চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছেন ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ জানে আলম

জানে আলম জনির বয়স ২০ বছর। তার বাবা বেলাল হোসেনের ছোট একটি মুদি দোকানের সামান্য আয়ে চলে তাদের সংসার। চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় জানে আলম খুঁজতে থাকেন উপার্জনের পথ। বছর তিনেক আগে চট্টগ্রামের শাহ আমানত মাজার এলাকার একটি টুপি-আতরের দোকানে কাজ নেন। থাকা-খাওয়া বাদে মাসে পেতেন ৭ হাজার টাকা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সেই আয়ের পথ এখন বন্ধ।

জানে আলম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই চট্টগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। নিয়মিত অংশ নিয়েছেন আন্দোলন কর্মসূচিতে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন ৫ই আগস্ট সকালে ছিলেন চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড় এলাকায়। হঠাৎ সেখানে পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে। গুলি থেকে বাঁচতে পেছনে ফিরতেই ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তারা সারা শরীর। সেই থেকে যন্ত্রণা শুরু। শরীরে অসংখ্য ছররা গুলি নিয়ে এখন বাড়িতেই ধুঁকছেন তিনি। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। জানে আলমের বাড়ি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাইশগাঁও ইউনিয়নের হাওরা গ্রামে। তার পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর পেছনে যাদের রক্ত ঝরেছে, তাদেরই একজন জানে আলমের খোঁজ কেউ রাখেনি। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে ছেলেটির জীবন এখন সংকটে।

জানে আলম বলেন, শুরু থেকেই চাকরির কথা চিন্তা না করে আন্দোলনে ছিলাম। ৫ই আগস্ট সকালের দিকে চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড় এলাকায় আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে থাকে পুলিশ। তিনি সামনে ছিলেন। গুলি থেকে বাঁচতে পেছনে ফিরতেই একের পর এক ছররা গুলি তার শরীরে লাগতে শুরু করে। বিশেষ করে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত এমন কোনো জায়গা নেই যে তার গুলি লাগেনি। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তার মধ্যেই লুটিয়ে পড়েন। সেখানে থাকা অন্য আন্দোলনকারীরা অচেতন ও রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। জানে আলম বলেন, হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ দিয়ে পরদিন ছেড়ে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে পরামর্শ দেয়া হয় সার্জারি চিকিৎসক দেখানোর। অভাবের সংসার, যার কারণে অন্য কোনো ব্যবস্থা না দেখে পরিবারের লোকজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ই তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেই কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সেখানে ওষুধপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে চিকিৎসা। কয়েক দিন অপেক্ষার পর আবার চলে আসেন বাড়িতে।

ছোট মুদি দোকান থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই কোনোমতে সংসার চালান জানে আলমের বাবা বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, সংসার চালাতেই অনেক কষ্ট হচ্ছে। পারিবারিক অসচ্ছলতায় ছেলেটাকে প্রাইভেট কোনো হাসপাতালে নিয়েও চিকিৎসা করাতে পারছেন না। অর্থের অভাবে বর্তমানে ছেলেটার জন্য ওষুধও কিনতে পারছেন না। তিনি প্রশাসন ও সরকারের কাছে ছেলেটার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা চান।

জানে আলম বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাসখানেক পর মনোহরগঞ্জের সদ্য সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা একটি মতবিনিময় সভায় তার সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে ইউএনও ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে তাকে কুমিল্লা সিএমএইচ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। সেখানে শরীর থেকে আটটি গুলি বের করা হয়। এরপরও শরীরে রয়ে গেছে শতাধিক গুলি। যার যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত কাতরাচ্ছেন। তিনি অনুদান নয়, উন্নত চিকিৎসা চান।

এ বিষয়ে মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, আগের ইউএনও বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে তার কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। তবে বর্তমানে তার উন্নত চিকিৎসা দরকার, যেটা অনেক ব্যয়বহুল। এ জন্য জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে আবেদন করেছেন। আশা করছেন, দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে।
জানে আলমের মা জাকিয়া বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ছেলেটা এভাবে কাতরাচ্ছে। এত কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না।’

mzamin

No comments

Powered by Blogger.