সম্পর্ককে কাঁটাতারের বাইরে নিতে হবে : এম হুমায়ুন কবির by ফারুক ওয়াসিফ
হুমায়ুন কবির |
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর সামনে রেখে প্রথম আলো মুখোমুখি হয় বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসছেন। গণমাধ্যমে এটা এমনভাবে উপস্থিত, যেন বিষয়টি দুই নেতা ও দুই দলের।
হুমায়ুন কবির : আসলে সম্পর্কটা হয় দুই দেশ ও দুই জনগণের মধ্যে। সরকার এখানে মাধ্যম। সরকার বদলায়, কিন্তু জনগণ থাকে এবং দেশের প্রধান শক্তি হচ্ছে জনগণ। তাই সরকার পরিবর্তন হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা থাকে। তাই সম্পর্কটা দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে হতে হবে। সেই ভিত্তিতেই একাত্তর সালে দুই দেশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক হয়েছিল। কিন্তু পরে সমস্যা হওয়ার কারণ, সম্পর্কটা শুধু সরকারি পর্যায়ে বা দলীয় স্তরে চলে গেলে অ্যালিয়েনেশন বা দূরত্ব তৈরি হয়।
প্রথম আলো : ভারতের নিরাপত্তা নীতিতে প্রায়ই বাংলাদেশ সমস্যা হিসেবে হাজির হয়; অন্যদিকে বাংলাদেশ কিছু বকেয়া সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। একদিকে স্থলসীমান্ত চুক্তি, আরেক দিকে কাঁটাতারের বেড়া। একদিকে অনুকূল বাংলাদেশ, অন্যদিকে ভারতে বাংলাদেশি নাগরিক ও পণ্য চলাচলে বাধা। এই দ্বিধা কাটানোর উপায় কী?
হুমায়ুন কবির : কোনো দুই রাষ্ট্রের স্বার্থ একই হবে, তা মনে করার কারণ নেই। ভারত বড় দেশ, তার নিজস্ব স্বার্থ, অভিপ্রায় ও লক্ষ্য আছে। বাংলাদেশেরও তেমনটাই আছে। তবে প্রতিযোগিতা ও ভিন্নতা যেমন থাকতে পারে, তেমনি সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের সুযোগও বিস্তর। ভারত অনেকগুলো বিষয়ে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। যেমন নিরাপত্তা প্রশ্নে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ যথেষ্ট ইতিবাচকভাবে হাত বাড়িয়েছে। স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থিত হওয়ায় আরও একটা বড় সমস্যা কমল। দ্বিতীয় বিষয়টা বিশ্বাসের। ভারতকে উপলব্ধি করতে হবে যে কাঁটাতার বন্ধুত্বের ভালো নিদর্শন নয়। কাজেই বাংলাদেশকে যদি ভারত বিশ্বাসভাজন বন্ধু বা অংশীদার ভাবে, তাহলে কাঁটাতারের বেড়ার কী প্রয়োজন? আমরা এখন পরস্পরের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট আছি, সুতরাং সম্পর্ককে কাঁটাতারের বাইরে নিতে হবে। তৃতীয়ত, পরস্পরের জনশক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ বাড়াতে হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর কারণ, অনেক ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশিরাও কি একইভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় পারমিটের মাধ্যমে ভারতে কাজে যেতে পারে না?
হুমায়ুন কবির : কাঁটাতারের বাইরে সম্পর্ককে নিতে হলে এই দিকে ভাবতে হবে। ভারতের অনেক জায়গাতেই বাইরের শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ভারতের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানি বলেছিলেন, বাংলাদেশের কেউ আগ্রহী হলে ভারতে অস্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ পেতে পারে। মোদি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারেন। ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের ধারণা তাহলে আরও ইতিবাচক ও স্বচ্ছ হবে এবং ভারত যে আমাদের ইতিবাচক অংশীদার, সেটাও মানুষের কাছে প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
প্রথম আলো : গত সাত-আট বছরের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে ভারতের সেই ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি?
