোর দেওয়া হয়। সংসদের প্রজ্ঞা যদি এত পূত-পবিত্র হবে, তাহলে জিয়ার ফরমান পঞ্চম ছাড়াও দ্বাদশ সংশোধনীতে দুই দলের প্রজ্ঞায় পাস হলেও তা এখন অপবিত্র হলো কেন।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা পরীক্ষার ওই মামলায় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তনকে সমর্থন করেন। কিন্তু বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার বিধানকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর বলে বর্ণনা করেন। ওই মামলার অন্যতম অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তা সমর্থন করেন। এভাবে আমরা দেখি, বিচারকেরা যেকোনো অবস্থাতেই উপদেষ্টা হতে পারেন না এবং তেমন বিধান বিচার বিভাগবিধ্বংসী, সে কথায় দুই বড় দলের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরা একমত। এবং তার প্রমাণ সুপ্রিম কোর্টের হেফাজতে আছে।
বিচারকেরা উপদেষ্টা, মন্ত্রী কিংবা সিইসি হলে কী ক্ষতি, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন বিচারপতি খায়রুল হক। কোনো অবস্থাতেই বিচারকদের উপদেষ্টার পদ গ্রহণ সমর্থন করেননি তিনি। পরোক্ষভাবেও বৈধতা দেননি। এমনকি তিনি অবসর নেওয়ার তিন বছর পরও এ ধরনের পদপদবি গ্রহণের বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করেন। যেমন তিনি বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা প্রায় সবাই যে জ্ঞানে-গুণে এবং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এটা অনস্বীকার্য যে অবসরে গমনের পরও বিচারপতিরা তাঁদের সুদীর্ঘ কর্মজীবনে আহরিত অমূল্য অভিজ্ঞতার ফসল বিভিন্ন বিচার বিভাগীয় পদে বহাল হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু তা কখনোই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূল্যে নয়।’
বিচারপতি অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ছিলেন আমেরিকার সপ্তম প্রেসিডেন্ট। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সহযোগী বিচারক। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ের উপসংহারে বলেছেন, ‘বিচারপতি জ্যাকসনের ভাষায়, ‘বিচারকেরা (জ্যাকসন অবশ্য তাঁর রায়ে বিচারক নয়, মানুষ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন) প্রায়ই অর্থের চেয়ে বেশি মাত্রায় উচ্চাভিলাষ ও আনুগত্যের ঘুষ গ্রহণ করে থাকেন। অতএব বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতাকে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কোনো কারণে বা কোনো অবস্থাতেই ক্ষুণ্ন করা যাবে না।’
বিচারপতি খায়রুল হক আরও লিখেছেন, ‘বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা এবং ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি সংবিধানের মূল নীতিগুলো অপরিবর্তনীয়। নির্বাহী আদেশ বা আইন সংশোধন মারফত কোনোভাবেই সংবিধানের কোনো মূল নীতিকে বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না, এমনকি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেও নয়।’ তার মানে, ত্রয়োদশ সংশোধনীতে বিচারকদের জন্য রাখা টোপের প্রতি তিনি কটাক্ষ হেনেছেন। তিনি লেখেন, ‘সংশোধিত সংবিধান যদি উক্ত মূল নীতিকে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্বল করে তাহলে সংশোধিত সংবিধানের সেই অংশ অসাংবিধানিক হবে। প্রলুব্ধতার হাত থেকে রক্ষা করবার স্বার্থে অবসর বা অপসারিত হবার পর প্রজাতন্ত্রের অন্য কোন লাভজনক পদে বহাল করা থেকে বিচারকদের সাংবিধানিকভাবে অযোগ্য করা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যৎ অনুগ্রহের আশায় দায়িত্ব পালন কর্মকালীন সময়ে তাঁদের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবার কোন আশঙ্কা না থাকে।’ এরপর তিনি আরও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেন যে ‘সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারক তাঁর পদে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কিংবা অবসর গ্রহণের পর কিংবা অপসারণের পর সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য বা নীতির পরিপন্থী বা ব্যতিক্রমকরত কোন প্রকার লাভজনক বা অলাভজনক পদ গ্রহণ করতে পারবেন না।’
