লাতিন আমেরিকান ফুটবলের জয়জয়কার
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে গোলের খরায় দর্শকদের প্রাণবায়ু যখন ওষ্ঠে আগত প্রায়, তখন পৃথিবীর কোটি কোটি ফুটবলপাগল দর্শকের মনঃকষ্টের দিকটা বিবেচনায় নিয়ে এই গোলখরা থেকে বেরিয়ে আসার পথ সন্ধানে ফুটবলের নিয়মকানুনের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনার জন্য ফিফাকে পরামর্শ দিয়ে চলমান রচনার তৃতীয় কিস্তিটি তৈরি করেছিলাম। লেখাটি ১৮ জুন, শুক্রবার প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকালে আনিসুল হক ফোন করে আমাকে বিনয়ের সঙ্গে জানাল যে আমার লেখাটি আজ ছাপা সম্ভব হয়নি, আগামীকালের কাগজে যাবে। আমি যেন রাগ না করি। সাধারণত এ রকম ক্ষেত্রে আমি রাগ করে থাকি। না করলেও, করা উচিত বলে মনে করি। আনিস তা জানে। কিন্তু লেখাটি ছাপা হয়নি জেনে আজ আমার রাগ তো হলোই না, আমি বরং খুশি হলাম। স্বস্তি পেলাম মনে। ভাবলাম, যাক ভালোই হলো। মানীর মান আল্লাহ বাঁচান। ১৭ জুন তিন খেলায় ১০টি গোল হয়েছে। আর্জেন্টিনা ৪-১ গোলে দক্ষিণ কোরিয়াকে, মেক্সিকো ২-০ গোলে ফ্রান্সকে এবং গ্রিস ২-১ গোলে নাইজেরিয়াকে পরাজিত করেছে। সেই গোলের বন্যা যাঁরা চাক্ষুস করেছেন, গোলের খরা কাটানোর জন্য ফুটবলের নিয়মকানুন পরিবর্তনের প্রস্তাবটি তাঁদের কাছে কিছুটা হাস্যকর বলেই মনে হতো। গতকাল যদি সব মিলিয়ে তিনটি কি চারটি গোল হতো, তাহলে আমার প্রস্তাবটি পাঠক হয়তো পছন্দ করতেও পারতেন। ওই রচনায় আমার উদ্বেগের পক্ষে আমি একটি পরিসংখ্যান দিয়েছিলাম। ২০০৬ বিশ্বকাপে গোল হয়েছিল মোট ১৪৭টি। খেলাপ্রতি ২ দশমিক ৩ গোল। আমি যখন নিয়ম বদলের প্রস্তাব করেছিলাম, তখন এবারের বিশ্বকাপে হয়ে যাওয়া ১৬ খেলায়, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া জার্মানির চার গোলসহ মোট গোল হয়েছিল মাত্র ২২টি। অর্থাৎ খেলাপ্রতি ১ দশমিক ৩৭ গোল। এ অবস্থায় পাঠক আপনিই বলুন, মাথা ঠিক রাখা কি সম্ভব? কাজ ফেলে, রাত জেগে খেলা দেখা কিসের জন্য? যে তিন বছরে একটি ফুটবল ম্যাচ দেখে না, সে কিনা দিনে তিন ম্যাচ দেখছে! গোল ছাড়া আমাদের আর পাওয়ার কী আছে বলুন? আমরা তো আর কাপ পাব না, আমরা পাব গোল। আমরা গোলের বন্যায় ভেসে যেতে চাই। ওটাই আমাদের লাভ। এই যে আমি জার্মানিকে এবারের বিশ্বকাপটি অলরেডি দিয়ে বসে আছি, সে তো ওই গোলের জন্যই। এখন পর্যন্ত চার গোলের ব্যবধানে জেতা দল তো জার্মানিই। নাক উঁচু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সে আমাকে চার-চারবার পরম আনন্দ দিয়েছে। তাই সেই আনন্দের বিনিময়ে আমি তাকে বিশ্বকাপটি দিয়ে দিয়েছি। নইলে জার্মানি আমার কে? অস্ট্রেলিয়াকে দেওয়া চার গোলের সুবাদে জার্মানিকে বিশ্বকাপ দিয়ে দেওয়ার অধিকার আমার আছে কি না—এ প্রশ্ন যদি কেউ তোলেন, তবে বলব, আছে। প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্য পারস্যের কবি যদি সমরখন্দ দিয়ে দিতে পারেন, তো আমিও পারি। আমি পরিষ্কার ভাষায় বলে দিতে চাই, ৪-০ গোলের ব্যবধানে যে পর্যন্ত না অন্য কোনো দল প্রতিপক্ষকে পরাভূত করছে, তখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ জার্মানির কাছেই থাকবে।
