পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হল: দায়িত্বে প্রভোস্ট তদারকিতে ছাত্রলীগ by মুনির হোসেন
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রভোস্টসহ একাধিক শিক্ষক দায়িত্বে থাকলেও স্ব স্ব হলের বিভিন্ন নথিপত্রে সই করা ছাড়া
কার্যত তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। সিট দেয়া থেকে শুরু করে কাউকে হলে ওঠানো কিংবা নামানোর সব কাজই করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। গত এক দশক ধরে এ ভূমিকায় রয়েছে শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। সংগঠনটির নেতাকর্মীরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো হল চালাচ্ছেন। এর আগে একই ভূমিকায় দেখা গেছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলকেও। ১৯৯০-এর পর গণতান্ত্রিক সরকার আমল থেকে এ ধারা শুরু হয়। হলগুলোতে কমতে থাকে প্রভোস্টসহ অন্যান্য শিক্ষকদের প্রভাব। পদ টিকিয়ে রাখতে শিক্ষকরাও ছাত্র সংগঠনগুলোর অনৈতিক সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিয়ে যাচ্ছেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে তাদের পাওয়া যায় না। অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মেলেনি। হলে ছাত্রলীগ ও প্রশাসন মিলেমিশে একাকার। বিভিন্ন দিবসে হল প্রশাসনের উদ্যোগে খাবার দেয়ার জন্য টোকেন বিতরণের সময় আবাসিক শিক্ষকদের দেখা মেলে।
এ ছাড়া আবাসিক হলে শিক্ষার্থীরা কেমন আছেন, কোনো সমস্যা আছে কিনা, পড়ালেখা চলছে কিনা- কোনো ধরনের খোঁজ নেন না দায়িত্বে থাকা আবাসিক শিক্ষকরা। গত এক দশকে দেখা গেছে, মতের অমিল হলেই বিভিন্ন সময় আবাসিক শিক্ষার্থীদের মেরে হল ছাড়া করেছে ছাত্রলীগ। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় পুলিশেও সোপর্দ করেছে সংগঠনটি। ব্যক্তিগত আক্রোশের জের ধরেও অনেককে মিথ্যা ব্লেম পেয়ে হলছাড়া হতে হয়েছিল। হলে হলে গড়ে তোলা হয়েছিল টর্চার সেল। যেখানে শ’ শ’ শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু কখনো হল প্রশাসন এসব ঘটনার তদন্ত করেনি। নেয়নি কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটে) শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলের দায়িত্বে থাকা প্রভোস্টদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একটি ছেলেকে হলের অভ্যন্তরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। অথচ কিছুই জানতেন না প্রভোস্ট। এমনকি অন্য কোনো শিক্ষার্থী এ ব্যাপারে প্রভোস্ট কিংবা অন্যান্য আবাসিক শিক্ষকদের অবহিত করার প্রয়োজন মনে করেননি।
শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইতোপূর্বে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা অনেকবার ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কখনো এর কোনো বিচার হয়নি। অবহিত করার পরও প্রভোস্ট ছিলেন নির্বিকার। আবার যারা একটু প্রতিবাদ করতো তাদেরও পরবর্তী সময়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাই কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র এটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য হল রয়েছে মাত্র ১৯টি। এর মধ্যে পাঁচটি ছাত্রীদের জন্য, ১৩টি ছাত্রদের জন্য আর একটি হল বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। একমাত্র বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত স্যার পিজে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলই প্রশাসনের নির্দেশনা অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। অন্যসব হল রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত। ছেলেদের হলগুলোর সর্বময় ক্ষমতা ছাত্রলীগের হাতে। প্রশাসন এখানে কেবল নথিপত্রে সই করার জন্যই রয়েছে। অন্য কোনো ভূমিকায় তারা নেই। কোনো শিক্ষার্থীকে সিট দেয়া থেকে কাউকে সিট থেকে নামিয়ে দেয়া সব কিছুই করে ছাত্রলীগ। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছেলেদের বিজয় একাত্তর হল ও মেয়েদের পাঁচটি হল। বিজয় একাত্তর হলে রাজনৈতিক প্রভাব ছেলেদের অন্য হলগুলোর তুলনায় কিছুটা কম। এখানে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। ছাত্রলীগও সিট দেয় তবে সেটি অনেক কম। আর মেয়েদের পাঁচটি হলের বেশিরভাগ সিটই প্রশাসন বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তবে এ পাঁচটি হলে ছাত্রলীগ নেত্রীদের হাতেও বেশ কিছু কক্ষ রয়েছে। তারাও সিট দেয়া নেয়ার কাজ করে। মেয়েদের পাঁচটি হল হলো- বেগম রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, কবি সুফিয়া কামাল হল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল। ছেলেদের ১৩টি হলের মধ্যে তীব্র সিট সংকট রয়েছে- সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, কবি জসীমউদ্্দীন হল, অমর একুশে হল, স্যার এ এফ রহমান হলে।