হুমায়ুন কবির : খানিকটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে গত নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে শক্তিশালী করায় উভয় দেশেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শক্তিশালী, অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে শক্তিশালীই করবে। শেষ বিচারে, মানুষই কিন্তু নীতির সমর্থক বা প্রতিবন্ধক। যেহেতু আমরা প্রতিবেশী, যেহেতু আমাদের ভাগ্য প্রায় একে অপরের সঙ্গে জড়িত, যেহেতু আগামী দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোও একই সূত্রে গাঁথা, সেই বিবেচনায় আগামী দিনের প্রেক্ষাপটে মানুষের অংশগ্রহণ ও ব্যাপক জনসমর্থনই কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সহযোগিতার রক্ষাকবচ।
প্রথম আলো : বর্তমানে দুই দেশের যান চলাচল নিয়ে যে কথা হচ্ছে, সেটা কি আগের একমুখী ট্রানজিট সম্পূর্ণ করার অংশ? নাকি তার মধ্যে বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোরও শর্ত আছে। নেপাল-ভুটান কিংবা আরও দূরবর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন তো বাংলাদেশেরও আছে।
হুমায়ুন কবির : অসম্পূর্ণ ট্রানজিটের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করাও যেমন আছে, আরও কয়েকটি স্তরও আছে। নীতিগত দিক থেকে বাংলাদেশেরও তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার দরকার আছে। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আমরা যদি আমাদের কাজ, বিনিয়োগ, রপ্তানি এবং মানুষে–মানুষে যোগাযোগের জন্য যদি বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ চাইতে পারি, তাহলে প্রতিবেশীদের সঙ্গেও তা হওয়া প্রয়োজন। সেই বিবেচনাতেই আঞ্চলিক যোগাযোগের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এবারেও এ ব্যাপারে বেশ কিছু চুক্তিও প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের সময় সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। ভারত তার স্বার্থে সুবিধা চাইবে, এটা দোষের কিছু না। তবে আমাদের চাওয়াকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব এবং মানুষের সামনে তুলে ধরব? এটা স্তরে স্তরে হওয়া উচিত। যেমন: ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়। এতে বাংলাদেশের সহযোগী হওয়া উচিত। পরের স্তরে নেপাল-ভুটানকে নিয়ে সড়ক-রেল যোগাযোগের যে কথা উঠছে, সেটাও ইতিবাচক। মনে রাখতে হবে, আরও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আমরা তিনটি শক্তিকে উত্থানের মুখে দেখতে পাচ্ছি: চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্মিলিত সংস্থা তথা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো। ভারতের সঙ্গে যে কানেকটিভিটির কাজ আমরা করছি, তা হলো প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে যেতে হলে বাংলাদেশকে আসিয়ানের সঙ্গে কানেকটিভিটি তৈরি করতে হবে, তৃতীয় স্তরে করতে হবে চীনের সঙ্গে। ভারতের হয়তো এ ব্যাপারে স্পর্শকাতরতা আছে। আমি মনে করি, ভারতের সঙ্গে যাদের প্রতিযোগিতা আছে তাদের হয়ে নয়, বরং সবার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার সুযোগটা বাংলাদেশের জন্য রাখতে হবে এবং বাংলাদেশেরও যথাযথভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিটা তুলে ধরতে হবে।
প্রথম আলো : জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ভারতের সঙ্গে আমাদের কোথায় কোথায় সহযোগিতা হতে পারে, সে বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা আমাদের কি আছে?
হুমায়ুন কবির : ভারতের সঙ্গেই আমাদের থাকতে হবে যেহেতু, সেহেতু তাকে তো বুঝতে হবে। ভারতে গত ৩০ বছরে যেভাবে পরিবর্তন হয়েছে, তার যথাযথ মূল্যায়ন ও উপলব্ধি থাকতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভারতকে বোঝায় আমাদের ঘাটতি আছে।
প্রথম আলো :ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ভারতের নেতারা যখন আমাদের দেশে আসেন, তার সঙ্গে বা আগে-পিছে তাঁদের নায়ক-নায়িকা ও শিল্পী-সাহিত্যিকেরাও আসেন। একে কোন ধরনের কূটনীতি বলবেন?
