নির্বাচন এখন নির্বাসনে! by সোহরাব হাসান
একটি
রাষ্ট্র তখনই গণতান্ত্রিক হয়, যখন তার প্রতিটি অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠান সংবিধান
মোতাবেক চলে বা চলতে দেওয়া হয়। আমাদের রাষ্ট্রের চালকেরা এ ব্যাপারে সব
সময়ই অনুদার ছিলেন এবং এখনো আছেন। ফলে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আমরা
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ (নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা) এবং তার অধীন
প্রতিষ্ঠানগুলো সংহত করতে পারিনি। বরং ঔপনিবেশিক আমলে যেসব প্রতিষ্ঠান
গড়ে উঠেছিল, সেসব প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক কাঠামোটিও এখন ধ্বংসের
দ্বারপ্রান্তে। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত।
গ্রিসের নগর রাষ্ট্রে সব নাগরিককে এক জায়গায় ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো,
কিন্তু বর্তমান যুগে সেটি তো সম্ভব নয়। এ কারণেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়
জনপ্রতিনিধি বাছাই বা নির্বাচন প্রথা চালু আছে। পৃথিবীতে এমন একটি দেশ
দেখানো যাবে না, যেখানে গণতন্ত্র আছে, অথচ নির্বাচন নেই। অথচ আমাদের
নেতা–নেত্রীরা সেই নির্বাচনকেই নির্বাসনে পাঠানোর সমস্ত আয়োজন করেছেন।
বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে নির্বাচনমুখী হলেও এখন সেটি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। আগে এই আতঙ্কটা জাতীয় নির্বাচনেই সীমিত ছিল, এখন তা বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনেও ছড়িয়ে পড়েছে। এফবিসিসিআই নির্বাচন সম্পর্কে গতকাল সহকর্মী শওকত হোসেন লিখেছেন, যার মোদ্দাকথা হলো সরকারের সমর্থন ছাড়া কেউ এই সংগঠনের শীর্ষ পদে জয়ী হবেন, এমনটি ভাবতে পারেন না। বছর দুই আগে অনুষ্ঠিত বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন) নির্বাচনে সরকার-সমর্থক চিকিৎসকেরা জয়ী হলে বিরোধী পক্ষ ভোট কারচুপির অভিযোগ আনে। অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচন নিয়েও। প্রথম আলোয় এ-সংক্রান্ত রিপোর্ট ছাপা হলে সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ে।
আমরা সাংবাদিকেরা দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রায়ণের কথা বললেও নিজেদের যে প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রেসক্লাব, তার গণতন্ত্রায়ণের কথা ভাবি না। এই প্রতিষ্ঠানে বহু সদস্য আছেন, যাঁরা ১৫-২০ বছর আগে সাংবাদিকতা পেশা থেকে বিদায় নিয়েছেন। আবার একটানা ২০-২২ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় থেকেও অনেকে প্রেসক্লাবের সদস্য হতে পারেন না। প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য কে কত বছর সাংবাদিকতা করেছেন, সেটি বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হলো পরিচালনা কমিটির ‘রহমত’ আছে কি না। বর্তমানে প্রেসক্লাব নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তার মূলে রয়েছে কোটারি স্বার্থ। এই কোটারি স্বার্থই প্রখ্যাত কবি ও অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার সম্পাদক শামসুর রাহমানের সদস্যপদও আটকে দিয়েছিল। মাননীয় হাইকোর্ট বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচন স্থগিত করেছেন ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকার কারণে। আমরা মনে করি, ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের সমঝোতা প্রেসক্লাবে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান দেবে না। প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনা নয়, পেশার জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রকৃত সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবের সদস্যপদ দিতে হবে।
গত ২৮ এপ্রিল তিন সিটি করপোরেশনের (ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম) যে নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েই জনমনে প্রবল সন্দেহ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। নির্বাচন মানে সবার মধ্য থেকে পছন্দসই প্রার্থী বাছাই করার সর্বজনীন প্রক্রিয়া, যা এখানে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার সংস্থার এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতিতে যে সুবাতাস বইতে পারত, তা সরকার, সরকারি দল ও নির্বাচন কমিশন নস্যাৎ করে দিয়েছে। নির্বাচনে নানা অনিয়ম, কারচুপি নিয়ে যারাই সমালোচনা করছে, ক্ষমতাসীনেরা তাদের ওপর খড়্গহস্ত। ভোট