নো ইভ টিজিং ও সাম্প্রতিক কথাবার্তা by ফরিদা আখতার
আমি বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি, ইভ টিজিং নিয়ে লিখব। প্রতিদিনের ঘটনা যা চারদিকে ঘটছে, তা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু লিখতে গিয়ে এগোতে পারছি না। ভেবে কূল পাচ্ছি না, কেন ছেলেরা মেয়েদের এমন করে উত্ত্যক্ত করছে, আর মেয়েরাই বা কেন নিজের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। নারী নির্যাতন এমনকি উত্ত্যক্ত করার বিষয়টি নতুন কিছু না হওয়া সত্ত্বেও কেন এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি? ব্যর্থতার গ্লানিতে ভুগছি।
বিষয়টি নিয়ে কেন লিখতে বসেছি, তার একটি কারণ আছে। সেদিন গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম, যানজট লেগে আছে। দেখি, সামনের যাত্রীবাহী বাসের পেছনে লেখা রয়েছে, ‘No ইভ টিজিং’। প্রথমে কিছু মনে হয়নি, স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। কিন্তু যানজটের সময় বেশি হওয়ার কারণে আমার চোখ বারবার সে লেখার ওপর আছড়ে পড়তে লাগল। খেয়াল করলাম, কথা পুরোটাই ইংরেজি হলেও লেখা হয়েছে অর্ধেক ইংরেজি অক্ষরে ‘No’ আর অর্ধেক বাংলা অক্ষরে ‘ইভ টিজিং’। এবার আমার ভ্রু কুঁচকাল। এ কাজটি খুবই সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। বলা যায়, বাসের মালিক সচেতন মানুষ। তিনি বা তাঁর সহকর্মীরা ইভ টিজিং রুখতে চান, তাই এটা লিখেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু কেন দুই রকম ভাষার অক্ষর ব্যবহার করা হলো, এ কৌতূহল আমার হচ্ছে। তাই একটু ব্যাখ্যার চেষ্টা করছি। আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার এবং বিশেষ করে ইংরেজি জানার হার কত কম, তা জানা সত্ত্বেও এভাবে সচেতন করার চেষ্টার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
এ বছরের শুরু থেকেই দেখছি, স্কুলগামী মেয়েদের এলাকার ছেলেরা উত্ত্যক্ত করছে এবং এতে বেশ কিছু মেয়ে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। খবর হিসেবে গুরুত্ব পাওয়া শুরু করল তখন থেকেই। ভালো কথা। কিন্তু কে বা কারা এ ঘটনাকে ইভ টিজিং নামকরণ করল, তা আমি খুঁজে দেখতে চাই। আমি ইংরেজি স্কুলে পড়ে এমন একটি ছেলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ইভ টিজিং কী? সে একটু হেসে বলল, মনে হয় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা। কিন্তু ইভ কী? সোজা উত্তর, সে জানে না। আবার বললাম, উত্ত্যক্ত করার অর্থ কী? তখন তার কাছে এই বাংলা অনেক কঠিন মনে হলো, জানি না। কিন্তু টিজ মানে বোঝো অবশ্যই। বলল, বিরক্ত করা আর কি। অর্থাৎ ইভ বোঝে না, কিন্তু টিজ বোঝে। আত্মহত্যার ঘটনার ছবি দেখে বোঝে এই ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে মেয়েরা।
আমি শুরু থেকেই জানার চেষ্টা করেছি, ইভ টিজিং কথাটি কোত্থেকে এল। আমি জানি, ইভ টিজিং নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সব লেখা আমি পড়িনি। কাজেই কেউ যদি এর মধ্যে এ বিষয়ে আলোকপাত করে থাকেন, পুনরাবৃত্তির জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। অর্থ খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই অবাক হয়েছি, এ শব্দ ব্যবহার ইউরোপ-আমেরিকার মতো খ্রিষ্টধর্মপ্রধান ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহারকারী কোনো দেশে নয়, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশেই ব্যবহূত হচ্ছে। উইকিপিডিয়ায় বলা হচ্ছে ইন্ডিয়ান ইংলিশ। মেয়েদের প্রতি পথে-ঘাটে যৌন হয়রানিমূলক উক্তিকেই ইভ টিজিং বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এ কথার সঙ্গে শুধু উক্তির সম্পর্ক, কোনো শারীরিক আক্রমণ ধরা হচ্ছে না। মেয়েদের স্কুল বা কলেজের সামনে অল্প বয়সী ছেলেদের অপরাধের মধ্যে ইভ টিজিং যুক্ত হয়েছে। তারা ইভদের টিজ করে, কিন্তু তারা অ্যাডাম নয়, তারা রোমিওর মতো আচরণ করে। ভারতের নারীবাদীরা এ ধরনের ঘটনাকে ইভ টিজিং না বলার কথাও অনেকবার বলেছেন। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে, ১৯৬০ সাল থেকেই মেয়েদের ওপর এ ধরনের উত্ত্যক্তকরণ চলছে, বিশেষ করে যখন থেকে মেয়েদের লেখাপড়া বেড়ে গেছে, একা চলাফেরা করছে, চাকরি করছে, তখন থেকেই এই বিরক্তি তারা সহ্য করে আসছে। বাংলাদেশে পোশাক কারখানার মেয়েরা বলে, ‘আহা, আমরা তো এই বিরক্তি সহ্য করতে করতে নিজেরাই নিজেদের রক্ষার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের বেলায় বলা হয় মাস্তান, স্কুলের মেয়েদের বেলায় বখাটে—এরা কী সব এক নয়? আমাদের বেলায় কারও উদ্বেগ দেখি না কেন?’
