নুসরাত হত্যা: কে এই রুহুল আমিন by জিয়া চৌধুরী
ফেনী
জুড়ে আলোচনায় এখন রুহুল আমিন। প্রাইমারি স্কুল উতরাতে না পারা রুহুল এখন
সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। শুক্রবার পিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তারের
পর তাকে নিয়ে চলছে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা। গত শনিবার তাকে আদালতে হাজির করে
পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সোনাগাজীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে
পুড়িয়ে হত্যার পেছনে অন্যতম কারিগর এই রুহুল আমিন। একসময় পেটের তাগিদে
সৌদি আরব চলে যান। সেখানে ট্যাক্সি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। কোন রকমে
চলতো তার সংসার।
আর এখন তিনি কোটিপতি। বিতর্কিত এই আওয়ামী লীগ নেতা ও সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা পরিচালনা কমিটির (সদ্য বাতিলকৃত) সহ-সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশ জাতীয় পার্টির হাত ধরে। অল্পদিনে তিনি দল পরিবর্তন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ দখল করেন।
এক পর্যায়ে সভাপতির অনুপস্থিতিতে বাগিয়ে নেন দলের উপজেলা শীর্ষ পদ। চাঁদাবাজি, বালু মহালের নিয়ন্ত্রণসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে দলের নেতা-কর্মীরাও তার রোষানলের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। নুসরাত হত্যার ঘটনায় শুক্রবার বিকেলে রুহুল আমিন গ্রেপ্তার হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছে স্থানীয় লোকজন। উঠে আসছে তার অপকর্মের ইতিহাস। গতকাল শনিবার সোনাগাজীর বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী, মাদরাসার একাধিক শিক্ষক-অভিভাবক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় রুহুল আমিনের অঘোষিত রাজত্বের ফিরিস্তি। সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উচিয়াঘোনা কেরানী বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন। পড়াশোনা করেছেন মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বড় ভাই আবুল কাশেম স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আরেক ভাই আবু সুফিয়ানও আমেরিকায় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান স্থানীয়রা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, এক সময় জাতীয় পার্টির সদস্য ছিলেন রুহুল আমিন। ১৯৯৭ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফয়েজুল কবিরের হাতে এক সমাবেশে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ২০০১ সালে চলে যান সৌদি আরব। সেখানে দীর্ঘ ৯ বছর ট্যাক্সি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করেছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ফের সোনাগাজীতে ফিরে আসেন রুহুল আমিন। দেশে ফিরেই দলে সক্রিয় হতে তৎপরতা চালান। ২০১৩ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে কাউন্সিলর মনোনীত হন। অনেকটা আকস্মিকভাবে ২০১৫ সালে সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন।
এখান থেকেই শুরু হয় তার নানা অপকর্ম। ডালপালা বিস্তার শুরু করে ক্ষমতার প্রভাব বলয়। রুহুল আমিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি থাকা অবস্থায় দলের সভাপতি ফয়েজুল কবিরের উপরও চলে নানা নিপীড়ন। এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়েন রুহুল আমিন। এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ফয়েজুল কবির এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে অবস্থান নেন। ২০১৮ সালের শুরুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে দলের সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সোনাগাজী উপজেলায় আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পদ পাওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। রুহুল আমিন গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। ছোট ফেনী নদীর সোনাগাজীর মুহুরী প্রকল্প অংশের একটি বালু মহাল ও ছোট ফেনী নদীর সাহেবের ঘাট এলাকায় আরেকটি বড় বালু মহাল দখলে নেন। বালু মহল দুটি থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রুহুল আমিন চক্র। যদিও একসময় এ দুটি বালু মহাল ছিল সদ্য সাবেক এমপি রহিম উল্যাহর লোকজনের নিয়ন্ত্রণে।