সিট সংকট কিছুটা কম হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মাস্টার’দা সূর্যসেন হল, ড. মু. শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হলে। আর শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীরা মোটামুটি প্রথম বর্ষ থেকেই সিট পেয়ে থাকে। ছেলেদের হলগুলোতে ছাত্রলীগ নেতারা দিনের পর দিন সিট দখল করে থাকেন। স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পর তারা সিট ছাড়েন না। এমনকি বেশিরভাগ ছাত্রনেতা হলের সিঙ্গেল কক্ষগুলো ধরে রেখেছেন। দুইজন কিংবা চারজনের কক্ষও একজন দখল করে রেখেছেন। কিন্তু প্রশাসন এদের হল ছাড়া করার কোনো উদ্যোগ নেন না। কখনো কখনো মেয়াদোত্তীর্ণদের হল ছাড়া করার অভিযান শুরু করলেও সেটি কেবল সাধারণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। প্রভোস্টের নেতৃত্বে আবাসিক শিক্ষকরা কেবল সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল ছাড়া করতে চান। কিন্তু তারা কখনো বছরের পর বছর কক্ষ দখল করে থাকা ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষের দিকে যান না। ছেলেদের হলগুলোতে ছাত্রলীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় অনেক বহিরাগত অবস্থান করলেও তাদের ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগী হতে দেখা যায় না হল প্রশাসনকে।
বৈধ শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে গণরুমে থাকলেও বহিরাগতরা বিভিন্ন কক্ষে আরামে থাকছেন। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে গেস্টরুমের (যে কক্ষে ম্যানর শেখানোর নামে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়) নামে নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা সামনে এলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেননি হল প্রশাসন। কোনোভাবে বড় ভাই অসন্তুষ্ট হলেই নবীন শিক্ষার্থীদের চরম পরিণতি ভোগ করতে হয়। বিভিন্ন সময় অনেক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ ভিন্নমত লালনের কারণে হল ছাড়া করেছে। অমানবিক নির্যাতনের পর তাদের হল ছাড়া করা হয়। কিন্তু প্রশাসন সেসব বিষয়ের কোনো তদন্ত করেনি। দেখেও না দেখার ভান করেন দায়িত্বে থাকা আবাসিক শিক্ষকরা। উল্টো প্রশাসনের সহযোগিতায় ছাত্রলীগের ইচ্ছায় তাদের পুলিশে দেয়া হয়েছিল। অনেক সময় থানা থেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়া পেয়েছেন অনেকে। ছাত্রলীগের গ্রুপ উপ-গ্রুপেরও বলি হতে হয়েছিল অনেক নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ঘটনারই তদন্ত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। কিছু কিছু ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হলগুলোও অলিখিতভাবে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করে। গত রোববার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলে আবরার ফাহাদ নামে এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয় তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ঘটনায় তোলপাড় পুরো দেশ। বিক্ষোভে বিক্ষোভে উত্তাল ছিল দেশের শিক্ষাঙ্গন। শুক্রবার আবরার ফাহাদ হত্যার জেরে বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। দেশের প্রাচীন এ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলেই ছিল ছাত্রলীগের টর্চার সেল। বিষয়টি জেনেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গুলি বিনিময়কালে সাবিকুন্নাহার সনি নামে এক ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফের বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি শুরু করে ছাত্রলীগ। এরপর হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিরাজ করতে থাকে। নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে হলের প্রাধ্যক্ষরা। সিট দেয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
চবির হলেও হর্তাকর্তা ছাত্রলীগ: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রত্যেকটি হলের দায়িত্বে প্রভোস্টরা থাকলেও হলগুলোর দেখভাল করছে ছাত্রলীগ। সবগুলো হল দখল করে আছে শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে হলে বৈধ শিক্ষার্থীদের মারধর করে হল থেকে বের করে দেয়ার নজির রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা হলের সার্বিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বে প্রভোস্টদের থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ প্রভোস্ট ক্যাম্পাসে থেকে দায়িত্ব পালন করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষকরা বছরে একবার শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফরমে সই করে দায় সারেন। হলের কোন ব্লকে কে থাকবে তা তদারকি করে ছাত্রলীগ। জানা যায়, বরাদ্দপ্রাপ্ত বৈধ শিক্ষার্থীরা থাকতে না পারলেও ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন হলে বহিরাগতরা অবস্থান করে। এই বছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে সোহরাওয়ার্দী হলের গেস্ট রুম থেকে এক বহিরাগত নারীসহ ১৮ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে দেশীয় ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে মাদক সেবনরত অবস্থায় একাধিক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করার নজির রয়েছে। এ ছাড়াও সমপ্রতি সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫১ নম্বার কক্ষে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি নাজিমের নেতৃত্বে কয়েকজন বহিরাগতকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোনো টর্চার সেল নেই।