সাম্প্রতিককালে, ২০০৭ সালে ইভ টিজিং কথাটি পরিচিতি পেয়েছে দিল্লির একজন কলেজপড়ুয়া মেয়ে পার্ল গুপ্তার মৃত্যুর কারণে। এর আগে ১৯৯৮ সালে চেন্নাইয়ে শারিকা শাহ আত্মহত্যা করেছিল। পরপর প্রায় আধা ডজন মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ঢাকা শহরে পিংকীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি। মুরাদ নামে এলাকার স্থানীয় বখাটে ছেলের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে পিংকী আত্মহত্যা করেছিল। তারপর আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, পত্রিকায় বখাটের অত্যাচার কিংবা উৎপাতের কথা ছিল, কিন্তু ইভ টিজিং হিসেবে বলা হয়নি। এরপর একে একে অনেক মেয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছে। হত্যা করা হয়েছে মেয়ের মা-বাবাকেও। প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন স্কুলশিক্ষক ও একটি মেয়ের মা। কখন একফাঁকে ইভ টিজিং শিরোনাম হতে শুরু করল, তা খতিয়ে না দেখে সবাই ইভ টিজিং বলতে শুরু করল। এমনকি আইন পর্যন্ত হয়ে গেল। ভ্রাম্যমাণ আদালত এখন ‘বখাটেদের’ দণ্ড দিতেও শুরু করেছেন। এটা সমাধান কি না, জানি না। ইংরেজির প্রাধান্য শুধু ঘটনা ব্যাখ্যায় নয়, এর প্রতিকারের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। যেমন—মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইভ টিজিংয়ের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে যে ভাষা জর্জ বুশ ব্যবহার করেছিলেন, তেমন ভাষা শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। সাধারণ মানুষ জিরো টলারেন্স (বাংলায় কী বলা হচ্ছে, জানি না) বোঝে কি না, জানি না। এটা শুধু শব্দের অর্থ বোঝা নয়, এর সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক রাজনীতিও বুঝতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের সব ছেলেই কি বখাটে? তাহলে জিরো টলারেন্স নীতিতে আসলে কাদের ধরা হবে?
যা হোক, এখন ভ্রাম্যমাণ আদালত অনেক বখাটেকে শাস্তি দিচ্ছেন, কিন্তু সবাই দোষী কি না, তার প্রমাণ কে করছে? সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সেলিনা বাহার জামানের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, নারী নির্যাতন রোধ আইনের সুযোগে দেশে একদিকে বহু মিথ্যা মামলা হচ্ছে, অন্যদিকে সত্য মামলা সঠিক তদন্তের অভাবে এবং আইনের মারপ্যাঁচে টিকছে না। এ অবস্থায় শুধু নারী নন, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই এক নির্যাতনমূলক নৈরাজ্যের দুর্ভাবনায় দিশেহারা (প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর, ২০১০)। দীর্ঘদিন নারী আন্দোলনের ফসল নারী নির্যাতন নিরোধের আইন যদি অপব্যবহূত হয়, তাহলে ইভ টিজিং-বিরোধী আইন নিরপরাধ অল্প বয়সী ছেলেদের জন্য এক ভীতিকর পরিস্থিতির যেন সৃষ্টি না করে, তা-ই আশা করছি। আবার যে মেয়েরা এখন নানা ধরনের আক্রমণের শিকার হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা দিতে যেন সরকার ও সমাজ ব্যর্থ না হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও আইনের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি মিথ্যা মামলার জন্য কঠোর শাস্তির কথা বলে দিয়েছেন।
শেষে বলব, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও ইভ টিজিং প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে খুব বাজেভাবে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী হওয়ার কারণে উভয় পক্ষের রাজনৈতিক নেতারা যেসব উক্তি করেন, তা ইভ টিজিংকেও হার মানায়। বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাড়ি ছাড়ার পর সরকারদলীয় একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা পরিষ্কার বলে দিলেন, উনি কেঁদেছেন, কিন্তু তাঁর লিপস্টিক ঠিক ছিল ইত্যাদি। শুনে আমি লজ্জা পেয়েছি। এই পরিস্থিতি বদলাতে হবে, অবশ্যই।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
বিষয়টি নিয়ে কেন লিখতে বসেছি, তার একটি কারণ আছে। সেদিন গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম, যানজট লেগে আছে। দেখি, সামনের যাত্রীবাহী বাসের পেছনে লেখা রয়েছে, ‘No ইভ টিজিং’। প্রথমে কিছু মনে হয়নি, স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। কিন্তু যানজটের সময় বেশি হওয়ার কারণে আমার চোখ বারবার সে লেখার ওপর আছড়ে পড়তে লাগল। খেয়াল করলাম, কথা পুরোটাই ইংরেজি হলেও লেখা হয়েছে অর্ধেক ইংরেজি অক্ষরে ‘No’ আর অর্ধেক বাংলা অক্ষরে ‘ইভ টিজিং’। এবার আমার ভ্রু কুঁচকাল। এ কাজটি খুবই সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। বলা যায়, বাসের মালিক সচেতন মানুষ। তিনি বা তাঁর সহকর্মীরা ইভ টিজিং রুখতে চান, তাই এটা লিখেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু কেন দুই রকম ভাষার অক্ষর ব্যবহার করা হলো, এ কৌতূহল আমার হচ্ছে। তাই একটু ব্যাখ্যার চেষ্টা করছি। আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার এবং বিশেষ করে ইংরেজি জানার হার কত কম, তা জানা সত্ত্বেও এভাবে সচেতন করার চেষ্টার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
এ বছরের শুরু থেকেই দেখছি, স্কুলগামী মেয়েদের এলাকার ছেলেরা উত্ত্যক্ত করছে এবং এতে বেশ কিছু মেয়ে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। খবর হিসেবে গুরুত্ব পাওয়া শুরু করল তখন থেকেই। ভালো কথা। কিন্তু কে বা কারা এ ঘটনাকে ইভ টিজিং নামকরণ করল, তা আমি খুঁজে দেখতে চাই। আমি ইংরেজি স্কুলে পড়ে এমন একটি ছেলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ইভ টিজিং কী? সে একটু হেসে বলল, মনে হয় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা। কিন্তু ইভ কী? সোজা উত্তর, সে জানে না। আবার বললাম, উত্ত্যক্ত করার অর্থ কী? তখন তার কাছে এই বাংলা অনেক কঠিন মনে হলো, জানি না। কিন্তু টিজ মানে বোঝো অবশ্যই। বলল, বিরক্ত করা আর কি। অর্থাৎ ইভ বোঝে না, কিন্তু টিজ বোঝে। আত্মহত্যার ঘটনার ছবি দেখে বোঝে এই ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে মেয়েরা।
আমি শুরু থেকেই জানার চেষ্টা করেছি, ইভ টিজিং কথাটি কোত্থেকে এল। আমি জানি, ইভ টিজিং নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সব লেখা আমি পড়িনি। কাজেই কেউ যদি এর মধ্যে এ বিষয়ে আলোকপাত করে থাকেন, পুনরাবৃত্তির জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। অর্থ খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই অবাক হয়েছি, এ শব্দ ব্যবহার ইউরোপ-আমেরিকার মতো খ্রিষ্টধর্মপ্রধান ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহারকারী কোনো দেশে নয়, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশেই ব্যবহূত হচ্ছে। উইকিপিডিয়ায় বলা হচ্ছে ইন্ডিয়ান ইংলিশ। মেয়েদের প্রতি পথে-ঘাটে যৌন হয়রানিমূলক উক্তিকেই ইভ টিজিং বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এ কথার সঙ্গে শুধু উক্তির সম্পর্ক, কোনো শারীরিক আক্রমণ ধরা হচ্ছে না। মেয়েদের স্কুল বা কলেজের সামনে অল্প বয়সী ছেলেদের অপরাধের মধ্যে ইভ টিজিং যুক্ত হয়েছে। তারা ইভদের টিজ করে, কিন্তু তারা অ্যাডাম নয়, তারা রোমিওর মতো আচরণ করে। ভারতের নারীবাদীরা এ ধরনের ঘটনাকে ইভ টিজিং না বলার কথাও অনেকবার বলেছেন। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে, ১৯৬০ সাল থেকেই মেয়েদের ওপর এ ধরনের উত্ত্যক্তকরণ চলছে, বিশেষ করে যখন থেকে মেয়েদের লেখাপড়া বেড়ে গেছে, একা চলাফেরা করছে, চাকরি করছে, তখন থেকেই এই বিরক্তি তারা সহ্য করে আসছে। বাংলাদেশে পোশাক কারখানার মেয়েরা বলে, ‘আহা, আমরা তো এই বিরক্তি সহ্য করতে করতে নিজেরাই নিজেদের রক্ষার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের বেলায় বলা হয় মাস্তান, স্কুলের মেয়েদের বেলায় বখাটে—এরা কী সব এক নয়? আমাদের বেলায় কারও উদ্বেগ দেখি না কেন?’
সাম্প্রতিককালে, ২০০৭ সালে ইভ টিজিং কথাটি পরিচিতি পেয়েছে দিল্লির একজন কলেজপড়ুয়া মেয়ে পার্ল গুপ্তার মৃত্যুর কারণে। এর আগে ১৯৯৮ সালে চেন্নাইয়ে শারিকা শাহ আত্মহত্যা করেছিল। পরপর প্রায় আধা ডজন মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ঢাকা শহরে পিংকীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি। মুরাদ নামে এলাকার স্থানীয় বখাটে ছেলের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে পিংকী আত্মহত্যা করেছিল। তারপর আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, পত্রিকায় বখাটের অত্যাচার কিংবা উৎপাতের কথা ছিল, কিন্তু ইভ টিজিং হিসেবে বলা হয়নি। এরপর একে একে অনেক মেয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছে। হত্যা করা হয়েছে মেয়ের মা-বাবাকেও। প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন স্কুলশিক্ষক ও একটি মেয়ের মা। কখন একফাঁকে ইভ টিজিং শিরোনাম হতে শুরু করল, তা খতিয়ে না দেখে সবাই ইভ টিজিং বলতে শুরু করল। এমনকি আইন পর্যন্ত হয়ে গেল। ভ্রাম্যমাণ আদালত এখন ‘বখাটেদের’ দণ্ড দিতেও শুরু করেছেন। এটা সমাধান কি না, জানি না। ইংরেজির প্রাধান্য শুধু ঘটনা ব্যাখ্যায় নয়, এর প্রতিকারের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। যেমন—মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শিরীন শারমিন চৌধুরী বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইভ টিজিংয়ের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে যে ভাষা জর্জ বুশ ব্যবহার করেছিলেন, তেমন ভাষা শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। সাধারণ মানুষ জিরো টলারেন্স (বাংলায় কী বলা হচ্ছে, জানি না) বোঝে কি না, জানি না। এটা শুধু শব্দের অর্থ বোঝা নয়, এর সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক রাজনীতিও বুঝতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের সব ছেলেই কি বখাটে? তাহলে জিরো টলারেন্স নীতিতে আসলে কাদের ধরা হবে?
যা হোক, এখন ভ্রাম্যমাণ আদালত অনেক বখাটেকে শাস্তি দিচ্ছেন, কিন্তু সবাই দোষী কি না, তার প্রমাণ কে করছে? সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সেলিনা বাহার জামানের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, নারী নির্যাতন রোধ আইনের সুযোগে দেশে একদিকে বহু মিথ্যা মামলা হচ্ছে, অন্যদিকে সত্য মামলা সঠিক তদন্তের অভাবে এবং আইনের মারপ্যাঁচে টিকছে না। এ অবস্থায় শুধু নারী নন, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই এক নির্যাতনমূলক নৈরাজ্যের দুর্ভাবনায় দিশেহারা (প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর, ২০১০)। দীর্ঘদিন নারী আন্দোলনের ফসল নারী নির্যাতন নিরোধের আইন যদি অপব্যবহূত হয়, তাহলে ইভ টিজিং-বিরোধী আইন নিরপরাধ অল্প বয়সী ছেলেদের জন্য এক ভীতিকর পরিস্থিতির যেন সৃষ্টি না করে, তা-ই আশা করছি। আবার যে মেয়েরা এখন নানা ধরনের আক্রমণের শিকার হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা দিতে যেন সরকার ও সমাজ ব্যর্থ না হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও আইনের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি মিথ্যা মামলার জন্য কঠোর শাস্তির কথা বলে দিয়েছেন।
শেষে বলব, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও ইভ টিজিং প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে খুব বাজেভাবে। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী হওয়ার কারণে উভয় পক্ষের রাজনৈতিক নেতারা যেসব উক্তি করেন, তা ইভ টিজিংকেও হার মানায়। বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাড়ি ছাড়ার পর সরকারদলীয় একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা পরিষ্কার বলে দিলেন, উনি কেঁদেছেন, কিন্তু তাঁর লিপস্টিক ঠিক ছিল ইত্যাদি। শুনে আমি লজ্জা পেয়েছি। এই পরিস্থিতি বদলাতে হবে, অবশ্যই।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
No comments