যেভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে অর্থ by এম এম মাসুদ
বাংলাদেশ
থেকে প্রতি বছরই টাকা পাচার বাড়ছে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ থেকে যেসব চ্যানেলে টাকা বেরিয়ে গেছে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মূল
কারণ চিহ্নিত করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে পণ্য
আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করে টাকা পাচার। আরেকটি হচ্ছে পণ্য
রপ্তানি করার সময় কাগজপত্রে দাম কম দেখানো। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে বিশাল
একটি অঙ্ক পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্নীতি, কালো টাকা বেড়ে যাওয়া, বিনিয়োগের
পরিবেশ না থাকা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে।
রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি ও আইনের শাসনের ঘাটতির কারণেও পাচার থামছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা জানান, তদন্তে অস্পষ্টতা এবং দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই বেড়েছে অর্থ পাচার। অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে বলে জানান তারা। সাম্প্রতিক সময়ে ৩টি সংস্থার রিপোর্টেই বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাগুলোর মধ্যে আছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা ও প্যারাডাইস পেপার। এসব প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও পাচার বন্ধে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সর্বশেষ জিএফআই ২৮শে জানুয়ারির প্রকাশিত রিপোর্টেও দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য (আমদানি-রপ্তানি) হয়েছে, এর মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। গত দশ বছরে দেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। যা চলতি (২০১৮-২০১৯) জাতীয় বাজেটের প্রায় দেড়গুণের কাছাকাছি এবং দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির তিনগুণেরও বেশি।
এদিকে গত বছরের জুনে প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) পানামা এবং প্যারাডাইস পেপার্সে এ পর্যন্ত অর্থ পাচারকারী হিসেবে ৮২ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেছে। কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়নি বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন। কারা টাকা পাচার করছেন, কেন করছেন, পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করার কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।
এদিকে আমদানির নামে এলসি বিল পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। প্রভাবশালী মহল পণ্য জাহাজিকরণের কাগজ জাল করে এলসিকৃত পণ্যের পুরো টাকাই তুলে নিয়ে বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। এ ধরনের বেশ কিছু কেস স্টাডি পাওয়া গেছে। এগুলো পর্যালোচনার পর পাচার বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আমদানির নামে এলসি খুলে বিল পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। এ ছাড়া রয়েছে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানি মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি টাকা পাচারের একটি বড় মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিটেন্স। একটি চক্র বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিটেন্স সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ উপায়ে খুব দ্রুতই সম্পদ বৃদ্ধি করা যায়। এর বড় অংশই বাইরে যায়। কারা পাচার করছে, তা জানা সত্যেও কোনো শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। এলসি খোলার পর ঠিকমতো জিনিসপত্র আসছে কিনা, সঠিক দামে খোলা হয়েছিল কিনা, তার নজরদারি নেই। এসব বিষয়ে সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিলে টাকা পাচার বন্ধের সম্ভাবনা নেই। সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করে তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে তথ্যের আদান-প্রদান করতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৫৯টি দেশ ওই গ্রুপের সদস্য। বাংলাদেশ এই গ্রুপের সদস্য হওয়ায় এখন সবগুলো দেশ থেকে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বা টাকা পাচার বিষয়ক যেকোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু টাকা পাচার থেমে নেই, বরং বেড়েই চলছে। আবার দেশ থেকে টাকা পাচার কিভাবে থামানো যায় তারও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, সাধারণত আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। গোটা পৃথিবীতে বিশ্ববাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। এ বিষয়ে এখন সবাই সতর্ক। তিনি বলেন, টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় কাজ করছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে যেসব আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন রয়েছে, আমরা তা পুরোপুরি মেনে চলছি।
এদিকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ায় দেশ বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এটা অব্যাহত থাকলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হবে। কাঙ্ক্ষিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো- জাতীয় জীবনে নিরাপত্তা অনিশ্চিত হলে দেশে বিনিয়োগ করতে ভয় পান বিনিয়োগকারীরা। আর এ কারণেই তাদের মূলধন বিদেশে নিয়ে যান অনৈতিক পন্থায়। তিনি বলেন, দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার অর্থই হলো দেশকে বঞ্চিত করা। টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান বাড়তো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা খুবই জটিল প্রক্রিয়া। দুই প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রথমত, অর্থ পাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে মামলা করতে হবে। স্থানীয় আদালতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় দিতে হবে। আদালতের এ রায়ের কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস অর্থ ফেরত দেয়া যায় কি না তা নিয়ে ওই দেশের আদালতে মামলা করবে। সংশ্লিষ্ট দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা রয়েছে কী না তা যাচাই-বাছাই করবে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। সূত্র জানায়, সবকিছু অনুকূলে থাকলে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্থ ফেরত আনতে ৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মামলা করা ছাড়াও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়, যদি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি কোনো জটিলতা না থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হবে হবে।
জিএফআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর গড়ে ৬৫১ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে। ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ডলার অর্থ পাচার হয়েছিল। তিন বছরের ব্যবধানে এ অর্থ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৬৬ কোটি ডলারে। তবে ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি ডলার। আর ২০১৫ সালে তা ৫৯০ কোটি ডলার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, পরের বছর ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ডলার পাচার হয়। ২০০৮ সালে পাচারের পরিমাণ ৬৪৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০০৯ সাল থেকে পরবর্তী দু’বছর অর্থ পাচার কিছুটা কমে আসে। ওই বছর ছিল ৫১০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়।
রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি ও আইনের শাসনের ঘাটতির কারণেও পাচার থামছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা জানান, তদন্তে অস্পষ্টতা এবং দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই বেড়েছে অর্থ পাচার। অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে বলে জানান তারা। সাম্প্রতিক সময়ে ৩টি সংস্থার রিপোর্টেই বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাগুলোর মধ্যে আছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা ও প্যারাডাইস পেপার। এসব প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও পাচার বন্ধে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সর্বশেষ জিএফআই ২৮শে জানুয়ারির প্রকাশিত রিপোর্টেও দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য (আমদানি-রপ্তানি) হয়েছে, এর মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। গত দশ বছরে দেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। যা চলতি (২০১৮-২০১৯) জাতীয় বাজেটের প্রায় দেড়গুণের কাছাকাছি এবং দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির তিনগুণেরও বেশি।
এদিকে গত বছরের জুনে প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) পানামা এবং প্যারাডাইস পেপার্সে এ পর্যন্ত অর্থ পাচারকারী হিসেবে ৮২ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেছে। কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়নি বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন। কারা টাকা পাচার করছেন, কেন করছেন, পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করার কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।
এদিকে আমদানির নামে এলসি বিল পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। প্রভাবশালী মহল পণ্য জাহাজিকরণের কাগজ জাল করে এলসিকৃত পণ্যের পুরো টাকাই তুলে নিয়ে বিদেশে রেখে দিচ্ছেন। এ ধরনের বেশ কিছু কেস স্টাডি পাওয়া গেছে। এগুলো পর্যালোচনার পর পাচার বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আমদানির নামে এলসি খুলে বিল পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। এ ছাড়া রয়েছে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানি মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি টাকা পাচারের একটি বড় মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিটেন্স। একটি চক্র বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিটেন্স সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ উপায়ে খুব দ্রুতই সম্পদ বৃদ্ধি করা যায়। এর বড় অংশই বাইরে যায়। কারা পাচার করছে, তা জানা সত্যেও কোনো শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। এলসি খোলার পর ঠিকমতো জিনিসপত্র আসছে কিনা, সঠিক দামে খোলা হয়েছিল কিনা, তার নজরদারি নেই। এসব বিষয়ে সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিলে টাকা পাচার বন্ধের সম্ভাবনা নেই। সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করে তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে তথ্যের আদান-প্রদান করতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৫৯টি দেশ ওই গ্রুপের সদস্য। বাংলাদেশ এই গ্রুপের সদস্য হওয়ায় এখন সবগুলো দেশ থেকে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বা টাকা পাচার বিষয়ক যেকোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু টাকা পাচার থেমে নেই, বরং বেড়েই চলছে। আবার দেশ থেকে টাকা পাচার কিভাবে থামানো যায় তারও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, সাধারণত আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। গোটা পৃথিবীতে বিশ্ববাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। এ বিষয়ে এখন সবাই সতর্ক। তিনি বলেন, টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় কাজ করছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে যেসব আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন রয়েছে, আমরা তা পুরোপুরি মেনে চলছি।
এদিকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ায় দেশ বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এটা অব্যাহত থাকলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হবে। কাঙ্ক্ষিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো- জাতীয় জীবনে নিরাপত্তা অনিশ্চিত হলে দেশে বিনিয়োগ করতে ভয় পান বিনিয়োগকারীরা। আর এ কারণেই তাদের মূলধন বিদেশে নিয়ে যান অনৈতিক পন্থায়। তিনি বলেন, দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার অর্থই হলো দেশকে বঞ্চিত করা। টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান বাড়তো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা খুবই জটিল প্রক্রিয়া। দুই প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রথমত, অর্থ পাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে মামলা করতে হবে। স্থানীয় আদালতে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় দিতে হবে। আদালতের এ রায়ের কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস অর্থ ফেরত দেয়া যায় কি না তা নিয়ে ওই দেশের আদালতে মামলা করবে। সংশ্লিষ্ট দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা রয়েছে কী না তা যাচাই-বাছাই করবে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। সূত্র জানায়, সবকিছু অনুকূলে থাকলে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্থ ফেরত আনতে ৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মামলা করা ছাড়াও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়, যদি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি কোনো জটিলতা না থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হবে হবে।
জিএফআই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর গড়ে ৬৫১ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে। ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ডলার অর্থ পাচার হয়েছিল। তিন বছরের ব্যবধানে এ অর্থ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৬৬ কোটি ডলারে। তবে ২০১৪ সালে ৯১১ কোটি ডলার। আর ২০১৫ সালে তা ৫৯০ কোটি ডলার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি, পরের বছর ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ডলার পাচার হয়। ২০০৮ সালে পাচারের পরিমাণ ৬৪৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০০৯ সাল থেকে পরবর্তী দু’বছর অর্থ পাচার কিছুটা কমে আসে। ওই বছর ছিল ৫১০ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি, ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়।
No comments