আমরা এটা ধরে নিতে পারি, প্রধান উপদেষ্টা হওয়াসংক্রান্ত জটিলতা তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিল। সে কারণে তিনি যেসব পদপদবি গ্রহণ করা যাবে না, তার একটি তালিকা দেন। এর নামকরণ করেন ‘উদ্ভাসিত সত্য’। সেই সত্যে তিনি অবসরে যাওয়া বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণকে নিষিদ্ধ করেন বলেই প্রতীয়মান হয়।
এমনকি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা টি এইচ খান নির্দিষ্ট অভিমত দেন, বিচারকেরা অবসরে গমনের দুই-তিন বছর পরই শুধু যথাযথ বিচার বিভাগীয় বা আধা বিচার বিভাগীয় পদে বহাল হতে পারেন। এমনকি বিএনপি-সমর্থিত বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনও এ বিষয়ে পরিত্রাণ পেতে সোচ্চার। আমরা শুধু দেখি, দুই নেত্রী তাঁদের বিচিত্র ও ঝাঁঝালো বাদানুবাদের মধ্যেও কায়দা করে এই বিষয়টিতে তাঁদের অবস্থান নির্দিষ্ট করছেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা পদে বিতর্কিত করতেই বিএনপি তাঁর সমালোচনা করছে। বিএনপি অনেক আগেই বলেছে, তারা তাঁর অধীনে নির্বাচনে যাবে না। রফিক-উল হক বলেন, ‘অ্যাটর্নি জানলেন কী করে যে তিনিই হবেন।’ তবে আমরা মনে রাখব, এ ধরনের বোলচালে কোনো গঠনমূলক অবস্থান নেই। আলোচ্য রায়ের কথা প্রবক্তাদের কাউকে মুখে নিতে দেখি না।
শেক্সপিয়ারের কালজয়ী ‘হ্যামলেট’ নাটক সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়। মনে হচ্ছে তার চেয়েও জনপ্রিয় ছয় শব্দের একটি সংলাপ। ‘টু বি অর নট টু বি’। এর অর্থ হতে পারে আলোতে বেরিয়ে আসব, নাকি অন্ধকারে। প্রধান বিচারপতি এই মুহূর্তে ‘টু বি অর নট টু বি’-তে আছেন ও থাকবেন। তিনি তাঁর ওই রায়ের ৩৭৭ নম্বর প্যারাগ্রাফে লিখেছেন, ‘এমতাবস্থায় একদিকে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণের সেবা গ্রহণ, অন্যদিকে তাঁদেরকে প্রলুব্ধতার হাত থেকে রক্ষা করে দেশ ও জাতিকে রক্ষাকরণ—এই দুইয়ের মধ্যে টু বি অর নট টু বি-এর মতো অবস্থান। এর মধ্যে একটি সমতা আনা প্রয়োজন। এই রূপ সমতা আনয়নের কথা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর অষ্টম সংশোধনী রায়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমতাবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারপতিকে তাঁর অবসর গ্রহণের অন্তত তিন বছর অতিবাহিত হবার পর কোন পদে বহাল করবার লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় সংশোধনী বাংলাদেশ সংসদ আনতে পারে।’
আমরা তাঁর সঙ্গে একমত। রুহুল কুদ্দুস বনাম বিচারপতি আজিজ মামলার রায়টির প্রতি অক্ষরের সঙ্গে আমরা একমত। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দুই বড় দলীয় কিংবা নির্দলীয় উল্লিখিত শীর্ষ আইনবিদেরা সত্যিই বিশ্বাস করেন, সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচাতে হবে। আর সে জন্য মুলো ঝোলানোর ওই বিধান অপসারণ করা দরকার। আমরা আশা করব, যথেষ্ট সময় থাকতেই ৯৯ অনুচ্ছেদে উপযুক্ত সংশোধনী আনা হবে। জনগণকে ভাঁওতাবাজির কবল থেকে মুক্তি দিতে পরম করুণাময় আমাদের সবাইকে শক্তি দিন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