হুমায়ুন কবির : ভারত তার রাষ্ট্রশক্তি তথা হার্ড পাওয়ারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক শক্তি তথা সফট পাওয়ারকেও আমাদের সামনে প্রদর্শন করছে। তাদের টেলিভিশন, সিনেমা এবং সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়েই তারা বাংলাদেশে উপস্থাপিত হয়। এবং ভারত এটা করে দলীয় চিন্তার বাইরে। বিপরীতে আমরা আমাদের যে সাংস্কৃতিক শক্তি ও রসদ আছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চমৎকার সব আইডিয়া আছে—যা আমাদের যথেষ্টভাবেই আছে—সেগুলোকেও দলনিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করা চাই। আমরা দলীয়করণ ও রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক শক্তিকে দুর্বল করে রাখছি। ভারত কিন্তু সেটা করে না। ভারতের এই সার্থকতা থেকে আমাদেরও শিখতে হবে যে, কীভাবে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক সক্ষমতাকে কাজে লাগাব।
প্রথম আলো : সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপে ভারত ও চীনের রেষারেষিতে অস্থিতিশীলতা আসছে। বাংলাদেশেও কি অনুরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে?
হুমায়ুন কবির : ভারতকে এটা চিন্তায় আনতে হবে, ভারত-চীনের লড়াই প্রতিবেশী দেশগুলোর স্থিতিশীলতার প্রতি কোনো হুমকি যেন না হয়। অন্যদিকে ভারত-চীনের লড়াইয়ের পাশাপাশি সহযোগিতাও তো আছে। এই সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রবেশ করে আমরা সবার জন্যই অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারি এবং প্রতিবেশীরাও তাতে উপকৃত হতে পারে। এই ইতিবাচক ধারণাকাঠামোকে আমাদের প্রাধান্যের মধ্যেও নিয়ে আসতে হবে। যাতে ভয় থেকে বেরিয়ে এসে সহযোগিতার মাত্রা বাড়াতে পারি। অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশ হিসেবে আমাদের এ বক্তব্য সামনে আনা উচিত। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, স্থিতিশীল বাংলাদেশ, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে চলা বাংলাদেশ শুধু ভারতের জন্যই নয়, উপমহাদেশের জন্যও বিরাট অবদান রাখতে পারে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
হুমায়ুন কবির ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসছেন। গণমাধ্যমে এটা এমনভাবে উপস্থিত, যেন বিষয়টি দুই নেতা ও দুই দলের।
হুমায়ুন কবির : আসলে সম্পর্কটা হয় দুই দেশ ও দুই জনগণের মধ্যে। সরকার এখানে মাধ্যম। সরকার বদলায়, কিন্তু জনগণ থাকে এবং দেশের প্রধান শক্তি হচ্ছে জনগণ। তাই সরকার পরিবর্তন হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা থাকে। তাই সম্পর্কটা দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে হতে হবে। সেই ভিত্তিতেই একাত্তর সালে দুই দেশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক হয়েছিল। কিন্তু পরে সমস্যা হওয়ার কারণ, সম্পর্কটা শুধু সরকারি পর্যায়ে বা দলীয় স্তরে চলে গেলে অ্যালিয়েনেশন বা দূরত্ব তৈরি হয়।
প্রথম আলো : ভারতের নিরাপত্তা নীতিতে প্রায়ই বাংলাদেশ সমস্যা হিসেবে হাজির হয়; অন্যদিকে বাংলাদেশ কিছু বকেয়া সমস্যা সমাধানে আগ্রহী। একদিকে স্থলসীমান্ত চুক্তি, আরেক দিকে কাঁটাতারের বেড়া। একদিকে অনুকূল বাংলাদেশ, অন্যদিকে ভারতে বাংলাদেশি নাগরিক ও পণ্য চলাচলে বাধা। এই দ্বিধা কাটানোর উপায় কী?