কোনো কর্মী কাউকে নির্যাতন করলে সেটার দায়ভার তার নিজের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করবো অভিযোগ পাওয়া গেলে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এবং এ বিষয়ে আমারও পুরোপুরি সহযোগিতা থাকবে। হলে বহিরাগতদের অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি জানি না যদি তা থাকে সেটা দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, হলগুলো দেখার দায়িত্ব প্রভোস্টদের হলেও তারা যেন হলের মেহমান। তাদেরকে হলে দেখাই যায় না। তারা শুধুমাত্র ছাত্রদের পরীক্ষার ফরমে স্বাক্ষরের দায়িত্বই পালন করেন। হল তদারকির বিষয়ে প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামান বলেন, ২৪ ঘণ্টা ক্যাম্পাসে থেকে হল পরিচালনার জন্য আবাসিক ও পরিবহন সুবিধা প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা এর কিছুই পাই না।
রাবির হলও চলে ছাত্রলীগের ইচ্ছায়: কর্তৃপক্ষকে তোয়াক্কা না করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র হলে সিট দখলে একচ্ছত্র আধিপত্য চালাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ও নিজের গ্রুপে ভিড়ানোর শর্তে দলীয় কর্মী কিংবা পছন্দের ছোট ভাইকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই হলে সিট করে দিচ্ছে তারা। এদের মধ্যে অনেকের আবার সংশ্লিষ্ট হলে সংযুক্তিও থাকে না। এ ছাড়াও বিভিন্ন হলে বহিরাগতদের অবস্থানের প্রমাণও মিলেছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের পরিচিতদের হলে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নেতাকর্মীদের এমন বেপরোয়ায় কোণঠাসা প্রশাসন। তাদের নীরব ভূমিকায় ভুগতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ হলেই অবৈধভাবে সিট দখল করে রেখেছে ছাত্রলীগ। হলগুলোতে পলিটিক্যাল নামে ব্লক দখল করে সেখানে অবৈধভাবে দলীয় কর্মীদের সিট দিচ্ছে নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা রুমে রুমে গিয়ে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের লিস্ট করে। তাদের পরীক্ষা কবে শেষ এবং কবে তারা হল ছাড়বে এ সময়গুলো লিখে নেয় তারা। এসব শিক্ষার্থী চলে গেলে ওই সিটগুলো দখলে নেয় ছাত্রলীগ।
নাম গোপন রাখার শর্তে রাবি ছাত্রলীগের সিনিয়র কয়েকজন নেতা বলেন, হলগুলোতে জুনিয়র নেতাকর্মীরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে কাউকে তোয়াক্কা করছে না তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, সিটের জন্য হলের নেতাদের কাছে জিম্মি তারা। অনেকেই আবার সিটের জন্য টাকাও দেয় এই নেতাদের। গত ১লা ফেব্রুয়ারি মতিহার হল থেকে এক অবৈধ শিক্ষার্থীকে বের করে দেন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আলী আসগর। পরে ওই শিক্ষার্থীকে আবার অবৈধভাবে সেই রুমেই তুলে দেয়া হয়। নাম প্রকাশ না করে এক হল প্রাধ্যক্ষ বলেন, গায়ের জোরে কিংবা দল ভারি করা যাই হোক না কেন নেতাকর্মীরা হলগুলোতে এসব করে যাচ্ছে। যারা অবৈধ তাদের হল থেকে বের করে দিতে গেলে বিভিন্নভাবে বাধা আসে। জানতে চাইলে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, আমরা দুয়েকদিনের মধ্যেই হলের দায়িত্বে থাকা নেতাকর্মীদের নিয়ে বসবো। হলগুলোতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি যেন বজায় থাকে আমরা সেই চেষ্টাই করবো। হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক রেজাউল করিম বকসী বলেন, আমি এ বিষয়ে শুনেছি। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যেই ভিসির সঙ্গে হল প্রাধ্যক্ষরা বসে এগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
‘ভাই’দের হাতে ইবির হল: কখনো দলীয় পরিচয় কখনোওবা ‘বড় ভাই’য়ের গ্রুপ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সিট পাওয়ার মাধ্যম এটা। মেধা তালিকায় হলে সিট পাওয়া যেন অমাবশ্যার চাঁদ। কালেভদ্রে গুটিকতেক শিক্ষার্থী মেধা তালিকায় সিট পায়। তবে ক্ষমতাসীন ‘বড় ভাই’দের তদবির ছাড়া উঠা যায় না নিজ রুমে। হল প্রশাসন নিজেদের মত চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে বরাবরই তারা জিম্মি। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবসময়ই বঞ্চিত হয়ে আসছে। প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ইবিতে হল রয়েছে ৮টি। যার ধারণ ক্ষমতা মোট শিক্ষার্থীর ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে মেয়েদের তিনটি হল প্রশাসনের কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ছেলেদের হলে পুরোই ভিন্ন চিত্র। হল প্রশাসনকে নামে মাত্র দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় ছাত্র হলগুলোতে। সিটে উঠতে শিক্ষার্থীদের যোগ দিতে হয় ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে। তদবির করতে হয় নির্দিষ্ট ‘বড় ভাই’দের সঙ্গে। ভাই বললে সিট জুটবে। ভাই না বললে মিলবে না। তার কথাতেই ছাড়তে হয় অনেকের স্বপ্নের হলের সিট। সম্প্রতি ইবির প্রতিটি হলে এক যোগে তল্লাশি করেছে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে দেখা যায় ৮০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী অনাবাসিক। প্রত্যেকেই শাখা ছাত্রলীগের কোনো না কোনো গ্রুপ বা উপ-গ্রুপের বড় ভাইদের মাধ্যমে হলে উঠেছে। এদিকে কয়েকটি হলে গত কয়েক বছর আবাসিকতা দেবার নামে আবেদন নেয়া হয়েছে। তবে অদৃশ্য কারণে অ্যালোটমেন্ট দিতে পারেনি হল প্রশাসন।
শত শত শিক্ষার্থী টাকা দিয়ে ২-৩ বার আবদেন করেও সুযোগ পায়নি হলে উঠার। আবার হলের আবাসিকতা দিলেও সিটে উঠতে পারে না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হলে অবস্থানরত অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী ১ম বা ২য় বর্ষের ছাত্র। অথচ মাস্টার্সসহ সিনিয়র ছাত্ররা আবেদন করেও সিট পাচ্ছে না। প্রতিবারই আবাসিকতা দেয়ার ঘোষণা আসলে একই ঘটনা ঘটে বলে হল সূত্রে জানা গেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তার ছাত্র সংগঠনের হতেই কার্যত হলের নিয়ন্ত্রণ থাকে। বর্তমান শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব নেতা হয়ে বঙ্গবন্ধু হলে উঠার ব্যবস্থা করতে হল প্রশাসনকে জানায়। তার ক্ষমতার প্রভাবে রুম নির্ধারণ করা, মেরামত, রং করা এবং আন্তর্জাতিক ব্লকের পুরো একটি ফ্লোর ফাঁকা করার নির্দেশ দেয় প্রভোস্ট। একইভাবে ইচ্ছেমতো নিজের কর্মীদের হলে তুলতে অন্য শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেয় নেতারা। তবে আবাসিকতা না পেলেও দিব্যি হলে অবস্থান করছে অনাবাসিক দলীয় শত শত কর্মী। এতে রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বরাবরই বঞ্চিত হয়ে আসছে। পুরো শিক্ষা জীবন শেষ করেও কোনো দিন হলে থাকতে পারেন নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বিরাট। এদিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হলে নিজ কর্মীসহ অবস্থানরত সকল শিক্ষার্থীর ওপর সবসময়ই চলে বড় ভাইদের খবরদারি। নিয়মিত মিছিলে যাওয়া, হলের মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা সকলের ওপর বাধ্যতামূলক।
কোনো কর্মসূচিতে না গেলে হল থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি আসে। গ্রুপিং রাজনীতির কারণে প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীদের হেনস্তার শিকার হতে হয় প্রায়ই। এ ছাড়া ছাত্রলীগের কয়েকটি কক্ষে নিয়মিত চলে মদ, গাঁজা আর জুয়ার আসর। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসব দেখেও তাদের ভয়ে কোনো কিছু বলার সাহস দেখাতে পারে না। এসব রুমে মাদকের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধরে এনে চাঁদা দাবি করা হয়। নিয়মিত চাঁদা না দিলে শিবির বলে মারধর ও পুলিশে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। শিক্ষা জীবন ও প্রাণ ভয়ে বরাবরই মুখ বন্ধ রাখে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। চাঁদা দিতে না পেরে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার ঘটনাও রয়েছে কয়েকটি। এসবের পেছনে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীনতা একমাত্র কারণ বলে অভিযোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বঙ্গবন্ধু হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দার জানান, হলগুলো তো ঠিকমতো চলছে না। গত ৯ মাস ধরে আমি দায়িত্বে আছি। আমি যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে পারছি না। প্রভোস্ট কাউন্সিলে আমি বলেছি, বাড়ির মালিক যদি না জানে তার বাড়িতে কে থাকে, তবে তো সে মালিকই হতে পারে না। আগামী ১ মাসে যদি হলের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তবে আমি আর থাকবো না। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. রাশিদ আসকারী বলেন, কোনো হলই নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে না। হলে উঠতে কারো সমস্যা হলে আমি নিজে তাকে তুলে দিয়ে আসবো। ঢাবির মতো অনুরূপ সিদ্ধান্ত আমরও নেব। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতো ইবির সকল হলে সার্চ হবে।টর্চার সেল বা এ ধরনের নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেব। সকল প্রভোস্টকে নিয়ে সভা ডেকেছি। আশা করি হলগুলোতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত হবে।
বেরোবিতে ছাত্রলীগের কাছে জিম্মি হল প্রশাসন: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ছাত্রদের আবাসিক হলের অধিকাংশ ছাত্রই থাকছেন অবৈধভাবে। ছাত্রলীগ পরিচয়ে হলে অবস্থান করায় হল প্রশাসনও জিম্মি। তবে ছাত্রলীগের দাবি, হল চালাতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের দায় ছাত্রলীগের উপর চাপাচ্ছে হল প্রশাসন। হল প্রশাসন বলছে, ছাত্রদের দুইটি হলই এখন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। হলে ভর্তি না হয়েও ছাত্রলীগের নেতাদের মাধ্যমে ছাত্ররা অবৈধভাবে হলে উঠছেন। তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আবু মোন্নাফ আল তুষার কিবরিয়া। হল সূত্র জানায়, হলে আসন শূন্য থাকা সাপেক্ষে গত বছর সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু হল ও ইলাহী হল ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেয়। শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু হলে ৬৭ জনকে এবং ইলাহী হলে ৩৬ জনকে আসন বরাদ্দ দেয় হল কর্তৃপক্ষ। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলে ১৩ জন এবং ইলাহী হলে ২৬ জন ভর্তি ফি দিয়ে বৈধভাবে হলে উঠেন। বাকিদের হলে না উঠার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, কাগজে-কলমে আসন ফাঁকা থাকলেও সবই অবৈধদের দখলে। যার মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় রয়েছেন।
(মানবজমিন এর এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাহাত খান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জাহিদুর রহমান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইমরান শুভ্র, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ইভান চৌধুরী )
