মুঠোফোনে পাহাড়ধসের পূর্বাভাস by অরুণ কর্মকার

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবনের
পাঁচতলার ছাদে বসানো হয়েছে বৃষ্টি পরিমাপক যন্ত্র।
এটি একটি সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত, যার মাধ্যমে
পাহাড়ধসের পূর্বাভাস দেওয়া যায় l ছবি: সৌরভ দাশ
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ও নরওয়ের জিওটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা
পাহাড়ধসের আগাম খবর দেওয়ার একটি পদ্ধতি বের করেছে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ও নরওয়ের জিওটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (এনজিআই)। এ পদ্ধতিতে মুঠোফোনে পাওয়া পূর্বাভাস কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যে পাহাড়ধসে প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
সাধারণত, ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে আলগা শিলা ও মাটির ভেতরে পানি চুইয়ে প্রবেশ করে। এতে মাটি ও শিলার ভেতর পানির চাপ বাড়ে। একপর্যায়ে ভূমিতে ফাটল দেখা দেয় এবং মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে ধস শুরু হয়। মূলত এই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তীব্রতা, সময় ও মাটির ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পাহাড়ধসের আগাম খবর দেওয়া হয়।
২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে প্রায় ১২৭ জন মারা যায়। এ ঘটনার পর পাহাড়ধসে প্রাণহানি রোধে জিএসবি এ গবেষণার উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালে পরীক্ষামূলকভাবে আগাম সতর্কতার যন্ত্র স্থাপন করা হয়। ২০১২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ল্যান্ডস্লাইড কনফারেন্সে এই পদ্ধতি সম্পর্কে গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করা হয়। গত বছর জার্মানির বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিনজার এ নিবন্ধটি তাদের একটি সংকলনে প্রকাশ করেছে।
এ প্রকল্পের গবেষক জিএসবির অন্যতম পরিচালক এবং নগর ও প্রকৌশল ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রধান রেশাদ মো. ইকরাম আলী প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ধসের কারণ প্রধানত ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়গুলোর মাটির ধরন। এ জন্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের অতীতের পাহাড়ধসের সময়কার বৃষ্টিপাতের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো দিন তিন ঘণ্টার মধ্যে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের আশঙ্কা তৈরি হয়। একইভাবে ২৪ ঘণ্টায় ২০০ মিলিমিটার কিংবা ৭২ ঘণ্টায় ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও একই আশঙ্কা থাকে। এসব তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হয়, যা একটি সার্ভার এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সংস্থার মোবাইল ফোন নম্বরগুলোর সঙ্গে যুক্ত। এই নেটওয়ার্কের আওতাধীন কোনো এলাকায় ওই পরিমাণ বৃষ্টি হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকেত সংশ্লিষ্ট মুঠোফোন নম্বরে পৌঁছায়। এর ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সম্ভাব্য বিপর্যয়ের আগেই স্থানীয় লোকজনকে নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নিতে পারে।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাখা বৃষ্টিপাতের হিসাবের তথ্য প্রতি ১৫ মিনিট পরপর অনলাইনে সংরক্ষিত হয়। বৃষ্টিপাতের হিসাব রাখার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটি চালু রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যাটারির চার্জ হয় সৌরশক্তির মাধ্যমে।
পাহাড়ধসের পূর্বাভাস পেতে চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার ও টেকনাফে (মোট চারটি স্থানে) যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ-নরওয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা কর্মসূচির আওতায় এসব যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে।
পূর্বাভাস নেটওয়ার্কের এলাকায় পাহাড়ধসের আশঙ্কার বার্তা নির্দিষ্ট কয়েকটি মুঠোফোন নম্বরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কিংবা তাঁদের প্রতিনিধি; টেকনাফ ও হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, আবহাওয়া অফিস, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রেড ক্রিসেন্ট, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, জিএসবি ও এনজিআইয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ওই সংকেত পেয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারেন।
কক্সবাজারে গণপূর্ত বিভাগের কার্যালয়ে স্থাপিত যন্ত্রটি গত ২৫ জুলাই পাহাড়ধসের আশঙ্কার সংকেত দিয়েছিল। তার ভিত্তিতে প্রশাসন ওই এলাকার পাহাড়ে বসবাসকারী লোকজনদের সরে যাওয়ার জন্য মাইকে প্রচার চালায়। এতে অনেকেই সরে যান। কিন্তু কিছু লোক সেখানে থেকে যায়। পরদিন সেখানে একটি পাহাড়ধসে পাঁচজন প্রাণ হারায়।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা আসে। সে অনুযায়ী তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রচার চালান, লোকজনকে সতর্ক করা ও প্রয়োজনে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নেন।
টেকনাফে যন্ত্রটি স্থাপন করা হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে। সেখান থেকে পাহাড়ধসের আশঙ্কার একটি সংকেত এসেছিল গত ২৬ জুলাই। পরদিন সেখানে পাহাড়ধস হয়। তবে লোকজন আগেই সরে যাওয়ায় কোনো প্রাণহানি হয়নি।
চট্টগ্রামে দুটি যন্ত্রের একটি বসানো হয়েছে সিটি করপোরেশন ভবনে। বাটালি পাহাড়সহ আশপাশের পাহাড়গুলোতে ধসের আশঙ্কা দেখা দিলে এই যন্ত্রের মাধ্যম তার পূর্বাভাস বা সংকেত পাওয়া যাবে। অন্যটি বসানো হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবনের পাঁচতলার ছাদে।
পাহাড়ধসের পূর্বাভাস পদ্ধতি যেভাবে কাজ করে
এ বিষয়ে ইকরাম আলী বলেন, আপাতত খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি শহরে তিনটি নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, যা নরওয়ের আর্থিক সহায়তায় হতে পারে। এরপর হয়তো সরকারি অর্থে আরও নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হবে। একেকটি নেটওয়ার্ক স্থাপনে ছয় লাখ টাকার মতো খরচ হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, এই পদ্ধতি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা গেলে পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব। অবশ্য কয়েক বছর আগে অযান্ত্রিকভাবে (ম্যানুয়ালি) এ পদ্ধতি সিডিএমপির পক্ষ থেকে চালু করা হয়েছিল বলে তিনি জানান।
তবে পদ্ধতিটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগোষ্ঠীর সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, পদ্ধতিটি কার্যকর হলেও মানুষ যদি পাহাড়ে যত্রতত্র বসবাস ও পাহাড় কাটার মতো কাজ চালিয়ে যায়, তাহলে প্রাণহানি ঠেকানো কঠিন হবে। এ জন্য সচেতনতা গড়ে তুলতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দরকার।

No comments

Powered by Blogger.