অকার্যকর আইনে আয়কর আদায় করছে এনবিআর!
সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সামরিক সরকারের সব অধ্যাদেশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ অন্যতম। উচ্চ আদালতের রায়ে এই অধ্যাদেশ এখন সম্পূর্ণ অকার্যকর (ভয়েড অব ইনিশিও)। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের তোয়াক্কা করছে না। অকার্যকর অধ্যাদেশেই নজিরবিহীনভাবে আয়কর আদায়, এসেসমেন্ট এবং কর ফাঁকির মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এ নিয়ে বড় ধরনের আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের আয়কর আদায় কার্যক্রমের বৈধতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় তড়িঘড়ি করে নতুন একটি আয়কর আইন তৈরির প্রস্তাব করেছে এনবিআর, যা গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভার নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। এতে আয়কর আইনকে ১৯৮৪ সালের ১ জুলাই থেকে অর্থাৎ প্রায় ৩৩ বছর আগে থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া হচ্ছে। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে ভেটিংয়ের জন্য আইনের খসড়া এখন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন আইনের সারসংক্ষেপে এনবিআর স্বীকার করেছে, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ১ জুলাই ১৯৮৪ থেকে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ কার্যকারিতা হারিয়েছে। এ কারণে সৃষ্ট আইনি শূন্যতা পূরণ করতে ৮১টি অধ্যাদেশের কার্যকারিতা দিয়ে ২০১৩ সালে ২ নম্বর অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই সময়ের জন্য ‘কতিপয় অধ্যাদেশ কার্যকরকরণ (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১৩’ জারি করা হয়। ‘দি ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪’ এই অধ্যাদেশের অন্তর্ভুক্ত। যার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের করা বিভিন্ন রিট মামলায় বিশেষ বিধান আইনটির কার্যকারিতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর কার্যকারিতাও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সারসংক্ষেপে বলা হয়, প্রস্তাবিত অর্থ বিলটি হবে আয়কর আইনকে ১৯৮৪ সালের ১ জুলাই থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা সংক্রান্ত। তবে সরকার ২০১৮ সালের জুলাই মাসের মধ্যে বাংলায় যে নতুন আয়কর আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সঙ্গে প্রস্তাবিত আয়কর আইন-২০১৭ এর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। বাংলায় নতুন আয়কর আইনটি জারির তারিখ থেকেই কার্যকর হবে।
নজিরবিহীন ও আত্মঘাতী : এদিকে এখন থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বিতর্কিত আয়কর অধ্যাদেশে নেয়া সব কার্যক্রমকে প্রস্তাবিত আইনে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়ার আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রচেষ্টা আইন ও সংবিধানসম্মত নয় এবং নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক বিশিষ্ট আইনজীবী। তারা বলছেন, এতে আইনি জটিলতা আরও বাড়বে। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া এমন পদক্ষেপ হবে আত্মঘাতী। ১৯৮৪ সালের ১ জুলাই থেকে ভূতাপেক্ষ বৈধতা দেয়ার এনবিআরের প্রস্তাবের সমালোচনা করে আইন বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন করেছেন, তাহলে কি বর্তমানে দেশে কোনো আয়কর আইন নেই? এতদিন আয়কর আইনে যেসব কার্যক্রম নেয়া হয়েছে তা অবৈধ ছিল? কারণ আইন কার্যকর না থাকলেই বিশেষ বিবেচনায় আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া যায়। এনবিআরের এই তড়িঘড়ি উদ্যোগ সেই আশঙ্কাকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করছে। এতদিন নেয়া কার্যক্রম যদি আইন বা বিধিসম্মত না হয় তাহলেই কেবল ভূতাপেক্ষ বৈধতা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আইনসিদ্ধ হবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদালতের রায়ে বাতিল হওয়া অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়ার জন্য আরেকটি অধ্যাদেশ বা আইন জারি সংবিধানপরিপন্থী এবং আইনগত ভিত্তিহীন। এ কারণে বারবার তা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ১৯৮৪ সালের অকার্যকর অধ্যাদেশে এনবিআরের দায়ের করা একাধিক বিতর্কিত কর ফাঁকির মামলার কার্যক্রমও আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে নতুন করে একটি রিট পিটিশনের মাধ্যমে ২০১৩ সালে পুনঃস্থাপিত/তর্কিত অধ্যাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এসব মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হওয়ায় এনবিআর দ্রুত নতুন একটি আইন তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন একাধিক আইনজীবী। এনবিআরের সারসংক্ষেপে বলা হয়, অ্যাটর্নি জেনারেল তার পরামর্শে বলেছেন, আয়কর অধ্যাদেশকে ২০১৩ সালের আইনের অন্তর্ভুক্ত না রেখে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর বিধান ওই সালের ১ জুলাই ও তার পরবর্তী বিভিন্ন বছরে যখন যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় কার্যকারিতা দিয়ে একটি আলাদা অর্থ বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা সমীচীন হবে। এ কারণে কতিপয় অধ্যাদেশ কার্যকরকরণ (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১৩ সংশোধন করে ওই আইনের তফসিল থেকে বাদ দিতে হবে।
ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতায় উদ্বেগ : দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, অকার্যকর অধ্যাদেশকে আরেকটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া যায় না। এ জন্যই ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশে আয়কর সংক্রান্ত মামলা বারবার আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রমাণ করে এনবিআর এখন যে আইনে আয়কর আদায় করছে তা বৈধ নয়। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হলে এনবিআরের এসব কার্যক্রম অবৈধ হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। এছাড়া সর্বোচ্চ আদালত যে সময়ের অধ্যাদেশ বা আইনকে বেআইনি ঘোষণা করেছে তারই কিছু অংশকে ২০১৩ সালে নতুন করে অধ্যাদেশ জারির মাধমে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এভাবে ৮১টি অধ্যাদেশের কার্যকারিতা দেখানো হয়েছে। এ ধরনের প্রচেষ্টা নজিরবিহীন ও বিস্ময়কর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অকার্যকর আয়কর অধ্যাদেশের ১৬৫/১৬৬ ধারায় অতি সম্প্রতি দায়ের হওয়া একটি কর ফাঁকির মামলার কার্যক্রম সর্বোচ্চ আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। কর ফাঁকির মামলাটি ছিল একতরফা ও বিদ্বেষপ্রসূত। করদাতাকে আয়কর আইনে কোনো নোটিশ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই সরাসরি মামলাটি করা হয়। এনবিআর চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত আগ্রহে আয়কর বিভাগ এই মামলা করতে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। কিন্তু তা আদালতের রায়ে স্থগিত হওয়ার পর চেয়ারম্যানের টনক নড়ে। তিনি আয়কর কর্মকর্তাদের ডেকে বিষয়টি জানতে চাইলে তাকে অবহিত করা হয়, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর আওতায় দায়ের করা অধিকাংশ মামলাই আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। কেউ যদি রিট করে তাহলে সরকারের আয়কর আদায় কার্যক্রমও বড় ধরনের আইনি জটিলতায় পড়বে। এরপরই এনবিআর চেয়ারম্যান অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন একটি আয়কর আইন তৈরির উদ্যোগ নেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, এর কয়েকদিনের মধ্যেই আইনের খসড়া তৈরি করা হয় এবং এ সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এতে ১৯৮৪ সালের ১ জুলাই এবং তার পরবর্তী বিভিন্ন বছরে যখন যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় কার্যকারিতা দিয়ে দি ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট-২০১৭ নামে আলাদা একটি অর্থ বিল তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে।
জটিলতা আরও বাড়বে : সংশ্লিষ্ট সূত্র স্বীকার করেছে, আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিতর্কিত অধ্যাদেশে আয়কর আদায় করা হচ্ছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করে সরাসরি আদালতে কর ফাঁকির মামলা দায়ের করছে আয়কর বিভাগ। এনবিআরের এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা এবং বেআইনি পদক্ষেপ উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় তড়িঘড়ি করে আলাদা একটি আইন তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি নতুন আইন তৈরি করতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মতামত ও পর্যালোচনা করতে হয়। এরপর আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়, যা সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু এনবিআর বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব কিছু না করেই দ্রুত আইনটি কার্যকর করতে চায়। একজন ব্যক্তির খামখেয়ালিপনায় এ ধরনের আইন তড়িঘড়ি করে তৈরি করা হলে তা ক্রটিপূর্ণ হতে পারে এবং এতে জটিলতা না কমে আরও বাড়বে বলেও সংশ্লিষ্টরা গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০০৭ সালের পর জরুরি অবস্থা চলাকালে বেশ কিছু রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ব্যবহার করে আদালতে সরাসরি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এ আইনের ১৬৪/১৬৫/১৬৬ ধারাসহ বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করা হয়। এতে করদাতার সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। করদাতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে এ সময়কালে দায়ের করা অধিকাংশ মামলাই আদালতে স্থগিত হয়ে পড়ে আছে।