কারচুপির কথা এলেই কথায় কথায় তাঁরা জিয়াউর রহমান ও এরশাদের তথাকথিত ‘গণভোটের’ উদাহরণ দেন। এ দেশে আইয়ুব থেকে এরশাদ—সামরিক শাসকের কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এসব জবরদস্তির নির্বাচনে জনরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। সামরিক শাসকেরা জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসেন না। তাঁরা ক্ষমতাকে জায়েজ করতে দুটি কাজ দক্ষতার সঙ্গে করেন। এক. বিরোধী দল থেকে লোক ভাগিয়ে এনে নতুন দল করা, দুই. যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠন করে নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করেন।
ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগও করা হয় যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন বলেই নাকি গণমাধ্যম, টিআইবি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের পেছনে লেগেছে। বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হলে সবাই চুপ মেরে যেতেন। তাঁদের এই ধারণা ও অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য। গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন বলে নয়। গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে নির্বাচনে ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি বলে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে থাকার কথা ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে যখন তাঁরা জয়ী হন, তখন দেশের তাবৎ গণমাধ্যম, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সেই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে সাধুবাদ জানিয়েছিল। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ে গণমাধ্যম কীভাবে দেখেছে, তা-ও ক্ষমতাসীনদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সমস্যা হলো সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলা অনেকেই পছন্দ করেন না। বিশেষ করে, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন। বিএনপি আমলে মাগুরা উপনির্বাচন ও ঢাকা-১০ উপনির্বাচন কিংবা আওয়ামী লীগ আমলের টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে গণতন্ত্র সত্যি সত্যি পরাজিত হয়েছিল।
আমাদের প্রশ্ন, যে কাজ ক্ষমতা জবরদখলকারী সামরিক শাসকেরা করেন, সেই কাজ কেন জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগ করবে? সিটি নির্বাচনে এবার যে পরিমাণ কারচুপি, অনিয়ম ও জবরদস্তি হয়েছে, তার খুব সামান্যই এসেছে গণমাধ্যমে। কিন্তু সেটিও ক্ষমতাসীনেরা সহ্য করতে পারছেন না। তাঁদের দাবি, বিএনপি কারচুপি করলে নাকি গণমাধ্যম মুখে কুলুপ এঁটে থাকে, আর আওয়ামী লীগ আমলে কিছু ঘটলেই হইচই শুরু হয়। তাঁরা এই অভিযোগের পক্ষে একটি প্রমাণও দেখাতে পারবেন না।
অনেক হতাশার মাঝেও মানুষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে একটু আশার আলো দেখতে চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ হলে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সুস্থিরতা আসবে। কিন্তু আসেনি। আওয়ামী লীগ একটি বড় সুযোগ হারাল। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, দেশে এক মুহূর্তের জন্যও অনির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচিত সরকারকে তো প্রমাণ করতে হবে যে তাদের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। ১৯৯৫–৯৬ সালে বিএনপি সেটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা এসেছিল। উচ্চ আদালতের রায়ে সেটি বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ যখন ব্যর্থ হলো, তখন বিকল্প কী? ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে ক্ষমতাসীনেরা দাবি করেন, বিএনপি আসেনি বলেই তারা একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভালো নির্বাচন করতে পারেননি। মানলাম। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ সত্ত্বেও কেন নগরবাসীরা ভোট দিতে পারলেন না? তিন মাসের পেট্রলবোমা মারা আন্দোলন করে যখন বিএনপি সর্বমহলে নিন্দিত ও ধিক্কৃত, তখনই নির্বাচন কমিশন কৌশল হিসেবে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। ক্ষমতাসীনেরা সম্ভবত ভেবেছিলেন বিএনপি নির্বাচনে আসবে না। কিন্তু তাদেরও একটি এক্সিট দরকার ছিল এবং নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কথা প্রায়ই বলেন। বিএনপি ও জামায়াত তিন মাস ধরে পেট্রলবোমা মারা আন্দোলন করার পরও মানুষ কীভাবে তাদের ভোট দেয়? দেয় এ কারণে যে মানুষ মনে করে, বিএনপি আগুনে–বোমা ছুড়ে দেশের যে ক্ষতি করেছে, আওয়ামী লীগ তার চেয়ে কোনো অংশে কম ক্ষতি করেনি। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, দুপুর ১২টা পর্যন্ত নির্বাচন করেই বিএনপি-সমর্থক তিন মেয়র প্রার্থীর ৩৫ শতাংশ ভোট পাওয়া অবাক কাণ্ডই বটে। তাই প্রধানমন্ত্রীকেই উপলব্ধি করতে হবে এত কিছুর পরও কেন মানুষ বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দিচ্ছে। তাহলে কি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এমন কিছু করছেন, যা বিএনপির আগুনে–বোমার চেয়েও ভয়ংকর। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে, টিভির সুইচ অন করলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের তাণ্ডব দেখতে পাই। সাংসদের হাতে উপজেলা চেয়ারম্যান, এক কাউন্সিলরের হাতে আরেক কাউন্সিলর খুন হন। ছাত্রলীগ মারছে যুবলীগকে, যুবলীগ মারছে আওয়ামী লীগকে। সাংসদের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি। গত ছয় বছরে কোনো ক্যাম্পাসে ছাত্রদল নেই, শিবির দু-একটি ক্যাম্পাসে থাকলেও অনেক আগেই তাদের মাজা ভেঙে গেছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনও এখন নেই। তাহলে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই সন্ত্রাস কারা চালাচ্ছে? সেটি বনেদি আওয়ামী লীগারই হোক আর পিপিপি বা প্রেজেন্ট পাওয়ার পার্টির নবাগতই হোক, সরকার দায় এড়াতে পারেন না।
সরকারি দলের নেতারা পেট্রলবোমার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করলেও এ পর্যন্ত সরকার কজনকে ধরেছে? লালবাগে কবজি উড়ে যাওয়া যুবদলের কর্মী কিংবা বোমাসহ আরও দু-একজনের বাইরে কাউকেই তারা ধরতে পারেনি। রাজশাহীতে দুই শিবির কর্মীকে ধরিয়ে দিয়েছে স্থানীয় মানুষ। তাতে পুলিশের তেমন কৃতিত্ব নেই। কিন্তু আমরা যখন দেখি বাসে পেট্রলবোমা মারার জন্য হিন্দু ছেলে নয়ন বছারকে ধরে পুলিশ শিবির কর্মী বানায় কিংবা তার ধর্ম পরিচয় প্রথমে তারা বিশ্বাসই করে না, পরে যখন জানা গেল সে প্রকৃত হিন্দু, তখন তাঁকে ছাত্রদলের কর্মী বানায়, তখন মানুষ কেবল ওই পুলিশের ওপরই বীতশ্রদ্ধ হয় না, আস্থা হারায় তাঁদের পরিচালনাকারী সরকারটির ওপরই। যখন পুলিশ পেট্রলবোমাবাজদের ধরতে না পেরে গয়রহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, কিংবা বিরোধী দলের নেতাদের রিমান্ড দাবি করে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না সরকারের ওপর মানুষ কতটা অনাস্থা প্রকাশ করে। একটি মিথ্যা মামলা ও অবিশ্বস্ত রিমান্ডের জন্য সরকারের কমপক্ষে ৫ শতাংশ করে ভোট কমছে। আর যতই সময় যাবে, ততই তার ভোট আরও কমতে থাকবে।
অনেক বছর আগে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবিচার দেখে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল–মামুন লিখেছিলেন সুবচন নির্বাসনে। এখন সম্ভবত লেখার সময় এসেছে নির্বাচন নির্বাসনে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে নির্বাচনমুখী হলেও এখন সেটি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। আগে এই আতঙ্কটা জাতীয় নির্বাচনেই সীমিত ছিল, এখন তা বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনেও ছড়িয়ে পড়েছে। এফবিসিসিআই নির্বাচন সম্পর্কে গতকাল সহকর্মী শওকত হোসেন লিখেছেন, যার মোদ্দাকথা হলো সরকারের সমর্থন ছাড়া কেউ এই সংগঠনের শীর্ষ পদে জয়ী হবেন, এমনটি ভাবতে পারেন না। বছর দুই আগে অনুষ্ঠিত বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন) নির্বাচনে সরকার-সমর্থক চিকিৎসকেরা জয়ী হলে বিরোধী পক্ষ ভোট কারচুপির অভিযোগ আনে। অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচন নিয়েও। প্রথম আলোয় এ-সংক্রান্ত রিপোর্ট ছাপা হলে সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ে।
আমরা সাংবাদিকেরা দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রায়ণের কথা বললেও নিজেদের যে প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রেসক্লাব, তার গণতন্ত্রায়ণের কথা ভাবি না। এই প্রতিষ্ঠানে বহু সদস্য আছেন, যাঁরা ১৫-২০ বছর আগে সাংবাদিকতা পেশা থেকে বিদায় নিয়েছেন। আবার একটানা ২০-২২ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় থেকেও অনেকে প্রেসক্লাবের সদস্য হতে পারেন না। প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য কে কত বছর সাংবাদিকতা করেছেন, সেটি বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হলো পরিচালনা কমিটির ‘রহমত’ আছে কি না। বর্তমানে প্রেসক্লাব নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তার মূলে রয়েছে কোটারি স্বার্থ। এই কোটারি স্বার্থই প্রখ্যাত কবি ও অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার সম্পাদক শামসুর রাহমানের সদস্যপদও আটকে দিয়েছিল। মাননীয় হাইকোর্ট বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচন স্থগিত করেছেন ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকার কারণে। আমরা মনে করি, ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের সমঝোতা প্রেসক্লাবে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান দেবে না। প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনা নয়, পেশার জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রকৃত সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবের সদস্যপদ দিতে হবে।
গত ২৮ এপ্রিল তিন সিটি করপোরেশনের (ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম) যে নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েই জনমনে প্রবল সন্দেহ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। নির্বাচন মানে সবার মধ্য থেকে পছন্দসই প্রার্থী বাছাই করার সর্বজনীন প্রক্রিয়া, যা এখানে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার সংস্থার এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতিতে যে সুবাতাস বইতে পারত, তা সরকার, সরকারি দল ও নির্বাচন কমিশন নস্যাৎ করে দিয়েছে। নির্বাচনে নানা অনিয়ম, কারচুপি নিয়ে যারাই সমালোচনা করছে, ক্ষমতাসীনেরা তাদের ওপর খড়্গহস্ত। ভোট কারচুপির কথা এলেই কথায় কথায় তাঁরা জিয়াউর রহমান ও এরশাদের তথাকথিত ‘গণভোটের’ উদাহরণ দেন। এ দেশে আইয়ুব থেকে এরশাদ—সামরিক শাসকের কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এসব জবরদস্তির নির্বাচনে জনরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। সামরিক শাসকেরা জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসেন না। তাঁরা ক্ষমতাকে জায়েজ করতে দুটি কাজ দক্ষতার সঙ্গে করেন। এক. বিরোধী দল থেকে লোক ভাগিয়ে এনে নতুন দল করা, দুই. যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠন করে নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করেন।
ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগও করা হয় যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন বলেই নাকি গণমাধ্যম, টিআইবি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের পেছনে লেগেছে। বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হলে সবাই চুপ মেরে যেতেন। তাঁদের এই ধারণা ও অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য। গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন বলে নয়। গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে নির্বাচনে ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি বলে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে থাকার কথা ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে যখন তাঁরা জয়ী হন, তখন দেশের তাবৎ গণমাধ্যম, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সেই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে সাধুবাদ জানিয়েছিল। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ে গণমাধ্যম কীভাবে দেখেছে, তা-ও ক্ষমতাসীনদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সমস্যা হলো সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলা অনেকেই পছন্দ করেন না। বিশেষ করে, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন। বিএনপি আমলে মাগুরা উপনির্বাচন ও ঢাকা-১০ উপনির্বাচন কিংবা আওয়ামী লীগ আমলের টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে গণতন্ত্র সত্যি সত্যি পরাজিত হয়েছিল।
আমাদের প্রশ্ন, যে কাজ ক্ষমতা জবরদখলকারী সামরিক শাসকেরা করেন, সেই কাজ কেন জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগ করবে? সিটি নির্বাচনে এবার যে পরিমাণ কারচুপি, অনিয়ম ও জবরদস্তি হয়েছে, তার খুব সামান্যই এসেছে গণমাধ্যমে। কিন্তু সেটিও ক্ষমতাসীনেরা সহ্য করতে পারছেন না। তাঁদের দাবি, বিএনপি কারচুপি করলে নাকি গণমাধ্যম মুখে কুলুপ এঁটে থাকে, আর আওয়ামী লীগ আমলে কিছু ঘটলেই হইচই শুরু হয়। তাঁরা এই অভিযোগের পক্ষে একটি প্রমাণও দেখাতে পারবেন না।