১৭ জুনের খেলা দেখার পর, আমার নিজেরও মনে হচ্ছে—না, ঠিকই আছে। ক্রিকেটের রানের খরা কাটানোর জন্য ক্রিকেটে যেমন রানবান্ধব নিয়ম তৈরি হয়েছে—সেই আদলে ফুটবলের নিয়মকানুন পরিবর্তন করার কোনো দরকার নেই। প্রথম সাত খেলায় নয় গোল দিয়ে যে বিশ্বকাপের শুরু—সেই বিশ্বকাপেই এক দিনের তিন খেলায় ১০-১০টি গোল হবে, ভাবিনি। সেই অভাবিত ঘটনাটি যখন ঘটেছেই, তখন তাকে যথেষ্ট বলেই ভাবছি। অফসাইডের নিয়ম শিথিল করে গোলের সংখ্যা বাড়ানোর আর দরকার পড়বে না। অফসাইড-নিয়ম শিথিল করে গোলের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাবটি (যদিও সেটি ছাপা হয়নি, তবু আনিসুল হক তো জানে) আমি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। আমরা জানি, অনাবৃষ্টির মতো অতিবৃষ্টিও আপদবিশেষ। অনেক গোল যাঁরা দেখতে চান, তাঁদের জন্য তো রাগবি, বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল ইত্যাদি খেলা রয়েছেই। চার-পাঁচ গোলের বেশি হলে ফুটবল আর ফুটবল থাকবে না। ফুটবলের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসানোর লোভে প্রচলিত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিশ্বকাপ চালু হওয়ার পর যেমন ক্রিকেট আর ক্রিকেট থাকছে না। সে এক উত্তেজক বাণিজ্যের মাধ্যম হয়ে উঠছে। ফুটবলেরও তা-ই হবে। এমনিতেই বিশ্বজুড়ে ফুটবল-বাণিজ্যের যে রমরমা ভাব, তার মধ্যে গোলের মসলা আরও বেশি করে যুক্ত না করাটাই শ্রেয় হবে।
গত দুই দিন ছিল লাতিন আমেরিকার দিন। ঈশ্বর নিজের হাতে তৈরি করে দিন দুটি লাতিন আমেরিকাকে উপহার দিয়েছেন বলেই মনে হয়। ১৬ জুন দীর্ঘ ৪৮ বছর অপেক্ষার পর পাবলো নেরুদার দেশ চিলি (১-০) জিতল হন্ডুরাসের বিরুদ্ধে; উরুগুয়ে (২-০) গোলে জিতল দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে। আর ১৭ জুন লাতিন আমেরিকার অন্য দুই ফুটবল পরাশক্তি আর্জেন্টিনা ৪-১ গোলে দক্ষিণ কোরিয়াকে এবং মেক্সিকো ২-০ গোলে হারাল বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সকে। ১৫ জুন রাতের খেলায় ব্রাজিল হারিয়েছিল উত্তর কোরিয়াকে। তার মানে হচ্ছে, ১৫ জুনের মধ্যরাত থেকে শুরু করে ১৭ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত প্রসারিত সময়টা লাতিন আমেরিকান ফুটবলের জন্য ছিল তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে সুবর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে তারা তাদের প্রতিটি ম্যাচে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছে। এর ভেতর দিয়ে যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো এই যে, লাতিন আমেরিকান ফুটবলাররাই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটি-হাওয়ার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে বলে মনে হয়। তা ছাড়া আরও একটি গূঢ় কারণ আছে বলে আমি ধারণা করি। আফ্রিকার মাটিতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর কোনো লিগেসি নেই, যা আফ্রিকার মুক্ত পায়ে লোহার শিকল পরানো ইউরোপের অনেক দেশেরই রয়েছে। তুলনামূলকভাবে জার্মানির তা কম বলেই চলতি বিশ্বকাপে জার্মানি এ পর্যন্ত ভালো করেছে, পরেও হয়তো করবে। আফ্রিকার মাটি ও মানুষের সমর্থন লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর প্রতিই বেশি থাকবে। শত্রুর শত্রু মানে বন্ধু—এই তত্ত্বে ভর করে আফ্রিকার মাটি ও মানুষের সমর্থন নিয়ে হয়তো এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বেও উঠে যাবে জার্মানি। তবে লাতিন আমেরিকান ফুটবলকে (আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল) চূড়ান্ত যুদ্ধে হারানোর মতো শক্তি, শৈলী, জল-মাটি-হাওয়া ও মানুষের সমর্থন সে পাবে কি না, তা দেখার জন্যই আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।
(জার্মানি-সার্বিয়া ম্যাচ দেখার আগে এ কলামটি লেখা)
কামরাঙ্গীরচর
১৮ জুন, ২০১০