গত সপ্তাহে এই আলোচনা হচ্ছিল আরটিভির ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’ অনুষ্ঠানে। বললাম, এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় আছে। শুধু রায় বললে কম বলা হবে। এটা একটা মাইলফলক রায়। শুধু প্রধান উপদেষ্টা কেন, অবসরের পরবর্তী প্রথম তিন বছরে যাতে তাঁরা কোনো পদই না নেন, তা হোক লাভজনক বা অলাভজনক, সে বিষয়ে বিচারপতি খায়রুল হকের একটি অনন্যসাধারণ রায় আছে। এটা শুধু অবসরপ্রাপ্তদের জন্য নয়, কর্মরতদেরও জন্য প্রযোজ্য। কর্মরতদের জন্য নির্বাচন কমিশনের পদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছে এই রায়। বাংলায় লেখা এই শ্রমসাধ্য দীর্ঘ রায়টি পড়লে আপনার সামনে ছবির মতো ভেসে উঠবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের হাজার বছরের ইতিহাস। অবাক বিস্ময়ে আমরা সেই ইতিহাস পড়েছি। স্পন্দিত হয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, এই রায়টি হয়েছে জরুরি অবস্থায়, ১২ ডিসেম্বর ২০০৭। পূর্ণাঙ্গ রায় এসেছে আরও অনেক পরে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তখন বাতাসে ভাসছে।
প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তাঁর রায়ে স্পষ্ট বলেছেন, অবসরে গিয়ে এ ধরনের পদপদবি গ্রহণের সুযোগ বিচারকদের জন্য রাখা হলে বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ওই আলোচনায় সে কথা উল্লেখ করে বলি, এর সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। তিনি এখন এ ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। বিচারপতি মো. গোলাম রাব্বানী এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের রায় সম্পর্কে আমার ‘আইডিয়া’ না থাকার কথা বলেন। তাঁর যুক্তি: বিচারকেরা রায়ের মাধ্যমে কথা বলেন। এর বাইরে কথা বলেন না। তাঁর মতে, বিচারপতি খায়রুল হকের তরফে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করা বা না-করা প্রশ্নে মন্তব্যের সময় এখনো আসেনি। টিভি উপস্থাপক অতঃপর ড. আকবর আলি খানের মন্তব্য জানতে চান। তিনি বিচারপতি রাব্বানীর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। তাঁর ভাষায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতে এখনো অনেক দেরি আছে। সুতরাং এখন বলার সুযোগ নেই।
তাঁদের প্রতিক্রিয়ার দুটি দিক আছে। একটি হলো, এখনই মতামত দিতে সংবিধান বাধা দেয় কি না। দ্বিতীয়ত, এখনই বলার সুযোগ আছে কি না। একটি আইনগত, অন্যটি রাজনৈতিক। আমি শুধু বললাম, বিজ্ঞ দুই আলোচক যে অভিমত রেখেছেন, সেটা আমি ধরে নিচ্ছি যে তাঁরা তাঁদের যুক্তি আইন ও সংবিধানের আলোকে করেছেন। প্রধান বিচারপতির এখন কথা বলা বারণ। টিভিতে শুধু বললাম, আমি বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি।
এম এ আজিজ কর্মরত বিচারক থাকতে সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস (প্রধান বিচারপতি তাঁকে বিতর্কের মুখে অতিরিক্ত বিচারক পদে সম্প্রতি শপথ দেন)। এ মামলায় সিইসি পদে আজিজের নিয়োগ অবৈধ ঘোষিত হয়। এই রায়ে কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়, একটি নীতি মীমাংসিত হয়। টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুল ইসলাম, এম আমীর-উল ইসলাম, এম কে রহমান (বর্তমানে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল) ও ড. শাহ্দীন মালিক ছিলেন অ্যামিকাস কিউরি। বার ও বেঞ্চ এক বিরল মতৈক্যে পৌঁছান। তাঁরা বলেন যে অবসরে গিয়েও কোনো লাভজনক পদ গ্রহণ করা বিচারকের জন্য সমীচীন নয়। সামরিক ও বেসামরিক আমলারা গত কয়েক বছরে অবসর নিয়ে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছিলেন। আইন করে অবসর গ্রহণের তিন বছরের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করা হয়। বাকি ছিলেন বিচারকেরা। এই রায় সেখানে শক্ত দেয়াল তুলে দেয়।
বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদটি পঞ্চম সংশোধনী মামলায় ফিরে আসতে পারত। তাহলে আমরা দেখতাম ত্রয়োদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিল হয়ে গেছে। বিচারপতি খায়রুল হক তা সযত্নে এড়িয়ে যান। কিন্তু এটা যে একটা বিরাট স্ববিরোধিতা ছিল, তা হয়তো তাঁকে পীড়িত করছিল। তাই আমরা দেখি, ২০০৫ সালে তাঁর ওই দৃশ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক পলায়ন দুই বছর বাদে তিনি বীরোচিতভাবেই মোকাবিলা করেন। তফাত শুধু এই যে ৯৯ অনুচ্ছেদকে বাঁচিয়ে তুলতে তিনি পুনর্মুদ্রণের সুযোগ সৃষ্টি করেননি। নির্দিষ্টভাবে সংসদকে শোধরাতে বলেছেন। পাঠক খেয়াল করবেন, নিজেদের পায়ের মাপের সঙ্গে এটা যায় না বলে দুই বড় দল ও তদীয় মিত্রজীবীরা এ বিষয়ে যথারীতি চুপচাপ আছেন।
