এরপরও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পেলাম না by মতিউর রহমান চৌধুরী
শুরুটা
কীভাবে করবো জানি না। কারণ সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২৬শে
মার্চ এলে সবই যেন উলটপালট হয়ে যায়। শুধু ভাবি আর ভাবি। এখনো বেঁচে আছি সে
তো বিস্ময়কর। বাঁচার কোনো কথাও নয়। অনেকেই বাঁচেনি। পাকবাহিনীর সঙ্গে
সম্মুখ সমরে কয়জনই-বা বাঁচতে পেরেছিল।
১৯৭১-এর ২৬শে মার্চ সকাল। সাত বন্ধু মিলে মৌলভীবাজারের সদর রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে গেলাম। উদ্দেশ্য পাকবাহিনীর গতি রোধ করা। সারা বাংলা তখন প্রতিরোধে জ্বলছে বারুদের মতো। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব কায়েম হয়ে গেছে পূর্ব বাংলায়। আলোচিত স্বাধীনতা যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। প্রস্তুতি চারদিকে। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। সমঝোতার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
একমাত্র অপশন তখন সরাসরি যুদ্ধ। যেটাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলছি। কারো ডাকের অপেক্ষায় নয়। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশে। রাত থেকেই প্রতিরোধের প্রস্তুতি। খালি হাতে কি প্রতিরোধ করবো? কে তখন বাধা দেয়। সাত বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম পাকবাহিনীকে মৌলভীবাজারে রুখতে হবে। কি পাগলামি দেখুন। মৌলভীবাজার গভর্নমেন্ট স্কুলের সামনে গাছপালা, ইট ফেলে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছি। এমন সময় পেছন থেকে একটি ট্রাক এসে থামলো। আচমকা, জাস্ট হল্ট। পাকসেনারা একে একে ট্রাক থেকে নামলো। সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। পালাবার কোনো সুযোগ নেই। ট্রাকে তুলে নিল সবাইকে। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছি। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা আমাদেরকে? পরের গন্তব্যই বা কি হবে? শুধু ভাবছি বাড়ির কেউ তো জানতে পারবে না। আমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে অল্প দূরে সার্কিট হাউসের সামনে গিয়ে থামলো ট্রাক। পাশেই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। পাকবাহিনী সেখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাদেরকে নিয়ে গেল এক অন্ধকার ঘরে।
হাত বাঁধার পর দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। সকাল গড়িয়ে দুপুর। কিছু খেতেও দেয় না। বরং হাত বাঁধা আছে কি না একজন দেখে গেল। বিকাল ৩টা। হাত খুলতে এলো এক সেপাই। উর্দুতে কি যেন বললো। এরপর দুখানা রুটি দিল। সঙ্গে কিছু হালুয়া। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। খেতে ইচ্ছে হয়। আবার হয় না। রাগে ক্ষোভে তখনো জ্বলছি। কি করবো? রুটি খেলাম একখানা। কখন যে রাত হয়ে গেছে। বেত নিয়ে এলো এক অফিসার। পায়ে এবং পিঠে আঘাত করতে থাকলো। বাইরে তখন কার্ফু জারি হয়ে গেছে। রাতটা কাটলো এভাবেই। ভোর হতেই শুনলাম আমাদের চার বন্ধুকে ওরা আলাদা করে রেখেছে। এর বেশি কিছুই জানি না। নিজের কথা ভাবছি। ব্রাশফায়ার কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকলো। দাঁড়াতেই পারছি না। ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। কারণ পাশের রুম থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
সে কি কান্না! আর কাদের ধরে আনলো। চার বন্ধুর খবরই বা কি? শহরে কি হচ্ছে তাও জানিনা। সহযোদ্ধারা কি করছে তাও জানার উপায় নেই। তিনদিন এভাবেই কেটে গেল। চারদিন পর হাত খুলে দিল ওরা। এখন কি করবে? ছেড়ে দেবে নাকি ব্রাশফায়ারের জন্য নিয়ে যাবে। এই ভাবনার মধ্যেই একটি বাঙালি কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। চোখ এমনভাবে বাঁধা কিছুই বোঝার উপায় নেই। দেখতেও পাচ্ছি না। অন্ধকার ঘরে আরো কয়েকজনের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। এক বাঙালি ক্যাপ্টেন এলেন। বাতি জ্বলে উঠলো। বললেন, প্রস্তুতি নাও। কিসের প্রস্তুতি। আমরা তিন বন্ধুকে জড়ো করলো। বাকি চারজনের খবর নেই। রাত বাজে তখন চারটা। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে চললো। বেশ খানিক পথ হাঁটার পর বললো- ওধার যাও।