অনেক হতাশার মাঝেও মানুষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে একটু আশার আলো দেখতে চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ হলে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সুস্থিরতা আসবে। কিন্তু আসেনি। আওয়ামী লীগ একটি বড় সুযোগ হারাল। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, দেশে এক মুহূর্তের জন্যও অনির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচিত সরকারকে তো প্রমাণ করতে হবে যে তাদের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। ১৯৯৫–৯৬ সালে বিএনপি সেটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা এসেছিল। উচ্চ আদালতের রায়ে সেটি বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ যখন ব্যর্থ হলো, তখন বিকল্প কী? ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে ক্ষমতাসীনেরা দাবি করেন, বিএনপি আসেনি বলেই তারা একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভালো নির্বাচন করতে পারেননি। মানলাম। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ সত্ত্বেও কেন নগরবাসীরা ভোট দিতে পারলেন না? তিন মাসের পেট্রলবোমা মারা আন্দোলন করে যখন বিএনপি সর্বমহলে নিন্দিত ও ধিক্কৃত, তখনই নির্বাচন কমিশন কৌশল হিসেবে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। ক্ষমতাসীনেরা সম্ভবত ভেবেছিলেন বিএনপি নির্বাচনে আসবে না। কিন্তু তাদেরও একটি এক্সিট দরকার ছিল এবং নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কথা প্রায়ই বলেন। বিএনপি ও জামায়াত তিন মাস ধরে পেট্রলবোমা মারা আন্দোলন করার পরও মানুষ কীভাবে তাদের ভোট দেয়? দেয় এ কারণে যে মানুষ মনে করে, বিএনপি আগুনে–বোমা ছুড়ে দেশের যে ক্ষতি করেছে, আওয়ামী লীগ তার চেয়ে কোনো অংশে কম ক্ষতি করেনি। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, দুপুর ১২টা পর্যন্ত নির্বাচন করেই বিএনপি-সমর্থক তিন মেয়র প্রার্থীর ৩৫ শতাংশ ভোট পাওয়া অবাক কাণ্ডই বটে। তাই প্রধানমন্ত্রীকেই উপলব্ধি করতে হবে এত কিছুর পরও কেন মানুষ বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দিচ্ছে। তাহলে কি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এমন কিছু করছেন, যা বিএনপির আগুনে–বোমার চেয়েও ভয়ংকর। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে, টিভির সুইচ অন করলেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের তাণ্ডব দেখতে পাই। সাংসদের হাতে উপজেলা চেয়ারম্যান, এক কাউন্সিলরের হাতে আরেক কাউন্সিলর খুন হন। ছাত্রলীগ মারছে যুবলীগকে, যুবলীগ মারছে আওয়ামী লীগকে। সাংসদের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি। গত ছয় বছরে কোনো ক্যাম্পাসে ছাত্রদল নেই, শিবির দু-একটি ক্যাম্পাসে থাকলেও অনেক আগেই তাদের মাজা ভেঙে গেছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনও এখন নেই। তাহলে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই সন্ত্রাস কারা চালাচ্ছে? সেটি বনেদি আওয়ামী লীগারই হোক আর পিপিপি বা প্রেজেন্ট পাওয়ার পার্টির নবাগতই হোক, সরকার দায় এড়াতে পারেন না।
সরকারি দলের নেতারা পেট্রলবোমার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করলেও এ পর্যন্ত সরকার কজনকে ধরেছে? লালবাগে কবজি উড়ে যাওয়া যুবদলের কর্মী কিংবা বোমাসহ আরও দু-একজনের বাইরে কাউকেই তারা ধরতে পারেনি। রাজশাহীতে দুই শিবির কর্মীকে ধরিয়ে দিয়েছে স্থানীয় মানুষ। তাতে পুলিশের তেমন কৃতিত্ব নেই। কিন্তু আমরা যখন দেখি বাসে পেট্রলবোমা মারার জন্য হিন্দু ছেলে নয়ন বছারকে ধরে পুলিশ শিবির কর্মী বানায় কিংবা তার ধর্ম পরিচয় প্রথমে তারা বিশ্বাসই করে না, পরে যখন জানা গেল সে প্রকৃত হিন্দু, তখন তাঁকে ছাত্রদলের কর্মী বানায়, তখন মানুষ কেবল ওই পুলিশের ওপরই বীতশ্রদ্ধ হয় না, আস্থা হারায় তাঁদের পরিচালনাকারী সরকারটির ওপরই। যখন পুলিশ পেট্রলবোমাবাজদের ধরতে না পেরে গয়রহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, কিংবা বিরোধী দলের নেতাদের রিমান্ড দাবি করে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না সরকারের ওপর মানুষ কতটা অনাস্থা প্রকাশ করে। একটি মিথ্যা মামলা ও অবিশ্বস্ত রিমান্ডের জন্য সরকারের কমপক্ষে ৫ শতাংশ করে ভোট কমছে। আর যতই সময় যাবে, ততই তার ভোট আরও কমতে থাকবে।
অনেক বছর আগে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবিচার দেখে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল–মামুন লিখেছিলেন সুবচন নির্বাসনে। এখন সম্ভবত লেখার সময় এসেছে নির্বাচন নির্বাসনে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments