তিনি মানবজাতিকে বিজ্ঞানের নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন by ড. আলী আসগর
স্টিফেন
হকিং জীবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন। সম্ভবত জীবিত
মানুষদের মধ্যেও। অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন, তিনি এত বড় বিজ্ঞানী। কিন্তু
নোবেল পুরস্কার পাননি কেন? এর কারণ, তার তত্ত্বগুলো এখনও পরীক্ষণের আওতাধীন
করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, গ্যালিলিও গ্যালিলি জড়তার সূত্র আবিস্কার
করেছিলেন। সেই সূত্র বলে, কোনো বস্তু চলতে থাকলে চলতে থাকবে অথবা স্থির
থাকলে স্থির থাকবে, যদি না তার ওপর কোনো বল প্রয়োগ করা হয়। মজার ব্যাপার
হচ্ছে, গ্যালিলিওর মৃত্যুদিবস আর স্টিফেন হকিংয়ের জন্মদিবস একই দিন। এর
সঙ্গে যুক্ত হলো আইনস্টাইনের জন্ম আর তার মৃত্যুদিন একই দিনে- ১৪ মার্চ।
আইনস্টাইনের জন্মদিনে কৃষ্ণগহ্বরের গবেষক স্টিফেন হকিং পৃথিবী থেকে বিদায়
নিলেন- মাত্র ৭৬ বছর বয়সে। স্টিফেন হকিংয়ের নাম সামনে এলে আমরা বুঝতে পারি,
বিজ্ঞানের তত্ত্ব নির্মাণে যে পরিবেশ তৈরি হয়, তা অসম্ভব সৃজনশীল
বিজ্ঞানীকে দাবি করে। বিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসা সমস্যাগুলো ঘিরে চাহিদা সৃষ্টি
হয়। তার ফলেই ইতিহাসের গতিধারায় এভাবে যুগে যুগে বড় বড় বিজ্ঞানী এসেছেন।
যারা একটা সমস্যাকে উদ্ঘাটন করে মানবজাতিকে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্তরে
নিয়ে গেছেন। তার কৃষ্ণগহ্বর ও মহাবিশ্ব-সংক্রান্ত গবেষণাগুলো সেই মাপের
ছিল। স্টিফেন হকিং অসুস্থ ছিলেন মোটর নিউরন ডিজিসে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো,
মোটর নিউরন ডিজিসে আক্রান্ত অসুস্থ শরীরে তিনি হাঁটাচলা করতে পারতেন না।
তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার হুইল চেয়ার ছিল। তিনি লিখতেও পারতেন না। তার জন্য
বিশেষ প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছিল, যাতে করে তিনি যে অক্ষরটা লিখতে চান, যে
শব্দটা লিখতে চান, যে বাক্যটা গঠন করতে চান- তা পারেন। এ জন্য প্রোগ্রামের
স্টোরে অনেকগুলো বাক্য ও শব্দ থাকত। আঙুলের বাটনে টিপে টিপে সেখান থেকে
সেগুলো নিয়ে তৈরি করতেন গবেষণাপত্র বা রচনা। তার কণ্ঠস্বরও সিন্থেসাইজ করা
হয়েছিল, অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে শব্দ করতেন। তার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা এ
কারণে, এত আশাবাদী একজন বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের জন্মের উৎস এবং এর পরিণতি
সম্পর্কে তিনি অনুসন্ধান করছিলেন। এই গবেষণা ও তার 'এ ব্রিফ স্টোরি অব
টাইম' গ্রন্থ তাকে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় মানুষে রূপান্তর করেছিল। তার
নোবেল না পাওয়ার কারণে এর উত্তর অনেকভাবে দেওয়া যায়। যেমন ধরুন সুপার
স্ট্রিং তত্ত্ব, যার মূল উপাদান কণিকা নয়, তন্তু; অনেকটা সুতার মতো।
এর
মধ্যে বিভিন্ন রকম কম্পন তৈরি করে নানা রকম কণা পাওয়া সম্ভব। এই কম্পনগুলোর
মাধ্যমে গঠিত কণা দিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব তৈরি। ফলে এই তত্ত্বের মাধ্যমে
মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝাও সম্ভব। তত্ত্বটা নিয়ে অনেকেই কাজ করেছেন,
সমর্থনও দিয়েছেন। স্টিফেন হকিংও এটা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। এগুলো এখনই
পরীক্ষার মাপকাঠিতে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তেমনি নক্ষত্র যখন সংকুচিত হয়ে যায়,
সেই নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের চেয়ে ১.৪ গুণ বেশি হয় (যাকে চন্দ্রশেখর সীমা
বলে), তখন নক্ষত্রটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই
কৃষ্ণগহ্বরের এত ঘনত্ব থাকে যে এর থেকে বিকিরণও বের হতে পারে না। কেননা, এত
ঘনত্বে যে মহাকর্ষ প্রভাব তৈরি হয়, তা অতিক্রম করে আলোও বেরিয়ে আসতে পারে
