ইতিহাসে উপেক্ষিত শহীদ নারী by জোবাইদা নাসরীন



১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবের ইতিহাস। সেই ইতিহাস নিয়ে আমাদের গর্ব আছে, আছে পূর্বসূরিদের প্রতি এই প্রজন্মের গভীর শ্রদ্ধাবোধ। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের প্রতি সম্মান জানাতে এ পর্যন্ত জাতীয়ভাবে করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি তালিকা (সূত্র: প্রথম আলো ১৭ ডিসেম্বর ২০০৯-এ প্রকাশিত তথ্য)। সেই তালিকার সঙ্গে আছে শহীদদের তালিকাও। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দফায় দফায় তৈরি হওয়া শহীদদের নামের তালিকায় নারী শহীদদের নাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনকি শহীদদের স্মৃতিতে তৈরি হওয়া বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভেও স্থান হয়নি শহীদ নারীদের। এ কারণে দেশের বেশির ভাগ মানুষই শহীদ হিসেবে নারীর পরিচিতি জানেন না। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও কতজন নারী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, এর কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু গবেষণাতথ্য বলে অন্য কথা।
‘ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা’—মুক্তিযুদ্ধের এই ধরনের বয়ান নির্মাণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের ভিত্তিকেও করা হয়েছে লিঙ্গীয় পক্ষপাতমূলক।
ইতিহাসে নারী-পুরুষের অবদানকে দেখার ক্ষেত্রে এই লিঙ্গীয় দ্বি-বিভাজিত অবস্থান পক্ষান্তরে নারীর বহুমাত্রিক ভূমিকাকে আড়াল করেছে দীর্ঘদিন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেন্দ্রিক বেশ কিছু বই প্রকাশিত হলেও এ বইগুলোতে বেশ একটা বড় সময় ধরে নারী ছিলেন অনুপস্থিত। কিন্তু গত দশকের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধে নারীর বহুমুখী অবদান নিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে অনেক অজানা তথ্য। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ, প্রকৃতি, তার মাত্রা ও ব্যাপকতা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য এখান থেকে জানা যেতে থাকে। মানুষ জানতে পারে তারামন বিবি বীর প্রতীক, ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম বীর প্রতীক, কাঁকন বিবি, শাহানারা পারভীনসহ আরও অনেক সশস্ত্র সংগ্রামী নারীর কথা। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নারীর বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি অনস্বীকার্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু শহীদ নারীদের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা স্পষ্ট হয়, কারণ এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কিংবা প্রকাশ করতে রাষ্ট্র খুব বেশি আগ্রহী হয় না। শহীদ নারী হিসেবে সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ও কবি মেহেরুন্নেসার নাম ছাড়া এ বিষয়ে খুব বেশি তথ্য আলোচনায় আসেনি। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত স্মৃতি ১৯৭১ (সম্পাদনায়: রশীদ হায়দার)-এর বিভিন্ন খণ্ডে প্রকাশিত স্মৃতিচারণামূলক লেখায় এর বাইরে আরও দুজন নারী শহীদের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন মাগুরার শহীদ লুৎফুন্নাহার হেলেন এবং ঢাকার শহীদ ডা. আয়েশা বেদৌরা চৌধুরী।