রহিম উল্যাহ মানবজমিনকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে ছয় একর জায়গা প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ইজারা নেয়ার পরও আমাকে জোর করে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়। আমার বালু মহাল দখলে নেয় রুহুল আমিন ও তার ক্যাডার বাহিনী। ওই বালু মহালে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বালু ছিল, সেগুলোও লুটে নেয় তারা। এসবের প্রতিবাদ করায় আমার ও পরিবারের সদস্যদের ওপর নানা সময়ে হামলা করা হয়েছে। আমার গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, বাড়ি ও জমিতে হামলা করা হয়। সোনাগাজী, জিরো পয়েন্ট ও নানা জায়গায় হামলা হয়েছে। মানুষ এখনো সেসবের সাক্ষী। রুহুল আমিনের হামলা-নির্যাতনে আমি এখন এলাকা ছাড়া। এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার ভাই ও ভাতিজাকে হারাতে হয়েছে। প্রবাস জীবনের কষ্টের টাকায় সোনাগাজীতে প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ কিনেছি। ভয়ে এলাকায় যেতে পারি না। রুহুল আমিনের হামলা-নির্যাতনের বিষয়ে কখনো অভিযোগ করেছেন কিনা এমন প্রশ্নে রহিম উল্যাহ মানবজমিনকে বলেন, বারে বারে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করেছি। কিন্তু কেউ আমার বিচার করে নাই। আমি এখন আর কারো কাছে বিচার চাই না।
আল্লাহর কাছে বিচার দেয়া ছাড়া আসলে আমার আর কিছু করারও নেই। শুধু আল্লাহর কাছেই এখন বিচার চাই। সোনাগাজী উপজেলার পশ্চিম চরচান্দিয়া এলাকায় ছোট ফেনী নদীর উপর নির্মানাধীন সাহেবের ঘাট ব্রীজ এলাকায় ইজারা এলাকার বাইরে বালু উত্তোলনের অভিযোগে গত বছরের ২৭ আগস্ট বিকালে ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল পারভেজ ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরীন ফেরদৌসী অভিযান চালায়। সে সময় ভ্রাম্যমান আদালত চলাকালে ঘটনাস্থলে বালু উত্তোলনকারী কাউকে না পেয়ে ড্রেজার মেশিনটি ধ্বংস করা হয়। একটি ড্রেজার মেশিনের সংযোগ তার কেটে দেয়া হয় এবং ড্রেজার মেশিনের ইঞ্জিনে এক কেজি লবণ ও এক কেজি চিনি ঢেলে দিয়ে অকেজো করে দেন। ওই ঘটনার পরদিন ফেনীর সোনাগাজীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল পারভেজ ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরীন ফেরদৌসির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বালু মহাল ইজারাদার মো. রুহুল আমিন।
বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিনটি অকেজো করে দেয়ার অভিযোগ এনে আনুমানিক ২২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬৪, ৪২৭ ও ৫০৬ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেয়। মামলার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাজে আদালতের হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তাতের ঝড় উঠলে ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপে ও জেলা প্রশাসকের মধ্যস্ততায় মামলা প্রত্যাহার করে নেয় রুহুল আমিন। দলের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নেতা হলেও তার সাথে সখ্য রয়েছে স্থানীয় বিএনপি-যুবদলের নেতাদের সাথেও। রুহুলের চাচাতো ভাই-চরচান্দিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াধন, বিএনপি নেতা খুরশিদ আলম, ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটক দুলাল ওরফে বাটা দুলাল, ইয়াবা বিক্রেতা হেলাল, সিরাজ ওরফে সিরাজ ডাকাত, আবুল কাশেম ওরফে কাশেম মাঝি, ফকির বাড়ির গোলাপ, আব্দুল হালিম সোহেল, সাবমিয়াসহ বেশ কয়েকজন তার ঘনিষ্ঠ।