কার্যত তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। সিট দেয়া থেকে শুরু করে কাউকে হলে ওঠানো কিংবা নামানোর সব কাজই করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। গত এক দশক ধরে এ ভূমিকায় রয়েছে শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। সংগঠনটির নেতাকর্মীরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো হল চালাচ্ছেন। এর আগে একই ভূমিকায় দেখা গেছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলকেও। ১৯৯০-এর পর গণতান্ত্রিক সরকার আমল থেকে এ ধারা শুরু হয়। হলগুলোতে কমতে থাকে প্রভোস্টসহ অন্যান্য শিক্ষকদের প্রভাব। পদ টিকিয়ে রাখতে শিক্ষকরাও ছাত্র সংগঠনগুলোর অনৈতিক সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিয়ে যাচ্ছেন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে তাদের পাওয়া যায় না। অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মেলেনি। হলে ছাত্রলীগ ও প্রশাসন মিলেমিশে একাকার। বিভিন্ন দিবসে হল প্রশাসনের উদ্যোগে খাবার দেয়ার জন্য টোকেন বিতরণের সময় আবাসিক শিক্ষকদের দেখা মেলে।
এ ছাড়া আবাসিক হলে শিক্ষার্থীরা কেমন আছেন, কোনো সমস্যা আছে কিনা, পড়ালেখা চলছে কিনা- কোনো ধরনের খোঁজ নেন না দায়িত্বে থাকা আবাসিক শিক্ষকরা। গত এক দশকে দেখা গেছে, মতের অমিল হলেই বিভিন্ন সময় আবাসিক শিক্ষার্থীদের মেরে হল ছাড়া করেছে ছাত্রলীগ। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় পুলিশেও সোপর্দ করেছে সংগঠনটি। ব্যক্তিগত আক্রোশের জের ধরেও অনেককে মিথ্যা ব্লেম পেয়ে হলছাড়া হতে হয়েছিল। হলে হলে গড়ে তোলা হয়েছিল টর্চার সেল। যেখানে শ’ শ’ শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু কখনো হল প্রশাসন এসব ঘটনার তদন্ত করেনি। নেয়নি কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটে) শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলের দায়িত্বে থাকা প্রভোস্টদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একটি ছেলেকে হলের অভ্যন্তরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। অথচ কিছুই জানতেন না প্রভোস্ট। এমনকি অন্য কোনো শিক্ষার্থী এ ব্যাপারে প্রভোস্ট কিংবা অন্যান্য আবাসিক শিক্ষকদের অবহিত করার প্রয়োজন মনে করেননি।
শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থীরা বলছেন, ইতোপূর্বে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা অনেকবার ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন। কিন্তু কখনো এর কোনো বিচার হয়নি। অবহিত করার পরও প্রভোস্ট ছিলেন নির্বিকার। আবার যারা একটু প্রতিবাদ করতো তাদেরও পরবর্তী সময়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তাই কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র এটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য হল রয়েছে মাত্র ১৯টি। এর মধ্যে পাঁচটি ছাত্রীদের জন্য, ১৩টি ছাত্রদের জন্য আর একটি হল বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য। একমাত্র বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত স্যার পিজে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলই প্রশাসনের নির্দেশনা অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। অন্যসব হল রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত। ছেলেদের হলগুলোর সর্বময় ক্ষমতা ছাত্রলীগের হাতে। প্রশাসন এখানে কেবল নথিপত্রে সই করার জন্যই রয়েছে। অন্য কোনো ভূমিকায় তারা নেই। কোনো শিক্ষার্থীকে সিট দেয়া থেকে কাউকে সিট থেকে নামিয়ে দেয়া সব কিছুই করে ছাত্রলীগ। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছেলেদের বিজয় একাত্তর হল ও মেয়েদের পাঁচটি হল। বিজয় একাত্তর হলে রাজনৈতিক প্রভাব ছেলেদের অন্য হলগুলোর তুলনায় কিছুটা কম। এখানে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। ছাত্রলীগও সিট দেয় তবে সেটি অনেক কম। আর মেয়েদের পাঁচটি হলের বেশিরভাগ সিটই প্রশাসন বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তবে এ পাঁচটি হলে ছাত্রলীগ নেত্রীদের হাতেও বেশ কিছু কক্ষ রয়েছে। তারাও সিট দেয়া নেয়ার কাজ করে। মেয়েদের পাঁচটি হল হলো- বেগম রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, কবি সুফিয়া কামাল হল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল। ছেলেদের ১৩টি হলের মধ্যে তীব্র সিট সংকট রয়েছে- সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, কবি জসীমউদ্্দীন হল, অমর একুশে হল, স্যার এ এফ রহমান হলে।