হুমায়ুন কবির : কোনো দুই রাষ্ট্রের স্বার্থ একই হবে, তা মনে করার কারণ নেই। ভারত বড় দেশ, তার নিজস্ব স্বার্থ, অভিপ্রায় ও লক্ষ্য আছে। বাংলাদেশেরও তেমনটাই আছে। তবে প্রতিযোগিতা ও ভিন্নতা যেমন থাকতে পারে, তেমনি সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের সুযোগও বিস্তর। ভারত অনেকগুলো বিষয়ে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। যেমন নিরাপত্তা প্রশ্নে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ যথেষ্ট ইতিবাচকভাবে হাত বাড়িয়েছে। স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থিত হওয়ায় আরও একটা বড় সমস্যা কমল। দ্বিতীয় বিষয়টা বিশ্বাসের। ভারতকে উপলব্ধি করতে হবে যে কাঁটাতার বন্ধুত্বের ভালো নিদর্শন নয়। কাজেই বাংলাদেশকে যদি ভারত বিশ্বাসভাজন বন্ধু বা অংশীদার ভাবে, তাহলে কাঁটাতারের বেড়ার কী প্রয়োজন? আমরা এখন পরস্পরের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট আছি, সুতরাং সম্পর্ককে কাঁটাতারের বাইরে নিতে হবে। তৃতীয়ত, পরস্পরের জনশক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ বাড়াতে হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর কারণ, অনেক ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে।
প্রথম আলো : বাংলাদেশিরাও কি একইভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় পারমিটের মাধ্যমে ভারতে কাজে যেতে পারে না?
হুমায়ুন কবির : কাঁটাতারের বাইরে সম্পর্ককে নিতে হলে এই দিকে ভাবতে হবে। ভারতের অনেক জায়গাতেই বাইরের শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। ভারতের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানি বলেছিলেন, বাংলাদেশের কেউ আগ্রহী হলে ভারতে অস্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ পেতে পারে। মোদি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারেন। ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের ধারণা তাহলে আরও ইতিবাচক ও স্বচ্ছ হবে এবং ভারত যে আমাদের ইতিবাচক অংশীদার, সেটাও মানুষের কাছে প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
প্রথম আলো : গত সাত-আট বছরের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে ভারতের সেই ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি?
হুমায়ুন কবির : খানিকটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে গত নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে শক্তিশালী করায় উভয় দেশেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শক্তিশালী, অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে শক্তিশালীই করবে। শেষ বিচারে, মানুষই কিন্তু নীতির সমর্থক বা প্রতিবন্ধক। যেহেতু আমরা প্রতিবেশী, যেহেতু আমাদের ভাগ্য প্রায় একে অপরের সঙ্গে জড়িত, যেহেতু আগামী দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোও একই সূত্রে গাঁথা, সেই বিবেচনায় আগামী দিনের প্রেক্ষাপটে মানুষের অংশগ্রহণ ও ব্যাপক জনসমর্থনই কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সহযোগিতার রক্ষাকবচ।
প্রথম আলো : বর্তমানে দুই দেশের যান চলাচল নিয়ে যে কথা হচ্ছে, সেটা কি আগের একমুখী ট্রানজিট সম্পূর্ণ করার অংশ? নাকি তার মধ্যে বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোরও শর্ত আছে। নেপাল-ভুটান কিংবা আরও দূরবর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন তো বাংলাদেশেরও আছে।
হুমায়ুন কবির : অসম্পূর্ণ ট্রানজিটের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করাও যেমন আছে, আরও কয়েকটি স্তরও আছে। নীতিগত দিক থেকে বাংলাদেশেরও তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার দরকার আছে। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আমরা যদি আমাদের কাজ, বিনিয়োগ, রপ্তানি এবং মানুষে–মানুষে যোগাযোগের জন্য যদি বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ চাইতে পারি, তাহলে প্রতিবেশীদের সঙ্গেও তা হওয়া প্রয়োজন। সেই বিবেচনাতেই আঞ্চলিক যোগাযোগের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এবারেও এ ব্যাপারে বেশ কিছু চুক্তিও প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের সময় সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। ভারত তার স্বার্থে সুবিধা চাইবে, এটা দোষের কিছু না। তবে আমাদের চাওয়াকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব এবং মানুষের সামনে তুলে ধরব? এটা স্তরে স্তরে হওয়া উচিত। যেমন: ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়। এতে বাংলাদেশের সহযোগী হওয়া উচিত। পরের স্তরে নেপাল-ভুটানকে নিয়ে সড়ক-রেল যোগাযোগের যে কথা উঠছে, সেটাও ইতিবাচক। মনে রাখতে হবে, আরও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আমরা তিনটি শক্তিকে উত্থানের মুখে দেখতে পাচ্ছি: চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্মিলিত সংস্থা তথা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো। ভারতের সঙ্গে যে কানেকটিভিটির কাজ আমরা করছি, তা হলো প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে যেতে হলে বাংলাদেশকে আসিয়ানের সঙ্গে কানেকটিভিটি তৈরি করতে হবে, তৃতীয় স্তরে করতে হবে চীনের সঙ্গে। ভারতের হয়তো এ ব্যাপারে স্পর্শকাতরতা আছে। আমি মনে করি, ভারতের সঙ্গে যাদের প্রতিযোগিতা আছে তাদের হয়ে নয়, বরং সবার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার সুযোগটা বাংলাদেশের জন্য রাখতে হবে এবং বাংলাদেশেরও যথাযথভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিটা তুলে ধরতে হবে।
প্রথম আলো : জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ভারতের সঙ্গে আমাদের কোথায় কোথায় সহযোগিতা হতে পারে, সে বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা আমাদের কি আছে?