রুহুল আমিনের ২০/২৫ জনের ক্যাডার বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময় নিপীড়নের শিকার হয়েছে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য আবুল কালাম বাহারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তার ক্যাডাররা। মতিগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটন, চরদরবেশ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ, সোনাগাজী সদর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা স্বপনসহ অনেকেই বিভিন্ন সময় হামলা-মারধরের শিকার হন। সোনাগাজী ইসলামীয়া ফাজিল মাদ্রাসার একাধিক সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সোনাগাজী পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মামুন ওই মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু ৬ থেকে ৭ মাস আগে নানা কৌশলে শেখ মামুনকে সরিয়ে দিয়ে রুহুল আমিন সদস্য মনোনীত হন। এক্ষেত্রে সিরাজের নানা অপকর্ম ঢাকতে এবং নিজের আধিপত্য ও প্রভাব বলয় বাড়াতে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজই তাকে সদস্য হবার সুযোগ করে দেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই সহ-সভাপতি বনে যান রুহুল আমিন।
মাদরাসার মার্কেটের ১২টি দোকান, ভেতরের বিশাল পুকুরের মাছ চাষ ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা উপায়ে আদায় করা বাড়তি টাকারও ভাগ পেতেন সহ-সভাপতি রুহুল ও আরেক সদস্য সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মকসুদ। ক্যাম্পাসের বাইরেও মাদরাসার রয়েছে জমিসহ কোটি টাকার সম্পদ। মাদরাসাটির একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে জানান, সিরাজ তাদের প্রায়ই বলতেন ‘রুহুল, মকসুদ এরা সবাই অশিক্ষিত। এরা থাকলে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। ওরা সবসময় আমাদের পক্ষে থাকবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘রুহুল ও মকসুদ মাঝে মাঝে ওই মাদরাসা ক্যাম্পাসের চারতলা ভবনের দোতলায় সিরাজের কক্ষে সময় কাটাতেন’। দলীয় একটি সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ফয়েজ কবির স্বপদে বহাল থাকা অবস্থায় রুহুল আমিন কীভাবে সভাপতি হলেন তা অনেকেই জানেন না। ফয়েজ কবির উপজেলা সভাপতি হিসেবে ফেনী জেলা পরিষদে প্রথমে সদস্য ও পরে প্যানেল চেয়ারম্যান পদ পান।
তিনি বলেন, ‘আমি পদ থেকে পদত্যাগও করিনি, আবার আমাকে বাদও দেয়া হয়নি। তাহলে অন্য কেউ কীভাবে এ পদের পরিচয় দিতে পারে-তা বোধগম্য নয়।’ এর বাইরে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি। রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে সোনাগাজী থানায় শালিস বাণিজ্য ও তদবির বানিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। নাসির উদ্দিন অপু নামে এক নেতা এক্ষেত্রে তার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন বলেও দলীয় সূত্রে জানা গেছে। সাবেক এমপি রহিম উল্যাহ বলেন, ‘আমি ও ডাক্তার গোলাম মাওলা সোনাগাজী শহীদ ছাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে সভাপতি পদে প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু সোনাগাজী বাজারের পশ্চিম দিকের একটি পক্ষ হঠাৎ করে রুহুল আমিনকে সেখানে নিয়ে যায় এবং অভিভাবক সদস্যসহ কয়েকজন সদস্যকে চাপ প্রয়োগ করে তাকে সভাপতি করতে বাধ্য করে।
কিন্তু তৎকালীন শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান আমাকে সভাপতি মনোনীত করলেও রুহুল ও তার ক্যাডারদের দফায় দফায় হামলা করায় আমি সভাপতির চেয়ারে বসতে পারিনি।’ সোনাগাজীর চাঞ্চল্যকর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে হত্যার ঘটনায় গত রোববার মামলার আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীমের ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে এজাহারের বাইরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনসহ ১৩ থেকে ১৪ জনের নাম উঠে আসে। নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার পর শাহাদাত হোসেন শামীম মোবাইল ফোন থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে ফোনে ‘কাজ হয়ে যাবার’ কথা জানায়। এসময় রুহুল বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা চলে যাও।’ নির্দেশ পাওয়ার পর আরো দু’একদিন তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে।
এরপর নুর উদ্দিন ময়মনসিংহের ভালুকা ও শামীম ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় চলে যায়। শুরুতেই একটি চক্র হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা করে। এটি সমন্বয় করেন ওসি মোয়াজ্জেম ও আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন। সহযোগিতা করেন কাউন্সিলর মকসুদ। এ কাজে ৫ থেকে ৬ জন স্থানীয় সাংবাদিককে দায়িত্ব দেয়া হয়। এদের প্রত্যেককে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। এদের দায়িত্ব ছিল নিজ নিজ গণমাধ্যমে এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ফেসবুকে নিজ নিজ আইডি থেকে অপপ্রচার চালানো। এদের মধ্যে তিনজন জাতীয় দৈনিকের উপজেলা সংবাদদাতা ও অন্য তিনজন স্থানীয় গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী। ঘটনার কিছু সময় পর নিজের ফেসবুক আইডিতে নুসরাতের আত্নহত্যা বলে পোস্ট দেন একটি দৈনিকের উপজেলা সংবাদদাতা। আদালত সূত্রের মতে-ঘটনার পর রুহুল ও শামীমের ৬ থেকে ৭ সেকেন্ডের ফোনালাপের নিশ্চিত তথ্য পিবিআই কর্মকর্তাদের কাছে রয়েছে।
সোনাগাজীর স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়-ঘটনার পর মিডিয়া এবং পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সামনে যেন ওই মাদরাসার কোন শিক্ষার্থী বা শিক্ষক মুখ খুলতে না পারেন-সেই চেষ্টাও করেন রুহুল আমিন ও তার সহযোগিরা। এর অংশ হিসেবে ঘটনার পরদিন অতিরিক্ত ডিআইজি আবুল ফয়েজ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে আগেই ঘটনাকে আত্মহত্যার চেষ্টা বলে বর্ণনা করতে কয়েকজন সাংবাদিক ও মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে গেলে মাদরাসায় দুর্বৃত্তরা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়। পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে তার জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দোলাকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৪/৫ জনকে আসামী করে নুসরাতে ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করে। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ওই মামলায় এজাহারভুক্ত ৮ জনসহ ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। এদের মধ্যে ৫ জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে।
আর এখন তিনি কোটিপতি। বিতর্কিত এই আওয়ামী লীগ নেতা ও সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা পরিচালনা কমিটির (সদ্য বাতিলকৃত) সহ-সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশ জাতীয় পার্টির হাত ধরে। অল্পদিনে তিনি দল পরিবর্তন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ দখল করেন।
এক পর্যায়ে সভাপতির অনুপস্থিতিতে বাগিয়ে নেন দলের উপজেলা শীর্ষ পদ। চাঁদাবাজি, বালু মহালের নিয়ন্ত্রণসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে দলের নেতা-কর্মীরাও তার রোষানলের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। নুসরাত হত্যার ঘটনায় শুক্রবার বিকেলে রুহুল আমিন গ্রেপ্তার হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছে স্থানীয় লোকজন। উঠে আসছে তার অপকর্মের ইতিহাস। গতকাল শনিবার সোনাগাজীর বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী, মাদরাসার একাধিক শিক্ষক-অভিভাবক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় রুহুল আমিনের অঘোষিত রাজত্বের ফিরিস্তি। সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উচিয়াঘোনা কেরানী বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন। পড়াশোনা করেছেন মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বড় ভাই আবুল কাশেম স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আরেক ভাই আবু সুফিয়ানও আমেরিকায় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান স্থানীয়রা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, এক সময় জাতীয় পার্টির সদস্য ছিলেন রুহুল আমিন। ১৯৯৭ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফয়েজুল