সিট সংকট কিছুটা কম হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মাস্টার’দা সূর্যসেন হল, ড. মু. শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হলে। আর শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীরা মোটামুটি প্রথম বর্ষ থেকেই সিট পেয়ে থাকে। ছেলেদের হলগুলোতে ছাত্রলীগ নেতারা দিনের পর দিন সিট দখল করে থাকেন। স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পর তারা সিট ছাড়েন না। এমনকি বেশিরভাগ ছাত্রনেতা হলের সিঙ্গেল কক্ষগুলো ধরে রেখেছেন। দুইজন কিংবা চারজনের কক্ষও একজন দখল করে রেখেছেন। কিন্তু প্রশাসন এদের হল ছাড়া করার কোনো উদ্যোগ নেন না। কখনো কখনো মেয়াদোত্তীর্ণদের হল ছাড়া করার অভিযান শুরু করলেও সেটি কেবল সাধারণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। প্রভোস্টের নেতৃত্বে আবাসিক শিক্ষকরা কেবল সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল ছাড়া করতে চান। কিন্তু তারা কখনো বছরের পর বছর কক্ষ দখল করে থাকা ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষের দিকে যান না। ছেলেদের হলগুলোতে ছাত্রলীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় অনেক বহিরাগত অবস্থান করলেও তাদের ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগী হতে দেখা যায় না হল প্রশাসনকে।
বৈধ শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে গণরুমে থাকলেও বহিরাগতরা বিভিন্ন কক্ষে আরামে থাকছেন। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে গেস্টরুমের (যে কক্ষে ম্যানর শেখানোর নামে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়) নামে নবীন শিক্ষার্থীদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা সামনে এলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেননি হল প্রশাসন। কোনোভাবে বড় ভাই অসন্তুষ্ট হলেই নবীন শিক্ষার্থীদের চরম পরিণতি ভোগ করতে হয়। বিভিন্ন সময় অনেক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ ভিন্নমত লালনের কারণে হল ছাড়া করেছে। অমানবিক নির্যাতনের পর তাদের হল ছাড়া করা হয়। কিন্তু প্রশাসন সেসব বিষয়ের কোনো তদন্ত করেনি। দেখেও না দেখার ভান করেন দায়িত্বে থাকা আবাসিক শিক্ষকরা। উল্টো প্রশাসনের সহযোগিতায় ছাত্রলীগের ইচ্ছায় তাদের পুলিশে দেয়া হয়েছিল। অনেক সময় থানা থেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়া পেয়েছেন অনেকে। ছাত্রলীগের গ্রুপ উপ-গ্রুপেরও বলি হতে হয়েছিল অনেক নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ঘটনারই তদন্ত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। কিছু কিছু ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হলগুলোও অলিখিতভাবে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করে। গত রোববার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলে আবরার ফাহাদ নামে এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয় তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ঘটনায় তোলপাড় পুরো দেশ। বিক্ষোভে বিক্ষোভে উত্তাল ছিল দেশের শিক্ষাঙ্গন। শুক্রবার আবরার ফাহাদ হত্যার জেরে বুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। দেশের প্রাচীন এ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলেই ছিল ছাত্রলীগের টর্চার সেল। বিষয়টি জেনেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গুলি বিনিময়কালে সাবিকুন্নাহার সনি নামে এক ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফের বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি শুরু করে ছাত্রলীগ। এরপর হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিরাজ করতে থাকে। নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে হলের প্রাধ্যক্ষরা। সিট দেয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
চবির হলেও হর্তাকর্তা ছাত্রলীগ: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রত্যেকটি হলের দায়িত্বে প্রভোস্টরা থাকলেও হলগুলোর দেখভাল করছে ছাত্রলীগ। সবগুলো হল দখল করে আছে শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে হলে বৈধ শিক্ষার্থীদের মারধর করে হল থেকে বের করে দেয়ার নজির রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা হলের সার্বিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বে প্রভোস্টদের থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ প্রভোস্ট ক্যাম্পাসে থেকে দায়িত্ব পালন করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষকরা বছরে একবার শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফরমে সই করে দায় সারেন। হলের কোন ব্লকে কে থাকবে তা তদারকি করে ছাত্রলীগ। জানা যায়, বরাদ্দপ্রাপ্ত বৈধ শিক্ষার্থীরা থাকতে না পারলেও ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন হলে বহিরাগতরা অবস্থান করে। এই বছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে সোহরাওয়ার্দী হলের গেস্ট রুম থেকে এক বহিরাগত নারীসহ ১৮ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে দেশীয় ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে মাদক সেবনরত অবস্থায় একাধিক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করার নজির রয়েছে। এ ছাড়াও সমপ্রতি সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫১ নম্বার কক্ষে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি নাজিমের নেতৃত্বে কয়েকজন বহিরাগতকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোনো টর্চার সেল নেই।