১৯৭১ সালে মার্চে তৈরি হওয়া অসহযোগের শহীদ যশোরের গৃহবধূ চারুবালাও স্থান পাননি ইতিহাসে। চারুবালার মৃত্যু সে সময় যশোরের নারীদের মিছিলে নিয়ে আসে এবং অসহযোগ আন্দোলনকে নতুন রূপ দেয়। ২৫ মার্চ সেই ভয়াল কালরাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শহীদ হন অন্তঃসত্ত্বা যোগমায়া দে ও রিনা রানী দে (শহীদ মধূসুদন দের কথা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এলেও তাঁদের কোথাও স্থান দেওয়া হয়নি)। এপ্রিল মাসে দিনাজপুরে নিজের বাড়িতেই শহীদ হন সুরবালা দেবী। একই মাসে সৈয়দপুরে শহীদ হন সাংস্কৃতিক কর্মী ভ্রমর, সুফিয়া খাতুন, হোসনে আখতার (যাঁকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়েছিল) ও সরোজিনী মল্লিক। সিলেটের পাত্রখোলা চা-বাগানে শহীদ হন বাবনী রাজগৌড়, লসিমুন কুর্মী, রাঙামা কুর্মী, সালগী খাড়িয়াসহ অনেকে। সিলেটের বিয়ানীবাজারে বাঙালিদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে প্রাণ দিতে হয়েছিল খাসি মেয়ে কাঁকেটকে। পটুয়াখালীতে হানাদারদের তাণ্ডবলীলায় শহীদ হন কনকপ্রভা গাঙ্গুলী, সোনাই রানী সমাদ্দার, বিদ্যাসুন্দরী দাস, সাবিত্রী রানী দত্ত, শান্তি দেবসহ আরও অনেকে। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মধ্য জুলাইয়ে শহীদ হন কিরণ রানী সাহা।
পিরোজপুরে শহীদ হন ভাগীরথী সাহা। ভিক্ষুক সেজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খোঁজখবর এনে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। পরে রাজাকারেরা তাঁকে ধরিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে জিপের সঙ্গে বেঁধে রাস্তায় টানতে টানতে হত্যা করে। সেই ভাগীরথীরও স্থান মেলেনি শহীদদের তালিকায়। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে আঞ্জুমান আরাকে মালবাহী ট্রেনের গরম কয়লার চুল্লিতে নিক্ষেপ করে হত্যা করে বিহারিরা। তাঁর অপরাধ, তিনি তাঁর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন।
এ ছাড়া হানাদার ক্যাম্পে কত নারী নানা ধরনের অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করেছেন কিংবা যাঁদের মেরে ফেলা হয়েছে, তাঁদের হিসাব কেউ জানে না, কিংবা জানার চেষ্টা করেনি। পরিবার ও সমাজের কাছে তাঁরা শহীদ হিসেবে জায়গা পাননি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার অল্প কিছুদিন পর গণকবরগুলোতে বেশ কজন নারীর লাশ পাওয়া গিয়েছিল এবং নির্যাতন ক্যাম্পগুলোতে কাচের চুড়ি, শাড়ি ও নারীর হাড়-কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় বধ্যভূমিগুলো থেকেও তেমনিভাবে উদ্ধার করা হয় নারীর কঙ্কাল। যুদ্ধের সময় নারী শহীদ হওয়ার এত সব সাক্ষ্য থাকলেও কেন তাঁদের জায়গা হলো না ইতিহাসে, সেটি আজও প্রশ্ন। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে নজর দেবে, তাঁদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করবে এবং যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ব্যবস্থা করবে।
শুধু ইতিহাসেই নয়, স্মৃতিচারণায় এসেছে লিঙ্গীয় রাজনীতি। যেসব পরিবারে মা-বাবা উভয়ই শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই মায়ের স্মৃতি অনেকটাই ভুলে গেছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে মায়ের কথা যেহেতু কেউ খুব একটা জানতে চাননি, তাই তাঁদেরও বলতে হয়নি। স্মৃতিচারণা না করা এবং এই বিষয়ে চর্চা না থাকায় মায়ের স্মৃতি তাঁরা ভুলে গেছেন অনেকটাই। অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় তো বটেই, একই ঘটনায় শহীদ হওয়ার পরও গুরুত্ব পেয়েছে পুরুষ—বাদ থেকেছেন নারী।
তাই আজও নারী শহীদদের স্মৃতিকথা বিস্মৃত ও বিবর্ণ। বর্তমান সরকার এত বছর পর হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করা যায়, এই সরকারের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি শহীদদের তালিকাও চূড়ান্ত করা হবে। আমরা চাই, শহীদদের তালিকায় নারী শহীদদের নামগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হোক। নারী শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা কত, তা সরকারকে আগ্রহ নিয়েই বের করতে হবে এবং তাঁদের যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তা করা হলে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণে লিঙ্গীয় পক্ষপাত কিছুটা হলেও দূর হবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.