না। কৃষ্ণগহ্বরে ঘটনার দিগন্ত সীমানা অতিক্রম করলেই এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু
হকিং দেখালেন, এই ঘটনার দিগন্ত সীমানায় কণা ও প্রতিকণা জন্ম হওয়া সম্ভব।
এটা কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানও অনুমোদন দেয়। ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনার দিগন্ত
হলো এমন একটি জায়গা বা শূন্যতা, যার থেকে কৃষ্ণগহ্বরের অধিকতর কাছে গেলেই
বস্তুকণা আর বের হয়ে আসতে পারে না। যখন ঘটনার দিগন্ত সীমানায় কণা-প্রতিকণার
জন্ম হয়, তখন কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে একটি কণা কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণে
ভেতরে ঢুকে যায়, আরেকটি বাইরের দিকে চলে আসে। দূরের দর্শকের কাছে মনে হবে,
কৃষ্ণগহ্বর বুঝি বিকিরণের স্রোত নির্গত করছে। এর ফলে শূন্যস্থান থেকে জন্ম
নেওয়া যে কণিকা ভেতরে ঢোকে, তা কৃষ্ণবিবরকে নিঃশেষিত করে দেয়। আর আমরা
ভাবি, কৃষ্ণগহ্বর বুঝি কণা বিকিরণ করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এটাকেই বলে হকিং
রেডিয়েশন বা হকিং বিকিরণ। কল্পকাহিনীতে আমরা যা দেখি, তারই ঘনীভূত একটি রূপ
দেখা যায় হকিংয়ের তত্ত্বে। এটাকে বলা যায় তত্ত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি বড়
উপাদান। বলা হয়ে থাকে, তার অসুস্থ শরীরের সঙ্গে যুক্ত আছে যে মস্তিস্ক, তা
আসলে ভীষণ উর্বর ও শক্তিশালী ছিল। এটা প্রচলিত আছে, দেহের কোনো পঙ্গুতা
অন্য কোনো ক্ষেত্রে ভীষণভাবে শক্তিশালী করে দেয়। ফলে একজন পঙ্গু মানুষও
শরীরের পঙ্গুতা নিয়ে অনেক বড় কাজ করতে পারে। তারই উদাহরণ স্টিফেন হকিং।
এখান থেকে আমরা আরেকটি জিনিস পেতে পারি, তা হলো প্রেরণা। স্টিফেন হকিং
একদিকে ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেও সৃজনশীলতায় অসাধারণ উচ্চতায় অবস্থান নিয়েছেন। এ
বিষয়টাকে হকিং রসিকতা করে বলেছেন, বিছানা থেকে নামতেও তার কষ্ট হতো এবং
সময় লেগে যেত, সেই সময়টাকেও তিনি তার তত্ত্ব নির্মাণের কাজে লাগাতেন। তার
অক্ষমতার কারণে যে সময়টা তিনি পেয়েছেন, তা সম্পূর্ণ সৃজনশীলতায় কাজে
লাগিয়েছেন। ইউনিফায়েড থিওরি বা একীভূত তত্ত্ব, যেটি আইনস্টাইনের স্বপ্ন
ছিল, সেটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। চারটি ভিন্ন ধরনের বল আছে। সেগুলো হচ্ছে
:মহাকর্ষ বল, বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও শক্তিশালী
নিউক্লিয়ার বল। বর্তমানে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় বল ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের
একীভূত রূপকে দেখানো সম্ভব হয়েছে। পরীক্ষায় প্রমাণও করা গেছে। ফলে আবদুস
সালাম ও ভাইনবার্গকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর সঙ্গে
শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলকে এক করে গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন তত্ত্ব নির্মাণ করা
হয়েছে। কিন্তু তা পরীক্ষাধীন রয়েছে। আর মহাকর্ষ তত্ত্বকে যুক্ত করে এখনও
তেমন কার্যকর শক্তিশালী তত্ত্ব নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্ট্রিং থিওরি
অবশ্য বলছে, মহাকর্ষকে যুক্ত করে এ রকম সবকিছুর তত্ত্ব নির্মাণ করা সম্ভব।
তবে তা একশ' বছর লেগে যাবে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। যে কোনো তত্ত্ব যত সুন্দর
হোক, তার ফলগুলো পরীক্ষিত হতে হবে। সে জন্য ইউনিফায়েড থিওরি বা একীভূত
তত্ত্বটা যখন পরীক্ষিত হবে, তখন হকিংয়ের ধারণা আরও শক্তিশালী হবে। আমার মনে
হয়, একটা মানবিক ব্যাপার আছে স্টিফেন হকিংকে ঘিরে। তার দর্শনও মানুষকে
ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল। সে জন্য তার জনপ্রিয়তা এত ব্যাপক। তিনি আসলে পৃথিবীকে
প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
পদার্থবিজ্ঞানী
পদার্থবিজ্ঞানী
No comments