হুমায়ুন কবির : ভারতের সঙ্গেই আমাদের থাকতে হবে যেহেতু, সেহেতু তাকে তো বুঝতে হবে। ভারতে গত ৩০ বছরে যেভাবে পরিবর্তন হয়েছে, তার যথাযথ মূল্যায়ন ও উপলব্ধি থাকতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে ভারতকে বোঝায় আমাদের ঘাটতি আছে।
প্রথম আলো :ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ভারতের নেতারা যখন আমাদের দেশে আসেন, তার সঙ্গে বা আগে-পিছে তাঁদের নায়ক-নায়িকা ও শিল্পী-সাহিত্যিকেরাও আসেন। একে কোন ধরনের কূটনীতি বলবেন?
হুমায়ুন কবির : ভারত তার রাষ্ট্রশক্তি তথা হার্ড পাওয়ারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক শক্তি তথা সফট পাওয়ারকেও আমাদের সামনে প্রদর্শন করছে। তাদের টেলিভিশন, সিনেমা এবং সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়েই তারা বাংলাদেশে উপস্থাপিত হয়। এবং ভারত এটা করে দলীয় চিন্তার বাইরে। বিপরীতে আমরা আমাদের যে সাংস্কৃতিক শক্তি ও রসদ আছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চমৎকার সব আইডিয়া আছে—যা আমাদের যথেষ্টভাবেই আছে—সেগুলোকেও দলনিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করা চাই। আমরা দলীয়করণ ও রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক শক্তিকে দুর্বল করে রাখছি। ভারত কিন্তু সেটা করে না। ভারতের এই সার্থকতা থেকে আমাদেরও শিখতে হবে যে, কীভাবে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক সক্ষমতাকে কাজে লাগাব।
প্রথম আলো : সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপে ভারত ও চীনের রেষারেষিতে অস্থিতিশীলতা আসছে। বাংলাদেশেও কি অনুরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে?
হুমায়ুন কবির : ভারতকে এটা চিন্তায় আনতে হবে, ভারত-চীনের লড়াই প্রতিবেশী দেশগুলোর স্থিতিশীলতার প্রতি কোনো হুমকি যেন না হয়। অন্যদিকে ভারত-চীনের লড়াইয়ের পাশাপাশি সহযোগিতাও তো আছে। এই সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রবেশ করে আমরা সবার জন্যই অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারি এবং প্রতিবেশীরাও তাতে উপকৃত হতে পারে। এই ইতিবাচক ধারণাকাঠামোকে আমাদের প্রাধান্যের মধ্যেও নিয়ে আসতে হবে। যাতে ভয় থেকে বেরিয়ে এসে সহযোগিতার মাত্রা বাড়াতে পারি। অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশ হিসেবে আমাদের এ বক্তব্য সামনে আনা উচিত। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, স্থিতিশীল বাংলাদেশ, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে চলা বাংলাদেশ শুধু ভারতের জন্যই নয়, উপমহাদেশের জন্যও বিরাট অবদান রাখতে পারে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
হুমায়ুন কবির ধন্যবাদ।
No comments