কবিরের হাতে এক সমাবেশে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ২০০১ সালে চলে যান সৌদি আরব। সেখানে দীর্ঘ ৯ বছর ট্যাক্সি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করেছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে ফের সোনাগাজীতে ফিরে আসেন রুহুল আমিন। দেশে ফিরেই দলে সক্রিয় হতে তৎপরতা চালান। ২০১৩ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে কাউন্সিলর মনোনীত হন। অনেকটা আকস্মিকভাবে ২০১৫ সালে সোনাগাজী ছাবের পাইলট হাই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মনোনীত হন।
এখান থেকেই শুরু হয় তার নানা অপকর্ম। ডালপালা বিস্তার শুরু করে ক্ষমতার প্রভাব বলয়। রুহুল আমিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি থাকা অবস্থায় দলের সভাপতি ফয়েজুল কবিরের উপরও চলে নানা নিপীড়ন। এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়েন রুহুল আমিন। এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে ফয়েজুল কবির এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে অবস্থান নেন। ২০১৮ সালের শুরুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক সভায় সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাকে দলের সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সোনাগাজী উপজেলায় আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পদ পাওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। রুহুল আমিন গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। ছোট ফেনী নদীর সোনাগাজীর মুহুরী প্রকল্প অংশের একটি বালু মহাল ও ছোট ফেনী নদীর সাহেবের ঘাট এলাকায় আরেকটি বড় বালু মহাল দখলে নেন। বালু মহল দুটি থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রুহুল আমিন চক্র। যদিও একসময় এ দুটি বালু মহাল ছিল সদ্য সাবেক এমপি রহিম উল্যাহর লোকজনের নিয়ন্ত্রণে।
রহিম উল্যাহ মানবজমিনকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে ছয় একর জায়গা প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ইজারা নেয়ার পরও আমাকে জোর করে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়। আমার বালু মহাল দখলে নেয় রুহুল আমিন ও তার ক্যাডার বাহিনী। ওই বালু মহালে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বালু ছিল, সেগুলোও লুটে নেয় তারা। এসবের প্রতিবাদ করায় আমার ও পরিবারের সদস্যদের ওপর নানা সময়ে হামলা করা হয়েছে। আমার গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, বাড়ি ও জমিতে হামলা করা হয়। সোনাগাজী, জিরো পয়েন্ট ও নানা জায়গায় হামলা হয়েছে। মানুষ এখনো সেসবের সাক্ষী। রুহুল আমিনের হামলা-নির্যাতনে আমি এখন এলাকা ছাড়া। এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার ভাই ও ভাতিজাকে হারাতে হয়েছে। প্রবাস জীবনের কষ্টের টাকায় সোনাগাজীতে প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ কিনেছি। ভয়ে এলাকায় যেতে পারি না। রুহুল আমিনের হামলা-নির্যাতনের বিষয়ে কখনো অভিযোগ করেছেন কিনা এমন প্রশ্নে রহিম উল্যাহ মানবজমিনকে বলেন, বারে বারে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ করেছি। কিন্তু কেউ আমার বিচার করে নাই। আমি এখন আর কারো কাছে বিচার চাই না।
আল্লাহর কাছে বিচার দেয়া ছাড়া আসলে আমার আর কিছু করারও নেই। শুধু আল্লাহর কাছেই এখন বিচার চাই। সোনাগাজী উপজেলার পশ্চিম চরচান্দিয়া এলাকায় ছোট ফেনী নদীর উপর নির্মানাধীন সাহেবের ঘাট ব্রীজ এলাকায় ইজারা এলাকার বাইরে বালু উত্তোলনের অভিযোগে গত বছরের ২৭ আগস্ট বিকালে ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল পারভেজ ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরীন ফেরদৌসী অভিযান চালায়। সে সময় ভ্রাম্যমান আদালত চলাকালে ঘটনাস্থলে বালু উত্তোলনকারী কাউকে না পেয়ে ড্রেজার মেশিনটি ধ্বংস করা হয়। একটি ড্রেজার মেশিনের সংযোগ তার কেটে দেয়া হয় এবং ড্রেজার মেশিনের ইঞ্জিনে এক কেজি লবণ ও এক কেজি চিনি ঢেলে দিয়ে অকেজো করে দেন। ওই ঘটনার পরদিন ফেনীর সোনাগাজীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল পারভেজ ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরীন ফেরদৌসির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বালু মহাল ইজারাদার মো. রুহুল আমিন।