এখনই বুঝি শেষ। ভয়ে ভয়ে হাঁটছি। কিছুদূর যেতেই টের পেলাম ওরা পেছনে নেই। এরপর হাঁটতে থাকলাম। চৌমুহনায় গিয়ে শুনলাম আমাদের চার সহযোদ্ধাকে মৌলভীবাজার শহরের লাগোয়া মনু ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করেছে। শহীদ হয়ে গেছে ওরা চারজন। আর আমি বেঁচে আছি! সে তো বিস্ময়কর। বাড়িতে খবর গেছে পাকবাহিনী আমাকে হত্যা করেছে। বাড়িতে তখন কুলখানিও হয়ে গেছে। কি করে যে বেঁচে গেলাম এই প্রশ্নের জবাব কখনো পাইনি। পাবার কথাও নয়। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। হেঁটে যখন বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালাম, তখন বড্ড ক্লান্ত। শরীর আর চলছে না। ভয়ে শরীর হিমশীতল হয়ে যাচ্ছে বার বার। এই বুুঝি পাকবাহিনী আসলো। সন্ধ্যায় যখন গ্রামে পা বাড়ালাম তখন শোরগোল পড়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে একজন অন্যজনের দিকে তাকাচ্ছে। আমি তখনো বুঝতে পারিনি। কি হয়েছে আসলে। একজন এসে সরাসরি প্রশ্ন করলো, আপনি বেঁচে আছেন? আমরা তো এই বিকালেই আপনার বাড়িতে কুলখানি করে এলাম। কে একজন দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়েছে- আমি বাড়িতে আসছি। বাড়ির সবাই ছুটে এলো আমাকে দেখতে।
সেটা আমার জীবনে এক ইতিহাস হয়ে রইলো। একা একা বসে যখন ভাবি তখন হিসাব মেলাতে পারি না। একই প্রশ্ন সামনে আসে বার বার। দেশের ডাকে এগিয়ে গিয়েছিলাম কিছু প্রাপ্তির জন্য নয়। যদিও দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে। অনেকেই বলেন, কি ব্যাপার আপানার সার্টিফিকেট কই? বিনীতভাবে তাদের বলি, কারো সার্টিফিকেট পাবার জন্য প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেইনি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সেদিন পাকিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতেও শান্তি ছিল না। পাকবাহিনীর নজরে ছিল বাড়িটি। আরো একবার তো গ্রেপ্তারই হয়ে গিয়েছিলাম। সেবার বাহুবলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সাক্ষাত শেষে যখন বাড়ি ফিরছি তখন পথিমধ্যে পাকবাহিনীর এ্যাম্বুশে পড়েছিলাম। জীবন সায়াহ্নে এসে প্রশ্ন জাগে- আসলেই তো একখানা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পেলাম না কেন? যারা যুদ্ধে অংশ নিল না তারা তো সার্টিফিকেট পেয়ে গেল। সুযোগ-সুবিধা নিল। অদ্ভুত এক দেশের বাসিন্দা আমরা। এখানে সরকার বদলায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও বদলে যায়। আর এই অশুভ প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্র মদদ দেয়। স্বাধীনতার পর পর স্বচক্ষে দেখেছি দশ টাকায় মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বিক্রি হতে। দল বেঁধে আমরা পল্টন ময়দানে এসব ভুয়া সার্টিফিকেট পুড়িয়েছি। তৎকালীন পত্রপত্রিকায় আমাদের ছবিও ছাপা হয়েছিল। এ নিয়ে ঝামেলা যে হয়নি তা নয়। এসবি আমাদের পিছু নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে কি করবো? কিছু একটা তো করতে হবে।
৭০ সন থেকেই লেখালেখির অভ্যাস। মফস্বল সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সাপ্তাহিক বাংলার বাণীতেও লিখতে শুরু করলাম। শেখ ফজলুল হক মনি যিনি আমার সাংবাদিকতার গুরু। তার নির্দেশেই পুরোদস্তুর সাংবাদিক হয়ে গেলাম। তিনি বলতেন অস্ত্রের যুদ্ধ শেষ। এখন কলমের যুদ্ধ করতে হবে। তার কথায়, পাকিস্তানিরা সাংবাদিকতাকে কব্জা করে রেখেছে। ওদের কাছ থেকে সাংবাদিকতাকে মুক্ত করতে হবে। যোগ দিলাম সাংবাদিকতায়। এখনো আছি। দেখতে দেখতে প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেল। কত কিছুই যে দেখলাম। বার কয়েক জেলেও গেলাম এই পেশাকে ভালোবাসতে গিয়ে। চাকরি হারালাম অন্তত তিনবার। বিদেশেও কাটাতে হলো বেশ কিছু সময়। দেশে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানেও তা সন্নিবেশিত রয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন বাধা! কে যেন পেছন থেকে ডাকছে।
১৯৭১-এর ২৬শে মার্চ সকাল। সাত বন্ধু মিলে মৌলভীবাজারের সদর রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে গেলাম। উদ্দেশ্য পাকবাহিনীর গতি রোধ করা। সারা বাংলা তখন প্রতিরোধে জ্বলছে বারুদের মতো। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব কায়েম হয়ে গেছে পূর্ব বাংলায়। আলোচিত স্বাধীনতা যুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। প্রস্তুতি চারদিকে। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। সমঝোতার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
একমাত্র অপশন তখন সরাসরি যুদ্ধ। যেটাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলছি। কারো ডাকের অপেক্ষায় নয়। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশে। রাত থেকেই প্রতিরোধের প্রস্তুতি। খালি হাতে কি প্রতিরোধ করবো? কে তখন বাধা দেয়। সাত বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম পাকবাহিনীকে মৌলভীবাজারে রুখতে হবে। কি পাগলামি দেখুন। মৌলভীবাজার গভর্নমেন্ট স্কুলের সামনে গাছপালা, ইট ফেলে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছি। এমন সময় পেছন থেকে একটি ট্রাক এসে থামলো। আচমকা, জাস্ট হল্ট। পাকসেনারা একে একে ট্রাক থেকে নামলো। সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। পালাবার কোনো সুযোগ নেই। ট্রাকে তুলে নিল সবাইকে। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছি। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা আমাদেরকে? পরের গন্তব্যই বা কি হবে? শুধু ভাবছি বাড়ির কেউ তো জানতে পারবে না। আমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে অল্প দূরে সার্কিট হাউসের সামনে গিয়ে থামলো ট্রাক। পাশেই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। পাকবাহিনী সেখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাদেরকে নিয়ে গেল এক অন্ধকার ঘরে।
হাত বাঁধার পর দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। সকাল গড়িয়ে দুপুর। কিছু খেতেও দেয় না। বরং হাত বাঁধা আছে কি না একজন দেখে গেল। বিকাল ৩টা। হাত খুলতে এলো এক সেপাই। উর্দুতে কি যেন বললো। এরপর দুখানা রুটি দিল। সঙ্গে কিছু হালুয়া। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। খেতে ইচ্ছে হয়। আবার হয় না। রাগে ক্ষোভে তখনো জ্বলছি। কি করবো? রুটি খেলাম একখানা। কখন যে রাত হয়ে গেছে। বেত নিয়ে এলো এক অফিসার। পায়ে এবং পিঠে আঘাত করতে থাকলো। বাইরে তখন কার্ফু জারি হয়ে গেছে। রাতটা কাটলো এভাবেই। ভোর হতেই শুনলাম আমাদের চার বন্ধুকে ওরা আলাদা করে রেখেছে। এর বেশি কিছুই জানি না। নিজের কথা ভাবছি। ব্রাশফায়ার কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকলো। দাঁড়াতেই পারছি না। ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। কারণ পাশের রুম থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
সে কি কান্না! আর কাদের ধরে আনলো। চার বন্ধুর খবরই বা কি? শহরে কি হচ্ছে তাও জানিনা। সহযোদ্ধারা কি করছে তাও জানার উপায় নেই। তিনদিন এভাবেই কেটে গেল। চারদিন পর হাত খুলে দিল ওরা। এখন কি করবে? ছেড়ে দেবে নাকি ব্রাশফায়ারের জন্য নিয়ে যাবে। এই ভাবনার মধ্যেই একটি বাঙালি কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। চোখ এমনভাবে বাঁধা কিছুই বোঝার উপায় নেই। দেখতেও পাচ্ছি না। অন্ধকার ঘরে আরো কয়েকজনের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। এক বাঙালি ক্যাপ্টেন এলেন। বাতি জ্বলে উঠলো। বললেন, প্রস্তুতি নাও। কিসের প্রস্তুতি। আমরা তিন বন্ধুকে জড়ো করলো। বাকি চারজনের খবর নেই। রাত বাজে তখন চারটা। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে চললো। বেশ খানিক পথ হাঁটার পর বললো- ওধার যাও।