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের বক্তব্য : আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী একটা অধ্যাদেশকে আরেকটা অধ্যাদেশ দিয়ে কার্যকারিতা দেয়ার সুযোগ নেই। বিলুপ্ত অধ্যাদেশকে সরকার আইনের মাধ্যমে কার্যকারিতা দিয়েছে। এটাও করা যায় না। আইন করে কোনোভাবেই বিলুপ্ত অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়া যায় না। ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে নতুন আইন তৈরির ব্যাপারে ড. শাহদীন মালিক বলেন, এটা নজিরবিহীন। সংশ্লিষ্টরা মেনে নিচ্ছেন, এ সময়কালে আইনের কার্যকারিতা ছিল না। তিনি বলেন, এতে বড় ধরনের আইনগত জটিলতা তৈরি হবে। যার মুখোমুখি আমরা কখনও হইনি। এতে যেসব আইনি প্রশ্নের উদ্ভব হবে, সেগুলো হবে খুবই জটিল এবং বৈধতা নিয়ে মামলা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, অকার্যকর আইনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কাউকে যদি শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে এবং পরে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে ওই শাস্তি সঠিক ছিল- এটা বলা যাবে না। শাস্তিটা ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতার মাধ্যমে জায়েজ করা যাবে না। আর যদি জায়েজ করা যেত তাহলে ৫ম ও ৭ম সংশোধনীই বা বাতিল করা হল কোন যুক্তিতে? অসাংবিধানিক কিছুকে তো পরে সাংবিধানিক বলার সুযোগই নেই। এখন আয়কর আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিলে সেটা হবে ওই ৫ম, ৭ম সংশোধনীর মতোই। সিনিয়র আইনজীবী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, একটি অধ্যাদেশকে আরেকটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া যায় না। সংবিধানের ৯৩(১)(খ) অনুচ্ছেদে এটা স্পষ্টভাবে বলা আছে। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ বাতিল করে দেয়ার পর তা আর পুনরুজ্জীবিত করার বা কার্যকারিতা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে এ অধ্যাদেশটিসহ সামরিক শাসনামলে জারি করা বেশ কিছু অধ্যাদেশের বৈধতা দিয়ে ২০১৩ সালে জারি করা আইনের বৈধতাও আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতে জটিলতা আরও প্রকট হবে। বর্তমানে আয়কর যেভাবে আদায় হচ্ছে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
নজিরবিহীন ও আত্মঘাতী : এদিকে এখন থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বিতর্কিত আয়কর অধ্যাদেশে নেয়া সব কার্যক্রমকে প্রস্তাবিত আইনে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়ার আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রচেষ্টা আইন ও সংবিধানসম্মত নয় এবং নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক বিশিষ্ট আইনজীবী। তারা বলছেন, এতে আইনি জটিলতা আরও বাড়বে। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া এমন পদক্ষেপ হবে আত্মঘাতী। ১৯৮৪ সালের ১ জুলাই থেকে ভূতাপেক্ষ বৈধতা দেয়ার এনবিআরের প্রস্তাবের সমালোচনা করে আইন বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন করেছেন, তাহলে কি বর্তমানে দেশে কোনো আয়কর আইন নেই? এতদিন আয়কর আইনে যেসব কার্যক্রম নেয়া হয়েছে তা অবৈধ ছিল? কারণ আইন কার্যকর না থাকলেই বিশেষ বিবেচনায় আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া যায়। এনবিআরের এই তড়িঘড়ি উদ্যোগ সেই আশঙ্কাকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করছে। এতদিন নেয়া কার্যক্রম যদি আইন বা বিধিসম্মত না হয় তাহলেই কেবল ভূতাপেক্ষ বৈধতা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আইনসিদ্ধ হবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আদালতের রায়ে বাতিল হওয়া অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়ার জন্য আরেকটি অধ্যাদেশ বা আইন জারি সংবিধানপরিপন্থী এবং আইনগত ভিত্তিহীন। এ কারণে বারবার তা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ১৯৮৪ সালের অকার্যকর অধ্যাদেশে এনবিআরের