বালু উত্তোলনের ড্রেজার মেশিনটি অকেজো করে দেয়ার অভিযোগ এনে আনুমানিক ২২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬৪, ৪২৭ ও ৫০৬ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেয়। মামলার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাজে আদালতের হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তাতের ঝড় উঠলে ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপে ও জেলা প্রশাসকের মধ্যস্ততায় মামলা প্রত্যাহার করে নেয় রুহুল আমিন। দলের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের নেতা হলেও তার সাথে সখ্য রয়েছে স্থানীয় বিএনপি-যুবদলের নেতাদের সাথেও। রুহুলের চাচাতো ভাই-চরচান্দিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াধন, বিএনপি নেতা খুরশিদ আলম, ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটক দুলাল ওরফে বাটা দুলাল, ইয়াবা বিক্রেতা হেলাল, সিরাজ ওরফে সিরাজ ডাকাত, আবুল কাশেম ওরফে কাশেম মাঝি, ফকির বাড়ির গোলাপ, আব্দুল হালিম সোহেল, সাবমিয়াসহ বেশ কয়েকজন তার ঘনিষ্ঠ।
রুহুল আমিনের ২০/২৫ জনের ক্যাডার বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময় নিপীড়নের শিকার হয়েছে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য আবুল কালাম বাহারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তার ক্যাডাররা। মতিগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটন, চরদরবেশ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ, সোনাগাজী সদর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা স্বপনসহ অনেকেই বিভিন্ন সময় হামলা-মারধরের শিকার হন। সোনাগাজী ইসলামীয়া ফাজিল মাদ্রাসার একাধিক সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সোনাগাজী পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মামুন ওই মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু ৬ থেকে ৭ মাস আগে নানা কৌশলে শেখ মামুনকে সরিয়ে দিয়ে রুহুল আমিন সদস্য মনোনীত হন। এক্ষেত্রে সিরাজের নানা অপকর্ম ঢাকতে এবং নিজের আধিপত্য ও প্রভাব বলয় বাড়াতে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজই তাকে সদস্য হবার সুযোগ করে দেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই সহ-সভাপতি বনে যান রুহুল আমিন।
মাদরাসার মার্কেটের ১২টি দোকান, ভেতরের বিশাল পুকুরের মাছ চাষ ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা উপায়ে আদায় করা বাড়তি টাকারও ভাগ পেতেন সহ-সভাপতি রুহুল ও আরেক সদস্য সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মকসুদ। ক্যাম্পাসের বাইরেও মাদরাসার রয়েছে জমিসহ কোটি টাকার সম্পদ। মাদরাসাটির একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে জানান, সিরাজ তাদের প্রায়ই বলতেন ‘রুহুল, মকসুদ এরা সবাই অশিক্ষিত। এরা থাকলে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। ওরা সবসময় আমাদের পক্ষে থাকবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘রুহুল ও মকসুদ মাঝে মাঝে ওই মাদরাসা ক্যাম্পাসের চারতলা ভবনের দোতলায় সিরাজের কক্ষে সময় কাটাতেন’। দলীয় একটি সূত্র জানায়, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ফয়েজ কবির স্বপদে বহাল থাকা অবস্থায় রুহুল আমিন কীভাবে সভাপতি হলেন তা অনেকেই জানেন না। ফয়েজ কবির উপজেলা সভাপতি হিসেবে ফেনী জেলা পরিষদে প্রথমে সদস্য ও পরে প্যানেল চেয়ারম্যান পদ পান।