এখনই বুঝি শেষ। ভয়ে ভয়ে হাঁটছি। কিছুদূর যেতেই টের পেলাম ওরা পেছনে নেই। এরপর হাঁটতে থাকলাম। চৌমুহনায় গিয়ে শুনলাম আমাদের চার সহযোদ্ধাকে মৌলভীবাজার শহরের লাগোয়া মনু ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করেছে। শহীদ হয়ে গেছে ওরা চারজন। আর আমি বেঁচে আছি! সে তো বিস্ময়কর। বাড়িতে খবর গেছে পাকবাহিনী আমাকে হত্যা করেছে। বাড়িতে তখন কুলখানিও হয়ে গেছে। কি করে যে বেঁচে গেলাম এই প্রশ্নের জবাব কখনো পাইনি। পাবার কথাও নয়। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। হেঁটে যখন বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালাম, তখন বড্ড ক্লান্ত। শরীর আর চলছে না। ভয়ে শরীর হিমশীতল হয়ে যাচ্ছে বার বার। এই বুুঝি পাকবাহিনী আসলো। সন্ধ্যায় যখন গ্রামে পা বাড়ালাম তখন শোরগোল পড়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে একজন অন্যজনের দিকে তাকাচ্ছে। আমি তখনো বুঝতে পারিনি। কি হয়েছে আসলে। একজন এসে সরাসরি প্রশ্ন করলো, আপনি বেঁচে আছেন? আমরা তো এই বিকালেই আপনার বাড়িতে কুলখানি করে এলাম। কে একজন দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়েছে- আমি বাড়িতে আসছি। বাড়ির সবাই ছুটে এলো আমাকে দেখতে।
সেটা আমার জীবনে এক ইতিহাস হয়ে রইলো। একা একা বসে যখন ভাবি তখন হিসাব মেলাতে পারি না। একই প্রশ্ন সামনে আসে বার বার। দেশের ডাকে এগিয়ে গিয়েছিলাম কিছু প্রাপ্তির জন্য নয়। যদিও দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে। অনেকেই বলেন, কি ব্যাপার আপানার সার্টিফিকেট কই? বিনীতভাবে তাদের বলি, কারো সার্টিফিকেট পাবার জন্য প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেইনি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সেদিন পাকিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতেও শান্তি ছিল না। পাকবাহিনীর নজরে ছিল বাড়িটি। আরো একবার তো গ্রেপ্তারই হয়ে গিয়েছিলাম। সেবার বাহুবলে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সাক্ষাত শেষে যখন বাড়ি ফিরছি তখন পথিমধ্যে পাকবাহিনীর এ্যাম্বুশে পড়েছিলাম। জীবন সায়াহ্নে এসে প্রশ্ন জাগে- আসলেই তো একখানা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পেলাম না কেন? যারা যুদ্ধে অংশ নিল না তারা তো সার্টিফিকেট পেয়ে গেল। সুযোগ-সুবিধা নিল। অদ্ভুত এক দেশের বাসিন্দা আমরা। এখানে সরকার বদলায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও বদলে যায়। আর এই অশুভ প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্র মদদ দেয়। স্বাধীনতার পর পর স্বচক্ষে দেখেছি দশ টাকায় মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বিক্রি হতে। দল বেঁধে আমরা পল্টন ময়দানে এসব ভুয়া সার্টিফিকেট পুড়িয়েছি। তৎকালীন পত্রপত্রিকায় আমাদের ছবিও ছাপা হয়েছিল। এ নিয়ে ঝামেলা যে হয়নি তা নয়। এসবি আমাদের পিছু নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে কি করবো? কিছু একটা তো করতে হবে।
৭০ সন থেকেই লেখালেখির অভ্যাস। মফস্বল সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সাপ্তাহিক বাংলার বাণীতেও লিখতে শুরু করলাম। শেখ ফজলুল হক মনি যিনি আমার সাংবাদিকতার গুরু। তার নির্দেশেই পুরোদস্তুর সাংবাদিক হয়ে গেলাম। তিনি বলতেন অস্ত্রের যুদ্ধ শেষ। এখন কলমের যুদ্ধ করতে হবে। তার কথায়, পাকিস্তানিরা সাংবাদিকতাকে কব্জা করে রেখেছে। ওদের কাছ থেকে সাংবাদিকতাকে মুক্ত করতে হবে। যোগ দিলাম সাংবাদিকতায়। এখনো আছি। দেখতে দেখতে প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেল। কত কিছুই যে দেখলাম। বার কয়েক জেলেও গেলাম এই পেশাকে ভালোবাসতে গিয়ে। চাকরি হারালাম অন্তত তিনবার। বিদেশেও কাটাতে হলো বেশ কিছু সময়। দেশে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানেও তা সন্নিবেশিত রয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন বাধা! কে যেন পেছন থেকে ডাকছে।
No comments