বাহাত্তরের সংবিধানে কেন বলা হয়েছিল যে অবসরে গিয়ে বিচারকেরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে অযোগ্য হবেন, তার ইতিহাস তুলে ধরেছেন বিচারপতি খায়রুল হক। ক্রুদ্ধ রাজার সামনে ‘ভূমিতে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণামরত’ অবস্থায় থাকা প্রধান বিচারপতি কোক থেকে পরের ৪০০ বছরের ইতিহাসের অতল স্পর্শ করেন তিনি। রাজনীতিক ও বিচারবহির্ভূত পদপদবি গ্রহণে আগ্রহী বিচারকদের চোখে তিনি সজোরে অঙ্গুলি চালিয়েছেন। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘একটি জাতির সামনে এমন কোনো পরিস্থিতিই আসা স্বাভাবিক নয়, যখন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকেরা লাভজনক পদে নিযুক্ত হবেন।’ আমাদের সমাজের কতিপয় লোক, গণতন্ত্র কিংবা বাংলাদেশি বাস্তবতার নিরিখে এখনো বিচারকদের রেহাই দিতে চান না, তাঁদের প্রতিও তিনি এই রোদনভরা বাণী দিয়েছেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
বিচারপতি খায়রুল হক প্রকারান্তরে লিখেছেন, বিচারকদের সামনে এ ধরনের পদের মুলো ঝুলিয়ে রাখা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। পাঠক যদি বলেন আপনি মুলো কথাটি বললেন, সেটা কি তিনি ব্যবহার করেছেন? আমি বলব, না, ঠিক মুলো নয়, তিনি এটাকে ‘ঘুষ’ বলেছেন। বলেছেন, এটা হলো ‘প্রলুব্ধকরণ’ বা সম্মোহন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কিন্তু অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে ১৯৮৯ সালে ঠিক এ কথাই বলেছিলেন। আবার এক বছর না যেতেই সেই তিনি তিন জোটের ঐতিহাসিক রূপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পদ গ্রহণ করেছিলেন। বিচারপতি খায়রুল হক যথার্থ বলেছেন, ‘নেহাত দুর্ভাগ্য ব্যতিরেকে কোনো জাতির জীবনে এই রূপ অস্বাভাবিক অবস্থা একাধিকবার আসে না। এবং সমস্যা সমাধানের অজুহাতে কখনোই নতুন কোনো স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।’ সুতরাং এরশাদের পতনের পর একটি বিশেষ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছিল। সেটাকে মডেল দেখিয়ে নির্বাহী বিভাগে বিচারকদের পদায়ন ছিল অবৈধ। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
তথাকথিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিচারিক যাচাই-বাছাই একেবারে কম হয়নি। ১৯৯৬ সাল। বিচারপতি এম এম হক ও বিচারপতি এম এ মতিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের সামনে সম্ভবত প্রথম প্রশ্ন এসেছিল। বলা হয়েছিল, এই সংশোধনীর জন্য গণভোট দরকার ছিল। ওই বেঞ্চ সরাসরি রিট নাকচ করে বলেছিলেন, গণভোট দরকার নেই। পরে ১৯৯৯ সালে আরেকটি রিটে যথার্থ প্রশ্ন তোলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে কি না? বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টার পদ গ্রহণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি ছিল এই রিটের অন্যতম প্রতিপাদ্য। বিচারপতি শাহ আবু নঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এই প্রশ্নে বিভক্ত রায় দিয়েছিলেন। সে কারণে তিন সদস্যের একটি বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ গঠিত হয়েছিল। ২০০৪ সালে তাঁরা রায় দেন। এতে সার্বিকভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনী টিকে যায়। কিন্তু বিচারকদের উপদেষ্টা হওয়ার বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায়। বিচারকেরা যথেষ্ট রক্ষণশীলতার সঙ্গে সমর্থন দেন। তাঁরা বলেন, কেউ যদি নিজেকে পক্ষপাত বা কোনো দলের বিজয় দেখতে আগ্রহী হন, তাহলে তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ নেবেন না। তাঁরা আরও বলেন, সংসদ চাইলে তার আপন প্রজ্ঞায় বদলে নিতে পারে। তদুপরি আমরা হাইকোর্টের রায়ের সমালোচনা করি। কারণ তাঁরা বিচারকদের ‘প্রধানমন্ত্রীর’ মতো রাজনৈতিক পদ গ্রহণের বিষয়টিকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোবিধ্বংসী হিসেবে ঘোষণা করতে অসমর্থ হয়েছিলেন। হাইকোর্টের রায়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘সংসদের প্রজ্ঞা’র ওপর জোর দেওয়া হয়। সংসদের প্রজ্ঞা যদি এত পূত-পবিত্র হবে, তাহলে জিয়ার ফরমান পঞ্চম ছাড়াও দ্বাদশ সংশোধনীতে দুই দলের প্রজ্ঞায় পাস হলেও তা এখন অপবিত্র হলো কেন।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা পরীক্ষার ওই মামলায় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তনকে সমর্থন করেন। কিন্তু বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার বিধানকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর বলে বর্ণনা করেন। ওই মামলার অন্যতম অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তা সমর্থন করেন। এভাবে আমরা দেখি, বিচারকেরা যেকোনো অবস্থাতেই উপদেষ্টা হতে পারেন না এবং তেমন বিধান বিচার বিভাগবিধ্বংসী, সে কথায় দুই বড় দলের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরা একমত। এবং তার প্রমাণ সুপ্রিম কোর্টের হেফাজতে আছে।
বিচারকেরা উপদেষ্টা, মন্ত্রী কিংবা সিইসি হলে কী ক্ষতি, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন বিচারপতি খায়রুল হক। কোনো অবস্থাতেই বিচারকদের উপদেষ্টার পদ গ্রহণ সমর্থন করেননি তিনি। পরোক্ষভাবেও বৈধতা দেননি। এমনকি তিনি অবসর নেওয়ার তিন বছর পরও এ ধরনের পদপদবি গ্রহণের বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করেন। যেমন তিনি বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা প্রায় সবাই যে জ্ঞানে-গুণে এবং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এটা অনস্বীকার্য যে অবসরে গমনের পরও বিচারপতিরা তাঁদের সুদীর্ঘ কর্মজীবনে আহরিত অমূল্য অভিজ্ঞতার ফসল বিভিন্ন বিচার বিভাগীয় পদে বহাল হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু তা কখনোই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূল্যে নয়।’
বিচারপতি অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ছিলেন আমেরিকার সপ্তম প্রেসিডেন্ট। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সহযোগী বিচারক। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ের উপসংহারে বলেছেন, ‘বিচারপতি জ্যাকসনের ভাষায়, ‘বিচারকেরা (জ্যাকসন অবশ্য তাঁর রায়ে বিচারক নয়, মানুষ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন) প্রায়ই অর্থের চেয়ে বেশি মাত্রায় উচ্চাভিলাষ ও আনুগত্যের ঘুষ গ্রহণ করে থাকেন। অতএব বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতাকে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কোনো কারণে বা কোনো অবস্থাতেই ক্ষুণ্ন করা যাবে না।’
বিচারপতি খায়রুল হক আরও লিখেছেন, ‘বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা এবং ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি সংবিধানের মূল নীতিগুলো অপরিবর্তনীয়। নির্বাহী আদেশ বা আইন সংশোধন মারফত কোনোভাবেই সংবিধানের কোনো মূল নীতিকে বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না, এমনকি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেও নয়।’ তার মানে, ত্রয়োদশ সংশোধনীতে বিচারকদের জন্য রাখা টোপের প্রতি তিনি কটাক্ষ হেনেছেন। তিনি লেখেন, ‘সংশোধিত সংবিধান যদি উক্ত মূল নীতিকে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্বল করে তাহলে সংশোধিত সংবিধানের সেই অংশ অসাংবিধানিক হবে। প্রলুব্ধতার হাত থেকে রক্ষা করবার স্বার্থে অবসর বা অপসারিত হবার পর প্রজাতন্ত্রের অন্য কোন লাভজনক পদে বহাল করা থেকে বিচারকদের সাংবিধানিকভাবে অযোগ্য করা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যৎ অনুগ্রহের আশায় দায়িত্ব পালন কর্মকালীন সময়ে তাঁদের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবার কোন আশঙ্কা না থাকে।’ এরপর তিনি আরও দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেন যে ‘সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারক তাঁর পদে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কিংবা অবসর গ্রহণের পর কিংবা অপসারণের পর সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য বা নীতির পরিপন্থী বা ব্যতিক্রমকরত কোন প্রকার লাভজনক বা অলাভজনক পদ গ্রহণ করতে পারবেন না।’
আমরা এটা ধরে নিতে পারি, প্রধান উপদেষ্টা হওয়াসংক্রান্ত জটিলতা তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিল। সে কারণে তিনি যেসব পদপদবি গ্রহণ করা যাবে না, তার একটি তালিকা দেন। এর নামকরণ করেন ‘উদ্ভাসিত সত্য’। সেই সত্যে তিনি অবসরে যাওয়া বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণকে নিষিদ্ধ করেন বলেই প্রতীয়মান হয়।
এমনকি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা টি এইচ খান নির্দিষ্ট অভিমত দেন, বিচারকেরা অবসরে গমনের দুই-তিন বছর পরই শুধু যথাযথ বিচার বিভাগীয় বা আধা বিচার বিভাগীয় পদে বহাল হতে পারেন। এমনকি বিএনপি-সমর্থিত বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনও এ বিষয়ে পরিত্রাণ পেতে সোচ্চার। আমরা শুধু দেখি, দুই নেত্রী তাঁদের বিচিত্র ও ঝাঁঝালো বাদানুবাদের মধ্যেও কায়দা করে এই বিষয়টিতে তাঁদের অবস্থান নির্দিষ্ট করছেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা পদে বিতর্কিত করতেই বিএনপি তাঁর সমালোচনা করছে। বিএনপি অনেক আগেই বলেছে, তারা তাঁর অধীনে নির্বাচনে যাবে না। রফিক-উল হক বলেন, ‘অ্যাটর্নি জানলেন কী করে যে তিনিই হবেন।’ তবে আমরা মনে রাখব, এ ধরনের বোলচালে কোনো গঠনমূলক অবস্থান নেই। আলোচ্য রায়ের কথা প্রবক্তাদের কাউকে মুখে নিতে দেখি না।
শেক্সপিয়ারের কালজয়ী ‘হ্যামলেট’ নাটক সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়। মনে হচ্ছে তার চেয়েও জনপ্রিয় ছয় শব্দের একটি সংলাপ। ‘টু বি অর নট টু বি’। এর অর্থ হতে পারে আলোতে বেরিয়ে আসব, নাকি অন্ধকারে। প্রধান বিচারপতি এই মুহূর্তে ‘টু বি অর নট টু বি’-তে আছেন ও থাকবেন। তিনি তাঁর ওই রায়ের ৩৭৭ নম্বর প্যারাগ্রাফে লিখেছেন, ‘এমতাবস্থায় একদিকে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণের সেবা গ্রহণ, অন্যদিকে তাঁদেরকে প্রলুব্ধতার হাত থেকে রক্ষা করে দেশ ও জাতিকে রক্ষাকরণ—এই দুইয়ের মধ্যে টু বি অর নট টু বি-এর মতো অবস্থান। এর মধ্যে একটি সমতা আনা প্রয়োজন। এই রূপ সমতা আনয়নের কথা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর অষ্টম সংশোধনী রায়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমতাবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারপতিকে তাঁর অবসর গ্রহণের অন্তত তিন বছর অতিবাহিত হবার পর কোন পদে বহাল করবার লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় সংশোধনী বাংলাদেশ সংসদ আনতে পারে।’
আমরা তাঁর সঙ্গে একমত। রুহুল কুদ্দুস বনাম বিচারপতি আজিজ মামলার রায়টির প্রতি অক্ষরের সঙ্গে আমরা একমত। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দুই বড় দলীয় কিংবা নির্দলীয় উল্লিখিত শীর্ষ আইনবিদেরা সত্যিই বিশ্বাস করেন, সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচাতে হবে। আর সে জন্য মুলো ঝোলানোর ওই বিধান অপসারণ করা দরকার। আমরা আশা করব, যথেষ্ট সময় থাকতেই ৯৯ অনুচ্ছেদে উপযুক্ত সংশোধনী আনা হবে। জনগণকে ভাঁওতাবাজির কবল থেকে মুক্তি দিতে পরম করুণাময় আমাদের সবাইকে শক্তি দিন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments