মধ্যপ্রাচ্যকে কব্জায় রাখতে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
পশ্চিম
এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক গোত্র, বর্ণ ও ধর্মের মানুষের বসবাস রয়েছে
যা কিনা বিভিন্ন ঐশী ধর্মের প্রাণকেন্দ্র। এ ছাড়া, ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং
তেল ও গ্যাসের খনির বিশাল ভাণ্ডারের কারণে এই এলাকাটির বিশেষ গুরুত্ব
রয়েছে সবার কাছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে পাশ্চাত্যের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে এ
অঞ্চলের ওপর।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভূ-রাজনৈতিক কারণে প্রথমে ব্রিটেন ও পরে আমেরিকার কাছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। গ্যাস ও তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাশ্চাত্য এ অঞ্চলকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। একই সঙ্গে তারা এ অঞ্চলের রাজতন্ত্র শাসিত সরকারগুলোর নিরাপত্তা দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেয়। ছোট বড় দেশগুলোর সমন্বয়ে আমরা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের যে ভৌগোলিক চেহারা দেখছি তা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসনের ফসল। ১৯১৪ সালে 'সাইকাস-পিকট' পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের ইচ্ছেমতো সীমানা নির্ধারণ করে মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক দেশের জন্ম দিয়েছিল। আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্ব, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সৌদি আরবের সীমানা বিরোধ এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান অন্যান্য সংকট এসবই মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশিক শাসনের ফল। ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ফিলিস্তিনকে খণ্ডবিখণ্ড করে এ অঞ্চলে যে স্থায়ী সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে তাও উপনিবেশিক শাসনের অন্যতম ফসল।
শীতল যুদ্ধের সময় দুই মেরুকেন্দ্রীক ব্যবস্থায় আমেরিকার টার্গেট ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দক্ষিণাঞ্চলীয় মুসলিম এলাকাগুলোকে আলাদা করে দেয়া। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অঞ্চলগুলোকেও জাতীয়তার ভিত্তিতে খণ্ড বিখণ্ড করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় মার্কিন সরকার। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত না হওয়ায় আমেরিকা এ অঞ্চলকে অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করে ফের এ এলাকার দেশগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার উদ্যোগ নিয়েছে। শীতল যুদ্ধের পর বিশেষ করে ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর আমেরিকা ও তার পাশ্চাত্যের মিত্ররা তেল সমৃদ্ধ ও ভূ-কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। সে অনুযায়ী তারা এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি, গৃহযুদ্ধ বাধানো এবং ধর্ম ও জাতীয়তার ভিত্তিতে দেশগুলোকে খণ্ড বিখণ্ড করার পদক্ষেপ নিয়েছে যাতে এ দেশগুলো সবসময় দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকে এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।
আমেরিকা ২০০৩ সালের শুরু থেকে সাদ্দাম সরকারের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার কথা বলে ইরাকের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা ও সংস্কারের শ্লোগান দিয়ে আমেরিকা যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দেয়। ১৯১৪ সালে ঘোষিত 'সাইকাস-পিকট' পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফসল হচ্ছে বর্তমানের সীমানা বিরোধ ও জাতিগত বিদ্বেষ যা কিনা এ অঞ্চলে পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপের সুযোগ এনে দিয়েছে। ২০০৩ সালে আমেরিকা কর্তৃক ইরাক দখলের ঘটনা 'সাইকাস-পিকট' পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আরেকটি দৃষ্টান্ত যার লক্ষ্য ইরাকসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোকে খণ্ডবিখণ্ড করা। অবশ্য আমেরিকা 'বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্য' গঠনের যে কথা বলছে তা ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নতুন সংস্করণ মাত্র। পাশ্চাত্যের সরকার ও গণমাধ্যমগুলো এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব সংঘাতকে শিয়া-সুন্নি সংঘাত বলে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়েও আমেরিকা দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা এ অঞ্চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বললেও সৌদি আরবের রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। এটা কারো অজানা নয় যে, সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের যে ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে তার উৎসভূমি হচ্ছে সৌদি আরব। মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য রিচার্ড হ্যাস বলেছেন, "'সাইকাস-পিকট' পরিকল্পনার আদলে যদি আমেরিকার নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় তাহলে দেশটি ইরাক ও সিরিয়ার যে চোরাবালিতে আটকা পড়েছে তা থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা পাল্টে নতুন আকৃতি ধারণ করবে।"
মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরে যে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বা মতভিন্নতা বিরাজ করছে তাকে ব্যবহার করে আমেরিকা স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মুসলিম দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এসবের মূলে রয়েছে পাশ্চাত্যের ভূমিকা এবং এটাও প্রমাণিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্নিগোলকে পরিণত করার জন্য ইরাকই তাদের প্রথম টার্গেট নয়। অন্যান্য মুসলিম দেশেও তারা ইরাকের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা করছে। এর আগে আমেরিকা বহু বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে ২০১১ সালে আফ্রিকার দেশ সুদানকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়। এরপর দখলদার ইসরাইলই প্রথম দক্ষিণ সুদানকে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইসরাইল ও আমেরিকার পরবর্তী টার্গেট হচ্ছে লিবিয়া ও ইয়েমেনকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা। পাশ্চাত্যের প্রচারমাধ্যমগুলো ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া, পাকিস্তান, লিবিয়া, ইরাক, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা বলছে যার পেছনে বার্নার্ড লুইস নামের এক ইহুদিবাদীর পরিকল্পনা কাজ করছে।
বার্নার্ড লুইস আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের ওপর প্রায় ২০ হাজার প্রবন্ধ ও বই রচনা করেছেন। প্রথমে তিনি ভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বর্নার্ড লুইস বিশাল ওসমানি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত আরব দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে গবেষণার দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে অস্ট্রিয়ায় এক সেমিনারে প্রথম তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশকে এমনভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করার প্রস্তাব তুলে ধরেন যাতে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করা যায়। তিনি ভাষা, ধর্ম, গোত্র, বর্ণের ভিত্তিতে বড় রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙে ছোট ছোট রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। ব্রিটেনের এই ইহুদিবাদীর উত্থাপিত ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, লেবাননের দ্রুজ, ইরানের বালুচ-তুর্ক-কুর্দি জাতিগোষ্ঠী, সিরিয়ার আলাভি, ইথিওপিয়ার খ্রিস্টান, সুদানের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, আরব দেশগুলোর বিচ্ছিন্নতাকামী উপজাতি গোষ্ঠী, তুরস্কের কুর্দিসহ অন্যান্য দেশের বিচ্ছিন্নতাকামী কিংবা বিদ্রোহীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেয়া উচিত।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভূ-রাজনৈতিক কারণে প্রথমে ব্রিটেন ও পরে আমেরিকার কাছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। গ্যাস ও তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাশ্চাত্য এ অঞ্চলকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। একই সঙ্গে তারা এ অঞ্চলের রাজতন্ত্র শাসিত সরকারগুলোর নিরাপত্তা দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেয়। ছোট বড় দেশগুলোর সমন্বয়ে আমরা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের যে ভৌগোলিক চেহারা দেখছি তা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উপনিবেশিক শাসনের ফসল। ১৯১৪ সালে 'সাইকাস-পিকট' পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের ইচ্ছেমতো সীমানা নির্ধারণ করে মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক দেশের জন্ম দিয়েছিল। আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্ব, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সৌদি আরবের সীমানা বিরোধ এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান অন্যান্য সংকট এসবই মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশিক শাসনের ফল। ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ফিলিস্তিনকে খণ্ডবিখণ্ড করে এ অঞ্চলে যে স্থায়ী সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে তাও উপনিবেশিক শাসনের অন্যতম ফসল।
শীতল যুদ্ধের সময় দুই মেরুকেন্দ্রীক ব্যবস্থায় আমেরিকার টার্গেট ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দক্ষিণাঞ্চলীয় মুসলিম এলাকাগুলোকে আলাদা করে দেয়া। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অঞ্চলগুলোকেও জাতীয়তার ভিত্তিতে খণ্ড বিখণ্ড করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় মার্কিন সরকার। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত না হওয়ায় আমেরিকা এ অঞ্চলকে অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করে ফের এ এলাকার দেশগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার উদ্যোগ নিয়েছে। শীতল যুদ্ধের পর বিশেষ করে ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর আমেরিকা ও তার পাশ্চাত্যের মিত্ররা তেল সমৃদ্ধ ও ভূ-কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। সে অনুযায়ী তারা এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি, গৃহযুদ্ধ বাধানো এবং ধর্ম ও জাতীয়তার ভিত্তিতে দেশগুলোকে খণ্ড বিখণ্ড করার পদক্ষেপ নিয়েছে যাতে এ দেশগুলো সবসময় দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকে এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।
আমেরিকা ২০০৩ সালের শুরু থেকে সাদ্দাম সরকারের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার কথা বলে ইরাকের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা ও সংস্কারের শ্লোগান দিয়ে আমেরিকা যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দেয়। ১৯১৪ সালে ঘোষিত 'সাইকাস-পিকট' পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফসল হচ্ছে বর্তমানের সীমানা বিরোধ ও জাতিগত বিদ্বেষ যা কিনা এ অঞ্চলে পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপের সুযোগ এনে দিয়েছে। ২০০৩ সালে আমেরিকা কর্তৃক ইরাক দখলের ঘটনা 'সাইকাস-পিকট' পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আরেকটি দৃষ্টান্ত যার লক্ষ্য ইরাকসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোকে খণ্ডবিখণ্ড করা। অবশ্য আমেরিকা 'বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্য' গঠনের যে কথা বলছে তা ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নতুন সংস্করণ মাত্র। পাশ্চাত্যের সরকার ও গণমাধ্যমগুলো এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব সংঘাতকে শিয়া-সুন্নি সংঘাত বলে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়েও আমেরিকা দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা এ অঞ্চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বললেও সৌদি আরবের রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। এটা কারো অজানা নয় যে, সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের যে ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে তার উৎসভূমি হচ্ছে সৌদি আরব। মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য রিচার্ড হ্যাস বলেছেন, "'সাইকাস-পিকট' পরিকল্পনার আদলে যদি আমেরিকার নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় তাহলে দেশটি ইরাক ও সিরিয়ার যে চোরাবালিতে আটকা পড়েছে তা থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা পাল্টে নতুন আকৃতি ধারণ করবে।"
মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরে যে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বা মতভিন্নতা বিরাজ করছে তাকে ব্যবহার করে আমেরিকা স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মুসলিম দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এসবের মূলে রয়েছে পাশ্চাত্যের ভূমিকা এবং এটাও প্রমাণিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্নিগোলকে পরিণত করার জন্য ইরাকই তাদের প্রথম টার্গেট নয়। অন্যান্য মুসলিম দেশেও তারা ইরাকের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির পায়তারা করছে। এর আগে আমেরিকা বহু বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে ২০১১ সালে আফ্রিকার দেশ সুদানকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়। এরপর দখলদার ইসরাইলই প্রথম দক্ষিণ সুদানকে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইসরাইল ও আমেরিকার পরবর্তী টার্গেট হচ্ছে লিবিয়া ও ইয়েমেনকে ভেঙে টুকরো টুকরো করা। পাশ্চাত্যের প্রচারমাধ্যমগুলো ইয়েমেন থেকে শুরু করে সিরিয়া, পাকিস্তান, লিবিয়া, ইরাক, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা বলছে যার পেছনে বার্নার্ড লুইস নামের এক ইহুদিবাদীর পরিকল্পনা কাজ করছে।
বার্নার্ড লুইস আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের ওপর প্রায় ২০ হাজার প্রবন্ধ ও বই রচনা করেছেন। প্রথমে তিনি ভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। কিন্তু ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বর্নার্ড লুইস বিশাল ওসমানি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত আরব দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে গবেষণার দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে অস্ট্রিয়ায় এক সেমিনারে প্রথম তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশকে এমনভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করার প্রস্তাব তুলে ধরেন যাতে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করা যায়। তিনি ভাষা, ধর্ম, গোত্র, বর্ণের ভিত্তিতে বড় রাষ্ট্রগুলোকে ভেঙে ছোট ছোট রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেন। ব্রিটেনের এই ইহুদিবাদীর উত্থাপিত ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, লেবাননের দ্রুজ, ইরানের বালুচ-তুর্ক-কুর্দি জাতিগোষ্ঠী, সিরিয়ার আলাভি, ইথিওপিয়ার খ্রিস্টান, সুদানের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, আরব দেশগুলোর বিচ্ছিন্নতাকামী উপজাতি গোষ্ঠী, তুরস্কের কুর্দিসহ অন্যান্য দেশের বিচ্ছিন্নতাকামী কিংবা বিদ্রোহীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেয়া উচিত।
মধ্যপ্রাচ্যের
দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করার পরিকল্পনায় ইরান হচ্ছে তাদের সবচেয়ে বড়
টার্গেট। কারণ যে কোনো উপায়ে ইরানের বর্তমান সীমান্তে পরিবর্তন আনা সম্ভব
হলে অর্থাৎ ইরানকে ভেঙে কয়েক টুকরায় পরিণত করতে পারলে খুব সহজে প্রতিবেশী
ইরাক, তুরস্ক ও পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা যাবে। এটা বার্নার্ড
লুইসের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা
হয়। এ কারণে আমেরিকা ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বার্নার্ড লুইসের
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরাক ও
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা উপস্থিতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশে
সামরিক ঘাঁটি স্থাপন ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরই অংশ। ইরাক দখলের পর ২০০৩
সাল থেকে আমেরিকা ও ব্রিটেন বহুবার এ অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোকে বিভক্ত করার
কথা বলেছে। এ থেকে বোঝা যায়, আমেরিকা আসলে যুদ্ধ, সংঘাত ও নৈরাজ্য সৃষ্টি
করে এ অঞ্চলের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
No comments