কোনো কর্মী কাউকে নির্যাতন করলে সেটার দায়ভার তার নিজের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করবো অভিযোগ পাওয়া গেলে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এবং এ বিষয়ে আমারও পুরোপুরি সহযোগিতা থাকবে। হলে বহিরাগতদের অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি জানি না যদি তা থাকে সেটা দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, হলগুলো দেখার দায়িত্ব প্রভোস্টদের হলেও তারা যেন হলের মেহমান। তাদেরকে হলে দেখাই যায় না। তারা শুধুমাত্র ছাত্রদের পরীক্ষার ফরমে স্বাক্ষরের দায়িত্বই পালন করেন। হল তদারকির বিষয়ে প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামান বলেন, ২৪ ঘণ্টা ক্যাম্পাসে থেকে হল পরিচালনার জন্য আবাসিক ও পরিবহন সুবিধা প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে আমরা এর কিছুই পাই না।
রাবির হলও চলে ছাত্রলীগের ইচ্ছায়: কর্তৃপক্ষকে তোয়াক্কা না করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র হলে সিট দখলে একচ্ছত্র আধিপত্য চালাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ও নিজের গ্রুপে ভিড়ানোর শর্তে দলীয় কর্মী কিংবা পছন্দের ছোট ভাইকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই হলে সিট করে দিচ্ছে তারা। এদের মধ্যে অনেকের আবার সংশ্লিষ্ট হলে সংযুক্তিও থাকে না। এ ছাড়াও বিভিন্ন হলে বহিরাগতদের অবস্থানের প্রমাণও মিলেছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের পরিচিতদের হলে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নেতাকর্মীদের এমন বেপরোয়ায় কোণঠাসা প্রশাসন। তাদের নীরব ভূমিকায় ভুগতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ হলেই অবৈধভাবে সিট দখল করে রেখেছে ছাত্রলীগ। হলগুলোতে পলিটিক্যাল নামে ব্লক দখল করে সেখানে অবৈধভাবে দলীয় কর্মীদের সিট দিচ্ছে নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা রুমে রুমে গিয়ে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের লিস্ট করে। তাদের পরীক্ষা কবে শেষ এবং কবে তারা হল ছাড়বে এ সময়গুলো লিখে নেয় তারা। এসব শিক্ষার্থী চলে গেলে ওই সিটগুলো দখলে নেয় ছাত্রলীগ।
নাম গোপন রাখার শর্তে রাবি ছাত্রলীগের সিনিয়র কয়েকজন নেতা বলেন, হলগুলোতে জুনিয়র নেতাকর্মীরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে কাউকে তোয়াক্কা করছে না তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, সিটের জন্য হলের নেতাদের কাছে জিম্মি তারা। অনেকেই আবার সিটের জন্য টাকাও দেয় এই নেতাদের। গত ১লা ফেব্রুয়ারি মতিহার হল থেকে এক অবৈধ শিক্ষার্থীকে বের করে দেন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আলী আসগর। পরে ওই শিক্ষার্থীকে আবার অবৈধভাবে সেই রুমেই তুলে দেয়া হয়। নাম প্রকাশ না করে এক হল প্রাধ্যক্ষ বলেন, গায়ের জোরে কিংবা দল ভারি করা যাই হোক না কেন নেতাকর্মীরা হলগুলোতে এসব করে যাচ্ছে। যারা অবৈধ তাদের হল থেকে বের করে দিতে গেলে বিভিন্নভাবে বাধা আসে। জানতে চাইলে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, আমরা দুয়েকদিনের মধ্যেই হলের দায়িত্বে থাকা নেতাকর্মীদের নিয়ে বসবো। হলগুলোতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি যেন বজায় থাকে আমরা সেই চেষ্টাই করবো। হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক রেজাউল করিম বকসী বলেন, আমি এ বিষয়ে শুনেছি। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যেই ভিসির সঙ্গে হল প্রাধ্যক্ষরা বসে এগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
‘ভাই’দের হাতে ইবির হল: কখনো দলীয় পরিচয় কখনোওবা ‘বড় ভাই’য়ের গ্রুপ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সিট পাওয়ার মাধ্যম এটা। মেধা তালিকায় হলে সিট পাওয়া যেন অমাবশ্যার চাঁদ। কালেভদ্রে গুটিকতেক শিক্ষার্থী মেধা তালিকায় সিট পায়। তবে ক্ষমতাসীন ‘বড় ভাই’দের তদবির ছাড়া উঠা যায় না নিজ রুমে। হল প্রশাসন নিজেদের মত চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে বরাবরই তারা জিম্মি। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সবসময়ই বঞ্চিত হয়ে আসছে। প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ইবিতে হল রয়েছে ৮টি। যার ধারণ ক্ষমতা মোট শিক্ষার্থীর ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে মেয়েদের তিনটি হল প্রশাসনের কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ছেলেদের হলে পুরোই ভিন্ন চিত্র। হল প্রশাসনকে নামে মাত্র দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় ছাত্র হলগুলোতে। সিটে উঠতে শিক্ষার্থীদের যোগ দিতে হয় ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে। তদবির করতে হয় নির্দিষ্ট ‘বড় ভাই’দের সঙ্গে। ভাই বললে সিট জুটবে। ভাই না বললে মিলবে না। তার কথাতেই ছাড়তে হয় অনেকের স্বপ্নের হলের সিট। সম্প্রতি ইবির প্রতিটি হলে এক যোগে তল্লাশি করেছে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে দেখা যায় ৮০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী অনাবাসিক। প্রত্যেকেই শাখা ছাত্রলীগের কোনো না কোনো গ্রুপ বা উপ-গ্রুপের বড় ভাইদের মাধ্যমে হলে উঠেছে। এদিকে কয়েকটি হলে গত কয়েক বছর আবাসিকতা দেবার নামে আবেদন নেয়া হয়েছে। তবে অদৃশ্য কারণে অ্যালোটমেন্ট দিতে পারেনি হল প্রশাসন।