১৭ জুনের খেলা দেখার পর, আমার নিজেরও মনে হচ্ছে—না, ঠিকই আছে। ক্রিকেটের রানের খরা কাটানোর জন্য ক্রিকেটে যেমন রানবান্ধব নিয়ম তৈরি হয়েছে—সেই আদলে ফুটবলের নিয়মকানুন পরিবর্তন করার কোনো দরকার নেই। প্রথম সাত খেলায় নয় গোল দিয়ে যে বিশ্বকাপের শুরু—সেই বিশ্বকাপেই এক দিনের তিন খেলায় ১০-১০টি গোল হবে, ভাবিনি। সেই অভাবিত ঘটনাটি যখন ঘটেছেই, তখন তাকে যথেষ্ট বলেই ভাবছি। অফসাইডের নিয়ম শিথিল করে গোলের সংখ্যা বাড়ানোর আর দরকার পড়বে না। অফসাইড-নিয়ম শিথিল করে গোলের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাবটি (যদিও সেটি ছাপা হয়নি, তবু আনিসুল হক তো জানে) আমি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। আমরা জানি, অনাবৃষ্টির মতো অতিবৃষ্টিও আপদবিশেষ। অনেক গোল যাঁরা দেখতে চান, তাঁদের জন্য তো রাগবি, বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল ইত্যাদি খেলা রয়েছেই। চার-পাঁচ গোলের বেশি হলে ফুটবল আর ফুটবল থাকবে না। ফুটবলের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসানোর লোভে প্রচলিত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিশ্বকাপ চালু হওয়ার পর যেমন ক্রিকেট আর ক্রিকেট থাকছে না। সে এক উত্তেজক বাণিজ্যের মাধ্যম হয়ে উঠছে। ফুটবলেরও তা-ই হবে। এমনিতেই বিশ্বজুড়ে ফুটবল-বাণিজ্যের যে রমরমা ভাব, তার মধ্যে গোলের মসলা আরও বেশি করে যুক্ত না করাটাই শ্রেয় হবে।
গত দুই দিন ছিল লাতিন আমেরিকার দিন। ঈশ্বর নিজের হাতে তৈরি করে দিন দুটি লাতিন আমেরিকাকে উপহার দিয়েছেন বলেই মনে হয়। ১৬ জুন দীর্ঘ ৪৮ বছর অপেক্ষার পর পাবলো নেরুদার দেশ চিলি (১-০) জিতল হন্ডুরাসের বিরুদ্ধে; উরুগুয়ে (২-০) গোলে জিতল দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে। আর ১৭ জুন লাতিন আমেরিকার অন্য দুই ফুটবল পরাশক্তি আর্জেন্টিনা ৪-১ গোলে দক্ষিণ কোরিয়াকে এবং মেক্সিকো ২-০ গোলে হারাল বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সকে। ১৫ জুন রাতের খেলায় ব্রাজিল হারিয়েছিল উত্তর কোরিয়াকে। তার মানে হচ্ছে, ১৫ জুনের মধ্যরাত থেকে শুরু করে ১৭ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত প্রসারিত সময়টা লাতিন আমেরিকান ফুটবলের জন্য ছিল তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে সুবর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে তারা তাদের প্রতিটি ম্যাচে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছে। এর ভেতর দিয়ে যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো এই যে, লাতিন আমেরিকান ফুটবলাররাই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটি-হাওয়ার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে বলে মনে হয়। তা ছাড়া আরও একটি গূঢ় কারণ আছে বলে আমি ধারণা করি। আফ্রিকার মাটিতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর কোনো লিগেসি নেই, যা আফ্রিকার মুক্ত পায়ে লোহার শিকল পরানো ইউরোপের অনেক দেশেরই রয়েছে। তুলনামূলকভাবে জার্মানির তা কম বলেই চলতি বিশ্বকাপে জার্মানি এ পর্যন্ত ভালো করেছে, পরেও হয়তো করবে। আফ্রিকার মাটি ও মানুষের সমর্থন লাতিন আমেরিকান দেশগুলোর প্রতিই বেশি থাকবে। শত্রুর শত্রু মানে বন্ধু—এই তত্ত্বে ভর করে আফ্রিকার মাটি ও মানুষের সমর্থন নিয়ে হয়তো এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বেও উঠে যাবে জার্মানি। তবে লাতিন আমেরিকান ফুটবলকে (আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল) চূড়ান্ত যুদ্ধে হারানোর মতো শক্তি, শৈলী, জল-মাটি-হাওয়া ও মানুষের সমর্থন সে পাবে কি না, তা দেখার জন্যই আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।
(জার্মানি-সার্বিয়া ম্যাচ দেখার আগে এ কলামটি লেখা)
কামরাঙ্গীরচর
১৮ জুন, ২০১০
No comments