তিনি বলেন, ‘আমি পদ থেকে পদত্যাগও করিনি, আবার আমাকে বাদও দেয়া হয়নি। তাহলে অন্য কেউ কীভাবে এ পদের পরিচয় দিতে পারে-তা বোধগম্য নয়।’ এর বাইরে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি। রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে সোনাগাজী থানায় শালিস বাণিজ্য ও তদবির বানিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। নাসির উদ্দিন অপু নামে এক নেতা এক্ষেত্রে তার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন বলেও দলীয় সূত্রে জানা গেছে। সাবেক এমপি রহিম উল্যাহ বলেন, ‘আমি ও ডাক্তার গোলাম মাওলা সোনাগাজী শহীদ ছাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে সভাপতি পদে প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু সোনাগাজী বাজারের পশ্চিম দিকের একটি পক্ষ হঠাৎ করে রুহুল আমিনকে সেখানে নিয়ে যায় এবং অভিভাবক সদস্যসহ কয়েকজন সদস্যকে চাপ প্রয়োগ করে তাকে সভাপতি করতে বাধ্য করে।
কিন্তু তৎকালীন শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান আমাকে সভাপতি মনোনীত করলেও রুহুল ও তার ক্যাডারদের দফায় দফায় হামলা করায় আমি সভাপতির চেয়ারে বসতে পারিনি।’ সোনাগাজীর চাঞ্চল্যকর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে হত্যার ঘটনায় গত রোববার মামলার আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীমের ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে এজাহারের বাইরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনসহ ১৩ থেকে ১৪ জনের নাম উঠে আসে। নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার পর শাহাদাত হোসেন শামীম মোবাইল ফোন থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে ফোনে ‘কাজ হয়ে যাবার’ কথা জানায়। এসময় রুহুল বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা চলে যাও।’ নির্দেশ পাওয়ার পর আরো দু’একদিন তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে।
এরপর নুর উদ্দিন ময়মনসিংহের ভালুকা ও শামীম ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় চলে যায়। শুরুতেই একটি চক্র হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা করে। এটি সমন্বয় করেন ওসি মোয়াজ্জেম ও আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন। সহযোগিতা করেন কাউন্সিলর মকসুদ। এ কাজে ৫ থেকে ৬ জন স্থানীয় সাংবাদিককে দায়িত্ব দেয়া হয়। এদের প্রত্যেককে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। এদের দায়িত্ব ছিল নিজ নিজ গণমাধ্যমে এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ফেসবুকে নিজ নিজ আইডি থেকে অপপ্রচার চালানো। এদের মধ্যে তিনজন জাতীয় দৈনিকের উপজেলা সংবাদদাতা ও অন্য তিনজন স্থানীয় গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী। ঘটনার কিছু সময় পর নিজের ফেসবুক আইডিতে নুসরাতের আত্নহত্যা বলে পোস্ট দেন একটি দৈনিকের উপজেলা সংবাদদাতা। আদালত সূত্রের মতে-ঘটনার পর রুহুল ও শামীমের ৬ থেকে ৭ সেকেন্ডের ফোনালাপের নিশ্চিত তথ্য পিবিআই কর্মকর্তাদের কাছে রয়েছে।
সোনাগাজীর স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়-ঘটনার পর মিডিয়া এবং পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সামনে যেন ওই মাদরাসার কোন শিক্ষার্থী বা শিক্ষক মুখ খুলতে না পারেন-সেই চেষ্টাও করেন রুহুল আমিন ও তার সহযোগিরা। এর অংশ হিসেবে ঘটনার পরদিন অতিরিক্ত ডিআইজি আবুল ফয়েজ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে আগেই ঘটনাকে আত্মহত্যার চেষ্টা বলে বর্ণনা করতে কয়েকজন সাংবাদিক ও মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল। গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে গেলে মাদরাসায় দুর্বৃত্তরা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়। পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে তার জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দোলাকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৪/৫ জনকে আসামী করে নুসরাতে ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করে। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ওই মামলায় এজাহারভুক্ত ৮ জনসহ ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। এদের মধ্যে ৫ জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে।
No comments