শত শত শিক্ষার্থী টাকা দিয়ে ২-৩ বার আবদেন করেও সুযোগ পায়নি হলে উঠার। আবার হলের আবাসিকতা দিলেও সিটে উঠতে পারে না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হলে অবস্থানরত অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী ১ম বা ২য় বর্ষের ছাত্র। অথচ মাস্টার্সসহ সিনিয়র ছাত্ররা আবেদন করেও সিট পাচ্ছে না। প্রতিবারই আবাসিকতা দেয়ার ঘোষণা আসলে একই ঘটনা ঘটে বলে হল সূত্রে জানা গেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তার ছাত্র সংগঠনের হতেই কার্যত হলের নিয়ন্ত্রণ থাকে। বর্তমান শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব নেতা হয়ে বঙ্গবন্ধু হলে উঠার ব্যবস্থা করতে হল প্রশাসনকে জানায়। তার ক্ষমতার প্রভাবে রুম নির্ধারণ করা, মেরামত, রং করা এবং আন্তর্জাতিক ব্লকের পুরো একটি ফ্লোর ফাঁকা করার নির্দেশ দেয় প্রভোস্ট। একইভাবে ইচ্ছেমতো নিজের কর্মীদের হলে তুলতে অন্য শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেয় নেতারা। তবে আবাসিকতা না পেলেও দিব্যি হলে অবস্থান করছে অনাবাসিক দলীয় শত শত কর্মী। এতে রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বরাবরই বঞ্চিত হয়ে আসছে। পুরো শিক্ষা জীবন শেষ করেও কোনো দিন হলে থাকতে পারেন নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বিরাট। এদিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হলে নিজ কর্মীসহ অবস্থানরত সকল শিক্ষার্থীর ওপর সবসময়ই চলে বড় ভাইদের খবরদারি। নিয়মিত মিছিলে যাওয়া, হলের মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা সকলের ওপর বাধ্যতামূলক।
কোনো কর্মসূচিতে না গেলে হল থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি আসে। গ্রুপিং রাজনীতির কারণে প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীদের হেনস্তার শিকার হতে হয় প্রায়ই। এ ছাড়া ছাত্রলীগের কয়েকটি কক্ষে নিয়মিত চলে মদ, গাঁজা আর জুয়ার আসর। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসব দেখেও তাদের ভয়ে কোনো কিছু বলার সাহস দেখাতে পারে না। এসব রুমে মাদকের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধরে এনে চাঁদা দাবি করা হয়। নিয়মিত চাঁদা না দিলে শিবির বলে মারধর ও পুলিশে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। শিক্ষা জীবন ও প্রাণ ভয়ে বরাবরই মুখ বন্ধ রাখে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। চাঁদা দিতে না পেরে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার ঘটনাও রয়েছে কয়েকটি। এসবের পেছনে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীনতা একমাত্র কারণ বলে অভিযোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বঙ্গবন্ধু হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দার জানান, হলগুলো তো ঠিকমতো চলছে না। গত ৯ মাস ধরে আমি দায়িত্বে আছি। আমি যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে পারছি না। প্রভোস্ট কাউন্সিলে আমি বলেছি, বাড়ির মালিক যদি না জানে তার বাড়িতে কে থাকে, তবে তো সে মালিকই হতে পারে না। আগামী ১ মাসে যদি হলের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তবে আমি আর থাকবো না। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. রাশিদ আসকারী বলেন, কোনো হলই নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে না। হলে উঠতে কারো সমস্যা হলে আমি নিজে তাকে তুলে দিয়ে আসবো। ঢাবির মতো অনুরূপ সিদ্ধান্ত আমরও নেব। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতো ইবির সকল হলে সার্চ হবে।টর্চার সেল বা এ ধরনের নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেব। সকল প্রভোস্টকে নিয়ে সভা ডেকেছি। আশা করি হলগুলোতে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত হবে।
বেরোবিতে ছাত্রলীগের কাছে জিম্মি হল প্রশাসন: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ছাত্রদের আবাসিক হলের অধিকাংশ ছাত্রই থাকছেন অবৈধভাবে। ছাত্রলীগ পরিচয়ে হলে অবস্থান করায় হল প্রশাসনও জিম্মি। তবে ছাত্রলীগের দাবি, হল চালাতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের দায় ছাত্রলীগের উপর চাপাচ্ছে হল প্রশাসন। হল প্রশাসন বলছে, ছাত্রদের দুইটি হলই এখন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। হলে ভর্তি না হয়েও ছাত্রলীগের নেতাদের মাধ্যমে ছাত্ররা অবৈধভাবে হলে উঠছেন। তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আবু মোন্নাফ আল তুষার কিবরিয়া। হল সূত্র জানায়, হলে আসন শূন্য থাকা সাপেক্ষে গত বছর সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু হল ও ইলাহী হল ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেয়। শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু হলে ৬৭ জনকে এবং ইলাহী হলে ৩৬ জনকে আসন বরাদ্দ দেয় হল কর্তৃপক্ষ। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলে ১৩ জন এবং ইলাহী হলে ২৬ জন ভর্তি ফি দিয়ে বৈধভাবে হলে উঠেন। বাকিদের হলে না উঠার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, কাগজে-কলমে আসন ফাঁকা থাকলেও সবই অবৈধদের দখলে। যার মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় রয়েছেন।
(মানবজমিন এর এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাহাত খান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জাহিদুর রহমান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইমরান শুভ্র, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ইভান চৌধুরী )
No comments