দায়ের করা একাধিক বিতর্কিত কর ফাঁকির মামলার কার্যক্রমও আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে নতুন করে একটি রিট পিটিশনের মাধ্যমে ২০১৩ সালে পুনঃস্থাপিত/তর্কিত অধ্যাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এসব মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হওয়ায় এনবিআর দ্রুত নতুন একটি আইন তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন একাধিক আইনজীবী। এনবিআরের সারসংক্ষেপে বলা হয়, অ্যাটর্নি জেনারেল তার পরামর্শে বলেছেন, আয়কর অধ্যাদেশকে ২০১৩ সালের আইনের অন্তর্ভুক্ত না রেখে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর বিধান ওই সালের ১ জুলাই ও তার পরবর্তী বিভিন্ন বছরে যখন যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় কার্যকারিতা দিয়ে একটি আলাদা অর্থ বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা সমীচীন হবে। এ কারণে কতিপয় অধ্যাদেশ কার্যকরকরণ (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১৩ সংশোধন করে ওই আইনের তফসিল থেকে বাদ দিতে হবে।
ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতায় উদ্বেগ : দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, অকার্যকর অধ্যাদেশকে আরেকটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া যায় না। এ জন্যই ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশে আয়কর সংক্রান্ত মামলা বারবার আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রমাণ করে এনবিআর এখন যে আইনে আয়কর আদায় করছে তা বৈধ নয়। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হলে এনবিআরের এসব কার্যক্রম অবৈধ হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। এছাড়া সর্বোচ্চ আদালত যে সময়ের অধ্যাদেশ বা আইনকে বেআইনি ঘোষণা করেছে তারই কিছু অংশকে ২০১৩ সালে নতুন করে অধ্যাদেশ জারির মাধমে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এভাবে ৮১টি অধ্যাদেশের কার্যকারিতা দেখানো হয়েছে। এ ধরনের প্রচেষ্টা নজিরবিহীন ও বিস্ময়কর। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, অকার্যকর আয়কর অধ্যাদেশের ১৬৫/১৬৬ ধারায় অতি সম্প্রতি দায়ের হওয়া একটি কর ফাঁকির মামলার কার্যক্রম সর্বোচ্চ আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। কর ফাঁকির মামলাটি ছিল একতরফা ও বিদ্বেষপ্রসূত। করদাতাকে আয়কর আইনে কোনো নোটিশ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই সরাসরি মামলাটি করা হয়। এনবিআর চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত আগ্রহে আয়কর বিভাগ এই মামলা করতে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। কিন্তু তা আদালতের রায়ে স্থগিত হওয়ার পর চেয়ারম্যানের টনক নড়ে। তিনি আয়কর কর্মকর্তাদের ডেকে বিষয়টি জানতে চাইলে তাকে অবহিত করা হয়, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর আওতায় দায়ের করা অধিকাংশ মামলাই আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। কেউ যদি রিট করে তাহলে সরকারের আয়কর আদায় কার্যক্রমও বড় ধরনের আইনি জটিলতায় পড়বে। এরপরই এনবিআর চেয়ারম্যান অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন একটি আয়কর আইন তৈরির উদ্যোগ নেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, এর কয়েকদিনের মধ্যেই আইনের খসড়া তৈরি করা হয় এবং এ সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এতে ১৯৮৪ সালের ১ জুলাই এবং তার পরবর্তী বিভিন্ন বছরে যখন যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় কার্যকারিতা দিয়ে দি ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট-২০১৭ নামে আলাদা একটি অর্থ বিল তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে।
জটিলতা আরও বাড়বে : সংশ্লিষ্ট সূত্র স্বীকার করেছে, আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিতর্কিত অধ্যাদেশে আয়কর আদায় করা হচ্ছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করে সরাসরি আদালতে কর ফাঁকির মামলা দায়ের করছে আয়কর বিভাগ। এনবিআরের এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা এবং বেআইনি পদক্ষেপ উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় তড়িঘড়ি করে আলাদা একটি আইন তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি নতুন আইন তৈরি করতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মতামত ও পর্যালোচনা করতে হয়। এরপর আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়, যা সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু এনবিআর বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব কিছু না করেই দ্রুত আইনটি কার্যকর করতে চায়। একজন ব্যক্তির খামখেয়ালিপনায় এ ধরনের আইন তড়িঘড়ি করে তৈরি করা হলে তা ক্রটিপূর্ণ হতে পারে এবং এতে জটিলতা না কমে আরও বাড়বে বলেও সংশ্লিষ্টরা গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০০৭ সালের পর জরুরি অবস্থা চলাকালে বেশ কিছু রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ব্যবহার করে আদালতে সরাসরি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এ আইনের ১৬৪/১৬৫/১৬৬ ধারাসহ বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করা হয়। এতে করদাতার সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। করদাতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়ে এ সময়কালে দায়ের করা অধিকাংশ মামলাই আদালতে স্থগিত হয়ে পড়ে আছে।
বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের বক্তব্য : আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী একটা অধ্যাদেশকে আরেকটা অধ্যাদেশ দিয়ে কার্যকারিতা দেয়ার সুযোগ নেই। বিলুপ্ত অধ্যাদেশকে সরকার আইনের মাধ্যমে কার্যকারিতা দিয়েছে। এটাও করা যায় না। আইন করে কোনোভাবেই বিলুপ্ত অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়া যায় না। ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে নতুন আইন তৈরির ব্যাপারে ড. শাহদীন মালিক বলেন, এটা নজিরবিহীন। সংশ্লিষ্টরা মেনে নিচ্ছেন, এ সময়কালে আইনের কার্যকারিতা ছিল না। তিনি বলেন, এতে বড় ধরনের আইনগত জটিলতা তৈরি হবে। যার মুখোমুখি আমরা কখনও হইনি। এতে যেসব আইনি প্রশ্নের উদ্ভব হবে, সেগুলো হবে খুবই জটিল এবং বৈধতা নিয়ে মামলা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, অকার্যকর আইনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কাউকে যদি শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে এবং পরে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে ওই শাস্তি সঠিক ছিল- এটা বলা যাবে না। শাস্তিটা ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতার মাধ্যমে জায়েজ করা যাবে না। আর যদি জায়েজ করা যেত তাহলে ৫ম ও ৭ম সংশোধনীই বা বাতিল করা হল কোন যুক্তিতে? অসাংবিধানিক কিছুকে তো পরে সাংবিধানিক বলার সুযোগই নেই। এখন আয়কর আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিলে সেটা হবে ওই ৫ম, ৭ম সংশোধনীর মতোই। সিনিয়র আইনজীবী বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, একটি অধ্যাদেশকে আরেকটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বৈধতা দেয়া যায় না। সংবিধানের ৯৩(১)(খ) অনুচ্ছেদে এটা স্পষ্টভাবে বলা আছে। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ বাতিল করে দেয়ার পর তা আর পুনরুজ্জীবিত করার বা কার্যকারিতা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে এ অধ্যাদেশটিসহ সামরিক শাসনামলে জারি করা বেশ কিছু অধ্যাদেশের বৈধতা দিয়ে ২০১৩ সালে জারি করা আইনের বৈধতাও আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতে জটিলতা আরও প্রকট হবে। বর্তমানে আয়কর যেভাবে আদায় হচ্ছে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন সম্ভাবনা থাকলে সেক্ষেত্রে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া যাবে না। এদিকে ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, আইনের ভেতরে যদি বলা থাকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া যাবে, তাহলে দিতে কোনো বাধা নেই। এছাড়া সব আইনই পাস হওয়ার পর থেকে কার্যকর হয়। ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়ার ফলে তৎকালীন সময় থেকে এখন পর্যন্ত যেসব কার্যক্রম হয়েছে (যেমন কর আরোপ, কর আদায়) সেগুলোর বৈধতা পাবে। তিনি স্বীকার করেন, নির্দিষ্ট সময়ে যদি কোনো আইন না থেকে থাকে, তাহলে সে সময়ে যেসব কার্যক্রম হয়েছে সেগুলোর বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যেই ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ফাইন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শম রেজাউল করিম বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে যেসব আইন ও অধ্যাদেশ বাতিল হয়ে গেছে তা পুনরায় বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যে যদি অধ্যাদেশ জারি করা হয় তা হবে কার্যত আদালতের রায়কে অকার্যকর করার প্রচেষ্টা। অন্যদিকে আদালতের রায়ে বাতিল ঘোষিত অধ্যাদেশ বা আইনের প্রয়োগ দেখিয়ে যদি কোনো মামলা দায়ের করা হয় তাও কার্যত বাতিল বলে গণ্য হবে।
No comments